করোনা বনাম ২০২০-২১ অর্থ বছরের বাজেট

প্রকাশিত: ৩:১০ অপরাহ্ণ, জুন ২২, ২০২০

করোনা বনাম ২০২০-২১ অর্থ বছরের বাজেট

ডা. জাফরুল্লাহ্ চৌধুরী, ২২ জুন ২০২০ : সম্প্রতি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দ্রুতগতিতে ধনী-দরিদ্রের মধ্যে বৈষম্য বেড়ে উল্কার বেগে ছুটছে। ফলে অনেক রাতকানা দার্শনিক, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী গভীরভাবে প্রচার করতে শুরু করেছেন যে, সাম্যবাদী সমসুযোগের সমাজব্যবস্থার সম্ভবত কোনো ভবিষ্যৎ নেই। ‘কার্ল মার্কস ইজ ডেড’, বেইজিংয়ের তিয়ানমেন স্কোয়ারে বিস্মৃত মাও সে তুং, হো চি মিন সিটির স্কোয়ারে শায়িত হো চি মিন হো। হাভানা স্কোয়ারের কোথাও নেই ফিদেল কাস্ত্রোর ভাস্কর্য, তবু তার উপস্থিতি অনুভবনীয়, চুরুটবিহীন হাসিও আকর্ষণীয়।

হাভানার বহু জায়গায় চে গুয়েভারা দৃশ্যমান, চিরতরুণ।
কৃষক-শ্রমিকের লাল ঝান্ডা কি আর ওড়বে না?
বিশ্ব পুঁজিবাদ হঠাৎ ভয়ানক ধাক্কা খেল এক অজানা, অদৃশ্য কিন্তু সর্বত্র বিরাজমান ক্ষুদ্র ভাইরাস নভেল করোনা কভিড-১৯-এর কাছে। প্রায় অজানা করোনাভাইরাস সারা পৃথিবীকে দাবড়িয়ে তুলাধোনা করেছে, ধনী-দরিদ্র, সৎ, দুর্জন, দুর্নীতিপরায়ণ রাজনীতিবিদ, আমলা, শিক্ষক, কৃষক জনতাকে। কারও পালানোর পথ নেই। করোনাভাইরাস ছাত্র, শ্রমিক সবাইকে একটি কঠিন প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছে- রাষ্ট্র ন্যায়ভিত্তিক সমাজব্যবস্থায় ফিরে আসবে তো?

প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন মূলকথা নয়, মূলকথা সুন্দর জীবন-জীবিকা এবং জীবনের সব ক্ষেত্রে সব নাগরিকের সমঅধিকার ও সমসুযোগ। যার অনুপস্থিতির কারণে কি করোনাভাইরাসের প্রতিশোধমূলক প্রয়াস; যার থেকে কারও রক্ষা নেই? ফরাসি মার্কসীয় অর্থনীতিবিদ টমাস বেকেটি কী ভাবছেন? নাকমুখে রক্ত সঞ্চার স্বাস্থ্যের লক্ষণ নয়, বরং মৃত্যুর সিগন্যাল। অন্যায় লুটেরা মুৎসুদ্দি শ্রেণি আজ সাধারণ মানুষের দুর্ভাগ্যের কাতারে দাঁড়াতে বাধ্য হচ্ছে।

বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার তাদের কোনো পথ খোলা নেই। উন্নয়নের স্বপ্নের রাজ্যে বসবাসকারী বাংলাদেশি দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদরা হঠাৎ দিশাহারা হয়ে পড়েছেন, চোখে অন্ধকার দেখছেন। অন্ধকার রুমে কালো বিড়াল খুঁজে বেড়াচ্ছেন। মুক্তি যেন সুদূরপরাহত। তিন মাসের মধ্যে বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণ চীনের উহানকে ছাড়িয়ে গেছে, শিল্প ও স্বাস্থ্য খাত পুরোপুরি বিপর্যস্ত। কেবল সুষ্ঠুভাবে চালু আছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, কুয়েত মৈত্রী, সিএমএইচ এবং কয়েকটি সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। দেশের সবচেয়ে বড় চিকিৎসা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান BSMMU হাসপাতাল সম্পর্কেও প্রশ্ন উঠেছে। হাতাহাতির ঘটনা ঘটেছে, কয়েক শিক্ষকের করোনা মৃত্যুর ঘটনায়, প্রায় ‘লকডাউন’। স্বাস্থ্যব্যয় বিল ও অক্সিজেনের স্বল্পতার আলাপ না-ই বা হলো। দেশের প্রায় ৫ হাজার ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্রের ১০% ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্রে একজন ডাক্তারও উপস্থিত থাকেন না
ঝড় উঠবে সেখানে। অর্থনীতির সংবাদ আরও দুর্বিষহ।
বোমা ফাটিয়েছে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (CPD) দরিদ্রতার হার ২০% থেকে বেড়ে ৩২% হবে। উন্নয়ন অন্বেষণের পরিচালক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রাশেদ তিতুমীরের হিসাবে এ বছরই বাংলাদেশে দরিদ্রতা বেড়ে ৪২-৪৩% পৌঁছবে। ভয়ানক তথ্য, হিসাবে খুব ভুল না-ও হতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে বাংলাদেশে অন্যূন ৫০ লাখ ব্যক্তি করোনায় আক্রান্ত হবে। অতিরিক্ত ২ কোটি দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত পরিবার খাদ্য সংকটে আছে, তাদের আয় ভয়ানকভাবে কমেছে, দ্রুত অবস্থার পরিবর্তনের সম্ভাবনা নেই। এসব সমস্যার মূলে রয়েছে সুশাসনের অভাব ও গণতন্ত্রহীনতা এবং লাগামহীন দুর্নীতি। জনপ্রতিনিধিরা পাপী, আমলারা নিষ্পাপ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ট্রিগার হ্যাপি।

উহানে করোনার ঢেউ দেখে এসএ টিভির মার্চের (২০২০) টকশোয় প্রধানমন্ত্রীকে সতর্ক করে আমি বলেছিলাম, ‘ঝড় আসছে, হাসপাতাল সামলান, ভেনটিলেটর নয়, বেশি প্রয়োজন নেবুলাইজার ও পর্যাপ্ত অক্সিজেন সরবরাহ’ এবং ‘এক মাসের মধ্যে দ্রুত প্রশিক্ষণ দেওয়া কয়েক হাজার সার্টিফিকেটধারী অবেদন চিকিৎসক (Anesthetist) যারা ভেনটিলেটর চালাবেন, ইনটুবেশন করবেন এবং যাদের শ্বাসনালি (ট্র্যাকসটমি) দ্রুত কেটে বাতাস প্রবেশের দক্ষতা থাকবে’। মূল সমস্যায় নজর না দিয়ে কভিড চিকিৎসার চিকিৎসক ও সেবিকাদের তিন-পাঁচ তারকা হোটেলে থাকা নিয়ে সময় ক্ষেপণ করলেন। প্রাইভেট হাসপাতালের সঙ্গে লেনদেন করলেন, দুর্নীতির প্রশ্রয় দিলেন, সেবা নিশ্চিত করলেন না। নিবেদিত চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সম্মান দিলেন না, যারা পালাচ্ছে তাদের উপঢৌকন দিলেন, অব্যবস্থাপনার মাধ্যমে অধিকতর দুর্নীতি ও অজুহাতের সুযোগ করে দিলেন।

