সমতাভিত্তিক বাজেট এখন আরও জরুরি

প্রকাশিত: ৬:৩৭ পূর্বাহ্ণ, জুন ১১, ২০২০

সমতাভিত্তিক বাজেট এখন আরও জরুরি

রাশেদ খান মেনন, ১১ জুন ২০২০ : এই লেখা যেদিন লিখছি, সেদিন জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশন শুরু হয়েছে। অর্থমন্ত্রী অধিবেশনের দ্বিতীয় দিন বাজেট পেশ করবেন। দেশসহ সারাবিশ্ব করোনাকাল অতিক্রম করছে। এর শেষ হওয়া নিয়ে কেউ নিশ্চিত নয়। সুতরাং এই করোনাকালে কোনো ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাও দুরূহ, যদি সেটা এক বছরের জন্যও হয়। এ কারণেই অর্থমন্ত্রী ইতোমধ্যে বলেছেন, এটা হবে আপৎকালীন বাজেট। উন্নয়নের যে গতিধারার মধ্যে ছিলাম তা যাতে অব্যাহত থাকে সেই লক্ষ্যকেই সামনে রেখে বাজেট প্রণীত হবে, সেটাই স্বাভাবিক। এখানে জীবন ও জীবিকার প্রশ্নটি অঙ্গাঙ্গিীভাবে জড়িয়ে গেছে। সুতরাং বাজেটের অগ্রাধিকার নিরূপণের ক্ষেত্রে এই বিষয়টি প্রাধান্য পাবে। অর্থমন্ত্রী ইতিমধ্যে বলেছেন, সরকার সেই লক্ষ্যে যে প্রণোদনাগুলো দিয়েছে তাকে সমন্বিত করেই বাজেট প্রস্তাবনা পেশ করা হবে।

করোনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে যে বিষয়গুলো দেখিয়ে দিয়েছে তা হলো- অর্থনৈতিক নীতি অর্থাৎ বাজারঘনিষ্ঠ উদারনৈতিক অর্থনৈতিক নীতি তা আমাদের দেশে কেবল নয়, বিশ্বেই প্রাসঙ্গিক হয়ে পরেছে। বিশ্বব্যবস্থাকে এখন নতুন করে ভাবতে হচ্ছে কোন পথে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার ঘটিয়ে সামনে এগোনো যাবে।

যদি আমাদের স্বাস্থ্য খাতকেই দেখি আমরা এই খাতকে বাজেটের ওপর ছেড়ে দিয়েছিলাম। যদিও আমাদের রাষ্ট্রীয় মূলনীতিতে স্বাস্থ্য, শিক্ষা নিশ্চিত করার কথা বলা আছে, সেখানে এই উভয় খাতকেই আমরা বেসরকারি ব্যবস্থাপনার ওপর ছেড়ে রেখেছি। এর ফলে আমরা দেখেছি যে যখন করোনা তার ভয়াল রূপ নিয়ে উপস্থিত হয়েছে তখন এই ব্যক্তি খাতের চিকিৎসা ব্যবস্থা পিছে সরে গেছে। তারা এমনকি সাধারণ রোগী নিতেও রাজি হয়নি। এখন সরকার কর্তৃক নির্দেশিত হয়ে কভিড-১৯ রোগী নিতে রাজি হলেও তার উচ্চমূল্য সাধারণ মানুষের আয়ত্তের বাইরে। এমনকি উচ্চ মধ্যবিত্তেরও। এখন বাধ্যতামূলক করায় মাস্ক, পিপিই সামগ্রী, অক্সিমিটার অক্সিমেট সিলিন্ডারের দাম চড়ে গেছে অস্বাভাবিকভাবে।

এই পরিস্থিতিতে মানুষের জীবন রক্ষায় তার চিকিৎসা ব্যবস্থার জন্য বাজেট যদি স্বাস্থ্য খাতকে অগ্রাধিকার না দেয়, সেটা কেবল অবিবেচনাপ্রসূতই হবে না, এটা ধরে নিতে হবে রাষ্ট্র জনগণের স্বাস্থ্যের দায়িত্ব নিতে রাজি নয়। এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্যবীমা ও সর্বজনীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কথা এসে যায়। এ নিয়ে বেশ কয়েক বছর আলোচনা হলেও কোনো অগ্রগতি নেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কমিউনিটি হাসপাতালের মাধ্যমে স্বাস্থ্যকে মানুষের দোরগোড়ায় নিয়ে গেছেন। তার ওপর একটু বিশেষাষিত চিকিৎসা হলেই সেটা জনগণের টাকায় কিনতে হবে এবং এর পরিমাণ শতকরা ৭২ ভাগ। সরকারের অংশ মাত্র ২৮ ভাগ। করোনা পরিস্থিতি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার এই অসঙ্গতিকেই বিশেষভাবে তুলে ধরছে।

