নারীবাদী উর্দু সাহিত্যিক ইসমত চুগতাই: তাঁর জীবন চেতনা ও মানবিক স্পর্ধার ব্যাপ্তি

প্রকাশিত: ১:২২ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ২৬, ২০২৪

নারীবাদী উর্দু সাহিত্যিক ইসমত চুগতাই: তাঁর জীবন চেতনা ও মানবিক স্পর্ধার ব্যাপ্তি

তৈমুর খান |

উর্দু সাহিত্যের সবচেয়ে বলিষ্ঠ নারীবাদী লেখিকা ইসমত চুগতাই। সমগ্র জীবনটাই ছিল তাঁর বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু। এমনকী মৃত্যুর পরও বিতর্ক তাঁর পেছন ছাড়েনি। যাবতীয় ধর্মীয় এবং সামাজিক কুসংস্কারের ঊর্ধ্বে তিনি যে মানবীয় বলয় তৈরি করতে চেয়েছিলেন তা সর্বযুগেই বিরল। সাহসী, বলিষ্ঠ, মননশীল, বাস্তববাদী লেখিকা হিসেবে যে দৃষ্টান্ত তিনি রেখে গেছেন সেই যুগের পরিপ্রেক্ষিতে, তা এই যুগেও কদাচিৎ চোখে পড়ে। যৌনতা, সমকামিতা, গোঁড়ামি এবং ধর্মীয় ভণ্ডামী, কুসংস্কার সবই তাঁর লেখার বিষয়। এক প্রগতিশীল মুসলিম পরিবারে জন্ম হয়েছিল এবং উপমহাদেশের মধ্যে প্রথম কোনো মুসলিম মহিলা বিএ, বিএড পড়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন বলেই তিনি যুক্তিবাদী, বিজ্ঞান মনস্ক এবং মানবতাবাদী ও বিদ্রোহিনী হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে পেরেছিলেন। তাঁর জীবন কথাই তাঁর সাহিত্য হয়ে উঠেছিল।

ইসমত চুগতাই ১৯১৫ সালের ১৫ই অগাস্ট ভারতের উত্তর প্রদেশের বাদায়ুনে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। তিনি ছিলেন বাবা-মায়ের নবম সন্তান। দশজন ভাইবোনের মধ্যে ছয়জনই ছিল ছেলে এবং চার জন মেয়ে। কিন্তু অতি শিশু বয়সেই তাঁর বোনদের বিয়ে হয়ে যায়। ফলে ভাইদের সঙ্গেই তাঁর বাল্যকাল কাটে। তাঁর বাবা ছিলেন একজন পদস্থ সরকারি আমলা। সেইকারণে বাবার কর্মস্থল রাজস্থানের যোধপুরে তিনি বড়ো হন। শিক্ষার সূচনা মূলত এখানেই।
ভাইদের সঙ্গে বড়ো হওয়ার ফলেই বিপরীত লিঙ্গের প্রতি যে জড়তা বা আড়ষ্টতা তা তাঁর অল্পবয়সেই দূর হয়। পরবর্তী সময়ে তাঁর লেখার মধ্যেও এর প্রভাব পড়ে। খোলামেলা একটা মুক্ত চিন্তার ক্ষেত্র গড়ে ওঠে। তাছাড়া ব্যক্তিসত্তার গঠন ও বিকাশে সহায়ক হয়। তাঁর কিশোরী অবস্থাতেই বড়ো ভাই মির্জা আজিম বেগ চুগতাই একজন নামকরা প্রতিষ্ঠিত লেখক। ইসমত তাঁর কাছেই প্রথম লেখার প্রেরণা পান। তাঁর গুরু হিসেবে বড়োভাইয়ের স্নেহচ্ছায়া এবং লেখা প্রকাশের ক্ষেত্রে অবলম্বন হিসাবে কাজ করে।
