গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতার প্রত্যয়

প্রকাশিত: ৫:০২ পূর্বাহ্ণ, মার্চ ৩, ২০২১

গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতার প্রত্যয়

রাজনৈতিক তাত্ত্বিক বিষয়ক – (পর্ব-২) || ঢাকা, ০৩ মার্চ ২০২১ : ◆ কি এই মার্কসবাদী লেনিনবাদী তত্ত্ব ও বিপ্লবী রীতি যা মাওবাদী হয়ে ওঠার মানদণ্ড?

◆মার্কসবাদ হলো সমাজ বিজ্ঞান, যা মানব সমাজ বিকাশের নিয়মগুলো আবিষ্কার করেছে ও বর্তমান বিশ্বব্যবস্থার আর্থ-সামাজিক সত্যগুলোকে প্রকাশ করে দিয়েছে এবং তারই ধারায় সমাজের অনিবার্য ভবিষ্যৎ পরিণতির পথ ও পদ্ধতির বৈজ্ঞানিক উপায় বাতলে দিয়েছে।

◆তার কির্তি সম্পর্কে খোদ মার্কস কি বলেন দেখা যাক:-

তিনি বলেন: “আর আমার কথা যদি ধরি, বর্তমান সমাজে শ্রেণির অস্তিত্ব ও তার সংগ্রাম আবিষ্কারের কৃতিত্ব আমার নয়। আমার অনেক আগেই বুর্জোয়া ঐতিহাসিকেরা শ্রেণি-সংগ্রামের এই ঐতিহাসিক বিকাশ এবং বুর্জোয়া অর্থনীতিকেরা শ্রেণির অর্থনৈতিক অঙ্গ-সংস্থান বর্ণনা করেছেন। আমি নতুন যা করেছি, সেটা শুধু এই প্রমাণ করা যে: ১) শ্রেণির অস্তিত্ব উৎপাদন বিকাশের নির্দিষ্ট এক-একটা পর্যায়ের সঙ্গে জড়িত, ২) শ্রেণি সংগ্রামের অনিবার্য পরিণতি প্রলেতারীয় একনায়কত্ব, ৩) এই একনায়কত্ব সমস্ত শ্রেণির বিলোপ ও শ্রেণিহীন সমাজে উত্তরণের পর্যায় মাত্র।

◆সুতরাং মার্কসবাদ কি?

দেখা যাচ্ছে খোদ মার্কস বলছেন শ্রেণি ও শ্রেণি সংগ্রামের কথা তিনি নয় বরং বুর্জোয়ারাই স্বীকার করেছে। তাই শ্রেণি বৈষম্য বা শ্রেণি সংগ্রামর কথা মার্কসবাদ নয়, তা বুর্জোয়াদেরই মতবাদ। মার্কসবাদ হলো সেই চলমান শ্রেণি ও শ্রেণি বৈষম্যের কারণটিকে তার নির্দিষ্ট যুগের বিশিষ্ট অবস্থায় আবিস্কারের করা। যার ধারায় বর্তমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অপরিহার্য পরিনতিতে সাম্যবাদী ব্যবস্থায় উত্তরণে শ্রেণি সংগ্রামের হাতিয়ার হিসেবে সর্বহারা একনায়কত্বের অনিবার্য বৈজ্ঞানিক পথ ও পদ্ধতির সার সুত্রায়ণ করা।

১) তার প্রথম আবিষ্কারঃ- যেহেতু কিছু মানুষ উৎপাদনের উপকরণ গুলোর মালিক আর অন্যরা তা থেকে বঞ্চিত; তাই একেকটি যুগের আলাদা আলাদা উৎপাদন ব্যবস্থা অনুযায়ী সেই মালিক আর বঞ্চিতদের মধ্যে একেকটি আলাদা আলাদা উৎপাদন সম্পর্কের মাধ্যমে সমাজের উৎপাদন ব্যবস্থা এগিয়ে চলে। একে বলে উৎপাদন সম্পর্ক। যা যে কোনো ব্যবস্থায় শুরুর দিকে সমাজ বিকাশের সহায়ক বা প্রগতিশিল থাকে। আর উৎপাদক, উৎপাদনের উপকরণ ও উৎপাদিত বস্তুর সবটা নিয়ে গড়ে ওঠে উৎপাদিকা শক্তি। কিন্তু যে কোনো ব্যবস্থাতেই একটা সময় পর চলমান উৎপাদিকা শক্তির বিকাশের সঙ্গে অনর উৎপাদন সম্পর্ক অসঙ্গতিপূর্ণ হয়ে পরে। সেই অবস্থায় চালু উৎপাদন সম্পর্কের সীমাবদ্ধ কাঠামো বিকশিত উৎপাদিকা শক্তিকে নিজের আয়ত্তে ধরে রাখতে পারেনা। তখন সমাজে দেখা দেয় বিশৃঙ্খলা। আর তা থেকে বাঁচার জন্য দরকার হয় বিকশিত উৎপাদন শক্তির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ উৎপাদন সম্পর্ক ও তার অনুকূলে প্রয়োজনিয় নতুন আরেকটি ব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যাওয়ার উল্লম্ফন। এই হলো আরেক দুইটি বিপরীত শ্রেণি স্বার্থের সংগ্রামের ফলে মানব সমাজ বিকাশের ঐতিহাসিক ধারা। অনেকটা প্রসূতি মায়ের প্রসবন্মুখ শিশুর জম্মের মতো। কিন্তু পুরোনো উৎপাদন সম্পর্কের শোষণমূলক শ্রেণি স্বার্থ বিকশিত উৎপাদিকা শক্তিকে দরকার মতো নতুন উৎপাদন সম্পর্কের জন্য স্বেচ্ছায় রাস্তা ছেড়ে দেয়না। তখন তাদের মধ্যে অনিবার্য সংঘাতই হলো সমাজ বিকাশ ও ব্যবস্থার এক পর্যায় থেকে আরেক পর্যায়ে উত্তরণের চালিকাশক্তি। যেমন প্রসবন্মূখ সন্তানের জম্মের জন্য প্রয়জন হয় অভিজ্ঞ ধাত্রীর হস্তক্ষেপ, তেমনই সমাজ বিকাশের ঐ বিশেষ মূহুর্তের সঠিক মিমাংসার জন্য দরকার হয় সচেতন সাংগঠনিক হাতিয়ারের সবল হস্তক্ষেপ। আমাদের যুগে যা বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি হিসেবে ঐতিহাসিক অনিবার্যতা অর্জন করেছে।

২) তার দ্বিতীয় আবিষ্কার:- শ্রেণী সংগ্রামের ঐ নিয়মে যখন উৎপাদিকা শক্তির বিকাশ নতুন উৎপাদন সম্পর্কের দাবী করে তখন ঐ নতুন সম্পর্কের উপযোগী হিসেবে যে শ্রেণিটি উঠে আসে, তাকে তার শ্রেণি স্বার্থের অনুকূলে নতুন উৎপাদন সম্পর্কের জন্য সমাজকে তৈরি করতে এবং পুরোনো ব্যবস্থার আবর্জনা ঝেটিয়ে বিদায় করতে যাবতীয় কাঠামো পুনঃনির্মানে তার নিজস্ব শ্রেণি একনায়কত্ব অর্জন করতে হয়। যা এযাবৎকাল এক শোষণমূলক ব্যবস্থার বদলে আরের শোষণমূলক ব্যবস্থায় রূপান্তর মাত্র। অন্তর্বস্তুতে যা অভিন্ন। কিন্তু কালপুরুষের অসীম রসিকতায় আমরা আমাদের যুগে এক গুণগত মোড় পরিবর্তণের দোড়গোড়ায় এসে দাড়িয়েছি। বর্তমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থা তার নিজের তাগিদেই লাগামহীন মুনাফা ও পুঁজি তথা উৎপাদনের উপকরণের ক্রম ঘণীভবণের তারনায় উৎপাদন ব্যবস্থার যথাসম্ভব সামাজিকিকরণ করতে বাধ্য হয়। যার ফল হলো সামাজিক দারিদ্রতা ও ব্যপক জনগণকে ক্রম সর্বহারা নিস্ব শ্রমিকে পরিণত করে চলার এক চমৎকার ঐতিহাসিক রসিকতা! ক্রমবর্ধমান শ্রেণি হিসেবে যে শ্রমিক শ্রেণির মজুরি দাসত্ব ছাড়া বেঁচে থাকার জন্য হাতে থাকে সপরিবারে না খেয়ে মরা বা আত্মহত্যার গণতান্ত্রিক অধিকার। সুতরাং এই শ্রেণিটি কি তার এই দুর্দশাগ্রস্ত শ্রেণি অস্তিত্ব বজায় রাখা বা বিস্তারের কথা ভাবতে পারে? অবশ্যই তা পারেনা। বরং তার এই অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য তাকে সীমাহীন বিকশিত উৎপাদিকা শক্তির ন্যায্য ব্যবহারের লক্ষ্যে এগোতেই হয়। যে লক্ষ্য পূরণের জন্য শ্রমিক শ্রেণিকে শুধুমাত্র নতুন উৎপাদন সম্পর্ক তৈরি করা ও পুরোনো পুঁজিবাদী উৎপাদন সম্পর্কের বাঁধা সাফ করার ক্ষুদ্র স্বার্থের বদলে অনেক বড় ও মহৎ উদ্দেশ্যে কাজ করতে হয়। আর তা শ্রমিক শ্রেণি তৈরির কারখানা এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থা সহ যাবতীয় শোষণমূলক ব্যবস্থার বদলে সাম্যবাদী ব্যবস্থার প্রতিস্থাপন ছাড়া সম্ভব নয়। অতয়েব মানব সমাজের ক্রমবিকাশের ধারায় এযাবৎ সর্বৎকৃষ্ট বিপ্লবী কর্তব্যের কারিগর হিসেবে বিপ্লবী শ্রমিক শ্রেণিকে রঙ্গমঞ্চে হাজির করেছে এ যুগের ইতিহাস। তাই শ্রমিক শ্রেণি তার এই মহান কর্তব্য ও উদ্দেশ্য পূরণের ঐতিহাসিক দায়িত্ব অবহেলা করতে পারেনা। আর অবশ্যই সম্পূর্ণ সাম্য ব্যবস্থা অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত তাই সে তার শ্রেণি একনায়কত্ব প্রয়োগ করবে। যা প্রলেতারিয় একনায়কত্ব হিসেবে মার্কসবাদের মূল কথা। যাকে লেনিন মার্কসবাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত বলে বর্ণনা করেছেন। যা অনেকটা মাতৃগর্ভ থেকে খোলা প্রকৃতিতে সদ্যজাতর মানিয়ে নেওয়া পর্যন্ত ধাত্রী মায়ের পরিচর্যার মতন আরকি।