দ্বিতীয় যে অগ্রাধিকারের বিষয় তা হলো, সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়ে বাজেটে সংস্থান। এখানে যে শুভঙ্করের ফাঁকি রয়েছে অর্থাৎ এই অর্থসংস্থানের ৩৫ শতাংশ যেখানে সরকারি কর্মচারীদের পেনশনে যায় তখন এর যে পরিমাণ দেখানো হয় তাতে সামাজিক সুরক্ষার বিষয়টি যথাযথভাবে নিশ্চিত করা যায় না। এবার করোনাকালে দারিদ্র্যসীমার নিচে যে মানুষ অর্থাৎ শতকরা ২১ ভাগ, তার সঙ্গে আরও ২১ ভাগ যুক্ত হবে বলে অর্থনীতি বিশ্নেষকরা বলছেন। এই দরিদ্র ও হতদরিদ্রদের জন্য সামাজিক সুরক্ষার পরিসর অনেক বিস্তৃত করতে হবে। ইতোমধ্যে সরকার সামাজিক সুরক্ষার লক্ষ্যে ১০ টাকা কেজি দরে চাল বিতরণ ও ৫০ লাখ পরিবারের জন্য ২৫০০ টাকা প্রণোদনা দিয়েছে। বাজেটে নিশ্চয়ই একে সমন্বিত করা হবে। কিন্তু বিপুল সংখ্যক মানুষের দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাওয়া ঠেকাতে এটা যে যথেষ্ট নয়, সেটা সাধারণ যে কেউ অনুধাবন করতে পারে। বাজেট বরাদ্দের ক্ষেত্রে এক হাজার কোটি টাকা বাড়িয়ে তা নিয়ে বড় গলা করা ঠিক হবে না। অত্যন্ত সচেতনভাবেই এ খাতে অর্থ বরাদ্দ বাড়াতে হবে।

তৃতীয় প্রশ্ন আসছে কর্মসংস্থান। করোনার প্রভাবে বিশাল সংখ্যক কর্মহীন হয়ে পড়েছে। গার্মেন্ট মালিকরা জুন মাসেই আরও অধিক সংখ্যককে ছাঁটাই করবে বলেছেন। প্রধানমন্ত্রী অবশ্য তার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণায় এ কথাটি মাথায় রেখে শ্রমিকদের বেতন দেওয়ার জন্য ২.৫০ শতাংশ সুদে ঋণ ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। যারা পূর্বে ঋণ নিয়েছিলেন তিন মাসের জন্য তাদের সুদারোপ স্থগিত করে দিয়েছেন, ঋণখেলাপির বিষয়েও শর্ত শিথিল করেছেন; তারপরও গার্মেন্ট মালিকদের এই কথা সরকারকে কলা দেখানোর শামিল।

বাজেট কৌশলে এই কর্মহীনতা রোধ করে কীভাবে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করা যায় অর্থমন্ত্রী সে পথ দেখাবেন বলে আশা করা অসমীচীন হবে না।

করোনাকালে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শিক্ষা। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরা কেবল শিক্ষা-সময়ই হারাচ্ছে না, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোও অকার্যকর হয়ে পড়ছে। এর উত্তর হচ্ছে অনলাইন শিক্ষা। ডিজিটাল বাংলাদেশে এটা কোনো অসম্ভব প্রস্তাব নয়। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এটা করলেও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সে পথে হাঁটছে না। বড় কারণ তাদের শিক্ষার্থীদের পক্ষে ল্যাপটপের ব্যবস্থা করা, ইন্টারনেট খরচ জোগান সম্ভব নয়। এর ফলে যেটা হচ্ছে তা হলো, ডিজিটাল ডিভাইড। সামর্থ্যবানরাই কেবল অনলাইনে টিকে থাকবে, অন্যরা নয়। এর উত্তর বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বহুগুণ বাড়িয়ে তাকে ডিজিটাল শিক্ষা উপযোগী করা। এছাড়া রয়েছে গবেষণা খাতে বরাদ্দের প্রশ্ন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবগুলোয় কভিড শনাক্তকরণের কাজ করতে পারত, যেভাবে অন্যান্য দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো করোনা মোকাবিলায় সরকারের সহায়তায় নেমেছে। এখানে কেবল অর্থ বরাদ্দের অভাবে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবগুলোর সক্ষমতা কাজে লাগানো যাচ্ছে না।

পঞ্চমত, করোনাকালে যার ওপর আমাদের দাঁড়াতে হবে তা হলো কৃষি, যা খাদ্য নিরাপত্তাকে নিশ্চিত করবে। এই কৃষি খাতে যান্ত্রিকীকরণ বা উপযুক্ত বীজ-সার সরবরাহ নিশ্চিত করলেই হবে না, এর জন্য যে পুঁজি প্রয়োজন হবে বাজেটকে তা সরবরাহ করতে হবে এবং সেটা ব্যক্তির হাতে কেন্দ্রীভবন করে নয়, সমবায় পদ্ধতি বা সমষ্টিগত মালিকানার ধারণাকে উৎসাহিত করে কৃষিকে এই সময়কালে অগ্রসরমাণ করে নিতে হবে।

আর এর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ আসবে কর সংগ্রহের মধ্য দিয়ে। দরিদ্র ও নিম্নবিত্তকে কর ছাড় দিয়ে কর সংগ্রহ করতে হবে সম্পদের ওপর থেকে, ব্যবসায়ের লাভের ওপর থেকে। কর ব্যবস্থার যে সংস্কার বিত্তবানদের স্বার্থরক্ষা করতে গিয়ে আজ পর্যন্ত হয়নি, বাজেটে সেই কর ব্যবস্থা সংস্কারের সুস্পষ্ট নির্দেশ থাকতে হবে।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ একটি সমতাভিত্তিক রাষ্ট্র ও সমাজ প্রতিষ্ঠার কথা বলেছে। সংবিধানেও তার পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। করোনা যেখানে উচ্চবিত্ত, নিম্নবিত্ত, ধনী দেশ ও দরিদ্র দেশকে এক কাতারে দাঁড় করিয়েছে, তার ওপর ভিত্তি করে একটি সমতাভিত্তিক অগ্রসরমাণ বাজেটই প্রত্যাশা করে দেশবাসী।
#
রাশেদ খান মেনন
রাজনীতিক; সংসদ সদস্য এবং বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি