১৯১৭ সাল: বিপ্লবের মেয়েরা

প্রকাশিত: ৯:৪২ পূর্বাহ্ণ, মার্চ ১০, ২০২১

১৯১৭ সাল: বিপ্লবের মেয়েরা

মেগান ট্রুডেল || ১০ মার্চ ২০২১ : নারীরা শুধুমাত্র রুশ বিপ্লবের স্ফূলিঙ্গ ছিলেন না বরং বিপ্লবকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার যান ছিলেন।

২৩ ফেব্রুয়ারী, ১৯১৭, আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী নারী দিবসের পরও নেভস্কি প্রসপেক্টে মিছিল করে মেয়েরা রেশন বৃদ্ধির দাবী করছেন।সেন্ট পিটার্সবুর্গ-এর কিনো-ফোটো-ফোনো দলিল কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রীয় আর্কাইভের সৌজন্যে
১৯১৭ সালের আন্তর্জাতিক নারী দিবসে পেট্রোগ্রাদের ভাইবর্গ জেলার মহিলা বস্ত্র শ্রমিকেরা ধর্মঘট করেন। কারখানার কাজ বন্ধ রেখে শত শত মহিলা কারখানা থেকে কারখানা ঘুরে অন্য শ্রমিকদের ধর্মঘটে যোগ দিতে আহ্বান করছিলেন; ফলে পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষেও জড়িয়ে পড়েন।
দিনের পর দিন অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে দিনে ১২-১৩ ঘণ্টা কাজ করেও অত্যন্ত কম মাইনে পেতেন নারী-শ্রমিকেরা। সেইজন্যেই তাঁরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলেন এবং পুরুষ শ্রমিকদের সক্রিয় সমর্থন চাইছিলেন; বিশেষতঃ কারিগরি ও ধাতব কারখানায় শ্রমরত দক্ষ শ্রমিকদের সক্রিয়তা আশা করছিলেন বেশি করে কারণ, তাঁরাই ছিলেন শহরের সবচেয়ে রাজনীতি-সচেতন অংশ। মহিলারা কারখানার দরজায় লাঠি, পাথর ও বরফবল ছুঁড়ে জোর ক’রে কারখানায় ঢুকে পড়তে চেষ্টা করেন। তাঁদের সমস্বর স্লোগান ছিল যাতে যুদ্ধ শেষ হয় এবং নিকটাত্মীয়েরা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ঘরে ফেরেন।
তৎকালীন বহু ইতিহাস-বিশেষজ্ঞের মতে যে নারীরা রুটির জন্যে লড়ছিলেন, তাঁরা বহু সময় ধরে প্রাচীন পন্থায় আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিলেন পুরোপুরি অর্থনৈতিক দাবিতে। তাঁদের সংগ্রামে হৃদয়াবেগ যত ছিল, তাত্ত্বিক ভিত্ত তত ছিল না। তাঁরাই ছিলেন জারের বিরুদ্ধে ঝড়ের পূর্বাভাস কিন্তু অচিরেই তাঁরা বিপ্লবী পুরুষ-শ্রমিকদের ভিড়ে এবং পুরুষশাসিত রাজনৈতিক দলগুলির প্রাধান্যে হারিয়ে গেলেন।
ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের প্রাক্‌-সময় থেকেই যুদ্ধবিরোধী স্লোগানই ছিল প্রতিবাদের মূল নির্যাস। নারীদের ঔদ্ধত্য, একাগ্রতা এবং পদ্ধতি কয়েকটা জিনিস পরিস্কার করে দিয়েছিল যে, তাঁরা নিজেদের সমস্যার শিকড় বুঝেছে, শ্রমিক-ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা বুঝেছে এবং জারের পক্ষ থেকে বিপ্লবের পক্ষে সৈন্যদের টেনে আনার প্রয়োজনীতা উপলব্ধি করেছেন। পরবর্তী কালে ট্রটস্কি লিখেছিলেন-
“শ্রমিক ও সৈন্যদের মধ্যে সম্পর্করক্ষায় নারীদের ভূমিকা অতুলনীয়। যে কোনো কর্ডন ভাঙ্গতে পুরুষদের থেকে বেশি উৎসাহী ছিলেন তাঁরা। রাইফেল ধরতেও বেশি দক্ষ ছিলেন; আর, তাঁদেরই দৃঢ়চেতা স্বর ছিল, ‘বেয়নেট ফেলে দাও। আমাদের সঙ্গে যোগ দাও।’ সৈন্যরা উত্তেজিত হত, লজ্জিত হত, উদ্বিগ্ন দৃষ্টিবিনিময় করত এবং হাত নাড়ত তাঁদের উদ্দেশে। কোনও একজন প্রথমে মন শক্ত ক’রে আগ্রণী জনতার কাঁধের ওপরে বন্দুক রেখেছিল অপরাধবোধ নিয়েই।”
২৩শে ফেব্রুয়ারির মধ্যেই যে সমস্ত সৈন্য ট্রাম ডিপোর রক্ষী ছিলেন, তাঁরা নারী-শ্রমিক ও আন্দোলনকারীদের কথায় সরকারের বিরুদ্ধে চলে যান। সৈন্যদের বিপক্ষ থেকে পক্ষে নিয়ে আসার এই কাজটা শুধুমাত্র যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতির বোঝা বেড়ে যাওয়া কিংবা আন্দোলনের ‘স্বতঃস্ফূর্ত’ প্রভাবের ফলেই সম্ভবপর হয়নি। ১৯১৪ সাল থেকেই পেট্রোগ্রাডের বিদ্রোহী কৃষকদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছিলেন মহিলা বস্ত্র শ্রমিকেরা। ব্যারাকের সৈন্যরা এবং কারখানার মহিলারা যাঁরা একই অঞ্চল থেকে শহরে এসেছিলেন, তাঁরা নিজেদের মধ্যে গভীর সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন, ফলে শ্রমিক ও সৈন্যের ভেদাভেদ ঘুচে গিয়েছিল। আর, নারী শ্রমিকরাও প্রয়োজনের মুহূর্তে সশস্ত্র সাহায্যের পূর্ণ আশ্বাস পেয়েছিলেন।