৩) তৃতীয় আবিষ্কার:- শ্রমিক শ্রেণীর একনায়কত্ব কোনো নতুন ব্যবস্থা নয়। তা হলো দুটি পরস্পর বিরোধী ভিন্ন গুনগত একটা পুরোনো ব্যবস্থা থেকে আরেকটা নতুন ব্যবস্থায় যাওয়ার মধ্যবর্তি পর্যায়। যার গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ আগের যে কোনো যুগের এক শোষণ ব্যবস্থা থেকে আরেক শোষণ ব্যবস্থায় যেতে শ্রেণি শোষণের ভিত্তি একই থাকত। শুধু এক শোষক থেকে আরেক শোষকের হাত বদল ঘটত। কিন্তু এই প্রথম শোষণ মূলক শ্রেণি সমাজ থেকে শ্রেণিহীন সাম্যবাদী সমাজে যাওয়ার আবশ্যকতা হিসেবে দরকার হয় হাজার হাজার বছরের শোষণমূলক, বৈষম্যমূলক শিক্ষা সংস্কৃতি, আচার, আচরণ সহ তার সহায়ক সমস্ত জঞ্জাল ও কাঠামোর আমূল উচ্ছেদ সাধন ও তার জাগায় নতুন সাম্যবাদী ব্যবস্থার উপযোগিতা নির্মাণের এক দীর্ঘ সময় ব্যপি উত্তরণ কালের। সেই উত্তরণ কালই হলো এই সর্বহারার একনায়কত্বের পর্যায়। মজার ব্যপার মাতৃ গর্ভ থেকে প্রকৃতিতে ভুমিষ্ঠ শিশুর এক অবস্থা থেকে আরেক অবস্থায় মানিয়ে নেওয়ার সেই যেন আতুরকালিন স্পর্শকাতর সময় এই একনায়কত্বের পর্যায়। লেনিন বলেছেন `যাকে অস্বীকার করার অর্থ মার্কসবাদকে অস্বীকার করা।`
এই হলো সংক্ষেপে মার্কসবাদ।

◆ পরবর্তী পর্বে..

◆◆কেন মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশে শ্রমিক শ্রেণীর আবির্ভাব ও তার ঐতিহাসিক কাজ অন্য সকল যুগের তুলনায় সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ?
চলবে…

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