হাফ এন আওয়ার চ্যাটিং এবাউট কালচার

প্রকাশিত: ৩:২১ পূর্বাহ্ণ, জুলাই ৩, ২০২০

হাফ এন আওয়ার চ্যাটিং এবাউট কালচার

মেহেদী উল্লাহ || ০৩ জুলাই ২০২০ : এই করোনাকালে হাই, হ্যালো ছাড়িয়ে চ্যাটিং গড়াচ্ছে বিভিন্ন চিন্তার কথাতে। টাইমলাইনে তেমনই এক আয়োজন— ‘হাফ এন আওয়ার চ্যাটিং এবাউট কালচার‘ (Half an hour chatting about culture). আজ থাকছেন মঞ্চ অভিনেত্রী ও জেলা শিল্পকলা একাডেমির সাংস্কৃতিক কর্মকতা Jyoti Sinha. সংস্কৃতি নিয়ে কথা হলো তাঁর সঙ্গে—

মেহেদী উল্লাহ : কমলগঞ্জের মণিপুরি থিয়েটারের সামগ্রিক চর্চাটা কেমন? ওই পরিবেশে, একটা নিরিবিলি ব্যাপার আছে! মহড়া, নির্দেশনা, অভিনয় —সবকিছু মিলিয়ে!

জ্যোতি সিনহা : কমলগঞ্জে মণিপুরি থিয়েটারের কার্যক্রম আর থিয়েটারের সাথে সাধারণত মিলে না, গ্রামের পরিবেশ, আবহাওয়া, মানুষের চিন্তা চেতনা এ সবকিছুর মধ্য দিয়ে একটা নিজস্ব ধরনে এখানে নাট্যচর্চা হয়ে থাকে। আমরা সাধারণত বছরের একটা নির্দিষ্ট সময় ধরে মহড়া করি, শীতকালে নাট্যপ্রযোজনা নির্মাণ করা হয়। কারণ, বছরের অন্যান্য সময় বৃষ্টিবাদলা থাকে, দূরদূরান্তের গ্রাম থেকে ছেলেমেয়েরা নদী পার হয়ে আসে, তাদের আসতে অসুবিধা হয়, শীতকালে নদীর পানি শুকিয়ে থাকে, এ সময় গরমও কম থাকে আমাদের কাজের এক উপযোগী পরিবেশ তৈরি হয়। এছাড়া দলের সভাপতি শুভাশিস সিনহার ইচ্ছে কমলগঞ্জেই নিজের মতো প্রতিষ্ঠানকে সাজাবেন, তিনি দলের কাজের নির্দেশনা দেন, প্রযোজনা নির্মাণের আগে একটি ওয়ার্কশপ করা হয় তার মধ্য থেকে নতুন কিছু মুখ বেছে নেয়া হয়, তাদের এবং পুরনো যারা আমরা কাজ করছি তাদের সমন্বয়ে নাটক নির্মিত হয়ে থাকে আর এভাবেই মণিপুরি থিয়েটার ২৩ বছর পার করছে।

মেউ : আপনি অভিনেত্রী হিসেবে ওই থিয়েটারের কেন্দ্রেই বলা চলে। প্রায় ত্রিশের মত নাটকে কাজ করেছেন। সুনাম এনে দিয়েছেন। নাটক পুরস্কৃত হয়েছে। কিন্তু গ্রামের মানুষের মধ্যে এই থিয়েটার নিয়ে প্রতিক্রিয়া কেমন? আর তাদের উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্যে আপনি কিভাবে বিরাজ করেন?

জ্যোতি সিনহা : প্রথমদিকে থিয়েটারকে গ্রামের মানুষ শখের একটা কিছু ভেবে বসেছিল, এটা যে এতবছর ধরে টিকে থাকবে তা কেউ হয়তো কল্পনাও করেনি। কিন্তু আমরা যারা গোড়া থেকে এর সাথে লেগেছিলাম, একে নিয়েই আমাদের জীবনপ্রবাহ সাজিয়েছিলাম, একটা অর্থ তৈরি করতে চেয়েছি, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিসরে দলের কাজগুলো উপস্থাপন করেছি। মূলত আমাদের কাজের বক্তব্য, উপস্থাপন ধারা, ফর্ম ইত্যাদি দিয়ে মানুষের খুব নিকটে পৌঁছানোর চেষ্টা করেছি, তাই বৃদ্ধ-যুবা-তরুণ-কিশোর সকল বয়সী মানুষের কাছে আমাদের গ্রহণযোগ্যতা খুব বেশি, আমরা তাদের ভালোবাসা নিয়েই আছি, আমি তাদের মুগ্ধতার ভালোবাসার জ্যোতি।

মেউ : শুভাশিস সিনহার এমন প্রচেষ্টাকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করেন? সাধনার ফল শহরে আসে, কিন্তু সাধনাটা গ্রামেই। এটা কি কেন্দ্র ভাঙার চিন্তা, নাকি একান্তই শহর ভালো লাগে না সেকারণে গ্রামেই থাকা?

