শ্রীমঙ্গল আছে আমার স্মৃতিতে, আমার ভাবনায়

প্রকাশিত: ৯:৩৮ পূর্বাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ৩০, ২০২৪

শ্রীমঙ্গল আছে আমার স্মৃতিতে, আমার ভাবনায়

আশ্রাফ আহমেদ |

ছবিতে আমার সঙ্গে যাঁকে দেখছেন তাঁর নাম সীতেশ রঞ্জন দেব। আমি ১৯৭৪ সালে কাজের সূত্রে শ্রীমঙ্গলে যখন প্রথমে আসি এবং যাদের সঙ্গে পরিচিত হই তাঁদের খুব স্বল্প সংখ্যক মানুষ এখন বেঁচে আছেন। যাঁরা বেঁচে আছেন তাদের মধ্যে সীতেশ বাবু একজন। আমরা মোটামুটি একই বয়সের। শ্রীমঙ্গল উপজেলায় একসময় ঘন জঙ্গল ছিল। প্রচুর জীবজন্তুর পশুপাখির আবাস ছিল। তখন প্রায়ই লোকজন হিংস্র জীবজন্তুর আক্রমণের শিকার হতো। সরকারিভাবে অনুমোদন ছিল শিকারের। যারা শিকার করতেন তারা সমাজে সাহসী হিসেবে মর্যাদা পেতেন। শিকারের জন্য পুরস্কারও দেওয়া হতো। সীতেশ বাবুর বাবা শীষ দেব এই অঞ্চলের নামকরা শিকারি ছিলেন। বাবার সঙ্গে শিকারের হাতেখড়ি। বাবা শিকারে গিয়ে অনেক সময় নানা ধরনের পাখি, হরিণসহ জীবন্ত পশু ধরে বাড়ি নিয়ে যেতেন। তখন শীতেশ বাবু সেই জীবজন্তুদের বাড়িতে লালন পালন করতেন। একসময় সীতেশ বাবু পুরোদস্তুর শিকারি হয়ে গেলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর একদিনের জন্য ১০ টাকায় বনবিভাগের পাস নিয়ে সর্বোচ্চ ১৫টি পশু বা পাখি শিকার করা যেত।

শীতেশবাবু ১৯৭৩ সালে বন্দুক ব্যবহারের লাইসেন্স পান। সেই থেকে মানুষকে আক্রমণ করা বহু প্রাণীকে তাড়িয়ে দিয়েছেন, কখনো বা শিকার করেছেন বনমোরগ, হরিণ ও অন্যান্য পাখি। এভাবে শিকার করতে করতে একদিন ভয়ংকর এক ঘটনায় সীতেশ বাবুর জীবন পাল্টে যায়। সেদিন তিনি মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসেন। শীতকালের এক সকালে খবর পেলেন পাত্রখলা চা বাগানের আদিবাসীদের ফসল নষ্ট করছে এক বুনো শুকর। সীতেশ বাবুও ছুটলেন তাদের কথামতো শুকুর তাড়াতে। ১৯৯১ সালের ১৪ই জানুয়ারি খুব ভোর বেলায় ঘন কুয়াশার মধ্যে পাত্রখলা চা বাগানের নলখাগড়ার বনের ভেতর দিয়ে চলছেন বন্ধুক হাতে। জায়গাটা ছিল ভারতীয় সীমান্তের ১০০ গজের মধ্যে। পথ চলতে চলতে উনি অনুভব করলেন যে উঁচু কিছুতে পা চাপা পড়েছে এবং মুহূর্তের মধ্যে বিশাল আকৃতির এক ভাল্লুক তার গালে এক থাবা দেয়। উনি পড়ে যান কিন্তু হাতে থাকা বন্দুক দিয়ে গুলি করেন। ভাল্লুকটি মারা যায়। প্রায় সংগে সংগেই মৌলুভীবাজার সদর হাসপাতালে নেয়া হয়। খবর পেয়ে সেইসময় ODA তে কর্মরত John Woolner মৌলুভীবাজারে ছুটে যান। অবস্হা খারাপ দেখে সেই সময়ের চা বোর্ডের চেয়ারম্যান জেনারেল আমিন আহমেদ চৌধুরীর সংগে পরামর্শ করেন। তিনিই সিএমএইচে চিকিৎসার ব্যবস্হা করেন। John Woolner তাঁর ল্যান্ড রোভারে ঢাকায় নিয়ে যান। সবার সহায়তায় সীতেশ বাবু সেবার প্রাণে বেঁচে যান। ঢাকা সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে সাতবার অপারেশন শেষে তার মুখে প্লাস্টিক সার্জারি করা হয়। তখন থেকে এক চোখ, মুখে লাগানোর দাঁত ও নাকের একটি ফুটা দিয়ে শ্বাস প্রশ্বাস চালিয়ে বেঁচে আছেন। সীতেশ বাবুর মতে এটি তার দ্বিতীয় জীবন। এখন উনি আর শিকার করেন না। উনার একটা চিড়িয়াখানা আছে যেটি বিভিন্ন জনের সহায়তায় তিনি স্থাপন করেছেন। এখানে বিপন্ন পশু পাখীকে আশ্রয় দেন। শ্রীমঙ্গলে কেউ বেড়াতে এলে সবাই সেটি দেখতে আসে। এছাড়া উনি লাইসেন্সড আর্ম ডিলার এবং বন্দুক মেরামত করেন।

আমার সঙ্গে সীতেশ বাবুর এটা যোগাযোগ সব সময় আছে। আসা যাওয়ার পথে মাঝে মাঝে দেখা হয়। আমিই দেখা করি। খুশি হন। বলেন “স্যার, আপনি আমাকে মনে রেখেছেন। পুরনো লোক আপনি। ”শ্রীমঙ্গলে একসময় অনেক নামকরা মানুষ ছিলেন।ইলিয়াস সাহেব ছিলেন এই অঞ্চলের জনপ্রতিনিধি।মহরম স্যার ছিলেন ভিক্টোরিয়া স্কুলের হেডমাস্টার। এস কে রায় ছিলেন নামকরা ব্যবসায়ী, শিক্ষক ছিলেন জানকী বাবু। মুজিব সাহেব ছিলেন শিক্ষাবিদ, আহাদ মিয়া ছিলেন জনপ্রতিনিধি, ডা: রমা রঞ্জন দেব ছিলেন চিকিৎসক। অনেকের নাম বলাই হলোনা। একে একে সবাই চলে গেছেন। রয়ে গেছেন শুধু শীতেশবাবু, চক্ষু চিকিৎসক ডাক্তার মতিন, যে আমাদেরকে সারাজীবন নিস্বার্থভাবে সহযোগিতা দিয়ে গেছে।

শ্রীমঙ্গল আছে আমার স্মৃতিতে, আমার ভাবনায়। আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ।