ইরানি নারীবাদী লেখক জয়া পিরজাদের- খরগোশ এবং টমেটোর গল্প

প্রকাশিত: ৬:২২ পূর্বাহ্ণ, জুন ২৭, ২০২০

ইরানি নারীবাদী লেখক জয়া পিরজাদের- খরগোশ এবং টমেটোর গল্প

|| ফাহিমা কানিজ লাভা || ২৭ জুন ২০২০ : প্রত্যেকদিন নিজেকে বলি, আজ আমি একটা গল্প লিখব। কিন্তু রাতে খাওয়াদাওয়া শেষ করে রান্নাঘরের সমস্ত নোংরা হাড়িপাতিল এবং থালাবাসন ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করার পর সমস্ত দিনের ক্লান্তি আর অবসাদে আমি ঘনঘন হাই তুলি । তখন মনে মনে বলি, ‘আগামীকাল, আগামীকাল অবশ্যই আমি গল্প লিখব।’

ইতিমধ্যে আমি ময়লা থালাবাসন এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র ধুয়েছি এবং রান্নাঘর পরিষ্কার করেছি। সব কাজ শেষ করে শোবার আগে খানিকক্ষণের জন্য টেলিভিশনের সামনে বসেছি। এক সময় স্বগতোক্তির মতো করে বললাম, ‘মনের ভেতর গল্পের যে বিষয়বস্তু জমা হয়ে আছে, তা সারাংশ হিসেবে কয়েকটি বাক্যের মাধ্যমে কাগজে লিখব এবং লেখা কাগজটা সিঙ্কের ওপর দেয়ালে টানিয়ে রাখব। কাল সকালে ঘুম থেকে উঠে যখন মুখ ধোবো, তখন নিশ্চয় মনে হবে যে আমি একটা গল্প লিখতে চাই। যাহোক, আগামীকাল দুপুরের খাবার তৈরি করার পর থেকে বিকেলে বাচ্চারা স্কুল এবং আমার স্বামী অফিস থেকে ফেরা পর্যন্ত বেশ খানিকটা সময় পাব। তখন অনায়াসে গল্প লিখতে পারব।
আগামীকাল দুপুরে খাবারের জন্য আমি ডামি গোজাহফারাঙ্গি (ভাত এবং টমেটোর তরকারি) রাঁধব। এটা রাঁধতে বেশি সময় লাগে না। এছাড়া বাচ্চারাও দারুণ পছন্দ করে, কিন্তু আমার স্বামী মোটেও পছন্দ করে না। তার মুখের ভঙ্গি দেখে আমি স্পষ্ট বুঝতে পারি। খাবারটা তার সামনে দিলে সে মুখ নিচু করে এবং কোনো উচ্চবাচ্য না করে চুপচাপ খেয়ে নেয়। ভালো-মন্দ কিছুই বলে না। খাওয়ার পর চেয়ার থেকে উঠে হাত-মুখ ধুতে চলে যায়। আমি জানি, আমার স্বামী ডামি গোজাহফারাঙ্গি মোটেও পছন্দ করে না, কিন্তু এ নিয়ে সে রাগ করে খাবার ছুড়ে ফেলে দেয়নি, এমনকি কখনোই কোনো অসন্তোষ প্রকাশ বা উচ্চবাচ্য করেনি। যাহোক, পরশু আমি তার পছন্দের খাবার রান্না করব। সেদিন আমি নিজে বাজারে গিয়ে আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র কিনব এবং ঘর্মা সবজি রান্না করব। তখন আমি কোনো গল্প লিখব না। তাই আমার হাতে প্রচুর সময় থাকবে এবং আমি সময় নিয়ে ময়লা সবজিগুলো ভালো করে ধুয়ে পরিষ্কার করব। সবজিগুলোয় এত বেশি মাটি লেগে থাকে যে, ওগুলোকে পানিভর্তি গামলায় অনেকক্ষণ ভিজিয়ে রাখতে হয়। আমি তাই করব। তারপর একটা একটা সবজি থেকে মাটি পরিষ্কার করব। পরে গামলায় ভালো পানি দিয়ে আর কয়েকবার ধুব। মাঝে মাঝে সবজিতে এত বেশি মাটি লেগে থাকে, যার জন্য নিদেন হলেও আমাকে সাত বা আটবার ভালো করে ধুতে হয়। তখন আমি চশমা পরে নিই, যাতে স্পষ্ট দেখতে পারি যে সবজিতে কোনো মাটির কণা লেগে নেই, তারপর সবজিগুলোকে কুচিকুচি করে কাটি।
