মো. আফজল হোসেইন | শ্রীমঙ্গল, ০৪ নভেম্বর ২০২৪ : বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন (রেজি: নং বি-৭৭)-এর কেন্দ্রীয়, ভ্যালী ও পঞ্চায়েত কমিটির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর প্রায় তিন বছর সময় পার হলেও অনুষ্ঠিত হয়নি নির্বাচন।
মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সিলেট, রাঙ্গামাটি, চট্টগ্রাম জেলার ফাঁড়িসহ ২৪১টি বাগান নিয়ে চা শ্রমিক ইউনিয়ন গঠিত। পাঁচ জেলায় মোট ভোটার সংখ্যা প্রায় এক লক্ষ। সর্বশেষ ২০১৮ সালে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের ত্রি-বার্ষিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ২০২১ সালে এর মেয়াদ শেষ হয়। এবার আরেকটি নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়ার কথা। এমতাবস্থায়ও নির্বাচন হওয়ার কোনো অগ্রগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছেনা বলে দাবী করেছেন চা শ্রমিকরা।
সোমবার (৪ নভেম্বর ২০২৪) সকাল সাড়ে ১১টায় বিভিন্ন বাগানের চা শ্রমিক ও পঞ্চায়েত কমিটির ব্যানারে নির্বাচনের দাবীতে শ্রীমঙ্গলে মিছিল ও সমাবেশ শেষে বিভাগীয় শ্রম দপ্তরে স্মারকলিপি প্রদান করা হয়। প্রায় দুই শতাধিক চা শ্রমিকের শ্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে রাজপথ।
সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক ও বালিশিরা ভ্যালী কমিটির সভাপতি বিজয় হাজরা।
সভাপতির বক্তব্যে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের বালিশিরা ভ্যালী কমিটির সভাপতি বিজয় হাজরা বলেন, বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের কেন্দ্রীয়, ভ্যালী ও পঞ্চায়েত কমিটির মেয়াদ প্রায় তিন বছর আগে শেষ হলেও এখনো নির্বাচনের আয়োজন করেনি নির্বাচন কমিশন। যার ফলে ন্যায্য অধিকারসহ নানা আইনী সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সাধারণ চা শ্রমিকেরা। শ্রমিকদের মজুরী বৃদ্ধি ও ন্যায়সঙ্গত অধিকার আদায়ে দরকষাকষি, চুক্তি সম্পাদন, ত্রিপক্ষীয় বৈঠক ও সবিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন। মজুরী- ভাতা, কর্মঘন্টা, ছুটিসহ চা শ্রমিক ও মালিক কর্তৃপক্ষের সাথে দরকষাকষির জন্য সিবিএ বৈঠক করে থাকে এই শ্রমিক ইউনিয়ন। দীর্ঘদিন যাবৎ চা শ্রমিক ইউনিয়নের নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হওয়ায় ওদের অধিকার আদায়ে সক্ষম হচ্ছে না।
তাছাড়া চায়ের মূল্য বাজারে কম থাকায়- এই অজুহাত দেখিয়ে চা শ্রমিকদের মজুরী-ভাতাও পরিশোধ করা হচ্ছেনা বলে অভিযোগ করেন এই শ্রমিক নেতা। আগামী ১৫ দিনের মধ্যে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের কেন্দ্রীয়, ভ্যালী ও পঞ্চায়েত কমিটির নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য সরকার ও শ্রম দপ্তরের কাছে জোর দাবী জানান তিনি।
স্মারকলিপি গ্রহণের পর উপস্থিত চা শ্রমিকদের আশ্বাস প্রদান করে বিভাগীয় শ্রম দপ্তরের উপ পরিচালক নাহিদুল ইসলাম বলেন, বিগত সরকারের আমলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আদেশ করেন যে চা শ্রমিক ইউনিয়নের নির্বাচনী ব্যয় সরকার বহন করবেনা। চা শ্রমিক ইউনিয়নকে তাদের নির্বাচনী ব্যয় নিজস্ব অর্থ দিয়েই নির্বাচন করার নির্দেশ দেন। যার ফলে নির্ধারিত সময়ে চা শ্রমিক ইউনিয়নের নির্বাচন আয়োজন করা সম্ভব হয়নি। ২০১৮ সালের বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের নির্বাচনে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৬৫ লক্ষ টাকা।নির্বাচন আয়োজনে পর্যাপ্ত অর্থের যোগান না থাকায় দীর্ঘসূত্রতা সৃষ্টি হয়েছে। অর্থ মন্ত্রনালয় থেকে এমন নির্দেশ এবং পরবর্তী সময়ে ২০২৩ সালে চা শ্রমিক ইউনিয়ন গঠনতন্ত্র সংশোধন করে নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়। নিবাচনী ব্যয়ের ২৫ লক্ষ টাকা নিবাচন কমিশনের কাছে জমা রয়েছে বলে জানান এই কর্মকর্তা।
ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে প্রয়োজনীয় অর্থের সংস্থানের বিষয়টি আলোচনা সাপেক্ষে আগামী ৩ মাসের মধ্যেই নির্বাচনের আয়োজন করার আশ্বাস প্রদান করেন তিনি।
বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের কেন্দ্রীয়, ভ্যালী ও পঞ্চায়েত কমিটির নির্বাচন ও এর ব্যয়ের সংস্থানের দাবী প্রসঙ্গে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির মৌলভীবাজার জেলা সম্পাদক মন্ডলীর সদস্য, সাপ্তাহিক নতুন কথার বিশেষ প্রতিনিধি, আরপি নিউজের সম্পাদক ও বিশিষ্ট কলামিস্ট কমরেড সৈয়দ আমিরুজ্জামান চলমান এ আন্দোলনের প্রতি পুন:সমর্থন ও একাত্মতা প্রকাশ করেন।
বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির মৌলভীবাজার জেলা সম্পাদক মন্ডলীর সদস্য কমরেড সৈয়দ আমিরুজ্জামান নির্বাচন অনুষ্ঠানসহ আলাপ আলোচনার মাধ্যমে মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপন উপযোগী যৌক্তিক মজুরি নির্ধারণ, বকেয়া পরিশোধ ও বন্ধ চা বাগান চালু করার আহবান জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, সামান্য কিছু সুযোগ-সুবিধাসহ দৈনিক মাত্র ১৭০ টাকা মজুরিতে আট ঘন্টা, কখনো-বা আরো অধিক সময় ধরে কাজের বিপরীতে এই সামান্য পারিশ্রমিক শোষণ-বৈষম্যমূলক ও সংবিধান পরিপন্থি। মজুরী বৃদ্ধিসহ অন্যান্য দাবীনামা নিয়ে দরকষাকষি ও আলোচনার মাধ্যমে উদ্ভূত পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে বাগান মালিকদের ঔপনিবেশিক মানসিকতা পরিহার করতে হবে ও সরকারকেও চা-শ্রমিকদের দেশের নাগরিক হিসেবে গণ্য করে ন্যায্য ও মানবিক উদ্যোগ নিতে হবে। একইসাথে, চা বাগানের শ্রমিকদের জন্য প্রযোজ্য শ্রম আইনের কার্যকর বাস্তবায়নের পাশাপাশি দেশের অন্যান্য সম-পর্যায়ের খাতের সর্বনিম্ন মজুরি বিবেচনায় নিয়ে মর্যাদাপূর্ণ জীবন ধারণের উপযুক্ত ও চা-শ্রমিকদের নিকট গ্রহণযোগ্য ন্যায্য পারিশ্রমিক নির্ধারণে বাগান মালিক, বাংলাদেশীয় চা সংসদ, শ্রম অধিদপ্তর ও সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন তিনি।
প্রতি দুই বছর পরপর চা-শ্রমিক ও বাগান কর্তৃপক্ষের মধ্যে মজুরি সংক্রান্ত চুক্তি নবায়নের রীতি রয়েছে, যদিও অধিকাংশ ক্ষেত্রে মজুরি নির্ধারণে বাস্তবে একতরফাভাবে বাগান কর্তৃপক্ষই সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে, তথাপি দীর্ঘদিন ধরে চা-শ্রমিকরা মজুরি চুক্তির বাইরে রয়েছে। দ্রব্যমূল্যের চরম ঊর্ধ্বগতির এই সময় চলমান আন্দোলনের প্রেক্ষিতে মাত্র ৮ টাকা ৫০ পয়সা মজুরি বৃদ্ধির প্রস্তাব চা-শ্রমিকদের ন্যায্য দাবির প্রতি অবজ্ঞা ও নিছক উপহাসমূলক অধিকার লঙ্ঘন ছাড়া আর কিছু নয় উল্লেখ করে তিনি বলছেন, চা-শ্রমিকদের প্রাপ্ত আবাসনসহ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা বিবেচনায় নিয়েও একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, দেশের অন্য যে-কোনো খাতের তুলনায় চা শ্রমিকদের মজুরি সর্বনিম্ন ও শোষণ-বৈষম্যমূলক। অথচ সার্বিক বিবেচনায় এ খাতটি অর্থনৈতিকভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়া, এখন পর্যন্ত কোনো পরিসংখ্যান বা তথ্য-উপাত্ত দিয়েও কেউ বলতে পারেননি যে, চা-বাগানের মালিক পক্ষ আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত বা এমন কোনো অবস্থায় আছেন যে, যাদের অবদানের ওপর নির্ভর করে চা-শিল্প বিকাশমান, সেই শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি প্রদানে তারা অক্ষম। বরং এটি একটি লাভজনক বাণিজ্যিক খাত। অন্যদিকে চা-শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরিসহ অন্যান্য মৌলিক অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার দায়িত্ব শুধু মালিকপক্ষের মর্জির ওপর ছেড়ে দেয়া ঠিক নয়। চা শ্রমিকদের দেশের নাগরিক হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে তাদের প্রাপ্য অধিকার নিশ্চিতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়সমূহকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে চলমান আন্দোলনের যৌক্তিকতা অনুধাবনের পাশাপাশি সমতাভিত্তিক আলোচনার মাধ্যমে চা শ্রমিকদের নিকট গ্রহণযোগ্য মজুরি নির্ধারণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।’
তিনি বলেন, দেশের “ন্যূনতম মজুরি বোর্ড” অন্যান্য খাতের ন্যূনতম মজুরি যেখানে কয়েক গুণ বেশি নির্ধারণ করেছে, সেখানে কোন অদৃশ্য শক্তির প্রভাবে শ্রম মন্ত্রণালয়ের “গাইড লাইন” উপেক্ষা করে বারবার চা বাগান মালিক পক্ষের নির্ধারণ করা ন্যূনতম মজুরির হার বহাল রেখে শ্রম মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করছে, তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।
Post Views:
১,০৮৯