সিলেট ৩১শে অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৫ই কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ১১:৫৭ পূর্বাহ্ণ, জুন ৯, ২০২০
অর্ক রাজপণ্ডিত, কলকাতা (ভারত), ০৯ জুন ২০২০ : বন্ধু কে? কাকে বলে বন্ধুত্ব? ঠিক ভুলের সীমারেখা ডিঙিয়ে যাওয়া একটা মাঠ, যেখানে বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়।
রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বন্ধুত্ব কেমন হয়? মতাদর্শে ফারাক যেখানে? যখন এক বন্ধু সঠিক রাজনৈতিক পথে চলে আরেক জন সেই পথেরই কট্টর বিরোধী হয়ে পড়ে? বন্ধুত্ব কি থাকে সেখানে?
একই রাজনৈতিক দলের সহযোদ্ধা। রাজনৈতিক পথ নিয়ে তীব্র বিরোধিতা যখন প্রায় শত্রুতার রূপ নেয় কি হয় বন্ধুত্বের? কত কথা কত হাসি কত গান, কত আড্ডা কত চায়ের ঠেকের উষ্ণতা কি মুখ ঢাকে?
লেনিনের কি এরকম বন্ধুত্ব ছিল? রাজনৈতিক পথের মত পার্থক্য, বিরোধিতায় সেই বন্ধুত্ব কি লেনিন হারিয়েছিলেন?
লেনিনের থেকে মাত্র তিন বছরের ছোট ছিলেন জুলিয়াস মার্তভ। প্রথম সাক্ষাৎ থেকেই লেনিনের বন্ধু। ঘনিষ্ঠতম বন্ধু। একই সঙ্গে লেনিনের সবচেয়ে বিরোধী ছিলেন মার্তভ।
রাশিয়ার ওডেসার ইহুদি পরিবারে জন্মানো মার্তভ ছোট থেকেই দেখেছেন জার জমানার ইহুদি বিদ্বেষ। লেনিনকে মার্তভ প্রায়শই বলতেন, আমি কোন শাসন ব্যবস্থা প্রগতিশীল না প্রতিক্রিয়াশীল বুঝে নি, সেই জমানা ইহুদিদের ক্ষেত্রে কি অবস্থান নেয়। জারের ইহুদি বিদ্বেষই মার্তভকে জার বিরোধী এবং স্থিতাবস্থার বিরোধী করে তোলে, মার্তভও পরিচিত হন মার্কসের লেখার সঙ্গে।
১৮৯৯। লেনিন ও মার্তভ একই সঙ্গে গড়ে তোলেন ‘ইমান্সিপিয়েশন অফ লেবার গ্রুপ’, লেনিন ও মার্তভ দুজনেই প্রিয় ছিলেন তাঁদের নেতা, লেনিনের ভাষায় রাশিয়ায় কমিউনিজমের জনক গ্রেগরি প্লেখানভের সঙ্গে।
১৮৯৩ সাল থেকেই লেনিন ও মার্তভ অভিন্ন হৃদয় বন্ধু। লেনিন মার্তভকে ডাকতেন, ‘টাই’ নামে। অমন ঘনিষ্ঠতা লেনিনের কারোর সঙ্গেই ছিল না।
‘ইমান্সিপিয়েশন অফ লেবার গ্রুপ’ থেকে ‘রুশ সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক লেবার পার্টি’ হওয়ার পথে রাজনৈতিক ভাবে লেনিন ও মার্তভ ছিলেন একসঙ্গেই। দুজনেই পার্টির মুখপত্র ‘ইসক্রা’ তে লিখছেন লেখা। মার্তভের লেখার ধরণ, যেভাবে মার্তভ জারের স্বৈরাচারকে কলমে ছিন্নভিন্ন করতেন, প্রাণ খুলে বন্ধুর প্রশংসা করতেন লেনিন।
লেনিন ও মার্তভের প্রথম বিরোধ শুরু হয় পার্টি মুখপত্র কিভাবে চলবে এই প্রশ্নেই। কোন পথে চলবে ইসক্রা? কাদের কথা বলবে ইসক্রা? এই প্রশ্নে দুই বন্ধুর শুরু হয় মতান্তর। ১৯০৩ সালে ইসক্রা’র নতুন এডিটোরিয়াল বোর্ড গঠিত হল। তিন জন সদস্য। লেনিন, প্লেখানভ ও মার্তভ।