বারবার অনুরোধ করা সত্ত্বেও গণতন্ত্রের মানসকন্যা একবারও সর্বদলীয় রাজনৈতিক আলোচনার উদ্যোগ নিলেন না। আপনার রাজনৈতিক কর্মীদেরও বিশ্বাস করতে পারছেন না, কিন্তু কেন? কোথায় সংশয়, আপনার এত ক্ষোভ কেন, দুঃখ কোথায় লুকিয়ে আছে? আপনার এত কঠোর পরিশ্রম, সজাগ দৃষ্টি, দেশের জন্য পিতার মতো অফুরন্ত ভালোবাসা, দেশের জন্য পুরো সুফল আনছে না কেন, ভেবে দেখেছেন কি? অতর্কিত করোনা সংক্রমণে বাংলাদেশে কয়েকজন মন্ত্রীর প্রলাপ উক্তি বৈসাদৃশ্য। করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রবাহ হবে ভয়ানক যা দ্বারপ্রান্তে অথচ আমাদের পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীরের উন্নয়ন অন্বেষণ ২০২০-২১ বাজেট সম্পর্কিত তত্ত্ব -উপাত্ত আলোচনায় দেখিয়েছেন যৌক্তিক প্রবৃদ্ধি ৪.২%-এর অধিক সম্ভব নয়, উৎপাদনশীল জিডিপি কমবে ১২.৪%, প্রবাসী রেমিট্যান্স আয় কমেছে, কয়েক দেশে প্রবাসী অভিবাসী বাংলাদেশিদের কর্মচ্যুতি ঘটেছে। ১৭৪টি রাষ্ট্রে বাংলাদেশের ১ কোটি ২০ লাখ অভিবাসী কাজ করেন, সেখানে কর্মসংস্থান বাড়ছে না, বরং কমছে এবং পোশাকশিল্পের আয় স্থবির হয়ে পড়েছে, নীরব ছাঁটাই চলছে, শিক্ষায় সবার সমান সুযোগ নেই, সামাজিক সুরক্ষা সুবিধা ভোগ করে মাত্র ৯৬ লাখ পরিবার। প্রাপ্তির সঙ্গে আছে দুর্নীতির উইপোকা, বেকারত্ব বাড়ছে ৩% হারে, অসহায়ত্ব শিক্ষিত বেকারদের।

২০২০-২১ গতানুগতিক বাজেটে দুঃসময় উত্তীর্ণ হওয়া যায় না, বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কল্যাণ অবসৃত থাকে, পর্যাপ্ত পুষ্টির অভাবে অর্জিত কর্মদক্ষতায় প্রতিযোগিতার পেছনে পড়ছে বাংলাদেশের শ্রমিকের উৎপাদনক্ষমতা। প্রধানমন্ত্রীর গণতান্ত্রিক আলোচনা দেখা যায়নি ১৪ দলের সভায়, অধিকাংশ সময়ে তিনি আমলা-পরিবৃত্ত, রাজনৈতিক সহকর্মীরা ম্রিয়মাণ। মৃত ব্যক্তির বন্দনা আছে, সঙ্গে আছে ঢাকঢোলের বাজনা অথচ কর্মীদের হৃদয়ে নেতার আকুতি অনুপস্থিত। একনাগাড়ে ২০ দিন গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে চিকিৎসক ও প্যারামেডিকদের অতুলনীয় সেবা ও জনগণের ক্রমাগত দোয়ায় করোনামুক্ত হয়ে সরাসরি গত ১৪ জুন, ২০২০ তারিখে বনানী কবরস্থানে গিয়েছিলাম মুক্তিযুদ্ধের সতীর্থ নাসিমকে শেষ অভিবাদন জানাতে। তখন রাষ্ট্রপতির গার্ড রেজিমেন্টের শ্রদ্ধাজ্ঞাপন পর্ব চলছিল। শহীদ তাজউদ্দীন, সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও ক্যাপ্টেন মনসুর আলীর কবর জিয়ারত না করে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সঙ্গে অন্য আওয়ামী লীগ কর্মীরা ফিরে গেলেন। বেগম ফজিলাতুন নেসার কবরের সামনে দাঁড়িয়ে কাউকে দোয়া করতে দেখলাম না।

১. দুঃসময়ের বাজেট নিয়ে আলোচনার উত্তাপ নেই। দেশের এতজন বিজ্ঞ অর্থনীতিবিদ, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, ব্যাংকার, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী বা রাজনীতিবিদ কেউ সাহস করে সত্য কথা জনসাধারণকে জানাচ্ছেন না। সবাই প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের অপেক্ষমাণ। তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন, এমনকি তোফায়েল, আমু সবাই, তাদের সংশয় কেন? তারা শেখ হাসিনার নির্ভরশীল রাজনৈতিক সহকর্মী।
২. বিএনপি তাদের স্ট্যান্ডিং ও উপদেষ্টা কমিটির সভায় অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য নিবিড়ভাবে পড়ে, অধ্যয়ন করে একাধিক আলোচনা-সমালোচনা করে মননশীল সুষ্ঠু সুপারিশ সরকারকে জ্ঞাত না করে ভুল করছে। দেশকে তো বাঁচাতে হবে।
৩. জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সংসদ সদস্যরা মুখে কুলুপ বেঁধেছেন কেন? সুচিন্তিত বাগ্মিতায় সংসদ উত্তপ্ত রাখুন, ভয় পাবেন না, নির্ভয়ে দায়িত্ব পালন করুন। সংখ্যার চেয়ে সাহস বড়।