সত্যি এবার আমি সাবধানে থাকব, যেন আঙুল না কাটি। সব সময় আমি সবজি কাটতে গিয়ে আঙুল কেটে ফেলি। তখন আমার স্বামী হাসতে হাসতে বলে, ‘গত পনেরো বছর ধরে সবজি কেটেও তুমি এখনো নিজের আঙুল বাঁচাতে পারো না।’
আমি জানি, আমার স্বামী মশকরা করে। তাই তার মন্তব্য হালকাভাবে নিই। তবে আমার আম্মাও বলেন, ঘর্মা সবজি রাঁধতে হলে সবজিগুলো ভালোমতো ধুয়ে সূক্ষ্মভাবে কুচিকুচি করে কাটতে হয়। সত্যি, আমার আম্মা সবজি-কাটায় ওস্তাদ। তিনি খুব তাড়াতাড়ি সুন্দর করে সবজি কাটতে পারেন এবং কখনোই তিনি তার আঙুল কাটেননি। সবজি ভাজার জন্য তার একটা নিজস্ব পদ্ধতি আছে। পনেরো বছর চেষ্টার পর অবশেষে আমি সেই সঠিক পদ্ধতি রপ্ত করতে পেরেছি। হালকা আঁচে সবজি ভাজতে হয় এবং মাঝে মাঝে নেড়ে দিতে হয়, যেন পুড়ে না যায়। অন্যান্য সবজির সঙ্গে একই সময় সেদ্ধ হওয়ার জন্য লাল শিমের বিচি আগের রাতে পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হয়। আগের বার আমি যখন ঘর্মা সবজি রান্না করেছিলাম, তখন আগের রাতে লাল শিমের বিচি পানিতে ভিজাইনি, বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম। রান্নার সময় মাংস সেদ্ধ হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু শিমের বিচি কিছুতেই সেদ্ধ হয়নি। এজন্য আমার স্বামী কিছু বলেনি, কিন্তু খাবার শেষে আমি যখন টেবিল থেকে এঁটো থালাবাসন গোছাচ্ছিলাম, তখন দেখতে পেলাম যে, থালার একপাশে সে শিমের বিচি সরিয়ে রেখেছে। শিমের বিচি খেয়ে সেই রাতে আমার মেয়ের পেটব্যথা হয়েছিল। তখন আমার স্বামী খবরের কাগজ পড়ছিল। একসময় সে খবরের কাগজ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে এনে আমার দিকে তাকায়। তার মুখে শব্দহীন মৃদু বাঁকা হাসি। সে চোখের ইশারায় আমাকে রান্নাঘর দেখায়। অন্যসব স্বামীদের মতো আমার স্বামীও জানে না যে, পনেরো বছর বয়সী মেয়েদের হরহামেশা পেটে ব্যথা হয়।
আগামীকাল ভাত এবং টমেটো রান্না করতে আমার বেশি সময় লাগবে না। তাই ফাঁকা সময়ে আমি গল্পটা লিখব। আমি যে গল্পটা লিখতে চাই, সেটা ছোটদের জন্য খরগোশ নিয়ে একটা গল্প। গল্পের বিষয়বস্তু এরকম : একদিন এক খরগোশ একটা গভীর গর্তের ভেতর পড়ে যায় । এক শিকারি খরগোশ ধরার জন্য সেই গর্তটা করেছিল। গর্তটা ভীষণ গভীর ছিল। তাই খরগোশটা কিছুতেই বেরিয়ে আসতে পারছিল না। এক সময় ওর বন্ধুরা ওকে খুঁজে পায়, কিন্তু গর্ত থেকে বেরিয়ে আসার জন্য কোনো সাহায্য করতে পারেনি। তবে ওরা খরগোশের জন্য খাবার এবং পানি সরবরাহ করেছিল, যেন ক্ষুধা এবং তৃষ্ণায় খরগোশের