রাজনীতিতে নীতি-আদর্শ, যুক্তি-তর্ক ও তত্ত্বচর্চা

প্রকাশিত: ১০:০৯ পূর্বাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ১৮, ২০২৪

রাজনীতিতে নীতি-আদর্শ, যুক্তি-তর্ক ও তত্ত্বচর্চা

মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম |

‘৭১ সালের ৭ ই মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দান থেকে দেয়া ঐতিহাহিক ভাষনে বলা হয়েছিল”—আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না, আমি মানুষের অধিকার চাই–।” এখন দেশের রাজনীতিতে প্রাধান্য বিস্তার করে থাকা বুর্জোয়া চরিত্রের তথাকথিত ‘মূলধারার’ রাজনৈতিক দলগুলোর মূলমন্ত্র হয়ে দাড়িয়েছে – “আমি মানুষের অধিকার চাই না, আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই।”

দেশে এখন দুই কিসিমের রাজনীতিতে চলছে। একটি হলো ‘নীতি-আদর্শ -আত্মত্যাগ-দেশপ্রেমের’ রাজনীতি। জাতির দুর্ভাগ্য যে এটি বর্তমানে অনেকটাই দুর্বল। দেশের রাজনীতিতে যেটি বর্তমানে প্রবল শক্তিমান এবং রাজনীতির ‘মূলধারা’ হিসাবে কথিত সেটি হলো – ‘আখের গুছানোর’ ও ‘কিছু পাওয়ার’ লক্ষ্যে দেনা-পাওনা ও লাভ-লোকসানের হিসাব নির্ভর ‘হালুয়া রুটির’ ব্যবসায়িক রাজনীতি। দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এখন সেই ‘অপ-রাজনীতির’ প্রাধান্য চলছে।

একসময় মানুষ রাজনীতি বলতে বুঝত- ‘রাজার নীতি’। তাকে গণ্য করা হতো ‘নীতির রাজা’ হিসেবে। রাজনৈতিক দলগুলো ‘অপ-রাজনীতিতে’ একেবারেই লিপ্ত থাকত না, তা নয়। তবে সেগুলোকে খারাপ চোখে দেখা হত। তারা প্রধানত নীতি-আদর্শ নিয়ে পরস্পরের সাথে প্রতিযোগিতা করতো, সেসবের জন্য আত্মত্যাগ করত, সংগ্রাম করত, এবং আদর্শ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে প্রচেষ্টা চালাত। এখন দিন বদলে গেছে। ‘রাজনীতির’ সেই সম্মান-মর্যাদা এখন প্রায় লুপ্ত। ‘লুটপাটতন্ত্রের’ হাতে বন্দী হয়ে রাজনীতির তথাকথিত ‘মূলধারা’ আজ অনাচার ও রুগ্নতায় ভরে গেছে। রাজনীতিকে এখন ‘ব্যাবসাতে’ পরিণত করা হয়েছে। ‘আখের গুছানোর’ ব্যাবসায়িক বিবেচনাই রজনৈতিক সংস্কৃতির ও রাজনীতির নিয়ামক শক্তি হয়ে উঠেছে। মূলতঃ এই কারণেই অধিকারহীনতা, গণতন্ত্রহীনতা, শোষণ, বৈষম্য, অনাচার, দারিদ্র, লুটপাতটতন্ত্রের নৈরাজ্য ইত্যাদি দেশকে গ্রাস করে রাখতে পারছে।

লুটেরা বুর্জোয়া শ্রেণির শাসনের ফলে দেশ আজ সমস্যা-সংকট- ধ্বংসের প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। অবাধ লুটপাটের প্রয়োজনে জনগণের অধিকারগুলোকে খর্ব করে একক কতৃত্ববাদী ফ্যসিস্ট কায়দায় দেশ চালানো হচ্ছে। এই অবস্থা থেকে পরিত্রানের উপায় কী? রাজনীতিতে বহুমত চর্চার ধারা চালু করার উপায় কী? অভিজ্ঞতায় বেশ বোঝা যাচ্ছে যে, মৌলিক সমাজ বিপ্লব ছাড়া এ কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। টুকরো-টুকরো করে আলাদা-আলাদাভাবে সমস্যা-সংকটের জাল চ্ছিন্ন করা যাবে না। কারণ অবস্থা দাড়িয়েছে – “সর্বাঙ্গে ব্যাথা, তো অসুধ দিব কোথা?”।

অধঃপতনের যে ধারায় দেশ আজ নিমজ্জিত তা ‘আমূলে পাল্টে দেওয়া’ আজ গোটা জাতির জন্য জরুরি কর্তব্য হয়ে উঠেছে। সেক্ষেত্রে রয়েছে অনেক কাজ! সেসবের একটি হল রাজনীতিতে নীতি-আদর্শ ও যুক্তি-তর্ক-তত্ত্বচর্চার ধারা ফিরিয়ে আনা। শুধু সে বিষয়ে আজ কিছু কথা তুলে ধরছি।

নীতি-আদর্শ-মতাদর্শ ইত্যাদি- এসবই একসময় ছিল রাজনীতির প্রধান বিবেচ্য বিষয় ও মুখ্য উপাদান। এক্ষেত্রে আগাগোড়াই সবচেয়ে বড় অবদান ছিল দেশের কমিউনিস্ট-বাম-প্রগতিশীল শক্তির। কিন্তু একসময় তাদের যে প্রভাব-ক্ষমতা ছিল, তা ঠিক এই মুহূর্তে আগের মতো নেই। দেশে এখন বুর্জোয়া শক্তির (যা আবার লুটেরা ধারায় পরিচালিত) একচ্ছত্র আধিপত্য চলছে। সাম্প্রদায়িক অপশক্তির ও সাম্প্রদায়িকতারও বিস্তার ঘটেছে। দেশের কথিত ‘মূলধারা’র বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলগুলো ‘নীতি-আদর্শ-মতাদর্শ’কে প্রায় সর্বাংশে ত্যাগ করেছে। এসব দলের এখন প্রধান ভাবনা হলো, ‘যে কোনো উপায়ে ক্ষমতায় যেতে হবে’। ‘নীতি-আদর্শ’ বিসর্জন দিয়ে হলেও এবং চুরি-বাটপারি-প্রতারণা-সহিংসতা-বিদেশের তাঁবেদারি প্রভৃতির আশ্রয় নিয়ে হলেও ‘গদিতে বসতে হবে’।

ক্ষমতার জন্য তাদের এই মরিয়া লালসার আসল কারণ ও উৎস কী? এর আসল উৎস হলো ব্যক্তিগতভাবে ‘টাকাওয়ালা’ হওয়ার উদগ্র লোভ। যেহেতু ‘গদি’তে থাকতে পারাটি এখন হলো টাকা ‘কামাই করার’ সবচেয়ে সহজ ও নিশ্চিত পথ, এবং যেহেতু ক্ষমতাসীন দলের হয়ে রাজনীতি করতে পারাটা এখন দেশের ‘সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসা’ হয়ে উঠেছে, তাই ‘গদি চাই-ই চাই!’।

