লেবাননের যুদ্ধকালীন বাংলাদেশি

প্রকাশিত: ৫:২৬ অপরাহ্ণ, জুন ২৬, ২০২০

লেবাননের যুদ্ধকালীন বাংলাদেশি

Manual3 Ad Code

|| ফজলুল বারী || সিডনি (অস্ট্রেলিয়া), ২৬ জুন ২০২০ : ফেসবুক যে আমাদের কত সম্পর্ক ফিরিয়ে দেয়! আবার কেড়ে নেয় কত সম্পর্ক! এই ছেলেটা হঠাৎ ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে ইনবক্সে লিখেছেন, ‘বারী ভাই আমাকে চিনতে পেরেছেন? আমি বৈরুতের হোসেন।

Manual4 Ad Code

এক সময় আমরা এক সঙ্গে অনেক সুন্দর সময় কাটিয়েছি’। চিনতে পারি হোসেনকে। স্মৃতিকাতর হয়ে পড়ি। ২০০৬ সালে লেবানন যুদ্ধ কভার করতে আমি বৈরুত যাই। হিজবুল্লাহ মিলিশিয়া বাহিনীর সঙ্গে ছিল সে যুদ্ধ।
তখন সেখানে হোসেনদের সঙ্গে পরিচয় বন্ধুত্ব হয়। কিন্তু তখন এই লেবানন পৌঁছাটাও ছিল আমার জন্যে আরেক যুদ্ধ! সবুজ পাসপোর্টের সাংবাদিকদের তখন অনেক সমস্যা। বাংলাদেশে লেবাননের দূতাবাসও ছিলোনা।
দুবাই গিয়ে ভিসার জন্যে সেখানকার লেবানিজ দূতাবাসে যাই। তারা বললো তুমি যে সাংবাদিক এমন একটি চিঠি তোমার দূতাবাস থেকে নিয়ে আসো। আমরা ভিসা দিয়ে দেবো। কিন্তু দুবাইর বাংলাদেশ দূতাবাসে গেলে তারা চিঠি দেয়না।
কারন আমি জনকন্ঠের সাংবাদিক। আর তখন বিএনপি ক্ষমতায়। ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন ডিজি ইপি জহিরুল হক ভাই এক সময় জনকন্ঠে কাজ করতেন। তাঁকে ফোন করলে তিনি বললেন, ‘আপনি জর্ডানের আম্মান চলে যান।
ওখানকার রাষ্ট্রদূত আমার বন্ধু। তাকে বলে দেবো’। চিন্তা করেন একটা চিঠির জন্যে আমাকে দুবাই থেকে আম্মান যেতে বলা হচ্ছে! আমি আম্মান না গিয়ে চলে গেলাম সিরিয়ার দামাস্কাসে। আমাকে সেখান থেকেই সড়ক পথে বৈরুত যেতে হবে।
কারন বৈরুত বিমান বন্দর তখন বোমা মেরে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে ইসরাইলিরা। এরমাঝে একটা সৌভাগ্য চলে আসে। লেবাননে তখন বাংলাদেশের দূতাবাস ছিলনা। একজন লেবানিজ অনারারি কন্সাল জেনারেল ছিলেন।
যুদ্ধের কারনে তিনি সিরিয়ায় পালিয়ে চলে আসায় তখন তাকে নিয়ে বাংলাদেশের মিডিয়ায় সমালোচনা হচ্ছিল। দামাস্কাসেও তখন তেমন একজন সিরিয়ান অনারারি কন্সাল জেনারেল ছিলেন।
তাঁর অফিসেই বৈরুত থেকে পালিয়ে আসা অনারারি কন্সাল জেনারেলের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। ওই ভদ্রলোক আমাকে পেয়ে কি করে হেল্প করা যায় তা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলেন। যেন আমি তাঁর পক্ষে লিখলে যদি তাঁর কিছুটা পাপমোচন হয়!
ভদ্রলোক তাঁর দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আমার ভিসার ব্যাপারে যোগাযোগ করলেন। তাঁকে বলা হয় তুমি তার হাতে একটি চিঠি লিখে দাও। আমরা চিঠি দেখে সীমান্তে ভিসা দিয়ে দেবো।