লেনিন দৃঢ়ভাবে মনে করতেন পার্টি মুখপত্র নিয়ন্ত্রণ করে রাজনীতি, অন্য কোন কিছু নয়। তখন পার্টিতেও বিতর্ক চলছে বলশেভিকদের সঙ্গে মেনশেভিকদের। সংশোধনবাদ, জার তন্ত্রের সঙ্গে আপস নিয়ে চরম বিতর্ক পার্টিতে। কোন পথে হবে বিপ্লব? বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব না কি সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব? কারা দেবে নেতৃত্ব? শ্রমিকরা না কৃষকরা না কি দুই শক্তিই? লেনিন মনে করতেন প্রতি পার্টি সদস্যেরই সংগঠনে কিছু না কিছু কাজে যুক্ত থাকতে হবে। মার্তভ এই প্রশ্নে ছিলেন খানিক উদারবাদী এবং লিবেরাল বুর্জোয়া মতের কাছাকাছি। ফারাক বাড়তে থাকে আরও।
লেনিন চেয়েছিলেন যে বিতর্ক থাক কিন্তু ভাঙন না ঘটে। মেনশেভিকরা লেনিনকে ইসক্রার এডিটোরিয়াল বোর্ড থেকে সরাতে বদ্ধ পরিকর। লেনিন তিন সদস্যের এডিটোরিয়াল বোর্ড চেয়েছিলেন, তিনি মনে করতেন মার্তভ একা সবটা সামলাতে পারবেন না, কাগজ উঠে যাবে। মেনশেভিক অংশের অগ্রণী মার্তভ তখন কোন কিছুই শুনতে নারাজ, প্লেখানভও মার্তভের পক্ষ ছিলেন।
তিন সদস্যের এডিটোরিয়াল বোর্ডে লেনিন হয়ে পড়লেন মাইনোরিটি, ১৯০৩ সালের নভেম্বরে ইসক্রা এডিটোরিয়াল বোর্ড ছেড়ে লেনিন বেরিয়ে আসেন।
১৯০৫’র বিপ্লব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পরে মার্তভ চেয়েছিলেন বলশেভিক ও মেনশেভিকদের ঐক্যবদ্ধ চেহারা যদিও লেনিনের ‘বিপ্লবের মহড়া’ তত্বকে মার্তভ মানেননি। ১৯০৭ সালে লন্ডনে বলশেভিক ওমেনশেভিকদের যৌথ সাংবাদিক সম্মেলনে ছিলেন দুই পক্ষ থেকে দুই বন্ধু। লেনিন ও মার্তভ। মার্তভ চেয়েছিলেন ডুমার ব্যবহার, মার্তভ চেয়েছিলেন বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব। শুধু লেনিন নয়, মার্তভের এই অবস্থানের বিরোধিতা করেছিলেন রোজা লুক্সেমবার্গ, এমনটি ট্রটস্কিও।
মত পার্থক্য চলতেই থাকলো দুই ঘনিষ্ঠ বন্ধুর। লেনিন ও মার্তভের। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় মার্তভ চেয়েছিলেন জারের পক্ষে দাঁড়াতে, লেনিন চেয়েছিলেন সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধকে পরিণত করো গৃহযুদ্ধে। লেনিন চেয়েছিলেন সরাসরি পার্টি অস্ত্র ধরুক, মার্তভ চাননি।
১৯১৭’র বিপ্লবের পরেও মত পার্থক্য থাকলোই দুজনের। মার্তভ জারি রাখলেন লেনিন বিরোধিতার। বন্ধুত্বের রঙ তো বহুদিন ধরেই ফ্যাকাসে। নেই বললেই চলে।
রাজনীতিই আলাদা করেছিল লেনিন ও মার্তভকে। বন্ধুর চেয়ে পার্টি বড়।
ফুল স্টপ পড়ে যাওয়ার কথা ছিল সেই বন্ধুত্বের।
কিন্তু তিনি তো লেনিন।
মার্তভ ক্রমশ অসুস্থ হয়ে পড়েন ১৯১৯ থেকেই। লেনিনের কানে আসতো মার্তভের অসুস্থতার কথা। তিনি সব সময় খোঁজ রাখতেন পার্টি মার্তভের চিকিৎসা ঠিক ঠাক করছে কি না। জার্মানির হ্যালে শহরে একটি আন্তজার্তিক সম্মেলন। পার্টির অনেকেই বিরোধিতা করেছিলেন মার্তভের সেখানে প্রতিনিধি হিসাবে যাওয়ার।
লেনিন চাইলেন মার্তভই যাবে, তিনিই ব্যবস্থা করে দিলেন মার্তভের জন্য সোভিয়েত পাশপোর্ট। লেনিনের বন্ধু প্রীতি থেকেই গেল।
মার্তভ আরো অসুস্থ হয়ে পড়লেন। লেনিন সব সময় খোঁজ রাখতেন খাবার, ওষুধ, টাকা ঠিক ঠাক পৌঁচচ্ছে কি না মার্তভের কাছে। লেনিন রিয়াজনভকে ডেকে বলেছিলেন, টাকা ওষুধ পৌঁছে দেওবার কথা। রিয়াজনভ উত্তরে বলেছিলেন, ‘উনি নেবেন না, যদি জানেন সাহায্য করছেন আপনি’, এমনই ছিল বন্ধুতার অভিমান!