নারী শ্রমিকরা ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের সামনের সারিতে ছিলেন, যে বিপ্লব জার সাম্রাজ্যের পতনের সূচনা করেছিল। বহু পুরুষ শ্রমিক ও বিপ্লবীর প্রারম্ভিক সংশয় সত্ত্বেও তাঁরা শুধুমাত্র ‘স্ফূলিঙ্গ’ ছিলেন না, বরং নিঃসন্দেহে আন্দোলনের চালিকাশক্তি ছিলেন!
ফেব্রুয়ারি বিপ্লবকে সাধারণতঃ অভিহিত করা হয় ‘স্বতঃস্ফূর্ত’ বিদ্রোহ বলে। হয়তো কিয়দংশে তা সত্যি, কারণ, বিপ্লবীদের পরিকল্পনামাফিক এই বিপ্লব নির্মিত বা পরিচালিত হয়নি। কিন্তু, স্বতঃস্ফূর্ততা মানেই যে রাজনীতির অভাব তা ক্ষেত্রে ঘটেনি। যে মেয়েরা পেট্রোগ্রাডের কল-কারখানায় কাজ করতেন এবং তাঁদের বাড়ির দায়িত্ব সামলাতে দীর্ঘক্ষণ খাবারের লাইনে দাঁড়াতেন, তাঁদের অভিজ্ঞতায় ‘খাদ্যের’ অর্থনৈতিক দাবি এবং বিপ্লবের রাজনৈতিক দাবির কোনও ফারাক ছিল না। ক্ষুধা এবং দারিদ্র্য থেকে উদ্ভূত বস্তুগত পরিস্থিতি সঠিক দিশাতেই পরিচালিত হয়েছিল- যুদ্ধ এবং যুদ্ধ-পরিচালক রাজনৈতিকদের বিরুদ্ধে। সেই সব দাবি কখনোই পূরণ হত না এক যুগান্তকারী পরিবর্তন ছাড়া।
এছাড়া, বলশেভিক নারীরা বহুবছর অক্লান্ত পরিশ্রম করেছিলেন অদক্ষ, অসংগঠিত নারী শ্রমিকদের সংগঠিত করতে, তাঁরাই ছিলেন ধর্মঘটের মধ্যমণি। যদিও তাঁদের নিজেদের পার্টির পুরুষদের বক্তব্য ছিল যে, নারীদের সংগঠিত করার অর্থ জারতন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রাম থেকে বিচ্যুতি এবং উচ্চশ্রেণির নারীবাদীদের ক্রীড়নক হয়ে শ্রেণি সংগ্রাম থেকে বিযুক্তি।
বিপ্লবী আন্দোলনের বহু পুরুষের ধারণা ছিল যে, আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রতিবাদ মিছিল অপরিণত পদক্ষেপ এবং দক্ষ শ্রমিকরা পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে নারী শ্রমিকদের অপেক্ষা করা উচিত। পার্টির ভেতরে সংখ্যালঘু নারী সদস্যরা ভাইবর্গ জেলায় একটি সমাবেশ করার পক্ষে যুক্তি দেন যেখানে যুদ্ধ ও মূল্যবৃদ্ধি বিষয়ে আলোচনা হবে এবং সক্রিয় নারী সদস্যরা আন্তর্জাতিক নারী দিবসে যুদ্ধবিরোধী প্রদর্শন সমাবেশ করবেন। তাঁদের মধ্যে অন্যতমা হলেন আনাস্তাসিয়া দেভিয়াৎকিনা যিনি একাধারে বলশেভিক, শ্রমিক; ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের পরে তিনি সৈন্যদের স্ত্রী-দের নিয়ে একটি ইউনিয়ন গঠন করেন।
ফেব্রুয়ারির পর থেকে অক্টোবর বিপ্লবের দিকে যাওয়ার পথে নারী সদস্যরা ক্রমেই অন্তর্হিত হচ্ছিলেন। কয়েকজন মাত্র মহিলা বিপ্লবী টিঁকে ছিলেন যেমন আলেকজান্দ্রা কোলনতাই, নাদেঝদা ক্রুপস্কায়া ও ইনেসসা আরমান্দ; ব্যক্তিগত জীবন, স্ত্রী বা প্রেমিকা হিসেবে ভূমিকার বাইরে মাঝেমাঝেই যাঁদের সক্রিয়তা ও তাত্ত্বিক অবদানের ব্যাপারে পর্যালোচনা হয়।
জারতন্ত্রের অবশেষ থেকে উদ্ভূত প্রশাসনিক ব্যবস্থায় মেয়েরা প্রধানত অনুপস্থিৎ ছিলেন। গ্রামীণ পরিষদগুলিতে, সংবিধান সভার প্রতিনিধি হিসেবে, অথবা সোভিয়েতের প্রতিনিধি হিসেবে, উপস্থিত ছিলেন খুব নগন্য সংখ্যক মেয়ে। কারখানা কমিটির নির্বাচনগুলোও পুরুষ-দমিত ছিল, যারা এমনকি সেই সব কারখানাতেও প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হন, যেখানে মহিলা শ্রমিকরা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিলেন। এর কারণ দ্বিবিধ, যদিও পরস্পর সম্পর্কিতঃ অভাবের সংসারে মহিলাদেরই মূল দায়িত্ব ছিল পরিবার প্রতিপালনের এবং উচ্চতর সক্রিয় রাজনীতির ক্ষেত্রে তাঁদের আত্মবিশ্বাস, পড়াশুনা সর্বোপরি সময়ের খুবই অভাব ছিল। শতাব্দীর পর শতাব্দী যে শোষণমূলক বাস্তবতার মধ্যে রাশিয়ার শ্রমজীবী নারীদের বেঁচে থাকতে হত, তাঁদের শোষণের যে বস্তুগত বাস্তবতা, সেটার ফলে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছিল তাঁদের রাজনীতিতে অংশ নেওয়ার ক্ষমতা, যদিও তাঁদের রাজনৈতিক সচেতনতা বাড়ছিল।
১৯১৭ সালের আগের রাশিয়া ছিল প্রধানত একটি কৃষক সমাজ। জারের সর্বময় কর্তৃত্বকে কায়েম করা ও মজবুত করার কাজটা করত চার্চ। সেই কর্তৃত্ব প্রতিফলিত হত পরিবারের মধ্যেও। বিবাহ ও বিবাহ-বিচ্ছেদ ছিল চার্চ ও ধর্ম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত; আইনমতে নারীরা হীনতর অবস্থানে ছিল, এবং তাঁদের মনুষত্বের প্রাণী এবং সম্পত্তি বলে ভাবা হত। সাধারণ রুশ প্রবাদে এই মতাদর্শের ভাবাবেগই প্রকাশিত হত, যেমন- “মনে হল যেন দু’জন মানুষ দেখলুম। কিন্তু আসলে একজন পুরুষমানুষ আর তার বউ।”
পরিবার ছিল প্রত্যক্ষ পুরুষতান্ত্রিক এবং প্রত্যাশা করা হত যে প্রবল পাশবিক পরিবেশেও মেয়েরা নীরব, নিস্ক্রিয় থাকবে। মনে করা হত তাঁরা নীরবে হাতফেরত হবে পিতার অধীনতা থেকে স্বামীর অধীনতায়, প্রায়শই প্রথাসিদ্ধ হিংসার শিকার হবে। কৃষক ও শ্রমিক নারীরা কর্মক্ষেত্রে প্রবল খাটনি খাটতে বাধ্য হতেন। শাস্তিমূলক কাজ করতে বাধ্য হতেন। গোদের ওপরে বিষফোঁড়ার মতো ছিল সন্তানদের দেখাশোনা করা ও গৃহকর্মের দায়িত্ব, এবং এমন এক যুগে যখন সন্তানের জন্ম দেওয়া ছিল কঠিন ও বিপজ্জনক, যখন গর্ভনিরোধক ছিল না এবং শিশুমৃত্যুর হার ছিল চড়া।
এতদসত্ত্বেও ১৯১৭-র বিপ্লবে নারীদের ভূমিকা শূণ্য থেকে পড়ে নি। রাশিয়ায় একটা দ্বান্দ্বিকতা ছিলঃ সংখ্যাগরিষ্ঠ শোষিত জনগণের অবর্ণনীয় দারিদ্র্য ও তাঁদের উপর মুষ্টিমেয়র অত্যাচার থাকলেও ১৯০৫ সালের আগের দশকগুলিতে রাশিয়ার অর্থনীতি ফুলেফেঁপে উঠেছিল। প্রচুর আধুনিক কলকারখানায় উৎপাদিত হচ্ছিল বস্ত্র ও অস্ত্র। রেলপথ দ্রুত বাড়তে থাকা নগরগুলোর মধ্যে যোগাযোগ তৈরী করছিল; আন্তঃরেলপথের বাড়বাড়ন্ত এবং ইউরোপ থেকে আশা প্রযুক্তি ও বিনিয়োগের ফলে লোহা ও তেল উৎপাদন অনেক বৃদ্ধি পেয়েছিল।
অর্থনীতির এই নাটকীয় পরিবর্তন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে রাশিয়ার সামাজিক ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য রূপান্তর ঘটিয়েছিলঃ বৃহৎ সংখ্যায় কৃষক নারীরা কারখানার শ্রমিক হিসেবে যোগদান করেছিলেন। এর একটা কারণ যেমন ছিল ক্রমবর্দ্ধমান দারিদ্র্য তেমনই যান্ত্রিক চাহিদার যুগে কারখানার মালিকদের প্রয়োজন ছিল প্রচুর পরিমাণে অদক্ষ শ্রমিক যারা সমস্ত শর্ত মানতে ‘বাধ্য’ থাকবে। আর, তাই লিনেন, কটন্‌, রেশম, পশম, সেরামিক ও কাগজশিল্প সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারী শ্রমিকের হার বৃদ্ধি পেয়েছিল।
মেয়েরা ধর্মঘটের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ১৮৯৬ সালে বস্ত্রকলে ধর্মঘটে, রুশ-জাপান যুদ্ধ শুরুর আগে বাধ্যতামূলক ভাবে সেনাবাহিনীতে নিয়োগের প্রতিবাদে, এবং বিশেষ করে ১৯০৫ সালের বিপ্লবে, যখন বস্ত্র, তামাক, মিষ্টি শিল্পের অদক্ষ নারী শ্রমিকরা এবং গৃহ-পরিচারিকা ও ধোপানিরা ধর্মঘট করেছিলেন এবং সার্বিক, ব্যাপক আন্দোলনের অংশ হিসেবে ইউনিয়ন গড়ার চেষ্টা করেছিলেন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রত্যক্ষ প্রভাব নারী শ্রমিকদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক গুরুত্ব বাড়ানোর ক্ষেত্রে নির্নায়ক হয়েছিল। যুদ্ধ পরিবারদের ধ্বংস করে, ও নারীদের চরম দুর্বিষহ অবস্থার মধ্যে ফেলেছিল। লাখ লাখ পুরুষ যুদ্ধে গিয়ে হয় আহত হচ্ছিল নয়তো মারা যাচ্ছিল, তার ফলে কৃষিকাজ সামলানো, গৃহস্থকাজ সামলানো এবং শহরের কারখানায় শ্রমিক হয়ে দিনযাপনে বাধ্য হচ্ছিলেন নারীরা। ১৯১৪ সালে নারীশ্রমিক ছিলেন মোট শ্রমিকের ২৬.৬%, যেটা ১৯১৭ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ৪৩.৪% তে। এমনকি দক্ষ, সংগঠিত ক্ষেত্রেও এই বৃদ্ধির হার ছিল উল্লেখযোগ্য। ১৯১৪ সালে ধাতব শিল্পে নারী শ্রমিক ছিলেন মাত্র ৩%, যা ১৯১৭ সালে বেড়ে হয়েছিল প্রায় ১৮%!
ফেব্রুয়ারি বিপ্লব পরবর্তী দ্বৈত ক্ষমতার পরিস্থিতিতে নারীদের প্রতিবাদ অন্তর্হিত হয়নি বরং তা প্রকট হয়ে উঠেছিল। এই প্রতিবাদ একটা প্রক্রিয়া অংগ হয়ে পড়ল, যার মাধ্যমে শ্রমিকদের সমর্থন প্রবাহিত হতে থাকে বেশী করে সরকার থেকে সোভিয়েতের পক্ষে, এবং সেপ্টেম্বরের মধ্যে সোভিয়েতের অন্দরে নরমপন্থী সমাজতন্ত্রী মেনশেভিক- সমাজতন্ত্রী বিপ্লবীদের থেকে বলশেভিক বিপ্লবীদের পক্ষে।
নারী ও পুরুষ শ্রমিকরা আশা করেছিলেন যে, জারতন্ত্রের পতনের পরে তাঁদের শোচনীয় পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি হবে; কিন্তু অচিরেই সে আশায় জল ঢেলে দেয় তৎকালীন সরকার ও সোভিয়েত নেতৃত্ব যখন তারা যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেয়। নিরবচ্ছিন্ন যুদ্ধবিরোধী প্রতিবাদের মুখে মে মাসের মধ্যেই প্রথম অস্থায়ী সরকারের পতন ঘটল। মেনশেভিক ও সমাজতন্ত্রী বিপ্লবীরা উদারনৈতিকদের সাথে মিলে জোট সরকার গঠন করল- কিন্তু সেটাও যুদ্ধের পক্ষেই ছিল। শ্রমিকদের স্বপ্নভঙ্গের বেদনা পরিণত হল একের পর এক ধর্মঘটে, যেখানে আবার নেতৃত্ব দিলেন নারী শ্রমিকরা। বলশেভিক সোফিয়া গনচারেস্কায়ার নেতৃত্বআধীন একটি ইউনিয়নের উদ্যোগে প্রায় ৪০ হাজার রজক-শ্রমিক ধর্মঘট করেন, বেতনবৃদ্ধি, দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের দাবি, কর্মক্ষেত্রের আবহ উন্নতি- যেমন, স্বাস্থ্যসম্মত কর্মক্ষেত্র, মাতৃত্বকালীন সুযোগসুবিধা (কারখানার মাটিতে বাচ্চার জন্ম না দেওয়া অবধি গর্ভবতী শ্রমিক নারী অনেক সময়েই গর্ভাবস্থা লুকিয়ে রাখতেন, এটা অস্বাভাবিক ছিল না) এবং যৌনহেনস্থা বন্ধের দাবি। ইতিহাসবিদ্‌ জেন ম্যাকডারমিড এবং অ্যানা হিলিয়ার লিখছেনঃ
ইউনিয়নের অন্যান্য সদস্যাদের সঙ্গে গনচারস্কায়া এক লন্ড্রী থেকে অন্য লন্ড্রীতে গিয়ে মেয়েদের ধর্মঘটে সামিল হতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। চুল্লী নেভানোর জন্যে তাঁরা বালতিতে করে ঠাণ্ডা জল ঢালতেন। একটি লন্ড্রীতে মালিক একটি ক্রো-বার নিয়ে মারতে এসেছিলেন গনচারেস্কায়াকে। তখন অন্যান্য শ্রমিকরা পেছন থেকে টেনে ধরে তাঁকে বাঁচান।
অগাস্ট মাসে জেনারেল কর্নিলভ যখন বিপ্লবকে টুঁটি টিপে মারতে চাইছিলেন, তখন পেত্রোগ্রাদ রক্ষায় এগিয়ে এলেন নারী শ্রমিকেরা। তাঁরা ব্যারিকেড তৈরি করে ও প্রাথমিক চিকিৎসা করে সহায়তা করতে লাগলেন। অক্টোবরে, বলশেভিক নারীরা প্রাথমিক চিকিৎসার পাশাপাশি স্থানীয় অঞ্চলগুলোর মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করতে লাগলেন। কয়েকজনের দায়িত্ব ছিল পেত্রোগ্রাদের কিছু অঞ্চলে বিদ্রোহ সংগঠিত করা; আর, রেড গার্ডের নারীরাও এই ব্যাপারে সাহায্য করছিলেন। ম্যাকডারমিড ও হিলিয়ার অপর এক বলশেভিক নারীর ব্যাপারে লিখছেনঃ
জুলাইয়ের দিনগুলির পর অস্থায়ী সরকার যখন শ্রমিকদের অস্ত্র কেড়ে নিতে চেষ্টা করেছিল, তখন ট্রাম কন্ডাক্টার রোডিওনোভা নিজের ডিপোতে ৪২টি রাইফেল এবং অন্য অস্ত্র লুকিয়ে রেখেছিলেন। অক্টোবরে তাঁর দায়িত্ব ছিল মেশিন গান ভর্তি দুটো ট্রাম যেন ডিপো থেকে উইন্টার প্যালেস দখলের জন্য ছেড়ে যায়। তাঁকে নিশ্চিত করতে হয়েছিল যেন ২৫ অক্টোবর-২৬ অক্টোবর রাতে ট্রাম চলাচল চালু থাকে, যাতে ক্ষমতা দখলে সহায়তা করা হয়, এবং সারা শহর জুড়ে লাল রক্ষী বাহিনী যারা বিভিন্ন জায়গায় নিয়োজিত, তাঁদের কাজের তদারকী করা।
বিপ্লব যে পথ ধরে এগোতে থাকল, তার ফলে ব্যবধান বাড়ছিল একদিকে শ্রমজীবী মহিলাদের সঙ্গে অন্যদিকে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের সমর্থক নারীবাদীদের, কারণ শ্রমজীবী মেয়েদের জীবনযন্ত্রণা বেড়েছিল যুদ্ধের জন্য, তাই তাঁদের শান্তির আবেদন চীৎকারে পরিণত হয়েছিল বছরটা যত গড়িয়েছিল। যে সমস্ত উচ্চশ্রেণিভুক্ত নারীবাদীরা আইন ও শিক্ষাক্ষেত্রে সমতাবিধান ও সামাজিক সংস্কারের দাবিতে আন্দোনরত ছিলেন, তাঁরা ভেবেছিলেন যে যুদ্ধের সপক্ষে নবনিযুক্ত সরকারের তোষামোদী করলেই সেইসব দাবি পূরণ হবে। ভোজসভায় আসনের মূল্য হল দেশপ্রেমের প্রমাণ দেওয়া!

ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের পরে নারীবাদীরা নতুন উদ্যমে সর্বজনীন ভোটাধিকারের আন্দোলন শুরু করলে, তা মান্যতা পায় জুলাই মাসে, যা ছিল এক উল্লেখযোগ্য বিজয় । কিন্তু, অধিকাংশ মেয়েদের জীবনে সামান্যই পার্থক্য আনল, কারণ তাঁদের জীবন তখনও দুরবস্থায় ছিল, দৈনন্দিন ঘাটতি, দীর্ঘক্ষণের পরিশ্রম এবং পরিবারের শ্রমের যাঁতাকলে পড়ে। কোলোনতাই ১৯০৮ সালে লিখেছিলেনঃ
নারীবাদীদের দাবি আপাতভাবে যতই বিপ্লবাত্মক হোক না কেন, তাঁদের শ্রেণিগত অবস্থানের কথা মাথায় রেখে এটাও ভাবা দরকার যে, তাঁরা সমকালীন সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতির আমূল বদলের জন্যে সংগ্রাম করবেন না, যেটা ব্যতিরেকে নারীদের মুক্তি সম্পূর্ণ হওয়া অসম্ভব।

অধিকাংশ শ্রমিক-কৃষক মহিলার জন্যে শোষণমুক্তি ও সমতাবিধান শুধুমাত্র বিমূর্ত কথার কথা ছিল না বরং তাঁদের নিজেদের ও শিশুদের তথা পরিবারের অবস্থা উন্নতির লড়াইয়ের থেকে বেরিয়ে এসেছিল। যাঁরা প্রকাশ্যে রাজনৈতিক এবং বেশী দ্বিধাহীন হয়ে উঠলেন, অনেক সময়ে বলশেভিক পার্টির সদস্যা হিসেবে, তাঁরা সেটা হলেন যুদ্ধ এবং রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে যৌথ লড়াইয়ের ফলে – যার কেন্দ্রে ছিল ক্ষুধা ও যুদ্ধের বিরুদ্ধে এবং জমির মালিকানার পক্ষে সংগ্রাম। রবার্ট সার্ভিস বলছেনঃ
বলশেভিকদের রাজনৈতিক কর্মসূচী শ্রমিক, কৃষক ও সৈন্যদের কাছে দারুণ গ্রহণযোগ্য হয়েছিল কারণ, শরতের শেষ দিকে সামাজিক অস্থিরতা এবং আর্থিক সংকট চরমে পৌঁছেছিল। কিন্তু, সেটাই অক্টোবর বিল্পবের জন্যে যথেষ্ট ছিল না।
এটা নারী কৃষক, শ্রমিক এবং সৈনিকদের স্ত্রীরা ততটাই অনুভব করেছিলেন, যতটা করেছিলেন তাঁদের পুরুষ সমগোত্রীয়রা। পেত্রোগ্রাদের অদক্ষ শ্রমিকদের ব্যাপক অংশের সমর্থন ছাড়া, যাদের একটা বড় অংশ মহিলা, তাঁদের জন্যেই অক্টোবর অভ্যুত্থান সফল হত না। বলশেভিকদের প্রতি সমর্থন কোনও অন্ধ অনুসরণ নয় বরং ট্রটস্কির ভাষায়, লক্ষ লক্ষ নারী ও পুরুষ শ্রমিকের “চেতনার সযত্ন ও কষ্টার্জিত বিকাশ”। অক্টোবরের মধ্যে সবরকম প্রচেষ্টাই করা হয়েছিল- অস্থায়ী সরকার ও মেনশেভিকরা বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল, মিছিলের জবাবে এসেছিল হয় দমনপীড়ন না হলে সামান্য অগ্রগতি যা আর তাঁদের উন্নত জীবনের আশাপূরণ করছিল না। সর্বোপরি, কর্নিলভের সামরিক উত্থান ব্যাপারটা পরিস্কার করে দিয়েছিল যে- লক্ষ্যপূরণে এগোও নয়তো ধ্বংস হও! একজন শ্রমিকের কথায়, “বলশেভিকরা সবসময় বলত যে, ‘আমরা নয়, জীবন তোমাদের লক্ষ্যপূরণে উদ্যমী করে তুলবে।’ আর, এখন তাদের কথাই সত্যি হল কারণ জীবন তাঁদের রণকৌশলকে সঠিক বলে প্রমাণ করেছে।”
বলশেভিকরা নারী প্রসঙ্গকে যতটা গুরুত্ব দিয়েছিলেন, সেটা তাঁদের কৃতিত্বের কথা। যদিও, এখনকার দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখলে নারীরা ভীষণভাবেই কম গুরুত্ব পেত; তবু, তাঁদের সংগঠিত করা ও উন্নতির জন্য গভীরভাবে চেষ্টা করা হয়েছিল। বলশেভিকরা যে অন্যান্য সমাজতন্ত্রী দলগুলোর থেকে নারী শ্রমিকদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার জন্য বেশী কাজ করেছিলেন, সেটা সবসময়ে নারী অধিকারের প্রতি অধিক মাত্রায় অঙ্গীকারের জন্য নয়।
মেনশেভিক ও বলশেভিক দুই পার্টিই মনে করেছিল নারীদের সঙ্গে শ্রমিক শ্রেণীর অঙ্গ হিসেবে আদানপ্রদান চালাতে। কিন্তু, বলশেভিকরা নারী-পুরুষ সমানাধিকারের লড়াইকে সরকার ও যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনের শ্রেণীগত রণনীতির ভিত্তির ওপরে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন। অন্যদিকে যেসমস্ত দল যুদ্ধের পক্ষে ছিল ও উচ্চশ্রেণির বা মালিকদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখত, তারা শুধুমাত্র নারী শ্রমিকদের ধর্মঘটের রিপোর্ট করতে পারত আর রাজনৈতিক অধিকার নিয়ে আলোচনা চালাত; কিন্তু নারীদের দুঃসহ বাস্তবতার কোনও নিশ্চিত সমাধান ছিল না তাদের কাছে।