জ্যোতি সিনহা : একদম তাই, কেন্দ্র ভাঙার ইচ্ছে, নিজের স্বতন্ত্র পথ তৈরির আকাঙ্ক্ষা। তিনি শুরু থেকেই শিল্পে নিজের মতো করে চলতে চেষ্টা করেছেন, থিয়েটারের এই ভাবনাও তারই অংশ। শহর ভালো লাগে না – ব্যাপারটা শুধু এই কারণে নয়, এটি তার দার্শনিক চিন্তাও, মাটির কাছে থেকে শিল্পের আত্মাকে ছোঁবার প্রয়াস।

মেউ : উপস্থাপন ও ফর্ম দিয়ে মানুষের কাছে পৌঁছানোর কথা বললেন। সেই উপস্থাপন ও ফর্ম নিয়ে শুনতে চাই। যেজন্য সেখানে সব মানুষের কাছে থিয়েটার গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে।

জ্যোতি সিনহা : আমরা যে নাটকই করি, আমাদের লক্ষ্য থাকে তা যেন গ্রাম থেকে শহর সব মানুষকেই স্পর্শ করতে পারে শৈল্পিকভাবে। কিন্তু শিল্পের সবকিছুই তো সবার কাছে সমান গ্রহণীয় হয় না, সেজন্য সাধারণ কিছু উপাদান যেমন নৃত্য – গীত – বাদ্য – অভিনয় সবকিছুকে এমন সৌলফুলি সমন্বিত করার চেষ্টা করা হয় যাতে কোনো না কোনোভাবে তা শহর/গ্রাম যে কোনো জায়গার দর্শককে যুক্ত করতে পারে। শুভাশিস দা গভীর কৌশলে এই কাজটি করে থাকেন। আমি, আমরা যথাসাধ্য তার পাশে দাঁড়াই।

মেউ : আচ্ছা। কোন চিন্তা থেকে দেশিয় বা বিষ্ণপ্রিয়া মণিপুরি ভাষার নাটক ছাড়াও অন্যভাষার নাটক আপনাদের চর্চায় বিবেচিত হয়? যেমন, হ্যাপি ডেজ!

জ্যোতি সিনহা : একদম সহজভাবে বলতে গেলে মাঝেমধ্যে একটু হাত-পা ছোঁড়ার ইচ্ছে। ভিন্ন ভাষা, ভিন্ন অভিজ্ঞতা। শিল্পীর জন্য তারও দরকার আছে। তবে যাই করি সেখানে আমাদের টোনটা, ভিউটা কিন্তু থাকেই। হ্যাপি ডেজ-ও শুধু বেকেটিয় (স্যামুয়েল বেকেট) আর থাকে নি, আমাদের হয়ে গেছে। ফর্মে নয়, গেটআপে নয়, স্ক্রিপ্টের আত্মাটাকে আমাদের মতো করে ধরার চেষ্টায়।

মেউ : মঞ্চের সঙ্গে আপনার অনেক বছরের সম্পর্ক। মঞ্চ কীভাবে আমাদের সাংস্কৃতিক সংকটগুলোকে পাল্টে দিতে পারে? সেখানে একজন অভিনেত্রীর ভূমিকা কী?

জ্যোতি সিনহা : এটা খুবই কঠিন, শুধু মঞ্চই নয়, শিল্প-সংস্কৃতি সমাজ বা রাষ্ট্রে আসলে কতটুকু প্রভাব ফেলতে পারে, এটা এখন চিন্তারই বিষয়। তারপরও সুন্দর কিছুর জন্যে, অন্ধকারে এক চিলতে আলোর জন্যে, মানুষের রুচি তৈরির জন্যে একজন অভিনেত্রীর কিছুটা ভূমিকা তো রয়েছেই। সেটাও সাংস্কৃতিক সংকটে পথ দেখায়।

মেউ : আচ্ছা।
অভিনয়ের পাশাপাশি আপনি জেলা শিল্পকলা একাডেমির সংস্কৃতিবিষয়ক কর্মকর্তা। দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে জেলার সংস্কৃতি নিয়ে অভিজ্ঞতা কী?

