বেঁচে গেলাম (৪র্থ খণ্ড)

প্রকাশিত: ৩:৪৯ পূর্বাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ৫, ২০২০

বেঁচে গেলাম (৪র্থ খণ্ড)

Manual5 Ad Code

|| মো: কামাল উদ্দিন || সহকারী শিক্ষক, শ্রীমঙ্গল সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২০ : আবার এমসি কলেজ। অধ্যাপক ঋষিকেশ ঘোষ। গণিত বিভাগের বিভাগীয় প্রধান। পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, জীববিজ্ঞান বিভাগ সহ বেশ কয়েকটি বিভাগের বিভাগীয় প্রধানের কক্ষ, অধাপকমণ্ডলীর কক্ষ অনেক উন্নয়ন হয়েছে।মখমলের বাহারি ডিজাইনের পর্দা লাগানো হয়েছে দরজা ও জানালাগুলোতে। কার্পেট দিয়ে ফ্লোর আচ্ছাদিত করা হয়েছে।দেখলেই প্রাণ জুড়িয়ে যায়।কিন্তু গণিত বিভাগ সেই ১০০ বছরের পুরনো বিল্ডিংই রয়ে গেলো। বৃটিশ আমলের দালানটির জীর্ণদশা কাটছেইনা। আমাদের ক্লাসের সবাই গিয়ে ধরলাম ঋষিকেশ স্যারকে।স্যার আমাদের গণিত বিভাগকে ওয়েল ফার্নিশড বা ডেকোরেট করতে হবে। স্যার আমাদের সকলের কথা মনযোগ দিয়ে শুনলেন।