বহুদিন ধরে এ দেশে ‘বাজার অর্থনীতি’র ব্যবস্থা চালু রয়েছে। ‘বাজার অর্থনীতি’ থেকে জন্ম নিয়েছে ‘বাজার রাজনীতি’। ঘটেছে রাজনীতির বাণিজ্যিকীকরণ। জন্ম নিয়েছে ‘লুটপাটতন্ত্র’। রাষ্ট্রক্ষমতা হাতে থাকলে বৈধ-অবৈধ নানা চোরাগুপ্তা পথে রাতারাতি ‘টাকাওয়ালা’ হওয়ার সুযোগ পাওয়া যায়। অবস্থা দাড়িয়েছে এমন যে – টাকা বানাতে’ হলে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলে থাকতে হবে। এবং রাষ্ট্রক্ষমতা দখলে রাখতে হলে ‘নীতি-আদর্শের’ বদলে, যখন যেভাবে প্রয়োজন সেভাবে দলকে পরিচালনা করতে হবে। নিছক ‘ক্ষমতা লিপ্সা’ এখন বুর্জোয়া দলগুলোর ‘আদর্শ’ হয়ে উঠেছে। বুর্জোয়া ধারার এসব দল থেকে ‘নীতি-আদর্শ-মতাদর্শ’ বলতে গেলে প্রায় বিলীন হয়ে গেছে। এগুলো হলো ‘হালুয়া রুটি’ মার্কা রাজনৈতিক দল।

তবে, এর পাশাপাশি দেশে ‘নীতি-আদর্শ-মতাদর্শ’ভিত্তিক রাজনীতির’ ধারাও সমান্তরলভাবে বিরাজ করছে। সাময়িকভাবে দুর্বল হয়ে পড়লেও ‘নীতি-আদর্শ-মতাদর্শ’ ভিত্তিক রাজনীতি আজও বীরদর্পে টিকে আছে এবং ‘উজান স্রোত’ ও প্রবল প্রতিকূলতার মাঝে ধীরে হলেও এগিয়ে চলছে। এ ধরনের আদর্শবাদী দলগুলোর মধ্যে একটি হলো কমিউনিস্ট পার্টি। এই দলের আদর্শ-চর্চা সম্পর্কে কিছু আলোচনা করা যাক!

কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) ‘বিলোপবাদ’সহ ভেতর ও বাইরের নানা হামলাকে মোকাবিলা করে তার মূল মতাদর্শগত ভিত্তিকে অক্ষুন্ন রেখে কাজ করে যাচ্ছে। এ ধরনের দলে সব সময়ই ‘মতাদর্শগত চর্চা’কে গুরুত্ব দেওয়া হয়। তবে, তাদের সেই ‘মতাদর্শগত চর্চা’ এখনো ব্যাপক জনগণের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া যায়নি। এর জন্য অবশ্য চলতি হাওয়ার ‘অপ-রাজনীতি’ ও ‘বি-মতাদর্শকীকরণ’-এর প্রভাবও দায়ী।

‘মতাদর্শ’ নিয়ে আলোচনাকে অনেকে ‘মূল্যহীন’ ও একটি ‘অ-কাজ’ বলে মনে করেন। অনেকে তাকে ‘তত্ত্বের কচকচানি’ বলে হেয় করে থাকেন। এ কথা ঠিক যে, প্রয়োগ ও বাস্তব সংগ্রাম ছাড়া তত্ত্ব হলো বন্ধ্যা। সঙ্গে সঙ্গে এ কথাও সত্য যে, তত্ত্ব ছাড়া শুধু বাস্তব সংগ্রাম হলো অন্ধ। মতাদর্শিক তত্ত্বচর্চা তো ‘অ-কাজ’ নয়ই, বরং গন্তব্যে পৌঁছাতে হলে তা একটি অপরিহার্য কাজ।

‘মতাদর্শিক তত্ত্বচর্চা’ সম্পর্কে অপর যে অভিযোগ করা হয়ে থাকে তা হলো – এটি একটি জটিল ও দুর্বোধ্য কঠিন বিষয়। মাথা খাটিয়ে ও কষ্ট করে এসব তত্ত্বচর্চার বদলে কেবল ‘কমনসেন্স পলিটিকস’ নিয়ে থাকাটিই সহজ ও ঝামেলামুক্ত ‘সহজ পন্থা’। কিন্তু এ ধরনের ‘সহজ পন্থা’র চিন্তা রাজনীতিতে মতাদর্শিক স্খলনের পথ সুগম করে দেয়। বিপদ ডেকে আনে। তাই ‘চিন্তার আলস্য’ ত্যাগ করে রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের তত্ত্বচর্চার জটিল জগতে প্রবেশ করা একান্ত কর্তব্য।

