চে গুয়েভারা: বিপ্লবের লাল রূপকথা ও মুক্তির চিরন্তন প্রতীক

প্রকাশিত: ১২:৫৮ পূর্বাহ্ণ, অক্টোবর ৯, ২০২৫

চে গুয়েভারা: বিপ্লবের লাল রূপকথা ও মুক্তির চিরন্তন প্রতীক

Manual4 Ad Code

সৈয়দ আমিরুজ্জামান |

“বিপ্লব সবসময়ই গভীর আবেগ আর ভালোবাসা দ্বারা পরিচালিত হয়,
সত্যিকার আবেগ আর ভালোবাসা ছাড়া বিপ্লব অসম্ভব।” — চে গুয়েভারা

১. ভূমিকা

দুনিয়া কাঁপানো কিংবদন্তি বিপ্লবী কমরেড চে গুয়েভারা—এক নাম, এক বিপ্লবের মহানায়ক। ১৯৬৭ সালের ৯ অক্টোবর বলিভিয়ার লা হিগুয়েরার জঙ্গলে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন এই আর্জেন্টাইন বিপ্লবী। আজ তাঁর ৫৮তম শাহাদাৎবার্ষিকীতে আমরা স্মরণ করি এক মহান নেতৃত্বকে, যিনি শুধু রাজনীতির ইতিহাসেই নয়, মুক্তি, মানবতা ও ন্যায়বোধের সংগ্রামে এক অনন্ত প্রতীক হয়ে আছেন।

চে গুয়েভারা শুধু একজন গেরিলা নেতা ছিলেন না; তিনি ছিলেন চিন্তাবিদ, দার্শনিক, লেখক, ডাক্তার, এবং সর্বোপরি—একজন মানবপ্রেমী বিপ্লবী। তাঁর জীবন ছিলো এক ধারাবাহিক বিপ্লবের মহাকাব্য, যা আজও তরুণ প্রজন্মের কাছে জাগরণের অনুপ্রেরণা।

২. জন্ম ও শৈশবের আদর্শ

এর্নেস্তো গুয়েভারা দে লা সের্না, সংক্ষেপে “চে”, ১৯২৮ সালের ১৪ জুন আর্জেন্টিনার রোসারিও শহরে জন্ম নেন। তাঁর পরিবার ছিল সমাজতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণার অনুসারী। ছোটবেলা থেকেই তাঁর মনে জন্ম নেয় দরিদ্র ও নিপীড়িত মানুষের প্রতি গভীর সহানুভূতি। শৈশবে হাঁপানিতে আক্রান্ত হলেও তাঁর সাহস, অধ্যবসায় ও ক্রীড়া-নিপুণতা তাঁকে অন্যদের চেয়ে আলাদা করে তুলেছিল।

তাঁর ঘরে ছিল প্রায় তিন হাজার বই—যার মধ্যে কার্ল মার্ক্স, লেনিন, নেহেরু, কামু, নেরুদা, হুইটম্যান, লোরকার মতো মনীষীদের রচনা। এই পাঠাভ্যাসই তাঁকে গড়ে তোলে এক চিন্তাশীল ও বিশ্লেষণধর্মী মানুষে।

৩. মোটরসাইকেল ডায়েরি: মানবতার জাগরণ

১৯৫১ সালে, চিকিৎসা শিক্ষার্থী অবস্থায়, চে তাঁর বন্ধু আলবার্তো গ্রানাডোকে সঙ্গে নিয়ে দক্ষিণ আমেরিকা ভ্রমণে বের হন মোটরসাইকেলে। এই যাত্রাই তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। তিনি প্রত্যক্ষ করেন দারিদ্র্য, ক্ষুধা, শ্রেণিবৈষম্য ও শোষণের নির্মম চিত্র। লেপার কলোনিতে (কুষ্ঠরোগীদের কেন্দ্র) কাজ করতে গিয়ে তিনি উপলব্ধি করেন—মানবতার কোনো সীমানা নেই।

সেই অভিজ্ঞতা থেকে তাঁর ডায়েরিতে উঠে আসে সেই বিখ্যাত বাক্য—
“মানব সত্তার ঐক্য ও সংহতির সর্বোচ্চ প্রকাশ এসেছিল এই বঞ্চিত মানুষদের মাঝেই।”

এই ভ্রমণ-অভিজ্ঞতাই তাঁকে চিকিৎসক থেকে বিপ্লবীর পথে চালিত করে। ২০০৪ সালে তাঁর এই ভ্রমণ নিয়ে নির্মিত হয় আন্তর্জাতিক খ্যাতিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র The Motorcycle Diaries।

৪. বিপ্লবের সূচনা দেশে দেশে: গুয়াতেমালা থেকে কিউবা

১৯৫৩ সালে গুয়েভারা গুয়াতেমালায় যান, যেখানে প্রেসিডেন্ট জাকোবো আরবেনজ সমাজ সংস্কারের প্রচেষ্টা চালাচ্ছিলেন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত “ইউনাইটেড ফ্রুট কোম্পানি”-র স্বার্থরক্ষায় সিআইএ পরিচালিত অভ্যুত্থানে সেই সরকার পতিত হয়। এই ঘটনাই চে’র মনে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ জাগায়। তিনি বুঝতে পারেন—পুঁজিবাদী ব্যবস্থার শোষণ ঠেকাতে হলে দরকার সশস্ত্র সংগ্রাম জনগণ-ভিত্তিক বিপ্লব।

এরপর ১৯৫৫ সালে তিনি মেক্সিকো সিটিতে ফিদেল কাস্ত্রো ও রাউল কাস্ত্রোর সঙ্গে পরিচিত হন। তাদের নেতৃত্বাধীন “২৬ জুলাই আন্দোলন”-এ যোগ দিয়ে তিনি হয়ে ওঠেন কিউবার মুক্তি সংগ্রামের অপরিহার্য সংগঠক।

৫. কিউবান বিপ্লব ও চে’র ভূমিকা

১৯৫৬ সালের নভেম্বরে মাত্র ৮২ জন বিপ্লবী নিয়ে কাস্ত্রো ও চে কিউবার উদ্দেশে পাড়ি জমান গ্রানমা নামক নৌকায়। যাত্রার পরপরই তারা সরকারের বাহিনীর হাতে আক্রান্ত হন; বেঁচে যান মাত্র ২২ জন। সেখান থেকেই শুরু হয় সিয়েরা মাস্ত্রা পর্বতমালায় গেরিলা যুদ্ধ।

চে ছিলেন সংগঠিত, কঠোর কিন্তু ন্যায়পরায়ণ কমান্ডার। তিনি চিকিৎসক থেকে হয়ে ওঠেন সেনাপতি—শিক্ষক থেকে পরিণত হন বিপ্লবের দার্শনিকে। তাঁর নেতৃত্বে গেরিলারা বাতিস্তা শাসনব্যবস্থাকে উৎখাত করতে সক্ষম হয়।
১৯৫৯ সালে কিউবা সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে, যার অন্যতম স্থপতি ছিলেন চে গুয়েভারা।

৬. বিপ্লব-পরবর্তী কিউবা ও চে’র রাষ্ট্রীয় ভূমিকা

Manual7 Ad Code

কিউবা বিপ্লবের পর চে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন—জাতীয় ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট, শিল্পমন্ত্রী, সামরিক প্রশিক্ষণ পরিচালক ইত্যাদি। তিনি কিউবার অর্থনীতি পুনর্গঠনে সমাজতান্ত্রিক নীতি প্রবর্তন করেন, কৃষি সংস্কার চালু করেন এবং শিক্ষা-স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে জনগণের নাগালে আনেন।

তাঁর স্বাক্ষরিত ব্যাংক নোটে ছিল কেবল একটি শব্দ—“চে”, যা ছিল তাঁর ব্যক্তিত্বের প্রতীক: অহংহীন, মানবিক, বিপ্লবী।

তবে সোভিয়েত ইউনিয়নের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতার সমালোচনা করায় তিনি কিউবার মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করেন এবং বিশ্ববিপ্লবের উদ্দেশ্যে নতুন অভিযাত্রা শুরু করেন।