সিরিয়ায় আবার লেবাননের দূতাবাস নেই। লেবাননে নেই সিরিয়ার দূতাবাস! কারন এই দুই দেশ পরষ্পরকে নিজের দেশের অংশ মনে করে! এখন আমি বৈরুত যাব কী করে। এয়ারপোর্ট, সড়ক যোগাযোগ বন্ধ।
ইসরাইলি বোমারু বিমান ট্যাক্সি দেখে হামলা করে। বুদ্ধি করে জাতিসংঘের সিরিয়া অফিসে চলে গেলাম। তাদের অফিস থেকে প্রতিদিন বৈরুতের উদ্দেশে একটি বাস ছেড়ে যায়।
যুদ্ধের কারনে বৈরুত থেকে যারা বেরিয়ে আসতে চাইছেন তাদের নিয়ে আসে সেই বাস। জাতিসংঘের সিরিয়া অফিস বললো তুমি চাইলে আমাদের বাসে করে যেতে পারো। জাতিসংঘের পতাকা থাকায় আমাদের গাড়ি নিরাপদ।
তাই করলাম। সিরিয়া-লেবানন সীমান্তে গিয়ে জর্দানের সেই বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। আমাকে যার কাছে চিঠি আনতে যেতে বলেছিল ঢাকা। এই ভদ্রলোক আবার আমাকে আগে থেকে চিনতেন।
কারন এর আগে আমি যখন মিশরে যাই তখন তিনি কায়রোর বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রথম সচিব ছিলেন। বৈরুত থেকে যে সব বাংলাদেশি পালিয়ে চলে আসছিলেন তাদের অভ্যর্থনা করতে জর্দানে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এসেছেন সীমান্তে।
সীমান্তে দেখা বাংলাদেশিরা আমাকে দেখে অবাক হয়ে বলে আপনার মাথায় সমস্যা নাকি ভাই! যখন সবাই প্রান বাঁচাতে চলে আসছে, আর আপনি মরতে সেখানে যাচ্ছেন নাকি! তাদের কথায় আমি হেসে ফেলি।
এটাই যে আমার পেশা। যুদ্ধ দেখতে রিপোর্ট করতে যাই যুদ্ধ আক্রান্ত জনপদে। ত্রিপলি নামের একটি শহর দিয়ে আমরা লেবাননে ঢুকি। সুন্দর সেই শহর দেখে অবাক হবার পালা। এতোদিন জানতাম ত্রিপলি লেবাননের রাজধানী।
আরেকটা ত্রিপলি যে লেবাননে আছে তা আগে জানতামনা। বিকেলের দিকে বৈরুত পৌঁছে একটি শপিংমলের সামনে জাতিসংঘের বাস আমাকে নামিয়ে দিয়ে চলে যায়। এখন আমি যাব কোথায় হোটেল কোথায় পাবো এরকিছুই জানিনা।
এর আগে বিবিসিতে শুনেছিলাম বৈরুতে বাংলাদেশি মালিকানাধীন একটি সাইবার ক্যাফে সেখানে এক রকম বাংলাদেশ দূতাবাসের মতো দায়িত্ব পালন করছে। সেখানে গিয়ে প্রবাসী বাংলাদেশিরা পরষ্পর থেকে সহায়তা নিচ্ছিলেন।
ঢাকা থেকে রওয়ানার আগে বিবিসির ঢাকা অফিসের মাধ্যমে সেই ক্যাফের মালিক হোসেনের ফোন নাম্বার নিয়ে এসেছিলাম। সেখানকার শপিংমল থেকে একটি মোবাইল ফোনের সিম নিয়ে একটিভ করে নিলাম।
এরপর ফোন দিলাম সেই হোসেনকে। পরিচয় জেনে জানতে চাইলেন আমি এখন কোথায় আছি। লোকেশন বলতেই সেখানে চলে আসেন হোসেন। এরপর তাঁর সাইবার ক্যাফেতে নিয়ে গেলেন।
মূহুর্তে আশেপাশের বাংলাদেশীদের মধ্যে খবর রটে যায়, বাংলাদেশ থেকে একজন সাংবাদিক এসেছে। মুহুর্তে সেখানে জনাপঞ্চাশেক প্রবাসী বাংলাদেশির সমাবেশ হয়ে যায়। আমাকে তারা বলেন এতদিন সাংবাদিক তারা টেলিভিশনে দেখেছেন।