কোনো অসুবিধা না হয়। এছাড়া খরগোশ যাতে একাকিত্ব বোধ না করে, তাই ওরা বিভিন্ন ধরনের গল্প বলে এবং হাস্যকৌতুক করে ওকে আনন্দ-ফুর্তিতে মাতোয়ারা করে রেখেছিল। এভাবে গর্তের ভেতর খরগোশটা বেশ অনেকদিন ছিল। যদিও খরগোশ ঢের পরিমাণে খাদ্য-খাবার এবং ঘুমানোর জন্য একটা তুলতুলে নরম বিছানা পেয়েছিল, কিন্তু বাইরে আসার জন্য তার মনটা সব সময় আনচান করত। গর্তের ভেতর থেকে সে বিশাল আকাশের একখণ্ড উজ্জ্বল নীল আকাশ দেখতে পেত। কখনো সেই নীলাকাশে হাতির মতো বিশাল ছাইরঙা মেঘের ভেলা ভাসতে দেখেছে। দিনের বেলায় খোলা আকাশের বুকে পাখনা মেলে পাখি-ওড়া দেখেছে এবং মেঘহীন রাতে দূরের আকাশের গায়ে পাকাফলের মতো ঝুলে থাকা রক্তিম তারার দিকে মুগ্ধদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকেছে।
সত্যি এখনো আমি জানি না, গর্ত থেকে খরগোশটাকে কীভাবে বের করে আনব। যাহোক, এ বিষয়ে আমি আগামীকাল ভাবব। এ পর্যন্ত যেটুকু ভেবেছি, সেটুকুই লিখে রাখা জরুরি। কেননা কাজের চাপে পরে হয়তো বেমালুম ভুলে যাব। তাড়াতাড়ি বিছানায় যাওয়া দরকার। সারারাত ভালো ঘুম হলে কাল ভোরে নিঃসন্দেহে তরতাজা হয়ে উঠতে পারব। তখন গভীর গর্ত থেকে খরগোশটা বের করে আনার একটা উপায় বের করা যাবে। এখন আমার ভীষণ তেষ্টা পেয়েছে। আমি রান্নাঘরে ঢুকে ফ্রিজ খুলে পানির বোতল বের করি। সেসময় মনের অজান্তে আমার দৃষ্টি আটকে যায় ফলের ঝুড়ির ওপর। ঝুড়িতে মাত্র দুটো টমেটো আছে। আগামীকাল দুপুরের খাবার বানানোর জন্য দুটো টমেটোতে হবে না। আরো টমেটো কিনতে হবে। ভরা বোতল থেকে ঠাণ্ডা পানি গ্লাসে ঢেলে আমি ঢকঢক করে পুরোটাই পান করি। আমার ভীষণ ঘুম পেয়েছে। একটা দীর্ঘ হাই তুলে আমি খালিগ্লাসটা টেবিলের ওপর রেখে বাতি বন্ধ করি এবং রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসি। কিছু একটা আমি লিখে রাখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু কী?
মনে পড়তেই আমি চটজলদি নোটবই থেকে একটা পাতা ছিড়ে ফেলি। আমি এ নোটবইয়ে দৈনন্দিন খরচাপাতির হিসেব লিখে রাখি।
ত্বরিত গতিতে আমি ছেঁড়া কাগজের ওপর লিখি ‘টমেটো’। কাগজটা বাথরুমের সিঙ্কের ওপর আয়নায় সেঁটে দিতে হবে, যেন কাল ভোরে মুখ ধোওয়ার সময় চোখে পড়ে এবং কিছুতেই ভুলে না যাই।

গল্পসূত্র : ‘খরগোশ এবং টমেটোর গল্প’ জয়া পিরজাদের ইংরেজিতে ‘দ্য স্টোরি অব দ্য রেবিট অ্যান্ড টমেটো’ গল্পের অনুবাদ। ইংরেজিতে গল্পটি অনুবাদ করেছেন রয়া মোনাজেম। বাংলাদেশে দিব্য প্রকাশ থেকে ফজল হাসানের অনুবাদে ‘ইরানি লেখিকাদের নারীবাদী গল্প’ সংকলন বইটি বের হয় ২০১৭ সালে। সেখান থেকে গল্পটা নিয়েছি বৈচিত্র্যের পাঠকদের জন্য।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