৪. এরশাদ সাহেব বেঁচে থাকলে বাজেটের প্রতি Item পড়ে বুঝে উপযুক্ত সমালোচনা উন্মুক্ত করতেন, জি এম কাদেরের মতো গৃহপালিত প্রাণীর আচরণ করতেন না। জি এম কাদের অনুগ্রহ করে হুক্কাহুয়া করা বন্ধ করুন। জাতীয় পার্টির ভবিষ্যৎ গড়ার জন্য আপনার অনেক কাজ বাকি।
৫. জনাব ওবায়দুল কাদের অনুগ্রহ করে মুখ বন্ধ রাখেন, বিরোধীদলীয় সব সমালোচনার উত্তর দিতে হয় না, এটা রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা, অর্থমন্ত্রীকে উত্তর দেওয়ার সুযোগ দিন। বাজেট অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব, আপনার নয়।

৬. মাননীয় প্রধানমন্ত্রী! সর্বদলীয় রাজনৈতিক সভা ডাকুন বিপন্মুক্তির বাজেট উদ্ভাবনের জন্য। নতুবা কোনো লাভ হবে না দেশের না দেশবাসীর। ওষুধের দাম কমবে না, কৃষক-শ্রমিক তার শ্রমের ন্যায্যমূল্য পাবে না, আইসিইউ প্রতারণা বাড়বে, মৃত্যুর পরও চিকিৎসার বিল দিতে হবে, ফড়িয়ারা রাজত্ব করবে, শহরবাসী অত্যধিক মূল্যে ফলমূল, শস্য কিনে প্রতারিত হবেন। স্বাস্থ্য খাতে নৈরাজ্য অব্যাহত থাকবে, ক্ষুধা-দারিদ্র্য বাড়বে, সঙ্গে যৌননিপীড়ন, নৈরাজ্য ও ব্যাপক দুর্নীতি।

২০২০-২১ বাজেটে আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রাপ্য বিদেশি ঋণের সুদ ও পিপিপি (Private Public Partnership) ভর্তুকি ও দায়বদ্ধতা পরিশোধ করতে ১ লাখ ৪১১ কোটি টাকা প্রয়োজন; যা ২০২০-২১ বাজেটের মোট বরাদ্দের ১৭.৬৮%। খাদ্য, দুর্যোগ, কৃষি, পানিসম্পদ ও স্থানীয় সরকারের মোট বরাদ্দের ১৩.৩৬% চেয়ে ২৫ হাজার কোটি টাকা বেশি। স্বাস্থ্যসেবা ও পরিবারকল্যাণ, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষায় বরাদ্দ মাত্র ৭৯ হাজার ৯৪১ কোটি যা বাজেটের ১৪.২৫%। ঋণ পরিশোধের জন্য প্রয়োজন ১৭.৬৮% বরাদ্দ। সংসদে এ সম্পর্কে প্রশ্ন না ওঠা দুর্ভাগ্যজনক। পরিশোধতব্য বিদেশি ঋণের বিষয়টি জনসাধারণের শিক্ষায় অন্তর্ভুক্ত করার ব্যাপারে বিএনপির তথা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতৃবর্গের ব্যর্থতা রাজনীতিতে তাদের অপরিপক্বতার পরিচায়ক এবং দুঃখজনক। বাংলাদেশের জনপ্রশাসন মাথাভারী, নিত্যনতুন সিনিয়র সচিবের জন্ম হচ্ছে, বাজেটের মোট বরাদ্দের প্রায় এক পঞ্চমাংশ জনপ্রশাসনে। ভোটারবিহীন নির্বাচনের জন্য তাদের উর্বর মস্তিষ্ক খুব কার্যকর।