এই প্রথম একজন সাংবাদিক সামনাসামনি দেখলাম। তাদের কাছে আমি একটা কমদামী হোটেলের সন্ধান চাইলাম যেখানে আমি বৈরুতে অবস্থানের সময় থাকবো। আমার এ কথায়তো সেখানে আসা লোকজন রেগে আগুন!
তাদের কথা আমরা কী মরে গেছি নাকি যে আমরা বেঁচে থাকতে আপনি হোটেলে থাকবেন। এক ভবনের চিলে কোঠার একটা রূমে আমার থাকার ব্যবস্থা করা হয়। সেটি ছিল সেই ভবনের নিরাপত্তা রক্ষীর রূম।
বৈরুতে থাকা বাংলাদেশি মেয়েরা গ্রুপ করে এসে আমার জন্যে রান্না খাবারের ব্যবস্থা করতেন। দুই হাজারের বেশি বাংলাদেশি তখন বৈরুতে ছিলেন। তাদের অনেকে গ্রীস হয়ে ইউরোপ যাবার আশায় লেবাননে যান।
সেখানে ভালো লাগায় থেকে গেছেন। যুদ্ধ রিপোর্ট করতে গিয়ে আমি হয়ে গেলাম তাদের প্রথম চাক্ষুষ দেখা সাংবাদিক কুটুম্ব। আমার বৈরুতের ডেরা হয়ে গেলো সেই চিলেকোঠার রূম।
আর লেখার জন্যে চলে যেতাম হোসেনের সাইবার ক্যাফেতে। বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলে বাড়ি এই হোসেনের। ফিলিপেনো স্ত্রী আর এক মেয়ে শাহীনকে নিয়ে তাদের পাখির বাসার মতো সাজানো সংসার।
বৈরুতের বাংলাদেশিদের সহযোগিতায় তখন আমার যুদ্ধ রিপোর্টিং অনেক সহজ হয়ে যায়। প্রতি রাতে যখন ইসরাইলি বিমান আক্রমন শুরু হতো তখন ব্ল্যাকআউটে অন্ধকার হয়ে যেত বৈরুত।
তখনও আমি সেই চিলেকোঠার কক্ষে মোমবাতির আলোয় রিপোর্ট লিখছি। লেখার সময়ে হোসেন বা কেউ একজন হয়তো ফোন করে জানতে চাইতেন। ভাই ভয় পাইসেন? বলতাম, না। কিন্তু আসলেতো ভয় পেতাম।
সে পরিস্থিতির বর্ননা থাকতো আমার লেখায়। আমার রিপোর্টের নীচে লেবাননের ফোন নাম্বার থাকায় বাংলাদেশ সহ সারা পৃথিবীর বাংলাদেশিদের অনেকে নিয়মিত ফোন করতেন। নানান তথ্য সহায়তা দিতে চাইতেন।
বাংলাদেশ থেকে একটা ফোন প্রতিদিন আসতো। আমাকে বলতেন আমার কোন সমস্যা হচ্ছে কিনা। কোন সহায়তা লাগবে কিনা। আমরা আপনার জন্যে দোয়া করছি ফজলুল বারী।
কারন বাংলাদেশের আপনি একমাত্র সাংবাদিক যিনি লেবাননের যুদ্ধ কভার করতে গেছেন’। তিনি মোহাম্মদ নাসিম। করোনাকালে তিনিও হারিয়ে গেছেন। বহুবছর পর সেই হোসেনের সঙ্গে আবার যোগাযোগ করিয়ে দিলো ফেসবুক।
আমাকে বললেন তিনি দেশে ফিরে গেছেন। তাঁর মেয়েটা এখন আমেরিকায়। আর ফিলিপেনো স্ত্রীকে তিনি এখন সংসার সাজিয়েছেন করছেন বাংলাদেশে। বাংলাদেশের পরিবেশের সঙ্গে ভালোই মানিয়ে নিয়েছেন তাঁর স্ত্রী।
ভালো থাকবেন হোসেন। আপনাদের বন্ধুত্ব আমার জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে।

Manual4 Ad Code

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

 


Follow for More!

Manual1 Ad Code
Manual5 Ad Code