কৃষি আইন-২০২০ ও কিছু তথ্য এবং এই উপমহাদেশের রাজনীতির স্বরূপ

প্রকাশিত: ৭:১২ অপরাহ্ণ, মার্চ ২২, ২০২১

কৃষি আইন-২০২০ ও কিছু তথ্য এবং এই উপমহাদেশের রাজনীতির স্বরূপ

শঙ্খ চিল || ২২ মার্চ ২০২১ : ভারতীয় উপমহাদেশের শ্রেণী সংগ্রামের ইতিহাস মানেই কৃষক সংগ্রামের ইতিহাস। তার উত্থান পতন ও ধাক্কাই এই উপমহাদেশের যাবতীয় বিনির্মাণের ইতিহাস। যার বাস্তবতাতেই দেখতে হবে এই উপমহাদেশের বর্তমান অবস্থা ও আন্তর্জাতিকতার সঙ্গে তার বস্তুগত বিন্যাসকে। তবেই আমরা এই অঞ্চলের সত্যিকার সমস্যা ও তার সমাধানের সঠিক পথ খুঁজে পেতে পারি। আমরা চেষ্টা করব সেই উদ্দেশ্যেই বর্তমান ভারত সরকারের ‘কৃষি আইন-২০২০’ নিয়ে খানিকটা ময়না করার।

আসুন দেখা যাক সদ্য লোকসভায় পাশ করা মোদী সরকারের পেশ করা তিনটি কৃষি আইনে কি আছে-
◆◆ এই তিনটি বিল হল:-
———————————————————-
১) ফারমার্স প্রোডিউস ট্রেড অ্যান্ড কমার্স (প্রোমোশন অ্যান্ড ফেসিলিটেশন) বিল ২০২০ (কৃষিপণ্য লেনদেন ও বাণিজ্য উন্নয়ন)।
২) এসেনশিয়াল কমোডিটিজ (অ্যামেন্ডমেন্ট) বিল ২০২০ (অত্যাবশ্যক পণ্য আইন)।
৩) ফারমার্স (এমপাওয়ারমেন্ট অ্যান্ড প্রটেকশন) এগ্রিমেন্ট অব প্রাইস অ্যাসিওরান্স অ্যান্ড ফার্ম সার্ভিসেস বিল, ২০২০ (কৃষিপণ্যের দাম নিশ্চিত রাখতে কৃষকদের সুরক্ষা ও ক্ষমতায়ণ চুক্তি)।
বিল তিনটি লোকসভায় পেশ হলেও, রাজ্যসভায় ধ্বনি ভোটে ‘কৃষিপণ্য লেনদেন ও বাণিজ্য উন্নয়ন’ ও ‘কৃষিপণ্যের দাম নিশ্চিত রাখতে কৃষকদের সুরক্ষা ও ক্ষমতায়ণ চুক্তি’ বিল দুটি পাশ হয়েছে। সংসদের ভিতরে ও বাইরে দেশ জোড়া প্রতিবাদের মধ্যে বিলগুলি গায়ের জোড়ে আইনে পরিণত করা হয়।
◆◆ এই বিলগুলির পক্ষে সরকারি দাবি কি?
———————————————————-
সরকারের দাবি, সরকার নিয়ন্ত্রিত বাজার থেকে কৃষকদের মুক্ত করে কৃষি বাণিজ্যের উদারীকরণের পথে প্রান্তিক চাষিদের ফসলের দরদাম করার সুবিধা ছাড়াও প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত কৃষি ও ২০২২ সালে প্রতিটি কৃষকের আয় দ্বিগুণ করা।
এখন প্রশ্ন হলো বহুল আলোচিত উদারীকরণের ফল কি হয়েছে দুনিয়া সহ আমাদের দেশের খেটে খাওয়া মানুষদের? গোদের উপর বিষ ফোঁড়ার মতো এরপর কৃষিতেও উদারীকরণের ফল কি হতে পারে? সরকারি রক্ষাকবচের বাইরে আমাদের হতগরীব কৃষকরা একচেটিয়া পুঁজির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় দাঁড়াতে পারবে তো? টিকে থাকার প্রতিযোগিতায় জর্জরিত, আমাদের প্রান্তিক কৃষকদের দুর্বলতা, সেই বাজারে পৌঁছনো ও দরদাম করার উপযোগী কি?
◆◆ সম্ভাবনা ও বাস্তব চিত্র
———————————————————-
◆ কৃষকদের নির্মম পরিনতি
এই উপমহাদেশের খাওয়া না খাওয়া, আধপেটা কৃষিজীবী মানুষের হাজারো বছরের আত্মত্যাগী শ্রমদান ও অভিজ্ঞতা, প্রায় সহযোগী জলবায়ু, নদীমাতৃক উর্বর মাটির উজার আশীর্বাদসহ সীমাহীন প্রাকৃতিক প্রাচুর্যতার সঙ্গে আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির গণ-প্রতিনিধিত্বমূলক ব্যবহার সম্ভব হলে, যে দেশ হতে পারত সুজলা সুফলা শষ্য শ্যামলা, সে দেশের বাস্তব ছবিটা কি?
আমাদের দেশে এখনো প্রায় ৭০% জনগণ নানাভাবে কৃষির উপর নির্ভরশীল। প্রায় ১৩০ কোটি মানুষের এই বিশাল অংশের অসহায় কৃষি নির্ভরশীলতা ও করুণ প্রতিযোগিতার ফল হয়েছে মারাত্মক। যার সুযোগে অর্থনীতি বহির্ভুত পশ্চাৎপদ আধা-সামন্ততান্ত্রিক সমাজকাঠামোর উপর ঔপনিবেশিক শক্তির চাপিয়ে দেওয়া আধা-ঔপনিবেশিক ও আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদী রাষ্ট্রযন্ত্রের কল্যাণে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি শুষে নিচ্ছে দেশের মানুষের রক্ত ও ঘাম। যার করুণ পরিণতিতে প্রতি ৪৬ মিনিটে একজন কৃষক আত্মহত্যা করতে বাধ্য হন।
বিশ্বায়নের ধারায় ১৯৯৪-তে মারাকাসে বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার ‘এগ্রিমেন্ট অন এগ্রিকালচার’ চুক্তির পর কৃষি উৎপাদন ১৯৯৫-এর জানুয়ারিতে ‘গ্যাট’র অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৯৫-এ বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার শর্ত মেনে কৃষিজ আমদানির উপর থেকে পরিমাণগত বিধিনিষেধ তুলে নেওয়া হয়। বিশ্ব বাজারে ভারত আমদানি বাণিজ্যের মুক্তাঞ্চলে পরিণত হয়। অলাভজনক হতে শুরু করে ভারতীয় কৃষিক্ষেত্র। এই নয়া উদারনীতির হাত ধরে অতিবৃহৎ বহুজাতিক সংস্থাগুলো চাল, গম, ভোজ্য তেল নিয়ে এদেশের মতো বিশাল বাজারে ঢুকে পরতে থাকে। কৃষি উপাদানের উপর সুরক্ষা ক্রমশ বাতিল করা হয়েছে। কৃষকদের প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ মূলত শূন্যে নামানো হয়েছে। বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা (WTO)-র নির্দেশে খাদ্য বাণিজ্যর উপর থেকে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ কমিয়ে আনা হয়েছে।ফলত ভারতীয় কৃষি ও কৃষকদের অবর্ণনীয় দুর্দশা ক্রমবর্ধমান। জাতীয় ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর রিপোর্টে স্পষ্ট যে, খোদ মোদির আমলে প্রথম বছর ৫%, দ্বিতীয় বছর ২% কৃষক আত্মহত্যা বেড়েছে। করোনা পরিস্থিতিতে দেশের অর্থনীতি বেহাল হওয়ার আগেই ২০১৯ সালে ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো (NCRB)-র পরিসংখ্যান বলছে, দেশের মোট আত্মহত্যাকারীর ৭.৪ শতাংশই দেশের কৃষকরা। কৃষি ক্ষেত্রে মোট আত্মঘাতীর মধ্যে চাষির সংখ্যা ৫৯৫৭ জন। যার মধ্যে ৫৫৬৩ পুরুষ ও ৩৯৪ জন নারী কৃষক। অপরদিকে, খেতমজুরদের মধ্যে ৩,৭৪৯ জন পুরুষ ও ৫৭৫ জন নারী খেতমজুর আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন। যদিও ভারতে কৃষিক্ষেত্রে নারীদের কৃষক হিসেবে ধরাই হয়না। দিনমজুদের আত্মহত্যা ৮ শতাংশ বেড়ে দেশের ৪২,৪৮০ জন কৃষক ও দিনমজুর আত্মহত্যা করেছে। যার মধ্যে ২০১৮ সালের ৩০,১৩২ জনের তুলনায় ২০১৯-এর ৩২,৫৫৯ জন দিনমজুরের আত্মহত্যার সংখ্যাটা উর্দ্ধমুখি। এবার ভাবুন মোদী সরকারের একের পর এক জনবিরোধী নীতি ও করোনা পরিস্থিতিতে লকডাউনের ফলে জীবন জীবিকা লাটে ওঠার পর সেই অবস্থাটা কি মারাত্মক হতে পারে!
◆◆ এখন প্রশ্ন হলো চরম দুর্দশাগ্রস্ত এই কোটি কোটি প্রান্তিক কৃষকদের এহেন দুর্দশার পেছনে কারণটা কি?
———————————————————-
যেখানে বর্তমানে দেশের ৭৩% সম্পদ ১% লোকের হাতে। ২০১৮ সালে বেকারের হার ছিল গ্রামীণ ৭.৩৭% ও শহরে ৯.৭০%, মোট ৭.৭৮%। নোট বন্দির পর এযাবৎ দেশে বেকারত্বের হার ৪৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। যুবদের বেকারত্ব ১৩% থেকে বেড়ে ২৭% হয়েছে। নারীদের বেকারত্ব ৩ গুণ বেড়ে ১৭.৪% হয়েছে। স্টেট ব্যাংক অফ ইণ্ডিয়ার মতে ২০২০ সালে ১৬ লক্ষ অতিরিক্ত বেকারের সম্ভাবনা প্রকাশ পেয়েছে। ২০১৭-র ৪০.৭ কোটি কর্মরত ভারতীয়র সংখ্যা ২০১৮- এ ৩৯.৭% নেমে বেকার দাঁড়িয়েছে ২.৫%। ২০১৬-এ লেবার পার্টিসিপেশন রেট ৪৮% নোটবন্দির পর ৬% কাজ হাড়িয়ে নেমে দাঁড়িয়েছে ৪২.৮% এ। দেশের ৮২% পুরুষ ও ৯২% নারী ১০ হাজার টাকার অনেক কম বেতনে কাজ করতে বাধ্য হন। ৯০% কর্মচারি জাতিয় পে-কমিশন নির্ধারিত সামান্য বেতনও পাননা। যে দেশে আজও গরীব জনগণকে টিকিয়ে রাখতে ন্যূনতম ‘১০০ দিনের কাজের ব্যবস্থা’ কর্মসংস্থান ও বেকারত্বের এক বিকালাঙ্গ অবস্থার বাস্তব ছবি, সেখানে ক্রমবর্ধমান এই বিপুল বেকারত্বের সুযোগে সস্তা শ্রমের বাজারে মরতে আসার চেয়ে কৃষিতে মার খাওয়া কৃষকরা আত্মহত্যাকেই অনেক সহজ মনে করে। যা ছাড়া আর একটিই মাত্র পথ খোলা আছে তাদের সামনে। তা হলো বিকল্পের জন্য সংগ্রাম।
দুর্ভাগ্য বহু সংগ্রাম থাকলেও অক্ষম কৃষকদের প্রকৃত রাজনৈতিক ক্ষমতার আধার ছাড়া যে কোনো বিকল্পের সংগ্রামই তাদের জন্য কাঠালের আমসত্ব হতে বাধ্য। প্রচলিত ব্যবস্থায় প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতাকে অক্ষুন্ন রেখে বরং সেই ক্ষমতারই বুড়ি ছোঁয়ার সংকীর্ণ স্বার্থের দলাদলিতে তা ইতিমধ্যে যথেষ্ট প্রমাণিত। তাই তথাকথিত বিরোধীতার ভান করে সংসদের বাইরে হইচই করে উক্ত বিলটিকে পাস হতে একপ্রকার সহযোগিতা করে সংসদীয় বিরোধীরা। জনগণের নজর ঘোরাতে অচিরেই ‘হাথরস’ দলিত কন্যার নির্মম ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা নিয়ে তারা ও প্রচার মাধ্যমের অতিসক্রিয়তা তাই প্রমাণ করে। কেননা ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর ২০১৮ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী ভারতে প্রতিদিন ৯১টি ধর্ষণ অর্থাৎ প্রতি ১৫ মিনিটে একজন মহিলা ধর্ষণের শিকার হন, সেখানে কৃষিবিলের বিরুদ্ধে কৃষক সংগ্রামের বদলে হঠাৎই হাথরস নিয়ে অতিসক্রিয়তার কারণ কি? বিতর্কিত মনে হলেও এ ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি মার্কণ্ডেয় কাটজু’র মন্তব্য আলোচনার দাবি রাখে। জনগণের বিরামহীন সমস্যা ও কৃষকদের লাগামহীন আত্মহত্যার অব্যাহত ধারায় সে সত্য এড়িয়ে যাওয়া ক্ষমাহীন ভণ্ডামি।
সুতরাং প্রচলিত ব্যবস্থার মধ্যেই খুঁজতে হবে কৃষিজীবী সহ সমগ্র খেটে খাওয়া মানুষের সমস্যার উৎসকে।
◆◆ তবে কৃষি সহ ভারতীয় আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা ও রাজনৈতিক কাঠামো কোন চরিত্রের বার্তাবাহক?
———————————————————-
এই প্রশ্নের উত্তরে আমাদের একটু পেছনে ফিরে ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসকে পরখ করতে হবে।
◆ ১৯৪৭-এর মধ্যরাতে ঢং ঢং করে বহাল তবিয়ত জমিদাতন্ত্র নিয়ে তথাকথিত স্বাধীনতা ঘোষিত হল ভারত সহ এই উপমহাদেশের। যে জমিদারি আমাদের দেশের সাধারণ সমাজ বিকাশের ফল নয়। বাইরে থেকে চাপিয়ে দেওয়া বিদেশি বণিকদের স্বার্থের জঞ্জাল। আমরা জানি সামন্ততন্ত্রের গয়াগঙ্গা করে ১৭৮৯-র ফরাসি বিপ্লবের কথা। যার ধারায় শিল্প বিপ্লবের রসদ ও বাজারের জন্য বৃটিশ ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির ভারত দখলের কথা। তাদের স্বার্থেই নতুন এক জমিদারতন্ত্র তৈরি করে তারা। তার আগে সাবেক জমিদাররা ছিল শাসকের খাজনা আদায়ের কর্মচারী। নিজস্ব সম্পত্তির বাইরে তাদের কোনো অধিকার ছিলনা। কিন্তু কোম্পানির জমিদাররা তাদের খাজনা আদায়ের এলাকার সকল সম্পত্তির মালিক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেল। সর্বাধিক কৃষিশ্রম শোষণ করতে তারা চিরস্থায়ী, রায়তোয়ারী, মহলওয়ারী ইত্যাদির অধীন বিভিন্ন উপস্বত্বভোগী বন্দোবস্তের মাধ্যমে প্রাচীন ভারতীয় সামন্ততন্ত্রকে এক নতুন সামন্ততান্ত্রিক কাঠামোয় বদলে নিল। যার গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল সুদখোর মহাজন সহ এক বহুস্তরিভূত মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণির আবির্ভাব। যারা কৃষকদের সর্বস্বান্ত করে কৃষির বিকাশের সব রাস্তা ধ্বংস করে দেয়।
বৃটিশরা পুরোনো ব্যবসায়ী, কারিগরদের ধ্বংস করে সম্ভাবনাময় ভারতীয় শিল্প ব্যবসাগুলিকে সবলে বিনাশ করে তাদের শিল্পজাত পণ্যের বাজারের জন্যে। তার জাগায় বৃটিশ প্রবর্তিত লাগামহীন সামন্ততান্ত্রিক শোষণের সম্পদে বৃটিশ বাণিজ্যের সহায়ক হিসেবে মারোয়ারী, পার্সি, গুজরাটিদের মতো সম্প্রদায়ের মধ্যে থেকে গড়ে ওঠে এক শ্রেণির ফরে ভারতীয় দালাল পুঁজিপতি। যারা বৃটেনে তৈরি যন্ত্র আমদানি করে বৃটিশ পুঁজির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখে শুরুতেই একচেটিয়া কারবার গড়ে তোলে। যার ছায়া পরে এই বিকৃত ব্যবস্থার সহায়ক হিসেবে বৃটিশদের শোষণ ও প্রশাসনের জন্য তৈরী পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত কেরানীকূল বা মধ্যবিত্ত সমাজ ও রাষ্ট্রযন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত আমলাবাহিনীর উপর। কিন্তু ঔপনিবেশিক স্বার্থে বৃটিশদের দেগে দেওয়া সীমাবদ্ধ বিকাশে বিক্ষুব্ধ এই দোদুল্যমান অংশের হতাশার প্রকাশ হিসেবে দেখা যায় কবর খুঁড়ে প্রাচীন ভারতীয় বৈদান্তিক ও ধর্ম বর্ণ ভিত্তিক তথাকথিত আর্য শ্রেষ্ঠত্ব ও সাম্প্রদায়িক সাংস্কৃতির ব্যর্থ চর্চা। বৃটিশদের প্ররোচনায় বাংলার নবজাগরণ বা স্বাধীনতা সংগ্রামের দখল নেওয়া তাদের তথাকথিত নেতৃত্ব সেই বিকৃত ব্যবস্থার ঘূর্ণিতে আটকে পরে। যার ধারায় গড়ে ওঠে জাতীয় কংগ্রেস ও তার গান্ধীগিরি নেতৃত্ব। অন্যদিকে বহু আত্মত্যাগ নিয়েও প্রকৃত সংগ্রামের সুযোগ ও জনগণের ভরসার স্থল হয়েও দোদুল্যমান ভারতের কমিউনিস্ট নেতৃত্ব প্রথম থেকেই সমস্যা ও তা সমাধানের সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হয়। বদলে কংগ্রেসের লেজুরবৃত্তি সহ তথাকথিত রাজনৈতিক সংগ্রামের বেনোজলে ভেসে তারা এক ঐতিহাসিক বিপ্লবী সম্ভাবনাকে হেলায় হারান। যার ফলে রাজনৈতিক বিশ্বাসঘাতকতা মারাত্মক সাম্প্রদায়িকতা তথাকথিত স্বাধীনতার আগে ও পরে জনগণের ভাগ্যকে বিপথগামী করে চলেছে।
যখন সর্বহারা মতাদর্শের সফল প্রয়োগে সমাজতান্ত্রিক রুশ বিপ্লব দুনিয়ার দেশে দেশে উপনিবেশ বিরোধী মুক্তি সংগ্রামের আকাঙ্ক্ষাকে তীব্র করে তোলে। তখন অব্যাহত ধারায় সামন্ততন্ত্র বিরোধী কৃষক সংগ্রামের ফলে ভারতীয় স্বাধীনতাকামী জনগণ ও তাদের অসংখ্য সশস্ত্র বিপ্লবী সংগ্রামের ঢেউ তথা ১৯৪৬ এর দেশপ্রেমিক বোম্বাই নৌ বিদ্রোহের বিপদ ছড়িয়ে পরার ভয়ে বৃটিশরা তরিঘরি তাদেরই স্বার্থের সহায়ক ঐ রাজনৈতিক শক্তির কাছে দেশভাগ সহ বিভেদের রাজনৈতিক ক্ষমতার হাতবদল করে আধা ঔপনিবেশিক দায়বদ্ধতার কাছে ভারতীয় উপ মহাদেশের ভাগ্য বন্ধক রেখে সরে পরে। তাই রবীন্দ্রনাথের বৃটিশ সম্রাট ৫ম জর্জকে উপহার দেওয়া “জনগণ অধিনায়ক” সঙ্গীতটি হয় তথাকথিত স্বাধীন ভারতের জাতীয় সঙ্গীত! আমরা জানি কংগ্রেস ও মুসলিম লিগের বেইমানিতে বৃটিশদের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানে ব্যর্থ আত্মসমর্পণকারী নৌ সেনাদের গুলি করে হত্যা করা হয়। নৌ সেনাদের শৃঙ্খলা বজায় রাখার পক্ষে বৃটিশ সেনাপতির বক্তব্যকে সমর্থন করেন সর্দার বল্লভ ভাই প্যটল। যিনি স্বাধীন ভারতের প্রথম স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী। (সূত্র:- স্বাধীনতা সংগ্রামে সশস্ত্র বিপ্লবীদের ভূমিকা, দাসগুপ্ত সুধাংশু, পৃ:- ১২৫-১২৬)। ১৯৪৬ এর কলকাতা ও বোম্বের গণ সংগ্রামের নিন্দা করে গান্ধীজি বলেন ‘স্বরাজের কফিনে পেরেক ঠোকা এই হিংসাত্বক কার্যকলাপে হিন্দু মুসলিমদের মিলন অপবিত্র ও ভারতের পক্ষে খারাপ।’ (সূত্র:- সাম্প্রদায়িকতা, ওমর বদরুদ্দিন)। বৃটিশদের পক্ষে গাড়োয়ালী সেনারা লড়তে অস্বীকার করলে গান্ধীজি বলেন “কর্তব্য বোধে অবহেলা বিশ্বাস ভঙ্গের অপরাধে এদের চরম শাস্তি হওয়া দরকার।” (সূত্র:- গান্ধীবাদের স্বরূপ, রায় সুপ্রকাশ)। ৪৭ এ স্বাধীনতার পর কলকাতার প্রথম পুলিশ কমিশনার সুরেন্দ্র নাথ চ্যাটার্জী হলেন বৃটিশ গুপ্তচর বসন্ত কুমার চ্যাটার্জীর পুত্র। ১৯১৬ সালে ৩০ শে জুন বিপ্লবীরা যাকে হত্যা করতে বাধ্য হয়েছিলেন। (সূত্র:- হ্যালো লালবাজার, ঘোষ জয়ন্ত কুমার, পৃ:-৪৯)। কোনোরকম বিশেষ সংস্কার ছাড়াই অপরিবর্তিত বৃটিশ সাম্রাজ্যের সেনাবাহিনীই ভারতীয় প্রতিরক্ষায় গ্রাহ্য হয়। ঔপনিবেশিক স্বার্থের ১৮৯৪ এর জমি অধিগ্রহণ আইন, ১৮৬৯ এর পুলিশ আইন মূলত অপরিবর্তিত ধাঁচা নিয়ে আজও বহাল। এই হলো তথাকথিত স্বাধীনতা ও ইংরেজদের নির্ধারিত নীতি সফল করার রাজনৈতিক কারিগরদের হাতে ক্ষমতা হাতবদলের কিছু নমুনা।
তাই তথাকথিত স্বাধীনতার ঘোর কাটতে না কাটতেই প্রকৃত গণমুখি কর্মসূচির বদলে দাঁত-নোখ বের করে ব্যপক দুর্নীতি, দাঙ্গা ও সম্প্রসারণবাদী ভারত রাষ্ট্রের গণ-বিরোধী চরিত্র ডালপালা মেলে ধরে এই উপমহাদেশের সর্বত্র। বড় বড় জমির মালিক ও একচেটে ফরে পুঁজিপতিদের রাষ্ট্র জনকল্যাণ ও প্রকৃত ভুমি সংস্কার তো দুর্অস্ত দৃষ্টিকটু জমিদারতন্ত্র নিয়ে গণক্ষোভকে প্রশমিত করার কথা ভাবতেও ১০ বছর লাগিয়ে দেয়। কারণ তথাকথিত স্বাধীনতার অনেক আগে থেকেই বৃটিশদের লালিত পালিত ও প্রশিক্ষিত সংসদ ও রাষ্ট্রের দখল নিয়ে নিয়ছিল এই কায়েমী শক্তি। যা বহু আগে থেকেই বৃটিশদের তৈরি সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থে আধা সামন্তত্রান্তিক ও আধা উপনিবেশিক আমলাতান্ত্রিক প্রকৃত রাষ্ট্রযন্ত্র উপনিবেশিক গর্ভজাত সমস্ত অপরিবর্তিত প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি নিয়ে আজও গণ নিষ্পেষণের হাতিয়ার হিসেবে বহাল তবিয়তে সক্রিয়। তেমন একটি ভিত্তিকে বজায় রেখে তার পার্শ্ব-প্রতিক্রীয়ার চিকিৎসার চেষ্টা একেবারেই আনারী হাতুড়েপনা বই কিচ্ছু নয়।
◆◆ সমস্যা ও তা সমাধানের পথে দুর্ভাগ্যটা কি?
——————————————————————–
◆ কিন্তু দুর্ভাগ্যটা হল এরপরেও সমাজ ক্রমবিকাশের বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিকে জলাঞ্জলি দিয়ে ঔপনিবেশিক যুগের কমিউনিস্ট নেতৃত্বের ব্যর্থতার ধারায় বহু তথাকথিত কমিউনিস্ট পার্টি আমাদের সমাজের এই আর্থ-রাজনৈতিক চরিত্র নিয়ে আনাড়ি হাতুড়েপনা করে জনগণকে ঠকিয়ে চলেছেন।
ভারতের কৃষি যে মূলত আধা-সামন্ততান্ত্রিক সে বিষয়ে সব কমিউনিস্ট দলেরই একমত। কিন্তু তাদের কেউ কেউ এর সাথে কৃষি অর্থনৈতিক ও দেশের আর্থ-সামাজিক তথা রাষ্ট্র চরিত্রকে পুঁজিবাদী বলে দেখান। মজার ব্যাপার কেউ কেউ আবার একে আধা-পুঁজিবাদীও বলেন। কি অর্থে বলেন? এখন একটা নির্দিষ্ট দেশের বিশিষ্টতায় যদি সামন্ত ব্যবস্থার মধ্যে জন্মানো পুঁজিবাদ সামন্ততন্ত্রকে উচ্ছেদ করেই বিকশিত হয় তবে আধা সামন্ততন্ত্র মানে যে আধা পুঁজিবাদ সে তো সমাজ বিকাশের সাধারণ চলমান ধারা হিসেবে ঠিকই আছে। অর্থাৎ সামন্ততন্ত্রকে উচ্ছেদ করে সম্পূর্ণ পুঁজিবাদ প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু আন্তর্জাতিক পুঁজিবাদ যদি সাধারণ সত্যি হয় ও তা সাম্রাজ্যবাদে বিকশিত হয়ে থাকে তবে সেই সাম্রাজ্যবাদ কোথায় তার সাম্রাজ্য ফলাবে? কারন আমাদের দেশের মতো ঐ আধা আধি বৈশিষ্ট্য যদি সামন্ততন্ত্র থেকে পুঁজিবাদে যাওয়ার সাধারণ ধারা হয় তবে সেও তো অচিরেই সম্পূর্ণ পুঁজিবাদে বিকশিত হয়ে সাম্রাজ্যবাদী হতে বাধ্য। কারন পুঁজিবাদের নিয়ম অনুযায়ী সে তো নিরীহ পুঁজিবাদী হয়ে বসে থাকবেনা। পুঁজির ক্রমঘণীভূত সঞ্চয়ণ ও সঞ্চালন তাকে সাম্রাজ্যবাদী হতে বাধ্য করবেই। এক্ষেত্রে এক অবস্থা থেকে অন্য অবস্থায় যাওয়ার বিশেষ মুহুর্ত হিসেবে সেই ‘উচ্ছেদ’ বা বিপ্লব বা উল্লম্ফনের মার্কসবাদী বুনিয়াদী শিক্ষার অনুপস্থিতির কি ব্যাখ্যা হবে? কেবল ওপর ওপর সংস্কারের মাধ্যমেই কি ব্যবস্থা বদল সম্ভব? অপর দিকে ইতিমধ্যে যারা সাম্রাজ্যবাদী শক্তি তারা কি তাদের পশ্চাদভুমি হারানোর এই নিরীহ প্রক্রিয়াকে ঘটতে দিয়ে এমনি এমনিই সাম্রাজ্যবাদী প্রতিযোগী তৈরি হতে দেবে? যদি তা হয় তবে মার্কসবাদের বিপ্লবী তত্ত্বের সাথে সাথে লেনিনবাদের সাম্রাজ্যবাদের তত্ত্বও কি ভুল প্রমাণিত হবে না? তবে কি বার্নস্তাইনের বিবর্তনবাদ বা সংস্কারবাদের তত্ত্বই সত্যি বলে মানতে হবে? যদি তা না হয়, যদি মার্কসবাদ, লেনিনবাদ সত্যি হয় তবে লেনিনের সাম্রাজ্যবাদের যুগে কোনো বিশেষ মুহুর্ত বা বিপ্লব বিহীন ঐ আধাআধি ব্যবস্থা আপনাআপনি একটা থেকে আরেকটা ব্যবস্থায় বদলে যাওয়ার অমার্কসবাদী নিরীহ নিরামিষ ঘটনা ঘটতে পারে না। এ শুধু উদ্ভটই নয় এ সচেতন বিকৃতি। বরং ঐ আধাআধি ব্যবস্থা কোনো বিপ্লবী ধাক্কা ছাড়া একটি আপত স্থায়ী সাম্রাজ্যবাদের রসদভুমি ছাড়া আর কিছুই নয়। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহারে উপর উপর সংস্কারের কারণ আর যাই হোকনা কেন, ভিত্তি হিসেবে তা সাম্রাজ্যবাদের রসদখানা ছাড়া আর কিছুই নয়। এই সরল সত্যটা তারা অস্বীকার করে যন্ত্রের মতো মার্কসবাদের অ-আ-ক-খ আউড়ে সরল মনের শিশুপনায় বিকাশের মতাদর্শ মার্কসবাদের সঙ্গে দুষ্টুমি করে যাচ্ছে।
◆◆ কি এই সাম্রাজ্যবাদ? কি বলেছেন লেনিন?
——————————————————————–
◆ সাম্রাজ্যবাদের লেনিনিয় বৈশিষ্ট্যগুলি হল:-
ক. জাতীয় ক্ষেত্রে একচেটিয়া পুঁজির নিরঙ্কুশ আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত।
খ. ব্যাঙ্ক ও শিল্প পুঁজির মিলিত লগ্নী পুঁজির রমরমা।
গ. পণ্য রপ্তানি ছাড়াও অনুন্নত দেশের সস্তা শ্রম ব্যবহার করে অতি মুনাফার জন্যে উদ্বৃত্ত পুঁজি রপ্তানি এক বিশেষ মাত্রা অর্জন করেছে।
ঘ. পুঁজিপতিদের আন্তর্জাতিক একচেটিয়ার সৃষ্টি হয়েছে এবং তারা নিজেদের মধ্যে বিশ্বকে বাটোয়ারা করে নিচ্ছে।
ঙ. কয়েকটি উন্নত দেশ ও তাদের একচেটিয়া পুঁজি শক্তি অনুযায়ী গোটা পৃথিবীকে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়েছে।
এখন কয়েকটা উন্নত দেশ যদি শক্তি অনুযায়ী অন্যান্য দেশগুলিকে ভাগ করে নেয় আর সেটা কি আপেক্ষিক ভাবে একটা স্থায়ী ব্যবস্থা হবেনা? আর তা হলে সাধারণত ঐ অন্যান্য দেশগুলির উৎপাদন সম্পর্ক উন্নত দেশগুলির তুলনায় আলাদা কি হবে না? কোনো পুঁজিবাদী দেশ সামন্ততন্ত্র উচ্ছেদ হয়ে যাওয়া আরেকটা পুঁজিবাদী দেশে শোষণ চালাতে কোনো স্থায়ী ব্যবস্থার গড়ে তুলতে পারেনা। কারণ পুঁজিবাদী দেশে থাকে মূলগতভাবে দুটি শ্রেণি যথা বুর্জোয়া ও শ্রমিকশ্রেণি। তাই স্থায়ী শোষণের জন্য আভ্যন্তরীণ মিত্রশক্তি সেখানে সম্ভব নয়। তাই সাম্রাজ্যবাদকে আধিপত্য বজায় রাখতে তাদের নিয়ন্ত্রিত দেশগুলির উৎপাদন সম্পর্ককে পুঁজিবাদী পথে বাধা দিয়ে প্রাক পুঁজিবাদী সম্পর্কগুলিকে মদত করে সামন্ততন্ত্রের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তুলতেই হয়।
মজার ব্যপার লক্ষ্য করুন এখন এই অনুন্নত দেশগুলিকে যদি এমনকি পুঁজিবাদের পথেও উন্নত হতে হয় তবে তাদের শুধু প্রাক পুঁজিবাদী সম্পর্ক কেবল নয় বরং সাম্রাজ্যবাদেরও মোকাবেলা করতে হবে। লেলিনের সাম্রাজ্যবাদের বিশ্লেষণ যদি একটি সার্বজনিন সত্যি হয় তবে সেই সাম্রাজ্যবাদ কি অনুন্নত দেশগুলির স্বেচ্ছায় এমন কোনো পরিবর্তন করতে দেবে যাতে অনুন্নত দেশগুলির স্বাধীন পুঁজিবাদী দেশ হয়ে উৎপাদিকা শক্তির বিকাশ ঘটতে পারে?
অথচ পরম ছেলেখেলায় আমাদের তথাকথিত বামপন্থী বন্ধুরা মনে করে যে, দেশে কৃষি ব্যবস্থা সামন্ততান্ত্রিক বা প্রাক্‌-পুঁজিবাদী অবস্থায় রয়েছে, ফলে কর্পোরেটদের জমি লুণ্ঠন তাদের সামনে ‘আদিম সঞ্চয়ন’ হিসেবেই মনে হয়। তাই সামন্ততন্ত্র থেকে পুঁজিবাদে উত্তরণ ছাড়া সমাজতন্ত্রের লড়াই সম্ভব নয় বলে সিপিআই(এম) এর মতো দলগুলি সেই সিঙ্গুরে টাটার কারখানা প্রতিষ্ঠার মতো ঘটনাকে ‘আদিম সঞ্চয়ন’ হিসেবে চিহ্নিত করে তার পক্ষ নেয় নির্লজ্জভাবে। অসংখ্য সাম্রাজ্যবাদী প্রতিষ্ঠান ও নীতিমালায় আষ্টেপৃষ্ঠে বাধা একটি রাষ্ট্রযন্ত্রের মাধ্যমে পুঁজির এ হেন ‘আদিম সঞ্চয়ন’ তাদের কথার কথা নয় বরং তা সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন সহ এ দেশের প্রকৃত রাষ্ট্র চরিত্রকে আড়াল করে জনগণকে বোকা বানানোর খেলা। আশ্চর্য; শ্রমিকের শ্রমশক্তি শোষণ করে মুনাফা তৈরির পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক বিকাশের অবাধ প্রতিযোগিতার যুগ পেরিয়ে তার একচেটিয়া সাম্রাজ্যবাদী লগ্নিপুঁজির একাধিপত্যের যুগেও পুঁজির আদিম সঞ্চয়ণের এই উদ্ভট তত্ত্বের ব্যাখ্যা নিয়ে তাই তাদের কোনো দায়বদ্ধতা নেই। কোনো ব্যবস্থা প্রাক মুহুর্তে তার প্রতিপক্ষ ব্যবস্থায় যে উপায়ে শক্তি সঞ্চয় করে তার নিজেরই চরম বিকাশ ও ক্ষমতার যুগে সেই একই উপায়ের কথা কোনো নির্বোধও ভাবতে পারে কি? যখন কিনা শক্তি সঞ্চয়ণ তো দুরের কথা ইতিমধ্যে পুঁজি তার জাতীয় সীমানায় সাধারণ পুঁজিবাদী ধারায় পণ্য, মুনাফা, পুণর্বিনিয়োগের সীমা টপকে অতি মুনাফার প্রতিযোগিতামূলক স্তর পেরিয়ে গেছে। তার জাতীয় সীমানায় পুনর্বিনিয়োগের জায়গা না পেয়ে উৎপাদনি চরিত্র হারিয়ে আন্তর্জাতিক ভাবে আর্থিক ফাটকাবাজি সহ বাজার দখলে মড়িয়া একচেটিয়া লগ্নিপুঁজি হিসেবে সর্বত্র যুদ্ধ, ধ্বংস ও পুণর্গঠণের নোংরা ফ্যাসিবাদী হুমকি হয়ে উঠেছে, সাম্রাজ্যবাদের সেই যুগেও শক্তি হিসেবে পুঁজির আদিম সঞ্চয়ণের এমন উর্বর চিন্তা আরও আশ্চর্যের। আর ঢের বেশি আশ্চর্যজনক এর পরেও নাকি তারা লেনিনবাদী!
◆◆ কৃষিতে পুঁজির কাজ করার মার্কসবাদী শিক্ষাটা কি?
——————————————————————————
সাধারণত পুঁজিবাদী দেশে কৃষির ভীতের উপরেই পুঁজিবাদ জন্ম নিয়েছিল। কিন্তু পুঁজিবাদে ‘গড় মুনাফার’ হার মূল্য থেকে দামে বদলের নিয়মেই ফসলের দামেরও বাজার দর ঠিক হয়। ধরা যাক গড় মুনাফার হারের ভিত্তিতে সাধারণত ১ বিঘা জমিতে ৫০০ টাকা লগ্নিতে ১০০ কিলো চাল চাষে (শ্রমিকের মজুরী, অনাপেক্ষিক খাজনা এবং অন্যান্য উপায়-উপকরণে ব্যয়িত) ২৫ টাকা লাভ হলে, ১ বিঘা জমি থেকে ১০০ কিলো চালের দাম হবে ৫২৫ টাকা। ফলে সব অবস্থাতেই ১ বিঘা জমির উপর ৫০০ টাকা লগ্নি প্রতি ঐ লাভ বা জমির মালিকের অতিরিক্ত পাওনা ২৫ টাকা হলো আপেক্ষিক খাজনা। সামন্ততান্ত্রিক নিয়মে জমির ব্যাক্তি মালিকানার উপর যে খাজনা, তা হল অনাপেক্ষিক খাজনা। উপরের উদাহরণে দেখা যাচ্ছে যে জমির উর্বরতার তারতম্যের ভিত্তিতে ক্ষেত মজুরের শ্রমশক্তি নিয়োগে উদ্ভূত উদ্বৃত্তের একাংশ (গড় মুনাফার হার অনুযায়ী সামাজিকভাবে নির্ধারিত) যায় বিনিয়োগকারীর কাছে তার লাভ হিসেবে এবং বাকিটা জমির মালিকের কাছে যায় আপেক্ষিক খাজনা (উন্নত পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মূল্য থেকে দামে রূপান্তরিত উদ্বৃত্ত) হিসেবে। ফলে, পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় মালিক-শ্রমিক সম্পর্ক ছাড়াও বিনিয়োগকারী হিসেবে এক ত্রিমাত্রিক সম্পর্কের নিয়ম কাজ করে, যদিও তার জন্য তিনজন থাকাটাই আবশ্যক নয়। জমির মালিক নিজেই ক্ষেত মজুর, লগ্নিকারী আলাদা বা লগ্নিকারী ক্ষেত মজুর হিসেবে ন্যূনতম দুইজনের মাধ্যেও ঐ ত্রিমাত্রিক সম্পর্ক চলতে পারে। এই সূত্রর প্রাথমিক আবিষ্কারক রিকার্ডো। কিন্তু তিনি ঋতূ ও জমির উর্বরতার ভিন্নতার উপরে আপেক্ষিক খাজনার অস্তিত্ব নির্ভরশীল বলে ভুল করেন। মার্ক্সই প্রথম আপেক্ষিক খাজনার উৎস হিসেবে গড় মুনাফার হারের ভিত্তিতে মূল্য থেকে দামে রূপান্তরের পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক পদ্ধতিকে তুলে ধরেন।
◆◆ আধাউপনিবেশিক আমলাতান্ত্রিক দুর্বৃত্ত পুঁজির স্বরূপ:-
———————————————————————————-
ফলত এইরকম মার্কসবাদীদের কল্যাণে লক্ষ্যভ্রষ্ট সমাজতান্ত্রিক শিবিরের দুর্বলতার সুযোগে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সঙ্কট থেকে পার পেতে সাম্রাজ্যবাদের এযাবৎ সবচেয়ে বড় আগ্রাসন, বিশ্বায়ণের কর্মসূচি। দেশে দেশে হাট করে খুলে দেওয়া মুক্ত বাজার অর্থনীতির সামনে দুর্বল অর্থনৈতিক ক্ষেত্র ও সরকারি ক্ষেত্রের বিলগ্নীকরনে জনগণের জীবন জীবিকা সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়। যার ধারায় ১৯৯১ সালে উদার অর্থনীতির হাত ধরে আমাদের দেশে দুর্বৃত্ত পুঁজির (ক্রোনি ক্যাপিটাল) শুরু। বড় বড় দুর্নীতির শুরু সেই থেকেই। শুরু হয় লাভজনক সরকারি সংস্থা জলের দরে বেচে দেওয়া। যার গালভরা নাম হল— ডিসইনভেস্টমেন্ট বা বিলগ্নীকরণ। যদিও নরসিংহ রাওয়ের প্রধানমন্ত্রিত্বের সময়ে শুরু হওয়া এই বিলগ্নীকরণের হার বর্তমানে মোদী জমানায় (‌২০১৪–‌১৯)‌ সবকিছুকে ছাপিয়ে গেছে। কয়লা খাদান দুর্নীতি ‌৪৫ হাজার কোটি, ন্যাশনাল আরবান লাইভলিহুড মিশন কেলেঙ্কারি ‌১ হাজার কোটি, পিডিএস ঘোটালা ‌৩৬ হাজার কোটি, কেজি বেসিন কেলেঙ্কারি ‌২০ হাজার কোটি টাকা। এইসবেই লাভবান হয়েছেন সরকারের উঁচু পদে থাকা মুষ্টিমেয় লোকজন, সংশ্লিষ্ট দপ্তরের আমলারা ও অবশ্যই বড় শিল্পগোষ্ঠী। আর সরকারি ব্যাঙ্কে জমা সাধারণ মানুষের টাকার ক্ষতি হয়েছে সবথেকে বেশি। হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি। এই দুর্নীতিই অর্থনীতিতে ক্রোনি ক্যাপিটাল হিসেবে পরিচিত। যার একটা বড় অংশ দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর কোষাগারে চলে যায় এবং দলীয় কার্যকলাপ বিশেষ করে ভোটের সময় ব্যবহার হয়। একটা তথ্য এই দুর্নীতির পরিমাণ বুঝতে সাহায্য করবে। ২জি স্পেকট্রাম কেলেঙ্কারিতে সরকারি কোষাগারের ক্ষতির পরিমাণ ১ লক্ষ ৭৬ হাজার কোটি টাকা, যেখানে ২০১১ সালে শিক্ষার অধিকার আইন বাস্তবায়িত করতে পরবর্তী পাঁচ বছরে প্রয়োজন ছিল ১ লক্ষ ৭৫ হাজার কোটি টাকা। আগে বৃহৎ পুঁজির মালিকরা উচ্চপদস্ত সরকারী ব্যক্তিদের ঘুষ দিয়ে লাইসেন্স, কাজের বরাত ইত্যাদি দখল করত বা নিম্নমানের জিনিস সরবরাহ করত। এখন উদার অর্থনীতির যুগে পুরো নীতিটাই বিক্রি হয়ে যাচ্ছে সাম্রাজ্যবাদ আশ্রিত পুঁজিপতিদের স্বার্থে। যার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ব্যাংক কেলেঙ্কারি। অডিট ম্যানেজম্যেন্ট সংস্থা ডেলট্রী (Delott Touche Tomatsu) জানিয়েছে, গত দু’‌বছরে দেশে ব্যাঙ্ক জালিয়াতির পরিমাণ আগের তুলনায় ২০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। শুধুমাত্র ‘‌কিং অফ গুড টাইমস’‌ বিজয় মালিয়া নন, নীরব মোদির ব্যাঙ্ক জালিয়াতি ১১ হাজার ৫০০ কোটি;‌ মেহুল চোসকি‌র ২১৮ কোটি;‌ সন্দেসারা ভাইরা অন্ধ্র ব্যাঙ্কের ৫,৩৮৩ কোটি টাকা তছরুপ করেছেন। ‌ জাল নথিপত্র দিয়ে বড় বড় শিল্পপতিরা ব্যাঙ্ক থেকে টাকা নিয়ে যে জালিয়াতি করেছেন, তা মোট ব্যাঙ্ক জালিয়াতির ১৫ শতাংশ। ডেলট্টি ব্যাঙ্কিং ফ্রড সার্ভে ২০১৮ অনুযায়ী, মোদি প্রধানমন্ত্রী হয়েই একটি আর্থিক বছরে বিদেশের ব্যাঙ্কে টাকা পাঠানোর ঊর্ধ্বসীমা ৭৫ হাজার ডলার থেকে ২ লক্ষ ৫০ হাজার ডলার করলেন কার স্বার্থে?‌ বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ‌র কোম্পানির শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছে ১৬০০ গুণ!‌ আমেদাবাদে অমিত শাহর কো–অপারেটিভ ব্যাঙ্কে অর্থ সংগ্রহের পরিমাণ বেড়ে ছুঁয়েছে ১ হাজার কোটি টাকার বেশি। একই সঙ্গে বিজেপি’র আয় কোন জাদুবলে ৮১ শতাংশ বৃদ্ধি পায়?‌ পাশাপাশি ১৯৯৫ সাল থেকে আজ পর্যন্ত যে ৩ লক্ষাধিক কৃষক আত্মহত্যা করেছেন তার প্রবণতাও বর্তমান সরকারের আমলে ক্রমবর্ধমান যা আমরা আগেই দেখেছি। একদিকে যেমন সরকারি ব্যাঙ্ক থেকে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা উধাও ও বিভিন্নভাবে নয়ছয় হয়েছে, কৃষকের ঋণ মকুবে চূড়ান্ত আমলাতান্ত্রিক উদাসীনতা, কর্পোরেটদের ট্যাক্স ছাড়ে সরকারি উদারতা আর অন্যদিকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম সূচক জিডিপি’‌র হার ক্রমহ্রাসমান। এ ছাড়াও মুদ্রাস্ফীতি, ডলারের তুলনায় টাকার বিনিময় মূল্য হ্রাস, জ্বালানির আকাশছোঁয়া দাম অর্থনীতিতে গোদের ওপর বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। ডলারের তুলনায় টাকার দাম কমা সত্ত্বেও রপ্তানি কমেছে। রপ্তানি হ্রাসের সঙ্গে সঙ্গে বৈদেশিক বাণিজ্যে ঘাটতিতে বৈদেশিক মুদ্রায় ক্রমশ টান‌ অর্থনীতিতে বড় বিপদের সঙ্কেত দিচ্ছে। অথচ সরকার উদাসীন, বৃহৎ পুঁজির স্বার্থে নিরন্তর ঢাক পিটিয়ে চলেছে। ফুলেফেঁপে উঠছে ক্রোনি ক্যাপিটাল। এই সবই জনগণের বিপক্ষে সাম্রাজ্যবাদীদের প্রতি দায়বদ্ধ এই ব্যবস্থা ও তার আমলাতন্ত্র সহ দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনৈতিক নেতাদের দাসত্ব ও দালালিপনার নগ্ন নজির। ২০১৬ সালে হঠাৎ করে নোটবন্দি ও নগদ লেনদেনের জন্য সরকার এখনো সক্রিয়। দেশের ৫০ শতাংশ এটিএম (‌যদিও প্রত্যন্ত গ্রামে নেই, অন্যান্য স্থানেও প্রয়োজনের তুলনায় কম)‌ বন্ধ করে আবার পেটিএম, আবার মাস্টার বা ভিসা কার্ড ইত্যাদির মাধ্যমে ক্রয় বিক্রয় চালাতে চাইছে সরকার। আরবিআই জানাচ্ছে, এই লেনদেনে যুক্ত কোম্পানি প্রতিটা ১০০ টাকার লেনদেনে ১.৯৯ টাকা হাতিয়ে নেবে। হিসেব বলছে, এই নগদহীন লেনদেনে মোট জাতীয় উৎপাদনের ১০–‌১২ শতাংশ ওই কোম্পানিগুলির কাছে চলে যাবে। এই হিসেব আবার আমার আপনার মতো মানুষ করেননি, করেছেন প্ল্যানিং কমিশনের প্রাক্তন সচিব তথা অর্থনীতিবিদ প্রণব সেন। মোট অঙ্কটা ২০০–‌২৪০ বিলিয়ন ডলার বা ১৪–‌১৬.‌৮ লক্ষ কোটি টাকা!‌ এই টাকারই একটা অংশ ঘুরে রাজনৈতিক দলের তহবিল বা রাজনৈতিক ব্যক্তিদের পকেট ভরে তুলবে তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই। তথাকথিত আধুনিক দুনিয়ার বেহাল স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ফাঁস হয়ে বিশ্বজোড়া করোনা মহামারির অযুহাতে তথাকথিত লকডাউনের নামে সম্পূর্ণ উৎপাদন ব্যবস্থাকে আটকে দেওয়া সত্যিই কি মানুষের স্বাস্থ্য ও স্বার্থের কথা ভেবে? তবে কোন যাদু বলে সেই সংক্রমণের ঝুঁকি হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়ে এখন সব খুলে দেওয়া হচ্ছে? অথচ সেই লকডাউনের মধ্যেই রেল সংলগ্ন প্রত্যক্ষ প্রায় ১৬ লক্ষ হকার সহ কয়লা ও বহু সংস্থার বেসরকারিকরণের পথে হাজার হাজার জনগণকে বেরোজগার করার উদ্দেশ্যকে সাম্রাজ্যবাদী অতি উৎপাদনের সঙ্কটের সাময়িক মেরামতি ছাড়া আর অন্য কিছু বলে ভাবা যায় কি? সাধারণত গণচাপে বকেয়া সমস্ত গণ বিরোধী নীতিগুলি এই সুযোগে চালু হয়ে যাচ্ছে। আর এদের দ্বারাই কর্মসংস্থান আর শিল্পায়ণের অযুহাতে জল-জঙ্গল-জমি থেকে লক্ষ লক্ষ জনগণকে উচ্ছেদ করার রাষ্ট্রীয় নারকীয়তার রাজনীতিকে কি হিসেবে চিহ্নিত করা উচিৎ? এই হচ্ছে ভারত তথা ভারতীয় উপমহাদেশ সহ তথাকথিত বিকাশশীল দেশগুলির জল-জঙ্গল-জমি ও জনগণের জীবন জীবিকা নিয়ে ধ্বংসাত্বক শিল্পায়ণ ও উন্নয়নের সামান্য কিছু নমুনা। যার ধারাতেই ২০২০-র বাজেটে অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামণ কৃষিতে ব্যাপক কর্পোরেট বিনিয়োগের কথা বলেছে। এই কর্পোরেট বিনিয়োগটা কিরকম? কর্পোরেটরা জমির দাম বা অ্যাসেট প্রাইসকে শেয়ার বাজারের ফাটকায় লাগাতে উদ্যত। সেই কারণেই টাটারা সিঙ্গুরের দুই কিংবা তিন ফসলী জমিতেই কারখানা করার পরিকল্পনা করে। ১০০০ একরের ৬০০ একরে কারখানা করলেও বাকি ৪০০ একরে তারা রিয়াল এস্টেট-এর পরিকল্পনা করে। নিজেদের জমির আপেক্ষিক খাজনা বাড়ানোর জন্য তারা সরকারী উদ্যোগে হাইওয়ে বানিয়ে দেওয়ার দাবী রাখে। নন্দীগ্রামে অসংখ্য মানূষকে উচ্ছেদ করে ইন্দোনেশিয়ার সালেম গোষ্টির কেমিকেল হাবও সেই একই উদ্দেশ্যে পরিকল্পিত হয়েছিল। আমাদের