আওয়ামী লীগ, যুবলীগ কর্মীরা যদি শেখ মুজিবকে ভালোবাসেন তবে ১৯৭৫ সালের ১২ আগস্টের নির্দেশনামা অক্ষরে অক্ষরে পালন করা হবে তাদের নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য। শেখ মুজিব গ্রামের মানুষকে ভালোবাসতেন নিজের চেয়েও বেশি, তাদের দুঃখমোচন ও ক্ষমতায়ন ছিল তাঁর স্বপ্ন। এবারের বাজেট হওয়া উচিত শেখ মুজিবের স্বপ্নের বাস্তবায়ন, স্বনির্বাচিত স্থানীয় প্রশাসন, দুর্নীতিমুক্ত সমঅধিকারে সুশাসিত গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ। মৌলিক সংস্কারের বিকল্প নেই। পিতার স্বপ্নের বাস্তবায়ন করুন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে অমর হওয়ার শেষ সুযোগ যার মূল্য নোবেল পুরস্কারের চেয়ে অনেক বেশি। ২০৪১ পর্যন্ত অপেক্ষা ভুল সিদ্ধান্ত, পিতার ভুল থেকে শিক্ষা নিন। আমলাদের বেশি বিশ্বাস করতে নেই। স্বচ্ছ রাজনীতি আপনার বর্ম ও ধর্ম। দলমতনির্বিশেষে সব রাজনৈতিক কর্মী এবং গ্রামগঞ্জের সাধারণ কৃষক-শ্রমিকের জন্য ছিল শেখ মুজিবের অফুরন্ত ভালোবাসা, তাঁর হৃদয়ের দরজা ছিল সবার জন্য উন্মুক্ত, তাদের খাদ্য নিরাপত্তা দেওয়া, সন্তানের শিক্ষা ও অধিকার প্রতিষ্ঠা ছিল তাঁর জীবনের ব্রত। সবাই তাঁর একান্তজন, আত্মীয়তুল্য। যাকে একবার শেখ মুজিব দেখেছেন, তাকে তিনি স্মরণ রেখেছেন ¯েœহডোরে। কেন্দ্রিকতা তাঁকে করাচি ও ইসলামাবাদের শাসনের কথা বারে বারে স্মরণ করিয়েছে নির্মমভাবে। পাকিস্তানের কেন্দ্রিকতা পূর্ব পাকিস্তানবাসীর সমসুযোগ ও সমউন্নয়নের ছিল প্রধান বাধা, মুখে রক্ত সঞ্চারের মতো। শহরের সব সুযোগ নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন গ্রামবাসীর জন্য, সঙ্গে নির্মল বাতাস ও লোকজ সংস্কৃৃতির বিস্তার। তৃণমূলের অধিকার আদায় ও জবাবদিহিমূলক গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ৬৪ জেলায় ৬৪ জন গভর্নর নিয়োগ দিয়েছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ সালের ১৭ জুলাই, আগস্ট অবধি চলছিল প্রশিক্ষণ। তিনি বুঝেছিলেন, পূর্ব পকিস্তানে শিল্প নেই কিন্তু ব্যাপক কৃষি সম্ভাবনা আছে। আছে শিল্পের উৎপাদন সৃষ্টির, তাই কৃষি হবে ব্যাপক কর্মসংস্থান ও খাদ্য নিরাপত্তার বাহন, পদ্ধতি হবে ইউরোপীয় সমবায় ব্যবস্থাপনা, মেজর খালেদ মোশাররফের ছোট ভাই রাশেদ মোশাররফকে ইউরোপে পাঠিয়েছিলেন সমবায় পদ্ধতি অবলোকন ও অধ্যয়নের জন্য। উদ্যোগ নিয়েছিলেন মৌলিক সংস্কারের যা আজও অসম্পূর্ণ।

দ্রুত বিপন্মুক্তির জন্য সবচেয়ে বেশি সরকারি বিনিয়োগ করতে হবে বেসরকারি কৃষি উৎপাদনে, সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও তদারকিতে উদ্বৃত্ত হয়ে ফিরে আসবে সব বিনিয়োগ। ব্যাংক খেলাপির ঝামেলায় ঘুম হারিয়ে যাবে না। শিল্পপতিদের বিশ্বাস করা যায় না, কিন্তু কৃষককে বিশ্বাস করা যায়, তারা মিথ্যাচার কম করেন, কারণ তারা ধর্মে বিশ্বাসী ও নীতিমান, তাদের ক্ষুধা সীমিত। মৎস্য, পানিসম্পদ, পোলট্রি, স্বাস্থ্যসেবা, ডেইরি ও খাদ্য নিরাপত্তায় ব্যাপক বিনিয়োগ নিশ্চিত করুন নির্ভাবনায়। BIDS অন্যান্য গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সুচারু তদারকির মাধ্যমে নিশ্চিত করতে হবে সঠিক নিবন্ধন, সঠিক কৃষককে সময়মতো ঋণদান, সময়মতো দুর্নীতিমুক্ত ঋণপ্রাপ্তি। সঙ্গে রাখুন NGO-দের, তারা তৃণমূলে সম্পৃক্ত এবং পরিশ্রমী।

প্রাণপ্রিয় নেতার অসমাপ্ত কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য প্রতিযোগিতামূলক স্বনির্বাচিত, স্বশাসিত ৬৪ জেলা স্টেট সৃষ্টির লক্ষ্যে অনতিবিলম্বে কমিশন গঠন করুন, ৬৪ জন গভর্নর নিযুক্ত দিন তৃণমূল রাজনীতিবিদ, চিকিৎসক, শিক্ষক, আইনজীবী, অবসরপ্রাপ্ত আমলা, পুলিশ ও সামরিক কর্মকর্তা, বিচারক-বিচারপতি, দানশীল ব্যবসায়ী, প্রখ্যাত সাংবাদিকদের মধ্য থেকে। ছয় মাসের মধ্যে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। কেন্দ্র ও জেলা স্টেটে প্রশাসনিক সামঞ্জস্য থাকবে, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণে দ্রুত উন্নয়ন হবে কিন্তু দুর্নীতি বহুলাংশে কমবে, সমঅধিকার ও সমসুযোগ সৃষ্টি হবে, জবাবদিহি থাকবে, সুখের পায়রার বাকবাকুম শুনতে হবে না, জনপ্রতিনিধিদের সার্বক্ষণিকভাবে নিজ জেলা স্টেটে সপরিবারে অবস্থান হবে তাদের নৈতিক দায়িত্ব। সরকারি কর্মকর্তাদের বেলায়ও এ নিয়ম কঠোরভাবে প্রযোজ্য হবে। তাদের সন্তানদের স্ব-জেলা স্টেটে অধ্যয়ন করতে হবে স্থানীয় কৃষক-শ্রমিকের সন্তানদের সঙ্গে একই বেঞ্চে বসে। দুই জায়গায় পরিবার রাখা মানে দুর্নীতিতে সজ্ঞানে অংশগ্রহণ। স্থানীয় শিক্ষিতদের ব্যাপক কর্মসংস্থান সুযোগ সৃষ্টি হবে জেলা প্রশাসনে, কৃষি উৎপদন সমবায়ে, কৃষি বাজারজাত সমবায়ে বহুদলীয় গণতন্ত্রের বিকাশ হবে। কমিউনিস্ট ও বাম রাজনৈতিক নেতারা তাদের ত্যাগ-তিতিক্ষার পুরস্কার অর্জন করতে পারবেন কোনো না কোনো জেলা স্টেটে, তাদের শাসনের ধরন নিশ্চয়ই ভিন্ন হবে। কেন্দ্রীয় রাজধানী ঢাকার সমমানের স্বাস্থ্য ও শিক্ষা সুবিধা, সঙ্গে মুক্তচিন্তার সংস্কৃতি ও বৈচিত্র্যময় লোকশিল্প নিয়ে। শান্তির দ্বীপ হবে সব জেলা স্টেট, সুস্থ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে, নারীর জীবনযাত্রা হবে নিরন্তর নিরাপদ ও আনন্দময় এবং সম্পত্তিতে সমান অধিকার।

#
লেখক : গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টি।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