জ্যোতি সিনহা : হ্যাঁ, আমি মৌলভীবাজার জেলায় কাজ করছি। এটি আমার নিজের জেলা, মানুষগুলো আমার পরিচিত, সেজন্য খুব একটা সমস্যা নেই, তারপরও কিছু সংকট তো থাকেই। আমি সাধ্যমতো চেষ্টা করি আমার দীর্ঘদিনের কাজের অভিজ্ঞতা দিয়ে তাদের মোটিভেট করতে, ভালো কিছু করতে।

মেউ : কি ধরনের মোটিভেশন দেন?

জ্যোতি সিনহা : অল্প সম্বল নিয়ে কোনো কাজের ভালো আউটপুট আনার জন্য আমি আমার থিয়েটারের স্কুলিংটাকে কাজে লাগাই – সেটা কোনো প্রোগ্রাম আয়োজনে বা যে কোনো বিষয়ে।

মেউ : এমন কি ঘটে আপনার একাডেমিতে শেখা সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে আপনি তাদের নিজস্ব ও সহজাত সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দেন, এটা তারা চায়? মানে কোন হীনম্মন্যতা আছে তাদের?

জ্যোতি সিনহা : না, সেরকম কিছু না। অভিজ্ঞতার এক ধরনের সমন্বয় তো প্রয়োজন পড়েই, একটা মিথষ্ক্রিয়া। প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কৃতি চর্চায় এটা জরুরি। এখন পর্যন্ত সেরকম কোনো হীনম্মন্যতার বিষয় এখানে ঘটেছে বলে মনে হয় না।

মেউ : আচ্ছা। ওখানে মানুষ কিসে বেশি সুখি ও আনন্দিত হয়? কিসে কষ্ট পায়? মানে শোক সংবাদ ছাড়া অন্য কষ্ট?

জ্যোতি সিনহা : কোথায়? গ্রামে?

মেউ : মৌলভীবাজারে?

জ্যোতি সিনহা : অন্যান্য মফস্বল শহরগুলোর ক্ষেত্রে যেরকম হয় এখানেও সেরকমই। পারিবারিক, সামাজিক অনেক ঘটনার প্রভাব যেমন থাকে, তেমনি দেশ/রাষ্ট্রের নানান ঘটনাতেও তারা কখনো আনন্দিত হয়, কখনো হাহুতাশ করে। বিচ্ছিন্ন কিছু তো নয়।
তবে হ্যাঁ, এখানকার মানুষ একটু সৌখিন, ঘোরাঘুরি, খাওয়া-দাওয়া, শপিং এসব খুব পছন্দ করে। আর সামাজিক সম্পর্কটাও জোরালো।

মেউ : শিল্পকলা কোন অনুষ্ঠান করলে তাতে স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে আসে দেখতে, আগে যেমন পালা, যাত্রা ইত্যাদি দেখতে যেত?

জ্যোতি সিনহা : হ্যাঁ, শুধু স্বামী-স্ত্রী নয়, আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবসহ আসে। এটা বেশ মজার।

মেউ : আচ্ছা। সেলিব্রেটির কাছে অটোগ্রাফ নেওয়ার চল আছে? আপনার নাটক দেখে নেয় অটোগ্রাফ?

জ্যোতি সিনহা : হা হা হা…টিভি সিনেমার নায়িকাদের মতো তো নয়, তবে অটোগ্রাফ দেবার কমবেশ অভিজ্ঞতা আছে, তার বেশি আছে ছবি তোলার অভিজ্ঞতা। প্রতি শোয়ের পরেই অনুরাগী দর্শকদের সাথে প্রচুর ছবি তুলতে হয়েছে। নানান গিফটও পেয়েছি।

মেউ : আচ্ছা, আচ্ছা, হ্যাঁ এখন সেলফিই বেশি তোলে। আপনি সিনেমা বা টিভি ফিকশনে কাজ করবেন?