Manual8 Ad Code

বললেন,” বাবারা, Decorate yourselves”.
তোমাদের নিজেদেরকে সাজাও।এমসি কলেজ নিয়ে তোমাদের ভাবতে হবেনা”। আমরা সবাই চুপ হয়ে গেলাম। কথাটির গভীরতা অনেক বেশি। আমরা ক্লাসে ফিরে আসি। স্যারের এই কথার ফলাফল বলছি। আমাদের ক্লাসের সবাই এখন সফল। ব্যাংকার, শিক্ষক, অফিস্যার, বি সি এস ক্যাডার। কেউ বেকার নই। সবাই নিজ নিজ পরিবারের দায়িত্বভার নিয়েছে। মানুষ হয়েছে।আর যারা নিজেদের সাজায়নি তারা এখনো ঘুরে বেড়াচ্ছে।
ক্লাস চলাকালীন আমরা এতোই নিমগ্ন চিলাম যে কেউ কারো দিকে নজরই দিতে পারিনি।সবাই আমরা ক্লাসমেইট এবং ভাল বন্ধু।মেয়ে ক্লাসমেইট না ছেলে ক্লাসমেইট বোঝার চেষ্টাও করিনি।আমি বহুদিন মেয়ে ক্লাসমেইট দের সাথে ক্লাস করে আসছি। ভাল করে দেখার চিন্তাও করিনি।একদিন এক বিয়েতে উপস্থিত ছিলাম। পাত্র লণ্ডনী। পাত্রীকে ৭০ ভরি স্বর্ণ দেয়া হল। গহনার ভারে ১৫ বছরের নিষ্পাপ পরীর মতো পাত্রীটি যেন নুয়ে পড়ছিলো। এতো গহনা কেনো? পরদিন কলেজে যাই।আবাক হয়ে দেখলাম, আমার মেয়ে ক্লাসমেইট গুলোর একজনও গহনা পরেনি।সবাই সাদাসিধে।তাদেরকেতো বেশ সুন্দরই লাগছে। উল্লেখ্য আমাদের ছেলে ক্লাসমেইটরা অধিকাংশই মেয়েদের খালা বলে ডাকতো। মেয়েরাও হেসে উড়িয়ে দিতো। ব্যাস এই পর্যন্তই। গহনা না পড়া এই মেয়েগুলো কিন্তু সবাই ভাল ভাল যায়গায় প্রতিষ্ঠিত। তারা নিজেদের সাজিয়েছে ভেতর থেকে গহনায় নয়। রাজনীতি, মিছিল,মিটিং আছে এখানেও। ছাত্রলীগ, ছাত্রদল, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র মজলিশ, ছাত্র শিবির। একদিকে ক্লাস চলছে অন্যদিকে তীব্র উত্তেজনায় বীরদর্পে মিছিল।কখনোবা শান্তিপূর্ণ মিছিল। “জয় বাংলা,জয় বঙ্গবন্ধু”, “জিয়ার সৈনিক এক হও”, ” দুনিয়ার মজদুর, এক হও”, আল ক্কোরেনের আলো, ঘরে ঘরে জ্বালো”। তবে লীগ, দল আর শিবির শক্ত অবস্থানে ছিল।সুস্থ রাজনৈতিক ধারা অব্যাহত ছিল। একদিন ক্লাস শেষে দোতালায় দাঁড়ানো আমরা।বাসায় চলে আসবো। হঠাৎ দেখি হই হুল্লোড় নীচে। প্রচুর ভীড় কলেজ গেইটের আসে পাশে। দুই গ্রুপের মধ্যে তীব্র বন্দুক যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলো। একজনকে দেখলাম সোনালী রঙের কাটা রাইফেল জোড়া দিচ্ছে দ্রুত। রাইফেলটি জোড়া দেওয়ার ফলে এটিকে দূর থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সে রাইফেল ঊঁচু করে আমাদের বিপরীত দিক থেকে আমাদের দিকে অবস্থিত ছাত্রদের তাক করে গুলি ছুঁড়ছে।যেই সে বন্দুক মাথার উপরে তুলে ট্রিগারে আঙ্গুল রেখেছে ঠিক সেইমাত্র আমি সবাইকে বলি মাথা নিচু কর। দোতালায় পাকা রেলিং এর নিচে আমরা সবাই মাথা নীচু করে থাকা অবস্থায় গুলির শব্দ শুনি ধ্রিম ধ্রিম। আমার বুকটা কেঁপে উঠলো। এবার এই পক্ষের দিক থেকেও গুলির শব্দ।আমরা উঠে দাঁড়াই।আবার বন্দুক তাক আবার মাথা নোয়াই।এভাবে চলতে লাগলো প্রায় ৩৫/৪০ মিনিট। এরপর কিছুটা শান্ত হলো মনে হল।ধীরপায়ে সাবধানে নীচে নামলাম আমরা। সবাই প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে দিক-বিদীক ছুটে যাই। টিলাগড় পয়েন্টে তখনো প্রচণ্ড ভীড়। আবার শুরু গোলাগুলি। আমি সহ ২০/২২ জন দৌড়ে উঠি কম্পিউটার পয়েন্ট ট্রেনিং সেন্টারে ২য় তলায়।আবারও দর্শকের ভুমিকায় আমরা।দেখলাম জান বাচানোর জন্য এক পাগল মহিলা কাপড় চোপড় খুলেই দৌড়াচ্ছে। জীবনের ডর পাগলেরও আছে। এদিকে বন্ধু নিরুর প্রচণ্ড প্রস্রাবের বেগ পেয়েছে। গোলাগুলির পরিস্থিতি থামছেইনা। তার তলপেট ফেটে যাচ্ছে। সে আর আটকাতে পারছেনা। এক পর্যায়ে সে গোলাগুলির তোয়াক্কা না করেই বেরিয়ে পড়লো। দে দৌড়। দৌড়ে গিয়ে পাসের মসজিদের বাথরুমে গিয়ে হালকা হয়ে গেলো। আসলে পরিস্থিতি মানুষকে সাহসীও করে ফেলে।তার নিরাপদে গমন দেখে আমরাও একজন একজন করে পা টিপে টিপে ধীরলয়ে দ্রুত প্রস্থান করলাম।বেঁচে গেলাম সেদিনের মতো। এর কিছুদিন পর আমি কলেজের অফিসে ঊঠলাম।অফিসটি একটি টিলার উপর। ৭০/৭৫ মিটার ঊঁচু হবে। ভারপ্রাপ্ত অধ্যাপক ছিলেন অধ্যাপক হালিম স্যার। উনি কাউকে কিছু বলেননা। ধমকও দেননা। শুধু তাকিয়ে থাকেন।চোখ দিয়ে শাসন করেন তিনি। আমি কাজ শেষে অফিস থেকে নামছি।দেখি মাঝ টিলায় একটি বটগাছের গুড়িতে অনেকগুলো পিস্তল,বন্দুক, রামদা, চাইনীজ কুড়াল, বল্লম, কাটারাইফেল হেলানোভাবে রাখা।আমি স্তব্ধ। আসে পাশে কিছু ছাত্র পায়চারি করছে। হঠাৎ দেখি অনেকগুলো ছাত্র দৌড়ে এসে এক এক করে অস্ত্রগুলো হাতে নিচ্ছে।আর সামনের দিকে তাক করে আছে। আমি ঠিক মাঝখানে। চারিদিকে সবাই অস্ত্র নিয়ে তাকিয়ে আছে আর আমি নিরস্ত্র।স্তব্ধ। এখান থেকেই প্রতিপক্ষের অস্ত্রধারীদের মোকাবেলা করছে। দেখলাম দ্রুত হালিম স্যার টিলা থেকে নেমে আসছেন। এসেই তিনি তাকিয়ে রইলেন ছাত্রদের দিকে। আমি স্যারের চোখের ভাষা বুঝতে পারলাম মনে হল। স্যার হয়তো বলছেন, “কলেজে যুদ্ধ করতে এসেছো? তোমাদের কাজ কী যুদ্ধ করা”? স্যারের চোখের ভাষা বুঝতে পেরে একে একে কেটে পড়লো সবাই। স্যার এবার গেইটের কাছে পজিশন নেয়া প্রতিপক্ষের সামনে গিয়েও অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। তারা স্যারের চোখের ভাষা বুঝতে পেরে সবাই পালিয়ে গেলো। ভাবলাম মূর্খ্য বন্ধুর চেয়ে শিক্ষিত শত্রুও ভাল। এ যাত্রায়ও আল্লাহর অশেষ কৃপায় বেঁচে গেলাম।
(চলবে)

Manual8 Ad Code

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

 


Follow for More!

Manual1 Ad Code
Manual2 Ad Code