৭. আন্তর্জাতিক বিপ্লব: কঙ্গো থেকে বলিভিয়া

১৯৬৫ সালে চে আফ্রিকায় যান—কঙ্গোর মুক্তি আন্দোলনে সহায়তা করতে। তিনি বিশ্বাস করতেন, আফ্রিকা হলো “রাজতন্ত্রের দুর্বল ঘাঁটি”—যেখানে বিপ্লবের আগুন ছড়িয়ে দিতে হবে। কিন্তু অভ্যন্তরীণ অনৈক্য ও নেতৃত্বের ঘাটতিতে সেই অভিযান ব্যর্থ হয়।

এরপর তিনি বলিভিয়ায় যান, লাতিন আমেরিকার নতুন বিপ্লব গড়ে তুলতে। কিন্তু স্থানীয় কমিউনিস্ট নেতৃত্ব ও কৃষকদের সমর্থনের অভাবে গেরিলা আন্দোলন ব্যর্থ হয়। ১৯৬৭ সালের অক্টোবর মাসে তিনি বলিভীয় সেনাদের হাতে বন্দী হন, মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর প্রত্যক্ষ সহায়তায়।

৮. মৃত্যু ও কিংবদন্তির সূচনা

Manual7 Ad Code

১৯৬৭ সালের ৯ অক্টোবর, দুপুর ১টা ১০ মিনিটে, লা হিগুয়েরা গ্রামের স্কুলঘরে গুলি করে হত্যা করা হয় বন্দী চে গুয়েভারাকে। তাঁকে হত্যা করা সৈনিক পরবর্তীতে স্বীকার করে—“আমি কাঁপছিলাম, যেন ইতিহাসের সামনে দাঁড়িয়ে আছি।”

নিউইয়র্ক টাইমস সে সময় লিখেছিল—
“একজন মানুষের সঙ্গে সঙ্গে একটি রূপকথাও চিরতরে বিশ্রামে গেল।”

কিন্তু ইতিহাস বলে—চে মরেননি। তিনি পরিণত হয়েছেন মুক্তির প্রতীকে। তাঁর কবর খুঁজে পাওয়া যায় ১৯৯৭ সালে বলিভিয়ার ভ্যালেগ্রান্ডের এক গণকবরে, এবং সেই বছরই তাঁর দেহাবশেষ কিউবায় ফিরিয়ে আনা হয়। হাভানায় আজও তাঁর সমাধিতে বিশ্বজুড়ে মানুষ শ্রদ্ধা জানাতে আসে।

৯. লেখক ও চিন্তাবিদ চে

Manual6 Ad Code

চে গুয়েভারা শুধু যোদ্ধা ছিলেন না, ছিলেন এক প্রখর লেখক ও চিন্তাবিদ। তাঁর রচিত “Guerrilla Warfare”, “Reminiscences of the Cuban Revolutionary War”, এবং “Socialism and Man in Cuba” আজও বিপ্লববিষয়ক পাঠ্য হিসেবে বিশ্বজুড়ে পড়ানো হয়।

Manual5 Ad Code

তিনি লিখেছিলেন প্রায় ৭০টি প্রবন্ধ, অসংখ্য চিঠি ও বক্তৃতা। তাঁর লেখায় উঠে এসেছে মানুষের মুক্তি, ন্যায়বিচার, শিক্ষা ও নৈতিকতার প্রতি গভীর বিশ্বাস।
তাঁর একটি বিখ্যাত উক্তি—
“বিপ্লবী হতে চাও? বিপ্লবের প্রথম শর্ত, শিক্ষিত হও।”

১০. চে-র বিপ্লবী দর্শন

চে বিশ্বাস করতেন—বিপ্লবের মূল শক্তি মানুষ, অস্ত্র নয়। তাঁর দর্শনে প্রেম, আদর্শ, নৈতিকতা ও আত্মত্যাগ একসূত্রে গাঁথা। তিনি বলেছিলেন—
“সর্বোপরি, একজন বিপ্লবীকে সবসময় দৃঢ়ভাবে বিশ্বের যেকোন প্রান্তে সংঘটিত অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে।”