বলশেভিকরা দ্রুত মহিলাদের রাজনীতিকরণ ও সঙ্ঘবদ্ধ করার চেষ্টা শুরু করেছিলেন- তাঁরা কিছুটা শিক্ষা পেয়েছিলেন ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের বারুদ থেকে আর কিছুটা পেয়েছিলেন তাঁদের নারী সদস্যাদের জেদের ফলে।

কোলোনতাই, ক্রুপ্সকায়া, আর্মান্দ, কনকর্দিয়া স্যামোইলোভা ও ভেরা স্লুৎস্কায়ার মতো অগ্রণী বলশেভিক নারীরা বহুদিন যাবৎ পার্টিকে বলছিলেন যাতে পার্টি নারীদের সংগঠিত ও রাজনীতিকরণের ব্যাপারে বিশেষ প্রচেষ্টা করে। পুরুষ কমরেডদের যুক্তির বিরুদ্ধে তাঁদের দীর্ঘদিনের লড়াই ছিল এই প্রতিযুক্তিতে যে, অদক্ষ অসংগঠিত নারী শ্রমিকদের যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে এবং কোনও মতেই তাঁরা নিষ্ক্রিয়, সংস্কারাচ্ছন্ন ও বিপ্লবের পথে ‘অন্তরায়’ নন! ১৯১৪ সালে প্রথম প্রকাশিত ও ১৯১৭ সালে পুনঃপ্রকাশিত রাবোৎনিৎসা (নারী শ্রমিক) পত্রিকায় বারবার ক্রেশ্‌, নার্সারি ও নারীদের জন্যে সুরক্ষিত কর্মক্ষেত্রের বিষয়ে প্রবন্ধ প্রকাশিত হত। বিশেষ করে গুরুত্ব দেওয়া হত যাতে সমতাবিধান ও ‘নারীদের দাবি’ বিষয়ে সমস্ত শ্রমিক সচেতন হন।