‘মতাদর্শ চর্চা’ সম্পর্কে আরেকটি অভিযোগ হলো- ‘মতাদর্শ’মাত্রই মতান্ধতার জন্ম দেয়। আজকাল একটি মহল থেকে এই অভিযোগ করাটি ‘ফ্যাশন’ হয়ে উঠেছে। অন্য মতাদর্শের ক্ষেত্রে এ অভিযোগের সত্যতা থাকলেও, ‘মার্কসবাদের’ ক্ষেত্রে এ অভিযোগ সত্য নয়। কেন? ‘মার্কসবাদ ও মতান্ধতা’ নিয়ে সামান্য কিছু কথা এখানে তুলে ধরছি।

যে কোনো মতাদর্শের প্রধান উপাদান হচ্ছে তার দার্শনিক ভিত্তি। সব মতাদর্শেরই সূত্রায়িত অথবা অসূত্রায়িত দার্শনিক ভিত্তি রয়েছে। ঠিক তেমনি, সে বিষয়ে সচেতন থাকুক বা না থাকুক, সব মানুষেরই একটি দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি আছে। এই দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির গোড়ার কথা হলো তার সামগ্রিক বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি। অর্থাৎ তার নিজের সঙ্গে পারিপার্শ্বিক বহির্জগতের আন্তঃসম্পর্ক বিষয়ে তার ধারণা ও দৃষ্টিভঙ্গি। দর্শন তথা সামগ্রিক বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি ছাড়া কোনো মানুষের অস্তিত্ব সম্ভব নয়। আর যেহেতু দর্শনকে ঘিরে সৃষ্টি হয় নির্দিষ্ট ‘মতাদর্শ’, তাই মতাদর্শবিহীন মানুষের কোনো অস্তিত্ব নেই, থাকতে পারে না।

অনেকে যুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করে থাকেন যে, “কোনো নির্দিষ্ট মতাদর্শের অনুসারী হওয়ার অর্থই হলো ‘মুক্তচিন্তা’কে সেই মতাদর্শের সীমার মধ্যে আবদ্ধ করে ফেলা।” তাই মুক্তচিন্তার পূর্বশর্ত হলো ‘মতাদর্শ থেকে মুক্তি’। আজকাল ‘উত্তর-আধুনিকতাবাদ’, ‘মানবিক নৈরাজ্যবাদ’, ‘সুশীল বা নাগরিক সমাজের তত্ত্ব’ ইত্যাদি নামে এই অতি পুরনো কথাটি আবার নতুন করে হাজির করা হচ্ছে। শিক্ষিত তরুণদের একটি অংশ বাস্তব শ্রেণি সংগ্রামের কষ্টকর পথ এড়িয়ে একলাফে ব্যক্তিসত্তার ‘নিরঙ্কূশ স্বাধীনতা’ প্রতিষ্ঠার বিমূর্ত আহ্বানে আকর্ষিত হচ্ছে। কিন্তু ‘মতাদর্শ থেকে মুক্তি’ সম্ভব নয়। কারণ, যারা এ কথাটি বলে থাকেন, সেটি যখন কারও ক্ষেত্রে একটি স্থায়ী দৃষ্টিভঙ্গি হয়ে ওঠে, তখন সেটিই পরিণত হয় নতুন আরেকটি বিশেষ বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গিতে, তথা দর্শনে, তথা একটি নতুন মতাদর্শে। এই সহজ কথাটি কে না বুঝবে! অর্থাৎ ‘মতাদর্শবিহীনতা’র মতবাদই এ ক্ষেত্রে হয়ে ওঠে আরেকটি নির্দিষ্ট মতাদর্শ। এ যেন মতাদর্শ নিয়ে লুকোচুরি খেলার ব্যর্থ প্রয়াস।