চে’র মতে, সমাজতন্ত্র মানে কেবল অর্থনৈতিক পরিবর্তন নয়; এটি হলো মানুষের মানসিক ও নৈতিক বিপ্লব। তাঁর চিন্তায় ছিল এক আদর্শিক মানবিকতা—যেখানে রাষ্ট্র, দল, ধর্ম বা জাতির চেয়ে মানুষই মুখ্য।

১১. চে গুয়েভারা ও সমকালীন প্রাসঙ্গিকতা

আজকের বৈশ্বিক বাস্তবতায়—যেখানে ধনী-গরিবের ব্যবধান, জলবায়ু বিপর্যয়, সাম্রাজ্যবাদী রাজনীতি ও পুঁজির শোষণ-লুণ্ঠন নতুন রূপে ফিরে এসেছে—চে গুয়েভারার দর্শন আবারও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।
চে আমাদের শেখান—
মানুষের মুক্তি কোনো একক দেশের নয়, এটি একটি বিশ্বমানবিক কর্তব্য।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, গণআন্দোলন বা শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আন্দোলনেও চে গুয়েভারার চিন্তা অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে আছে। তাঁর প্রতিকৃতি আজও বামপন্থী রাজনীতির ব্যানারে, বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালে, কিংবা তরুণদের বুকের টিশার্টে—মুক্তির প্রতীক হয়ে বেঁচে আছে।

১২. জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে চে

চে গুয়েভারার জীবন নিয়ে তৈরি হয়েছে বহু তথ্যচিত্র, নাটক ও চলচ্চিত্র। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো স্টিভেন সোডারবার্গ পরিচালিত Che (২০০৮), যেখানে চে’র চরিত্রে অভিনয় করেন বেনিসিও দেল টোরো।
তাঁর ছবি—“Guerrillero Heroico”, আলবের্তো কোর্দার তোলা সেই বিখ্যাত ফটোগ্রাফ—আজ বিশ্বের সর্বাধিক পুনর্মুদ্রিত প্রতিকৃতি, যা বিপ্লবের বৈশ্বিক প্রতীক।

১৩. কিছু অমর উক্তি-

১. “বাস্তববাদী হও, অসম্ভবকে দাবি কর।”
২. “নতজানু হয়ে সারাজীবন বাঁচার চেয়ে আমি এখনই মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত।”
৩. “আমরা কিসের জন্য বাঁচব সেটা আমরা নিশ্চিত হতে পারি না, যতক্ষণ না আমরা তার জন্য মরতে প্রস্তুত।”
৪. “বিপ্লব তো গাছে ধরা আপেল নয়, পাকলে পড়বে—বিপ্লব অর্জন করতে হয়।”
৫. “নীরবতা এক ধরনের যুক্তি, যা গভীর সত্য বহন করে।”

১৪. উপসংহার

চে গুয়েভারা ইতিহাসের পৃষ্ঠা ছাড়িয়ে আজ এক মানবিক মূল্যবোধের প্রতীক। তিনি এমন এক বিশ্বাসের নাম, যে বিশ্বাস বলে—অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোই মানবতার ধর্ম। তাঁর জীবন আমাদের শেখায়—
বিপ্লব কেবল বন্দুকের শব্দ নয়, এটি এক আবেগ, ভালোবাসা, এবং আত্মত্যাগের যাত্রা।

আজ যখন পৃথিবী আবারও বৈষম্যে ভরপুর, তখন চে গুয়েভারার সেই আহ্বান—
“হয় সমাজতন্ত্র, না হয় মৃত্যু”—
আমাদের মনে করিয়ে দেয়, মানবতার পক্ষে লড়াই কখনো শেষ হয় না।
#

লেখক:
সৈয়দ আমিরুজ্জামান
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট;
বিশেষ প্রতিনিধি, ইংরেজি দৈনিক দ্য ফিনান্সিয়াল পোস্ট ও সাপ্তাহিক নতুনকথা;
সম্পাদক, আরপি নিউজ,
কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, জাতীয় কৃষক সমিতি
ই-মেইল: syedzaman.62@gmail.com | মোবাইল: ০১৭১৬৫৯৯৫৮৯

 

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