সিলেট ১৫ই অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৩০শে আশ্বিন, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ১১:২১ পূর্বাহ্ণ, এপ্রিল ৭, ২০২১
০৭ এপ্রিল ২০২১: প্রেক্ষিত ভারতবর্ষঃ
ভারতবর্ষে অযোধ্যায় “বাবরি মসজিদ রামমন্দির” বিতর্ককে কেন্দ্র করে সারা ভারতব্যাপী যে মারাত্মক সাম্প্রদায়িক দাংগা হয়ে গেল। ভারতবর্ষে এমন দাংগা যে এই প্রথম তা নয়, ১৯৪৭ এর পরবর্তী অধ্যায়ে এদেশে হিন্দু মুসলমান বা বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে কেবল ধর্মীয় আবেগকে কেন্দ্র করে আঞ্চলিক ভিত্তিতে বা সমস্ত ভারতবর্ষব্যপী বেশ কয়েকটি দাঙ্গা হয়েছে।
বিশ্বব্যাপী দাঙ্গার ইতিবৃত্তঃ
শুধু ভারতবর্ষেই নয়, সমগ্র বিশ্বই এই কলঙ্কের হাত থেকে মুক্ত নয়। ১০৭৬ খৃষ্টাব্দে সেলজগুতুর্কিদের হাত থেকে জেরুজালেমের অধিকারের জন্য পোপ দ্বিতীয় আর্বান এভাবেই একক্রুসেড বা ধর্ম যুদ্ধের ডাক দিয়েছিলেন। ৬৫৬ খৃষ্টাব্দের পর ইসলাম ধর্মও ভাগ হয়েছিল শিয়াসুন্নি মতবাদে, সাম্প্রতিক কালের ইরাক ইরান যুদ্ধেও যার উপাদান মেলে। ইতিহাস প্রমাণ দেয়, সমস্ত ধর্মের নামে যদ্ধু আসলে মানুষের মধ্যে ধর্মীয় আবেগ সৃষ্টি করে ধর্মীয় নেতাদের ক্ষমতা সংহত করার চেষ্টা মাত্র। মধ্যযুগের ক্রুসেডের পরোক্ষ কারণ বিশ্লেষণ করলেই একথা বোঝা যায়। ঐতিহাসিকদের মতামত বিচার করলে দেখা যায় যে, সামন্ততান্ত্রিক ইউরোপের মানুষ বহু শ্রেণীতে বিভক্ত ছিল। সামন্ত জমিদারদের অনেকেই পুর্বের প্রতিপত্তি কিছুটা হারিয়ে, তাদের ভাগ্য পরিবর্তনের একটা বিরাট সুযোগ বলে মনে করেছিল। দরিদ্র শ্রেণীর অনেকে এই ধর্মযুদ্ধের সময় সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে সমাজে মর্যাদা পাবার এবং আর্থিক সুবিধা পাবার কথা ভাবত। ইতিহাসে দেখা যায়, ১০৯৫ খৃষ্টাব্দে প্রথম ক্রুসেডে অংশ নেওয়া এরকম প্রায় বিশ হাজার ক্ষুধিত মানুষ কেবল এই জাগতিক ক্ষুধা তৃষ্ণা আর সামন্ত প্রভুদের অত্যাচার থেকে মক্তিু ও স্বাধীনতার জন্য ক্রুসেডে অংশ নিয়েছিল। কিন্তু তারা সুখ ও শান্তি চেয়ে পেয়েছিল মত্যুৃ।
তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতাঃ
ধর্ম হচ্ছে প্রতিটি সমাজে হাজার বছর ধরে গড়ে ওঠা একটি চিন্তা ও তার অভিব্যক্তি। তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতা বা সেকুলারেজমের নাম করে, আমাদের মত দেশে যা বলা বা করা হয়, তা সবই হচ্ছে লোক দেখান ভাওতা। আর এ দেশের তথাকথিত বামপন্থীরাও পুঁজির সবধরণের প্রভুত্বের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ব্যতিরেকে, কেবল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির নাটক শুরু করে, ভারতবর্ষের শাসকশ্রেণীর তৈরি তথাকথিত সেই সেকুলারইজম-এর ছেঁড়া জুতো পায়ে দিয়েই রাজনৈতিকমঞ্চে হেঁটে বেড়াচ্ছে।
লেনিনের শিক্ষাঃ
ধর্মের সমস্ত ধরণের হুমকির বিরুদ্ধে যিনি ২০ মিলিয়ন মানুষের এক বিশাল দেশকে বেঁধেছিলেন শ্রমিক সম্প্রীতির ডোরে, সেই কমরেড লেনিন শিখিয়েছেন, “মেহনতী জনগণের সামাজিক দলিতাবস্থা, পুঁজিবাদের অন্ধশক্তির সামনে তাদের বাহ্যত পূর্ণ অসহায়তা, যদ্ধু , ভূমিকম্প ইত্যাদি সবকিছু অসাধারণ ঘটনার চেয়েও এই পুঁজিবাদ সাধারণ মেহনতী মানুষের ওপর প্রতিদিন, প্রতি ঘন্টায় হাজার গুণ বেশি ভয়ঙ্কর কষ্ট ও প্রচণ্ডতম যন্ত্রণা চাপিয়ে দিচ্ছে। এই হল ধর্মের গভীরতম সাম্প্রতিক শিকড়। তাই পুঁজিবাদের অন্ধ ধ্বংস শক্তির আধীনস্থ জনগণ যতদিন নিজেরাই সম্মিলিত, সংগঠিত, সুপরিকল্পিত ও সচেতনভাবে ধর্মের এই শিকড়ের বিরুদ্ধে, পুঁজির সবধরণের প্রভুত্বের বিরুদ্ধে লড়াই না করতে শিখছে, ততদিন কোন জ্ঞান-প্রচারণী পুস্তিকাতেই জনগণের মধ্যে থেকে ধর্মকে মোছা যাবে না”।
এ থেকে কি এই সিদ্ধান্ত দাঁড়ায় যে, ধর্মের বিরুদ্ধে কোন জ্ঞান-প্রচারণী পুস্তিকা ক্ষতিকর অথবা অবান্তর? নিশ্চয়ই তা নয়। বরং এর মানে হচ্ছে “সোশ্যাল ডেমোক্রাসির নিরীশ্বরবাদী প্রচারকে হতে হবে, তার মূল কর্তব্য অর্থাৎ শোষকদের বিরুদ্ধে শোষিত জনগণের শ্রেণীসংগ্রাম বৃদ্ধিরই অধীনস্থ”। এই মতবাদে যারা বিশ্বাসী আমরাও তাদের একজন। তাই প্রলেতারিয় শ্রেণী সংগ্রামের অগ্রগিতর সাথে সামঞ্জস্য রেখে, খুব সংক্ষেপে আমরা সনাতন হিন্দু ধর্মের উৎপত্তি ও বিবর্তন প্রসঙ্গে এই লেখায় আলোচনা করব।
ধর্ম কীঃ
আজ থেকে কোটি কোটি বছর আগেকার কথা, মানুষ তখন ছিল সম্পূর্ণ প্রকৃতি নির্ভর, বনের ফলমূল খেয়ে আর জীব-জন্তু শিকার করেই তারা জীবনধারণ করত, বড় বড় গাছের কোটর আর গুহায় তারা বসবাস করত। প্রকৃতির বহু সম্পদ ও রহস্য তখন পর্যন্ত ছিল তাদের অজানা।