তাই মুক্তচিন্তার জন্য, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা চালিত হওয়ার জন্য, ‘মতাদর্শ থেকে মুক্তির’ ভাবনাটি যুত্তিহীন ও বাস্তবতাবর্জিত। এ ক্ষেত্রে যেটি বাস্তবসম্মত ও যুক্তিযুক্ত তা হলো- বিভিন্ন মতাদর্শের মধ্য থেকে সেই মতাদর্শটিকে খুঁজে নিতে হবে (অথবা প্রয়োজনে নতুন সেই মতাদর্শ উদ্ভাবন করতে হবে), যা মুক্তচিন্তার ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিপূরক, যা বাস্তবতাকে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করে, বাস্তবতাকে পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখায় এবং সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের একটি সম্ভাবনাময় পথের নিশানা প্রদর্শন করে। মার্কসবাদ হলো তেমনই একটি ‘মতাদর্শ’।

সাধারণভাবে সব ‘মতাদর্শ’ই নানাভাবে জ্ঞেয়, জ্ঞান ও সত্য সম্পর্কে একটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্তনির্ভর। বেশিরভাগ সূত্রায়িত ‘মতাদর্শ’ কোনো না কোনোভাবে ‘পরম সত্য’ ধারণ করার দাবি করে। তারা ‘পরম সত্য’কে একটি ফর্মুলার গন্ডির মধ্যে আবদ্ধ করে ফেলে। এ কারণে এসব ‘মতাদর্শ’ হয়ে ওঠে মতান্ধতা, গোঁড়ামি ও ‘ডগমা’-র উৎস। এ ক্ষেত্রে ‘মতাদর্শ’ হয়ে ওঠে ‘অনড় সত্যের’ অচলায়তন। ‘মতাদর্শ’ সম্পর্কে মার্কসবাদের বক্তব্য এ থেকে সম্পূর্ণ অন্যরকম, এবং বলতে গেলে বিপরীতমুখী।

বেশিরভাগ মতাদর্শের স্বীকৃত সাধারণ ‘অনড়’ বৈশিষ্ট্যকে যদি ‘মতাদর্শ’ অভিধা দিয়ে চিহ্নিত করা হয়, তা হলে সে ক্ষেত্রে মার্কসবাদ হলো ‘মতাদর্শের’ নেতিকরণ অর্থাৎ ‘an ideology which is anti-ideology’। মার্কসবাদের অন্যতম ভিত্তি হলো- বস্তু, দ্বন্দ্ব ও গতি। বস্তুর অন্তহীন গতিময়তার নিরিখেই সে বস্তুজগৎ, ভাবজগৎ, বিশ্বব্রহ্মান্ডকে বিচার করে। সেই বিশেষ বৈশিষ্ট্যগত কারণেই মার্কসবাদ চিরযৌবনা, অনন্ত গতিময়তার প্রাণশক্তিসম্পন্ন একটি সৃষ্টিশীল জীবন্ত মতাদর্শ।

অনেকে মার্কসবাদ সম্পর্কে এমন অপবাদ দিয়ে থাকেন যে, মার্কস তার মতবাদকে হাজির করেছেন একান্তই প্রায়োগিক (utilitarian) বিবেচনায়। এর সঙ্গে সত্য-মিথ্যার বিষয়টি কোনোভাবেই জড়িত নয়। তিনি মানবতাবাদী ও বিপ্লবী ছিলেন। বিপ্লবের প্রয়োজনে তিনি বিপ্লবের একটি মতাদর্শ ‘সৃষ্টি’ করেছেন। তাদের আরও কথা হলো, আজ যেহেতু বিপ্লবের যুগ শেষ হয়েছে (?), দুনিয়া অনেক বদলে গেছে, তাই সেই মতাদর্শের প্রাসঙ্গিকতা এখন আর নেই।

তা ছাড়া মার্কস নিজেই বলেছেন যে, এই মতাদর্শ শ্রেণিনিরপেক্ষ নয়। এটি হচ্ছে শ্রমিক শ্রেণির মতাদর্শ। এর দ্বারা কি তা হলে এ কথাই স্বীকার করে নেওয়া হচ্ছে না যে, মার্কসবাদ আসলে শ্রেণি স্বার্থের দ্বন্দ্বের পরিপ্রেক্ষিতে একটি পক্ষের স্বার্থ অবলম্বন করে ‘রচিত’ মতাদর্শ। সেখানে সত্য-মিথ্যা বিচারের কোনো প্রসঙ্গ নেই। মার্কসবাদকে এভাবে মূল্যায়ন করা হবে নিতান্তই ভ্রান্ত। তত্ত্বকে এবং তত্ত্বের সত্যতাকে প্রয়োগ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখার ভ্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই এ ধরনের ভ্রান্তির সৃষ্টি হতে পারে।

মার্কসবাদ নিঃসন্দেহেই বর্তমান সামাজিক বাস্তবতাকে রূপান্তরের তাগিদ থেকে উদ্ভাবিত। এই সমাজকে পাল্টাতে চায় বলেই মার্কসবাদ সমাজ ও জগৎকে অধিকতর পূর্ণতার সঙ্গে বুঝতে চায়। সেই তাগিদই মার্কসবাদকে নিয়ে যায় বস্তুজগৎ, চেতনাজগৎ তথা সমগ্র বিশ্বব্রহ্মান্ড সম্পর্কে প্রকৃত জ্ঞান অন্বেষার অভিমুখে। বাস্তবতাকে বদলানোর প্রয়োজনেই দরকার হয় বাস্তবতা সম্পর্কে যথাসম্ভব সত্য জ্ঞান। সে জন্যই প্রয়োজন হয় সমাজ-অর্থনীতি-রাজনীতির সুনির্দিষ্ট বাস্তবতা ও তার গতিপ্রকৃতির বাস্তব অনুধাবন। সে জন্য অবলম্বন করতে হয় জ্ঞানানুসন্ধানের সঠিক পথ ও পদ্ধতি। ইতিহাস ও বাস্তবতার আলোকে মার্কসবাদ সেই পথ ও পন্থা আবিষ্কার করেছে।

এভাবে সমাজ পাল্টানোর তাগিদই মার্কসবাদকে নিয়ে যায় সত্যানুসন্ধানের বস্তুনিষ্ঠ ও বিজ্ঞানসম্মত বিশ্লেষণ পদ্ধতির কাছে। মার্কসবাদের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করে তত্ত্ব উদ্ভাবন করা হয়। সেই তত্ত্ব প্রয়োগ করে বাস্তবতা থেকেই সেই তত্ত্বের সঠিকতা যাচাই করে নেওয়া হয়। প্রয়োগের ধারাবাহিকতায় উদ্ভাবিত তত্ত্বের সঙ্গে ক্রমাগত যুক্ত হতে থাকে নতুন মাত্রিকতা ও উপাদান। এভাবে মার্কসবাদের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি তত্ত্বের নবায়নকে একটি ক্রমাগত প্রক্রিয়ায় পরিণত করে। সে কারণে মার্কসবাদ কোনোভাবেই মতান্ধতা বা ‘ডগমা’কে প্রশ্রয় দেয় না। তাই সমাজতন্ত্র ও মার্কসবাদই উপযুক্তভাবে পারে বহুমতের চর্চার সুযোগের আদর্শগত ও শ্রেণিগত ভিত্তি রচনা করতে।

লুটেয়া বুর্জোয়া’ শাসনের চরম দেউলিয়াপনা ও ব্যার্থতা আজ স্পষ্ট। ‘সমাজতন্ত্র অভিমূখীন বিকল্প’ ধারা ও শক্তির শাসন আজ জাতির ও ইতিহাসের দাবী। দেশের কমিউনিস্ট-বামপন্থি-প্রগতিশীলদেরই এ কাজটিকে এগিয়ে নিতে হবে।