মহামারি মোকাবেলায় সোভিয়েত ইউনিয়ন: লেনিনের নেতৃত্বে গড়ে তোলে পৃথিবীর প্রথম জনস্বাস্থ্যব্যবস্থা

প্রকাশিত: ৮:৩৮ অপরাহ্ণ, মে ১০, ২০২০

মহামারি মোকাবেলায় সোভিয়েত ইউনিয়ন: লেনিনের নেতৃত্বে গড়ে তোলে পৃথিবীর প্রথম জনস্বাস্থ্যব্যবস্থা

শান্তনু দে, ১১ মে ২০২০: স্প্যানিশ ফ্লু মোকাবিলা করতে গিয়ে বিপ্লবী সোভিয়েত ইউনিয়ন লেনিনের নেতৃত্বে গড়ে তোলে পৃথিবীর প্রথম জনস্বাস্থ্যব্যবস্থা।

১৯১৫, জারের রাশিয়া।

মহামারিতে আক্রান্ত ৮ লাখ মানুষ। সে সময় গড় আয়ু মাত্র ৪০ বছর। প্রতিবছর যে ৬০ লক্ষ শিশুর জন্ম হয়, তার ২০ লাখই মারা যায় রোগভোগে আর অপুষ্টিতে।

১৯১৭, অক্টোবর বিপ্লব।

বিপ্লবের কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই শুরু হয় বিশ্ব মহামারি। ‘স্প্যানিশ ফ্লু’, যদিও তা স্পেনে শুরু হয়নি। ১৯১৮ সালের শেষের দিকে সোভিয়েতে প্রতি সপ্তাহে আক্রান্ত হচ্ছেন ১৫০ জন। অবশ্য, টাইফাসের তুলনায় অনেক কম। সংক্রামক রোগ টাইফাসে তখন হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছিলেন সপ্তাহে প্রায় এক হাজার জন। আর এই টাইফাসের কারণ ছিল উকুন।

উকুনবাহিত টাইফাসের মহামারি ঠেকাতে লেনিন সেদিন সোভিয়েতবাসীকে বলেছিলেন, ‘যদি উকুন মারতে না পারো, তবে উকুন বিপ্লবকে মেরে ফেলবে। হয় সমাজতন্ত্র উকুনকে পরাস্ত করবে, নতুবা উকুন পরাস্ত করবে সমাজতন্ত্রকে।’

তরুণ সোভিয়েতে তখনো জারের ভেঙে পড়া চিকিৎসাব্যবস্থা। জনগণ চরম দারিদ্র্যে। অসুস্থ রুগণ শরীর। গৃহযুদ্ধে জেরবার। দুর্ভিক্ষের হুমকি। লেনিন ছিলেন কাউন্সিল অব কমিশারসের চেয়ারম্যান, বিপ্লবী সরকারের প্রধানমন্ত্রী পদের তুলনীয়। প্রথমেই তিনি অন্যতম পদক্ষেপ নেন জনস্বাস্থ্য বিষয়ে।

২১ জুলাই, ১৯১৮। ডিক্রি জারি করে পিপলস হেলথকেয়ার কমিশারিয়াত গঠন করা হলো। সব স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে কেন্দ্রীভূত করার উদ্যোগ। সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ ছিল তার অন্যতম অগ্রাধিকার। দেশের সব মানুষের জন্য এই বিশ্বের প্রথম পাবলিক হেলথ গভর্নিং বডি। নিকোলাই আলেকজান্দ্রোভিচ সেমাশকো তাঁর প্রথম প্রধান। যেখানে ১৯৫৩ পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তৈরি করে উঠতে পারেনি কোনো স্বাস্থ্য দপ্তর।

সোভিয়েত রাশিয়াতেই প্রথম সবার জন্য জনস্বাস্থ্য পরিষেবা গড়ে তোলা হয়। স্বাস্থ্য পরিষেবা কোনো অনুগ্রহ নয়। অধিকার। সবার জন্য বিনা মূল্যে চিকিৎসা। বিনা মূল্যে সার্জারি। বিনা মূল্যে ওষুধ। কমিশারিয়াতের দায়িত্ব স্বাস্থ্য পরিষেবার অধিকার যাতে সুনিশ্চিত করা হয়।