জ্যোতি সিনহা : হুম, সেলফি। কয়েকটি টিভি ফিকশনে কাজ করেছি, ভালো অফার পেলে সিনেমাতেও কাজ করার ইচ্ছে আছে।

মেউ : আচ্ছা। নটমন্ডপে এমন অনেকেই আপনার অভিনয় দেখেন যারা বাস্তবেও আপনাকে হাসতে দেখে, রাগতে দেখে, মন খারাপ করে থাকতে দেখে, তো সেই তারাই আবার অভিনয়ে একই এক্সপ্রেশন দেখে! একই? নাকি আলাদা কিছু ঘটান?

জ্যোতি সিনহা :মজার প্রশ্ন। ওভাবেই সবকিছু অভিনয়ে করলে বা দেখালে তো লোকজন পাগল বলবে, নির্ঘাৎ! আলাদা কিছু না ঘটালে কি হয়? লুকোচুরি খেলতে হয় নিজের সাথে!
একটু আড়াল, একটু ফোকাস, একটু রঙ, কম-বেশ… হা হা হা।
এখন নিশ্চয় বলবেন, আসলে কী ঘটাই! সেটার কিন্তু উত্তর দেব না। থিয়েটারে এসেই দেখতে হবে।

মেউ : জি নিশ্চই চলে আসব। আচ্ছা, কোভিড ১৯ শুটিংয়ে চেঞ্জ এনেছে, ফর্মেও। মঞ্চে কি কোন চেঞ্জ আনবে? আর ভার্চুয়ালি শো করার চিন্তা কি করা যেতে পারে?

জ্যোতি সিনহা : গল্পে ভাবনায় অনেক নতুন কিছু আসবে মনে করি। নতুন বাস্তবতা। এরকম চলতে থাকলে প্রেজেন্টেশন নিয়েও নতুন উদ্যোগ আসতে পারে এক সময়। তবে ভার্চুয়ালি থিয়েটার খুব একটা এফেকটিভ হবে বলে মনে হয় না। অভিনয় হতে পারে টুকটাক, নানা ফরমেটে, থিয়েটার না।
আপাতত জীবন আর মানুষ বাঁচানোটাই জরুরি। আর অপেক্ষা… শেক্সপিয়ারও তো প্লেগ মহামারির পরে ছ’বছর গ্রামে বসেছিলেন।

মেউ : দিদি, আদিবাসী বা নৃগোষ্ঠীর নিজস্ব বাদ্যযন্ত্রগুলো মঞ্চে কী ধরনের মাত্রা যোগ করে? এগুলো বাজানোর লোক কি এখন পাওয়া যায়?

জ্যোতি সিনহা : অবশ্যই, মঞ্চে আমাদের নাটকে গীতনৃত্য আর নিজস্ব বাদ্য (বিশেষ করে মৃদঙ্গ) আলাদা ব্যঞ্জনা তৈরি করে, জীবনের একটা স্পন্দন পাওয়া যায়। খুব প্রাণবন্ত। যদিও আগের মতো তো নেই, তবু চর্চা থেমে যায়নি। আর্থসামাজিক বাস্তবতা তো আছেই। মানুষ এখন বহির্মুখী। তারপরও মণিপুরিদের ক্ষেত্রে তরুণদের উৎসাহ চর্চা এখনো বেশ আছে। দেখেছি।

মেউ : মঞ্চনাটকের এত সংকটের মধ্যেও মণিপুরি থিয়েটার কাজ করে যাচ্ছে সাফল্যের সঙ্গে। এমন নাটকের দল আর কি কি আছে? মঞ্চ ঘিরে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?

জ্যোতি সিনহা : এভাবে একেবারে গ্রামে থেকে, পারিপার্শ্বিক প্রাকৃতিক প্রতিকূলতার মধ্যেও থিয়েটারের সামগ্রিক মান বজায় রেখে নিয়মিত নাটক মঞ্চায়ন করে যাওয়া দল তেমন আছে বলে জানা নেই। অন্য পরিসরে বিশেষ করে মফস্বল বা জেলা শহরের অনেক দলই তাদের মতো লড়াই করে টিকে আছে, ভালো কাজ করছে। ভবিষ্যত পরিকল্পনার মধ্যে দুটো নাটকের ভাবনা চলছে, করোনাকাল কেটে গেলে আমরা হয়তো প্রস্তুতি নিতে শুরু করবো। ভবিষ্যতে একটা অভিনয় স্কুল করার ইচ্ছে আছে।

মেউ : দিদি, অনেক ধন্যবাদ আপনাকে, সময় দেওয়ার জন্য। ভালো থাকবেন।

জ্যোতি সিনহা : তোমাকেও অনেক ধন্যবাদ, ভালো থেকো।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