ইসমত চুগতাই এর লেখার প্রধান বৈশিষ্ট্য হল তীব্র নারীবাদী চেতনার প্রতিফলন ঘটানো। তিনি ৩২ বছর বয়সে তাঁর জন্মদিনেই ভারতবর্ষ দ্বিখণ্ডিত হতে দেখেছেন। একদিকে পাকিস্তান, অন্যদিকে ভারত। ধর্মকে কেন্দ্র করে দ্বিজাতিতত্ত্বের এই রাজনৈতিক প্রভাবকে কখনোই তিনি মনে প্রাণে মানতে পারেননি। পাকিস্তান মুসলিমদের জন্য আলাদা দেশ হলেও সেখানে তিনি যাননি। অথচ তাঁর ভাই-বোনেরা এবং আত্মীয়স্বজনেরা সবাই চলে গেছেন। যে ক’জন মুসলিম বন্ধুবান্ধব চিন্তাশীল ব্যক্তি এপারে থেকে গেলেন, অর্থাৎ ভারতে রয়ে গেলেন তাঁদের সঙ্গে নিয়েই এক উর্দু সাহিত্যের পরিমণ্ডল গড়ে তুললেন। সেই সময়ের উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিরা হলেন— রশিদ জাহান, ওয়াজেদা তাবাসসুম ও কুররাতুলাইন হায়দার। সকলে মিলেই গড়ে তুললেন বিপ্লবী নারীবাদী রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ও নন্দন তাত্ত্বিক মূল্যবোধের জাগরণ মঞ্চ। তাঁদের সাহিত্য কর্মে উঠে এলো স্বাধীন বিভক্ত ভারতের মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকদের জীবনযাত্রা। যৌনতা, বিবাহ, সমকামিতা এবং নারীদের প্রতি অত্যাচারও। তবে নারীরাও গৃহকোণের অন্তরালে কীভাবে তাদের অবদমিত ইচ্ছার স্ফুরণ ঘটায় বা যৌনতা ও সমকামিতা লালন করে সেসবও লেখার বিষয় হয়ে উঠল। একদিকে নারীদের প্রতি শোষণ, বঞ্চনা, পীড়ন, অন্যদিকে সমকালীন আরও বহু বিতর্কিত বিষয়কে আশ্রয় করলেন সাহিত্য সৃষ্টিতে। বাস্তবতা, মননধর্মিতা এবং আবেগদীপ্ত অথচ মেধাবী লেখিকা হিসেবেই আত্মপ্রকাশ করলেন।
রাজনৈতিক মতাদর্শেও ইসমত চুগতাই প্রথম থেকেই বামপন্থী আন্দোলনকে সমর্থন করেছেন। ১৯৩৬ সালে লক্ষ্ণৌয় থাকাকালীন (তখন তিনি স্নাতক শ্রেণির ছাত্রী) ভারতের কম্যুনিস্ট পার্টির সংগঠনে যুক্ত হন। প্রোগ্রেসিভ রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশন (P.W.A) এর প্রথম সভায় তিনি যোগদান করেন। এখানেও তাঁর কর্মদক্ষতা, মানবিক চেতনার নানা পরিচয় ফুটে ওঠে। বিখ্যাত চলচিত্র পরিচালক ও চিত্রনাট্য লেখক শহিদ লতিফকে ১৯৪১ সালে বিয়ে করেন। স্বামীর সঙ্গেই বহু চলচ্চিত্রে কাজও করেন। ১৯৬৭ সালে শহিদ লতিফের মৃত্যুর পর লেখিকা হিসেবেই সময় কাটাতে পছন্দ করতেন। বিবাহিত জীবনে তাঁদের দুটি কন্যা সন্তান জন্ম গ্রহণ করে। কন্যারাও মায়ের আদর্শে মানবিক গুণ সম্পন্না হয়। পরবর্তী কালে একজন হিন্দু সম্প্রদায়ের এক ছেলেকে বিয়ে করে। শুধু মেয়েই নয়, তাঁর এক ভাইঝিও এই কাজ করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। ইসমত চুগতাই জাতিভেদ মানতেন না। ধর্ম বলতে মানবিক ধর্ম পালনকেই শ্রেষ্ঠ মনে করতেন। শুধু লেখিকা হিসেবেই নয়, ব্যক্তিজীবনেও তিনি ছিলেন সর্বধর্ম সমন্বয়ের প্রতীক। ভারতাত্মার মহান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে মহামানবের মিলনক্ষেত্র। এই মিলনকে তিনি আন্তরিকভাবেই গ্রহণ করতে চেয়েছিলেন। তাই কন্যা এবং ভাইঝির বিয়েই শুধু নয়, মৃত্যুর পরে তাঁর নিজের দেহকে কবর দেওয়ার বদলে শ্মশানে দাহ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। তাই তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর ইচ্ছাকে সম্মান জানিয়ে ১৯৯১ সালের ২৪ অক্টোবর মুম্বাইয়ের চন্দনবাড়ি মহাশ্মশানে তাঁকে দাহ করা হয় হিন্দু রীতি অনুযায়ী। এতটা উদারতা ভারতে কে দেখাতে পেরেছে? হিসেব করলে খুব কম জনকেই আমরা পাই। ইসমত চুগতাই নিজেই বলেছেন, তিনি এসেছেন এমন এক পরিবার থেকে ‘যেখানে হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান সবাই শান্তিতে বসবাস করে’। তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন, তাঁর মধ্যেই জেগে আছে হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান সব জাতির মানুষই। তাই তিনি শুধু কোরানই পড়েননি, মুক্ত মনে গীতা এবং বাইবেলও পড়েন। সুতরাং তাঁর জীবন ছিল সব সংস্কারের ঊর্ধ্বে মানবিক আদর্শে গড়া বিশ্ববোধের চেতনার আলোয় আলোকিত। তথাকথিত কোনো সংস্কার বা ভণ্ডামিরও কোনো প্রশ্রয় ছিল না।
ইসমত চুগতাই এর গল্পগুলি ছিল মানবীয় প্রবৃত্তি রসে জাগরিত, রোমান্টিক বা তথাকথিত কাহিনিধর্মী নয়। এক প্রকার জীবন রসায়নের বিশ্লেষণ। তসলিমা নাসরিনের মতো উগ্র একপেশে প্রবন্ধ-নিবন্ধও তিনি লেখেননি। বরং ছোটো গল্পগুলিতেই নারীজাগরণ এবং নারীর অধিকার সম্পর্কে তিনি সচেতন করে তুলেছেন। প্রসঙ্গক্রমে লোভ, ঘৃণা, বিদ্বেষও ফুটে উঠেছে চরিত্রগুলিতে। কোথাও বাস্তব ভারসাম্য হারায়নি। আবার শ্রমজীবী মানুষের কথাও কোনো কোনো গল্পে স্থান পেয়েছে, যেগুলিতে শ্রম, অনাহার, দারিদ্র্যের রূপ ফুটে উঠেছে। একজন শিল্পী হিসেবে তিনি যেমন তাঁর উপলব্ধির ক্ষেত্র বিস্তৃত করেছেন, তেমনি সততার বা স্পষ্টবাদিতারও কার্পণ্য করেননি। মবিনুল হক কৃত তাঁর গল্পের অনুদিত গ্রন্থটি ‘লেপ ও অন্যান্য গল্প’ পাঠক মহলে যথেষ্ট সাড়া ফেলেছে। সমসাময়িক বহু লেখকই তাঁর কাছ থেকে প্রেরণা পেয়েছেন। তাঁর ‘লিহাফ’ (বা লেপ) ১৯৪২ সালের উর্দু সাহিত্য সাময়িকী ‘আদাব এ লতিফ’ এ প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে সমগ্র মুসলিম সমাজেই একটা আলোড়ন দেখা দেয়। গল্পটির বিরুদ্ধে পাকিস্তানের লাহোর আদালতে মামলা দায়ের হয় অশ্লীলতা ও ধর্মদ্বেষিকতার অভিযোগে। লেখিকা কখনো আদালতের কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করেননি। অবশেষে বিচারে তিনিই জয়ী হন। কারণ গল্পটিতে সমকামিতা বা ধর্মবিরুদ্ধতার সরাসরি কোনো প্রমাণ নেই। আকার ইঙ্গিতে অনেকটাই বলা আছে। গল্পের অনুবাদকৃত কিছুটা অংশ এইরকম—