স্প্যানিশ ফ্লু নিয়ে ব্রিটিশ সাংবাদিক লরা স্পিনি লিখেছেন আকর্ষণীয় বই ‘পেল রাইডার: দ্য ফ্লু দ্যাট ট্রান্সফর্মড দ্য টোয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরি’। ২০১৭-তে পেঙ্গুইন প্রকাশিত এই বইটিতে সোভিয়েত ইউনিয়নের গোড়ার দিকে নীতির তাৎপর্য ব্যাখ্যা করেছেন তিনি। লিখেছেন: ‘১৯২০ সালে রাশিয়া ছিল কেন্দ্রীয়ভাবে পূর্ণ সরকারি চিকিৎসাব্যবস্থা চালুর ক্ষেত্রে প্রথম দেশ। সর্বজনীন ছিল না, কেননা গ্রামীণ জনসাধারণ এর আওতায় পড়তেন না…কিন্তু এতৎসত্ত্বেও তা ছিল বিপুল সাফল্য এবং তার পেছনে চালিকা শক্তি ছিলেন ভ্লাদিমির লেনিন।’

‘ভবিষ্যতের চিকিৎসক কেমন হবেন, তার সরকারি দৃষ্টিভঙ্গি ১৯২৪-এ বলা হয়, যখন সরকার মেডিকেল স্কুলগুলোকে বলে এমন ডাক্তার তৈরি করতে হবে, যাদের অসুস্থতার পেশাগত ও সামাজিক কারণ অনুসন্ধান করার দক্ষতা রয়েছে। কেবল অসুস্থতার নিরাময় নয়, তা যাতে আর না হয় তার উপায় ভাববার সামর্থ্য রয়েছে। লেনিন বুঝেছিলেন মেডিসিন কেবল জীববৈজ্ঞানিক এবং পরীক্ষামূলকই হবে না, সমাজতত্ত্বের বিষয়ও বটে। প্রায় একই সময়ে এপিডেমিওলজিকে—রোগের চরিত্র, কারণ এবং প্রভাবের জ্ঞানকে বিজ্ঞান হিসেবে পূর্ণ স্বীকৃতি দেওয়া হয়। জনস্বাস্থ্যের পক্ষে তা ছিল মাইলফলক।’ লিখেছেন লরা।

দ্রুততার সঙ্গে তৈরি হয় হাসপাতাল, পলিক্লিনিক। সঙ্গে প্রশিক্ষিত চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী। সম্প্রসারিত করা হয় মেডিকেল স্কুল, ব্যাকটেরিওলজিক্যাল ইনস্টিটিউট। পেত্রোগ্রাদ কমিউনের জনস্বাস্থ্য কমিশারিয়াত ই পি পেরভুকিন ১৯২০-তে বলেন, ‘ওষুধের জন্য তৈরি হয়েছে নতুন কারখানা। ওষুধের কালোবাজারিদের হাত থেকে বিপুল পরিমাণে ওষুধ বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে।’

স্বাস্থ্য মানে আর মুনাফা নয়। আবার স্বাস্থ্য মানে কেবল ডাক্তার, নার্সদের একার ব্যাপার নয়। দরকার শ্রমিক-কৃষকের অংশগ্রহণ। মহামারি ঠেকাতে ১৯১৮-তে গ্রাম-শহরে তৈরি হয় ওয়ার্কার্স কমিটি।

অক্টোবর বিপ্লবের মাসেই শ্রমিক ও কৃষকদের সরকারের তরফে লেনিন শান্তির ডিক্রি জারি করেন। যেখানে প্রধান শক্তিগুলোর মধ্যে যুদ্ধ বন্ধের ডাক দেওয়া হয়। একদিকে ব্রিটেন, ফ্রান্স, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। অন্যদিকে জার্মানি ও তার মিত্ররা লেনিনের আহ্বান উপেক্ষা করে। ব্রিটেন ও তার মিত্ররা মনে করে তারা যুদ্ধে জিততে চলেছে। সে কারণে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে চায়। যদি শান্তি চুক্তি হতো, তাহলে মারণ ইনফ্লুয়েঞ্জার বিরুদ্ধে আরও ভালো করে লড়াই করা যেত। যখন ১৯১৮-র অক্টোবরে ফ্লুর দ্বিতীয় এবং আরও মারাত্মক চেহারার ঢেউ আসে, তখন লাখ লাখ সেনার মৃত্যু হয়।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাসে এই অন্ধকার অধ্যায় সাম্রাজ্যবাদের অমানবিক চরিত্রকে বেআব্রু করে দেয়। আধিপত্যের জন্য অভিযানে অসুস্থ ও মুমূর্ষুকে যত্নের মানবিক বিবেচনাকে অস্বীকার করা হয়। রাশিয়া এই সময়ে গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। বিপ্লব ও শ্রমিক রাষ্ট্র ধ্বংসের জন্য প্রতিবিপ্লবী শক্তি বর্বর যুদ্ধ শুরু করে।

ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারিতে ঠিক কত মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল, তা জানা নেই। আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছিল তরুণ সাধারণতন্ত্রের তরুণ রাষ্ট্রপতি বলশেভিক নেতা ইয়াকভ ভেরদলভ। তখন তাঁর বয়স ৩৪। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হতেই সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো রাশিয়াকে আক্রমণ করে বিপ্লবকে শ্বাসরুদ্ধ করার লক্ষ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে। প্রতিবিপ্লবী শক্তিকে সাহায্য করতে ১১টি দেশ সেনা পাঠায়। মহামারি নয়, বিপ্লবের দমনই ছিল তাদের চিন্তার বিষয়।

মার্চ, ১৯১৯। রাশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টি (বলশেভিক) সপ্তম কংগ্রেসের মূল লক্ষ্য ঘোষণা: সোভিয়েত স্বাস্থ্য পরিষেবার জন্য কর্মসূচি রূপায়ণ।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ। ১ মার্চ, ১৯২০। মেডিকেল ওয়ার্কারদের দ্বিতীয় নিখিল রুশ কংগ্রেসে লেনিন বলেন,

‘এই কংগ্রেসের উদ্দেশ্য ও যে কাজ আপনারা করেছেন, তা নিয়ে দীর্ঘ বক্তব্যের কোনো প্রয়োজন নেই। প্রত্যাশার সঙ্গে তাল মিলিয়েই রণাঙ্গনে সম্ভবত এমন কোনো ক্ষেত্র ছিল না, যাতে আপনারা আত্মত্যাগ করেননি।

চার বছরের সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ মানবজাতিকে দিয়েছে লাখ লাখ পঙ্গু মানুষ আর মহামারি।

আমাদের সেনাদের ওপর চেপেছে ভয়ংকর, কঠিন ও দায়িত্বপূর্ণ কর্তব্য। রণাঙ্গনের সংগ্রাম দেখিয়েছে, সাম্রাজ্যবাদীদের চেষ্টায় কোনো ফল হয়নি। আমাদের পেছনে রয়েছে রণাঙ্গনের ভয়াবহ সমস্যা। তবে এখন আমাদের ঠিক করা উচিত শান্তিপূর্ণ উন্নয়নের কাজের ভার। রক্তাক্ত ফ্রন্টে যে অভিজ্ঞতা আমরা অর্জন করেছি, আমাদের একে প্রয়োগ করতে হবে আরও রক্তাক্ত ফ্রন্টে, যেখানে আমাদের অনেক বেশি করে দেখাতে হবে সহানুভূতি।

মহামারির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমাদের প্রয়োগ করতে হবে সব প্রত্যয় এবং গৃহযুদ্ধের সব রকম অভিজ্ঞতা।

বিজ্ঞানী ও শ্রমিকদের মধ্যে সহযোগিতাই দারিদ্র্য, রোগব্যাধি এবং তুচ্ছ বিষয়ের অবসান ঘটাতে পারে। কোনো অন্ধকারের শক্তিই ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না বিজ্ঞানী, সর্বহারা এবং প্রযুক্তিবিদের মধ্যে মৈত্রীকে।’

মার্চ, ১৯২৩। বার্লিনে ওয়ার্কার্স ইন্টারন্যাশনাল রাশিয়ান রিলিফের সম্মেলনে নিকোলাই সেমাশকোর ঘোষণা: ‘জনস্বাস্থ্যের জন্য কমিশারিয়াতের কাজের বোঝা বিপুল এবং রয়েছে প্রচুর দায়িত্ব। কিন্তু এসব কিছুর পরেও, আমরা মহামারি মোকাবিলায় সফল।’

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