লেনিনের যখন প্রথম স্ট্রোক হল, মার্তভও গুরুতর অসুস্থ। হুইল চেয়ারে বসে একদিন ক্রুপস্কায়াকে বললেন, ‘জানো মার্তভও বোধ হয় মরে যাবে’! লেনিনের যখন দ্বিতীয় স্ট্রোক হল মার্তভ তখন আর নেই।
কিন্তু প্রিয়তম বন্ধুর মৃত্যুর খবর সঙ্গে সঙ্গে জানানো হয়নি লেনিনকে, তিনি আরও যদি অসুস্থ হয়ে পড়েন।
যেদিন লেনিন শুনলেন মার্তভ আর সত্যিই নেই ডাক্তার ক্রুপস্কায়া কারোর বাধাই শুনলেন না। হুইল চেয়ারে এলেন ক্রেমলিনের অফিসে। একা একা পড়তে লাগলেন মার্তভ কে নিয়ে কে কি শ্রদ্ধা জানিয়ে লিখেছেন।
মার্তভ আর পৃথিবীতে নেই, লেনিন মানতে পারেননি। লেনিনের মারা যাওয়ার কদিন আগে পর্যন্ত সব সময় মার্তভকে খুঁজতেন।
কথা বলতে পারতেন না, শরীর আর দেয় না তবু মার্তভের লেখা বইগুলির দিকে আঙুল তুলে ড্রাইভারকে বলতেন নিয়ে চলো ওর কাছে। লেনিনের এই অবস্থার কথা লিখেছেন কৃষি দপ্তরের কমিশার সিডারস্কি। ক্রপস্কায়া আবার বুঝিয়ে বলতেন লেনিনকে, মার্তভ আর সত্যিই বেঁচে নেই, চুপ করে যেতেন লেনিন!
মার্তভ মারা যাওয়ার ঠিক আট মাস বাদে জীবনাবসান ঘটে লেনিনের। শেষ দিনগুলিতে মার্তভ আর নেই শুনেও লেনিন চাইতেন মার্তভের কাছে যাওয়ার।
কেন? বন্ধুত্ব তো ফ্যাকাসে ছিল অনেক দিন? তবুও কেন?
লেনিনও পারেননি বন্ধুকে ভুলতে। শেষ দিন অবধি লেনিনের ঘুমে জাগরণে জীবন্ত ছিল বন্ধুত্ব।
লেনিন ও মার্তভের সময় স্মার্ট ফোন ছিল না। স্ক্রিন শট ছিল না। তাই রাজনৈতিক মত পার্থক্য কখনোই ক্ষুদ্র নীচতায় পর্যবসিত হয়নি।
লেনিন ছিলেন এমনই। শিখিয়ে যান সব কিছুই।
বন্ধুত্বও কেমন হতে পারে, শিখিয়েছেন লেনিন।
১৫০ বছরের জন্মদিনে লেনিনের ছবিতে মালা ফুল লেনিন মূর্তিতে শ্রদ্ধা জানানোর পাশাপাশি সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ লেনিনের শিক্ষাকে অনুশীলন করা।
বইয়ের পাতা উঠে আসুক জীবন চর্চায়। লেনিনের প্রতি সেটাই হবে সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা।
সম্পাদক : সৈয়দ আমিরুজ্জামান
ইমেইল : rpnewsbd@gmail.com
মোবাইল +8801716599589
৩১/এফ, তোপখানা রোড, ঢাকা-১০০০।
© RP News 24.com 2013-2020
Design and developed by M-W-D