ফেব্রুয়ারিতে নারী শ্রমিকদের ভূমিকা এবং পেত্রোগ্রাদের শ্রমিকদের মধ্যে তাঁদের গুরুত্বের ফলে বলশেভিক পুরুষদের অনেকের মধ্যেও [পুরোনো] দৃষ্টিভঙ্গির বদল ঘটাতে সাহায্য করেছিল, যে দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, নারী সমস্যার ব্যাপারে বেশি মাথা ঘামানো মানে নারীবাদকে উৎসাহ দেওয়া এবং বিপ্লবের নেতৃত্ব দেবে সবথেকে দক্ষ, সংগঠিত ও রাজনৈতিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ অগ্রণী (পুরুষ) শ্রমিকরাই কেবল। বলাবাহুল্য, এই লড়াই ছিল কষ্টকর। যখন কোলনতাই পার্টিতে স্বতন্ত্র মহিলা শাখার কথা বললেন, তখন তাঁকে একঘরে ক’রে দেওয়া হল। যদিও লেনিনের সমর্থন পেয়েছিলেন তিনি। লেনিনের এপ্রিল থিসিসও অবশ্য সেই বলশেভিক নেতৃত্ব ভালভাবে মেনে নেয়নি- একইভাবে, কেন্দ্রীয় কমিটিতে কোলনতাই ছিলেন লেনিনের একমাত্র সমর্থক।[1]

পরবর্তী কয়েকমাসে এটা পরিষ্কার হয়ে গেছিল যে, সোভিয়েতরা ক্ষমতা দখল করার দিকে বিপ্লবকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লেনিনীয় তত্ত্ব এবং কোলনতাইয়ের বারংবার নারী শ্রমিকদের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণের তত্ত্ব- দুইই এসেছিল বিপ্লবের গতি থেকে, এবং বিপ্লবকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারত। রাবোৎনিৎসা-র বাইরে অন্যান্য বলশেভিক পত্রিকাগুলোও এই যুক্তি দিতে লাগল যে, প্রবল লিঙ্গবিদ্বেষী দৃষ্টিভঙ্গি শ্রেনী ঐক্যের ক্ষতি করছে। এরপর পার্টির চেষ্টায় বিভিন্ন কারখানায় মহিলারাও শ্রমিক প্রতিনিধি হলেন পুরুষ শ্রমিকদের চিন্তাভাবনার বিরোধিতা করে, যাঁরা মহিলা শ্রমিকদের বিপদ বলে মনে করতেন। পার্টি তাঁদের যুক্তি দিল যে কেন মহিলা প্রতিনিধিদের নির্বাচিত করা প্রয়োজন- বিশেষতঃ কারখানায় যেখানে তাঁরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। আর, নারী শ্রমিকদের যেন সহকর্মী, প্রতিনিধি ও কমরেডের মর্যাদা দেওয়া হয়।

অক্টোবর বিপ্লবের ৬ সপ্তাহের মাথায় ধর্মীয় বিবাহের জায়গায় এলো নাগরিক নিবন্ধীকরণ এবং স্বামী বা স্ত্রী যেকোনও একজনের আবেদনে বিবাহবিচ্ছেদ্দের আইন। এক বছরের মধ্যে আনা পরিবার আইনে এই বিষয়গুলিকে আরো বিস্তারিতভাবে দেখা হল। নারী পুরুষ আইনের চোখে সমানাধিকার পেল। ধর্মীয় নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্তি ঘটল, এক আইনে মুছে গেল শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলে আসা প্রাতিষ্ঠানিক শোষণ। যেকোনও একজন কারণ প্রদর্শন না করেই বিবাহবিচ্ছেদ দাবি করতে পারত। নারীদের নিজেদের আর্থিক মালিকানা স্বীকৃত হল এবং একজনের অপরজনের সম্পত্তির ওপর অধিকার থাকল না। কোনও মহিলা যদি সন্তানের পিতৃত্বের ব্যাপারে নিশ্চিত না হতেন, তা’হলে তাঁর সমস্ত যৌনসঙ্গীকে সেই সন্তানের দায়িত্ব পালন করতে হত। রাশিয়ায় ১৯২০ সালে বিশ্বের প্রথম আবেদনের ভিত্তিতে গর্ভপাত আইনসিদ্ধ হল।

১৯১৭-র বিপ্লব নারীদের দ্বারাই শুরু হয়েছিল এবং দিশা পেয়েছিল; বছরভর অক্লান্ত প্রচেষ্টায় নারীদের সম্পর্কে বহু প্রাচীন ধ্যানধারণা বদলে গিয়েছিল। নারীরা দুর্বল, তাঁরা পুরুষের সম্পত্তি, তাঁরা নিষ্ক্রিয়, পিছিয়ে পড়া, রক্ষণশীল, তাঁরা স্বনির্ভর নয়, কমজোরি- এইসব বস্তাপচা ধারণা একেবারে মুছে না গেলেও নারীরা সক্রিয়তা ও রাজনৈতিক দক্ষতা দিয়ে এই ধারণাগুলোর বিরুদ্ধতা করেছিলেন।

কিন্তু, রুশ বিপ্লব পুরুষ কর্তৃত্বকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করতে পারেনি বা নারীদের সর্বাত্মক মুক্তি দিতে পারেনি। রুশ বিপ্লব পরবর্তী গৃহযুদ্ধের বীভৎসতা ও সোভিয়েত সরকারের কিছু বিকৃতি ও বিচ্যুতির জন্যেই তা সম্ভব হয়নি। বৈষম্য রয়েই গেছিল। কিছু মহিলা কর্তৃত্বকারী অবস্থানে পৌঁছেছিলেন, কয়েকজন প্রশাসনিক পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন এবং অক্টোবর পরবর্তী প্রতিকূল পরিস্থিতিতে লিঙ্গবিদ্বেষী মনোভাব পুরো শেষ হয়ে যায়নি।

বিপ্লবের দিনগুলোতে নারীরা হয়তো পুরুষদের মতো অত বেশি সংখ্যায় অংশগ্রহণ করেননি কিংবা উচ্চতর রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অতটা তাৎপর্যমূলক অবদান রাখতে পারেননি কিন্তু জীবনের দৈনন্দিন সীমাবদ্ধতাকে জয় ক’রে তাঁরা প্রত্যাশাকে ছাপিয়ে গেছিলেন এবং বিপ্লবের রূপরেখা গড়তে পেরেছিলেন। ম্যাকডারমিড এবং হিলিয়ার যেমন বলছেনঃ
এটা সত্যি যে, পুরুষ ও নারীর মধ্যে শ্রম বিভাজন থেকে গিয়েছিল। কিন্তু, মেয়েরা পুরুষ প্রাধান্যকে প্রশ্ন করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন, একথা মনে না করে আমরা বরং ভাবতে পারি, মেয়েরা তাঁদের পরম্পরাগত ক্ষেত্রের মধ্যে কীভাবে কৌশল করেছিলেন; এবং সেটা বিপ্লবী প্রক্রিয়ার কাছে কি অর্থ এনেছিল, তা বুঝতে হবে।

নারীরা ১৯১৭-র বিপ্লবে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে ছিলেন, পুরুষের কাঁধে কাঁধ মিলিয়েই ইতিহাস রচনা করেছিলেন। নীরব দর্শকের ভূমিকায় বা নিষ্ক্রিয় অরাজনৈতিক হিসেবে নয়, তাঁদের সাহসী প্রত্যক্ষ ভূমিকা আরও উজ্জ্বল ছিল, কারণ এতদিনের শোষণের প্রতিস্পর্ধী ছিলেন তাঁরা। নারীদের চোখে বিপ্লব পর্যালোচনা করলে তবেই নারীদের জীবনের সবচেয়ে প্রগতিশীল ঐতিহাসিক বিদ্রোহকে অনুধাবন ক’রে সমৃদ্ধ হওয়া যায়।

অনুবাদ-
প্রবুদ্ধ ঘোষ
অনুবাদ সম্পাদনা – কুণাল চট্টোপাধ্যায়

________________________________________
[1] লেখিকা এখানে দুটি সময়ের মধ্যে মিশিয়ে ফেলেছেন। এপ্রিল থিসিস যে সভাতে লেনিন পেশ করেন, সেখানে কোলোনতাই ছিলেন লেনিনের একমাত্র সমর্থক। কিন্তু তিনি বলশেভিক কেন্দ্রীয় কমিটিতে নির্বাচিত অন ষষ্ঠ পার্টি কংগ্রেসে, জুলাই মাসে, যখন তিনি কেরেনস্কীর জেলে। — সম্পাদক

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