জনগণের কর্ম সংস্থান বা চাহিদা পুরণের পরিপন্থী এই বিশাল পুঁজি নির্ভর ভারী উদ্যোগ কোন ধরনের শিল্পায়ন? কর্মসংস্থানের ভেল্কিতে কৃষিকাজ থেকে বিচ্ছিন্ন অল্প সংখ্যক লোককে কিছু দাম দিয়ে কোনোক্রমে টিকে থাকা অধিকাংশ গরীব কৃষকদের জীবন জীবিকা থেকে উচ্ছেদ করে সস্তা শ্রমের ক্রমবর্দ্ধমান বেকার বাহিনী তৈরি করে দেশকে সম্পূর্ণ পঙ্গু করা এর আসল লক্ষ্য। আর সেটা কাদের পক্ষে তা ইতিমধ্যে আমরা বুঝেছি বোধহয়। আসলে তা হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদী লগ্নি পুঁজির স্বার্থে এক কৃষিভিত্তিক দেশের উর্বর জমি নিয়ে ফাটকাবাজী পথে জমির আপেক্ষিক মুনাফা তৈরির বিকৃত উপায়। যাকে তথাকথিত বামেরা পুঁজিবাদী পদ্ধতি বলে চালাতে চেয়েছিল। আমাদের জনগণের ক্রয় ক্ষমতা অনুযায়ী এই ধরনের শিল্প পণ্যের বাজার ও তার ভবিষ্যৎ যে অন্ধকার তা বোঝার জন্যে পণ্ডিত হওয়ার দরকার পরেনা। অথচ বামপন্থীরা কেন তা বুঝলেন না! আসলে তাদের না বোঝার পিছনে ছিল ভোগবাদী সংস্কৃতির ধারক ও বাহক রাজনৈতিক সংস্কৃতি আশ্রিত সুবিধাভোগি নগন্য এক নব্য মধ্যবিত্তের সাধ ও সাধ্যের চাহিদা পূরণের নামে, তাদের নিষ্কৃয় করে এই তথাকথিত শিল্পায়ণের মাধ্যমে দেশের কৃষি নির্ভর সার্বভৌমত্বকে ধ্বংস করে দেশকে সাম্রাজ্যবাদের মুখাপেক্ষি বাজার করে তোলার এক গভীর চক্রান্ত। গণ নিবিড় এলাকায় কেমিকেল হাবের মতো বিধ্বংসী কর্মকাণ্ডের এই উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দেহ রাখাও দ্বিচারিতা। যখন কিনা টাটাদের ন্যানো গাড়ি শিল্পের পিছনে ইতালির ফিয়েদ কোম্পানি ও সালেম গোষ্টির পেছনে খোদ আমেরিকার মানুষের দ্বারা ধিকৃত কুখ্যাত ডাউ কেমিকেলের যোগসাজসের কথা ফাঁস হয়ে যায় সে সময়ের সংবাদপত্রে। টাটাদের উত্থানের ইতিহাস বলছে তারা চীনে আফিমের ব্যবসা, ইথিয়োপিয়ার যুদ্ধে বৃটিশ সৈনিকদের খাদ্য, পানীয় ও নারী সরবরাহ করে দালাল পুঁজিপতি হয়ে উঠে আসে। আর সালেমরা স্বৈরশাসক সুহার্তোর ইন্দোনেশীয় কমিউনিস্ট নিধনের কুখ্যাত দোসর। আর ভিয়েতমিন বিপ্লবীদের উপর ভয়ঙ্কর জ্বলন্ত নাপাম জেলির উদ্ভাবক কুখ্যাত ডাউ কোম্পানি ভোপালের গ্যাস লিক কান্ডে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু ও ভয়ঙ্কর অভিশপ্ত জীবনের দায় চাপিয়ে আইনকে কলা দেখিয়ে উচ্চ পদস্ত আমলা ও ক্ষমতাবান রাজনৈতিক নেতাদের দৌলতে পগাড় পার হয়ে গেছে। এই হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থে আমাদের দেশ ও তার মতো বিকাশশীল অনুন্নত দেশগুলির কায়েমী স্বার্থের রাজনীতির স্বরূপ। যা নিয়ে দেশ ও দেশবাসীর মঙ্গলের কথা ভাবা সাম্রাজ্যবাদের কাছে টিকি বাধা গণবিরোধী নরখাদকদের পক্ষেই সম্ভব।
◆◆ উপসংহার
———————————————————-
অতএব, সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থে ঐতিহাসিকভাবে গড়ে ওঠা এই বিকৃত ব্যবস্থার চুড়ান্ত বৈষম্যের সুযোগে সাধারণত প্রশাসন ও আমলাতন্ত্রের উপযোগী হিসেবে গড়ে ওঠার সুযোগ পায় যারা, এই ব্যবস্থা আষ্টেপৃষ্ঠে তাদেরই শ্রেণি স্বার্থের সহায়ক। সুতরাং সেই ব্যবস্থা ও তার প্রশাসন, আমলাতন্ত্র সহ প্রচলিত রাষ্ট্র কাঠামোকে অপরিবর্তিত রেখে তার কোনো উদ্যোগ, কোনো সংস্করই যে আসলে জনগণের ভালো করতে পারবেনা, তথাকথিত স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত ইতিহাস সেই সাক্ষীই দিচ্ছে। প্রকৃত গণ-প্রতিনিধিত্বের অনুপস্থিতিতে কৃষক সহ খেটে খাওয়া জনগণের সর্বত্র সামান্য সংস্কারের ফলও কিভাবে লুট হয়ে যাচ্ছে তা সাধারণ মানুষ মাত্রই জানে। বরং তা যে জনগণের অসহায়তার সামনে ক্ষমতাবান ও বহুজাতিক কর্পোরেটদের লাগামহীন লুন্ঠনের জন্য লেলিয়ে দেওয়া ছাড়া আর কিছুই নয় তা বলাই বাহুল্য। তার ধারায় এই কৃষি আইন-২০২০ ও আমাদের মতো গরীব দেশে কৃষকদের উন্নয়ন ও তথাকথিত ফরেদের হাত থেকে রক্ষার নামে কৃষি অর্থনীতির উপর নির্ভরশীল অধিকাংশ জনগনের জীবন জীবিকার সর্বনাশ হিসেবে সাব্যস্ত হবে। দিল্লীর বুকে চলমান কৃষক সংগ্রাম, যা ইতিমধ্যে সচ্ছল ও মাঝারী কৃষির সঙ্গে একচেটিয়া পুঁজির সংঘাত হিসেবে এই প্রথম গণ বিরোধী ভারতীয় ফেডারেলের কেন্দ্রকে ঘিরে ধরেছে, তা যথেষ্টই আশাব্যঞ্জক। তাকে সামগ্রিক সাফল্যের পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে না পারলে অচিরেই সারা দেশের জন্যই চুড়ান্ত সর্বনাশ হয়ে দেখা দেবে। তাই আমাদের মতো দেশগুলিতে প্রকৃত কৃষি ক্ষমতার অক্ষ তৈরি করে, তাদের উন্নয়ন ও ক্রয় ক্ষমতার গ্যারান্টি তৈরী করে, কৃষি সহ সমগ্র জনগণেরই সত্যিকারের বিকাশের রাস্তাতেই ঐ চলমান কৃষক সংগ্রামের সাফল্য সম্ভব। তাছাড়া হাজার মাথা ঠুকে মরলেও আর পাঁচটা বিশ্বাসঘাতকতার মতো একটা সাময়িক ধোকাই হবে এই সংগ্রামেরও করুণ পরিণতি। তাই দরকার সঠিক দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার দুর্বল পাঁজর ও ঘূণ ধরা চিন্তার বিরোধিতা করে আমাদের প্রকৃত চিন্তা ও রাজনৈতিক রাস্তায় হাটা।