“অন্ধকারের মধ্যে বেগম জানের লেপ আবার হাতির মতো দুলছিলো।”
“আল্লাহ! আঁ!” আমি ক্ষীণস্বরে গুঙিয়ে উঠলাম।
লেপের ভেতরে হাতি একটা লম্বা শ্বাস ফেলে বসে পড়লো। আমিও চুপ হয়ে গেলাম। হাতি আবার ফিরে এসে নড়তে লাগলো। আমার প্রতিটি রোম পর্যন্ত শিউরে উঠলো।”
বর্ণনার শেষ অংশে লিখেছেন— “হাতিটা আবার ফড়ফড় করে উঠলো এবং যেন সে হাঁটু গেড়ে বসার চেষ্টা করছিলো। চপড় চপড় করে কিছু খাওয়ার আওয়াজও আসছিলো, যেন কেউ খুব মজাদার চাটনি চাখছে।”
শীতের রাতে লেপের ভেতর বেগম আর তার দাসী রব্বো যে এই হাতির মূর্তি ধারণ করছে তা রগরগে যৌনাচারের বর্ণনায় না গিয়েও লেখিকা কৌশলে বর্ণনা করেছেন। নবাব সাহেব অন্য কাজে মশগুল থেকে বেগম সাহেবার যৌনতৃপ্তি দিতে পারতেন না। ফলে প্রতিটি রাতই দাসী রব্বোকে দিয়ে তৃপ্তি পেতেন তিনি এবং সমকামী আসক্ত হয়ে উঠেছিলেন। অদ্ভুত বর্ণনা শক্তি এবং বাস্তববোধ ছিল বলেই গল্পের প্রতিটি স্তরই কৌতূহলী করে তোলে পাঠককে।
যে যুগে বেগম রোকেয়া শাখাওয়াত হোসেন বাংলার মুসলিম মহিলাদের শিক্ষার আলোয় আপন অধিকার আদায় করার কথা বলেছিলেন এবং প্রয়োজনে ধর্মগ্রন্থকেও সংস্কারের কথা বলেছিলেন, সেইযুগেই একজন উর্দুভাষী মহিলা ইসমত চুগতাই আরও একধাপ অগ্রসর হয়ে দেশ ও জাতির কাছে মানব মহিমাকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন। যদিও উভয়েই ছিলেন নারীবাদী লেখিকা, কিন্তু উভয়েরই লক্ষ্য ছিল সমাজ ও মানুষ। ইসমত চুগতাই এর কাছের মানুষ ছিলেন উর্দু লেখক মান্টো। তাঁর সম্পর্কে বলতে গিয়ে লেখিকা লিখেছেন- “আমাদের নিজেদের মনের পবিত্রতার আবরণটি সরিয়ে ভিতরের কুসংস্কার, ক্রোধ, ঘৃণা, যৌন বিকৃতি ইত্যাদির মোকাবেলা করতে হয়। তাতে করে আর কিছু না হোক, আমরা অন্যদের সঙ্গে একাত্মবোধ করি, সহন আর ক্ষমাশীলতার মূল্য আরও প্রয়োজন হঠাৎ প্রতিভাত হয় আমাদের কাছে।” (অবসর, ২০১৪) এই বক্তব্য থেকেই বোঝা যায় ইসমত চুগতাই এর ব্যাপ্তি কতখানি মানবমহিমার কাজে ব্রতী হয়ে উঠেছিল। তাঁর প্রতিভার স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি ১৯৮৪ সালে পেয়েছিলেন গালিব অ্যাওয়ার্ড এবং ১৯৭৫ সালে পেয়েছিলেন ফিল্মফেয়ার বেস্ট স্টোরি অ্যাওয়ার্ড। আধুনিক সাহিত্য, সমাজভাবনা এবং নারীচেতনায় তাঁর কাজের অবদান কোনোদিনও ম্লান হবে না। তাঁর হাতে সাহিত্য যতটা সমৃদ্ধ হয়েছে ততটাই প্রগতিশীল ভাবনার দ্যোতক হয়ে উঠেছে। আজ তাঁকেই বেশি করে আমাদের প্রয়োজন।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