জীবনধারণের সংগ্রামে প্রকৃতির কাছে বারবার বিপর্যস্ত হতে লাগল তারা। দুরন্ত ঘুর্ণিঝড়ের তাণ্ডবে আদিম মানব আর দৃশ্যমান পশু পাখি হত মৃত্যু ও গৃহহারা। গাছপালা ধ্বংসের ফলে খাদ্যের ভাণ্ডারে টান পড়তে লাগল তাদের। বজ্রপাতে জ্বলে যেতে লাগল তাদের গাছের কোটরের আশ্রয়স্থলগুলি। গাছে গাছে ঘর্ষণ সৃষ্ট দাবানলে নিশ্চিত মৃত্যুৃর বিভীষিকা দেখত তারা। আতঙ্কে দিশাহারা মানবেরা প্রাণ বাঁচাবার তাগিদে যখন ছুটে যেত গভীর জঙ্গলের বাইরের ফাঁকা নদী বা সমুদ্রের কিনারায় – ভয়ানক জলোচ্ছ্বাসে, সেখানেও মৃত্যুৃ হত তাদের। এছাড়াও প্রচণ্ড শীতে অর্ধ উলঙ্গ মানবদের পরিত্রাতা ছিল সূর্য কিরণ যা তাদের নগ্ন দেহগুলিকে উত্তাপ দিয়ে বাঁচিয়ে রাখত। এইভাবে প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল আদিম অনুন্নত মানব গোষ্ঠীগুলির মধ্যে অতিপ্রাকৃত ঈশ্বর ধারনার জন্ম হল। প্রকৃতির কাছে আদিম মানুষের এই ভয়মিশ্রিত আত্মসমর্পণের রূপ দেখি আমরা অগ্নি, বায়ু, বরুণ, পৃথিবী, সূর্য প্রভৃতি প্রাকৃতিক শক্তির উপর দেবত্ব আরোপের মাধ্যমে। দেবতা বা ধর্ম যেমন হাজার বছরের পুরাতন এক সংস্কৃতি তেমনি একথাও সত্য যে প্রতিটি বস্তু ও ঘটনার মত এরও একটা শুরু ও বিকাশের ইতিহাস আছে। তাই যে হিন্দু ধর্মকে সনাতন, সুপ্রাচীন, মহান প্রভৃতি বিশেষণে ভূষিত করা হয়েছে, আমরা বস্তুবাদীর চোখ দিয়েও জিজ্ঞাসার মন নিয়ে তাকে একটু বিশ্লেষণ করে দেখতে চাই।
হিন্দু ধর্মের উৎপত্তিঃ
বৈদিক আর্যরাই ভারতে প্রথম সভ্যতার আলো জ্বালিয়ে ছিলেন এবং ভারতের বর্তমান সভ্য জাতি ও গোষ্ঠীগুলি সবাই আর্যসন্তান, এ ধারনা ভুল। কারণ মহেঞ্জোদাড়ো ও হরপ্পার প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান প্রমাণ করেছে যে বৈদিক আর্যদের ভারতে আসার অনেক আগেই এবং যীশুখৃস্টের জন্মের হাজার তিনেক বছর আগেই ভারতবর্ষ সভ্যদেশ ছিল যে সভ্যতা বয়সে
মিশর ও সুমেরীয় সভ্যতার প্রায় সমসাময়িক এবং ঠিক এই দুই সভ্যতার মতই উন্নত। এদের হাজার দুই বছর পরে বৈদিক আর্যরা ভারতবর্ষে এসে বসতি স্থাপন করে। আর্যরা ছিলেন যাযাবর জাতি। তাঁরা লোহার ব্যবহার জানতেন এবং আরণ্যক ঘোড়াকে পোষ মানাতে শিখেছিলেন।
এই দুইয়ের সাহায্যে তারা উত্তরাপ দখল করে নেন। তখন সেখানকার অধিবাসীদের একঅংশ পালিয়ে যান পুর্ব ও দক্ষিণ ভারতে আর অপর অংশ উত্তরেই থেকে যান বিজয়ী আর্যদের দাস রূপে। পরবর্তীতে এঁরাই পরিচিত হন শুদ্রজাতি হিসাবে। বিজয়ী আর্যরা একদিকে যেমন অনার্যদের সভ্যতা, সংস্কৃতি প্রভতি ধ্বংস করে দিতে চেয়েছিল অন্য দিকে তেমনি বাস্তব কারণেই আর্য অনার্যদের মিলন গড়ে উঠেছিল। তাই দেখি অনার্য দেবতা ব্রহ্মা ও শিব, আর্যসমাজের পুজিত দেবতা হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছেন। এই ভাবেই এক সময় আর্য অনার্যদের সংমিশ্রণের মধ্যে দিয়ে হিন্দু ধর্মের উৎপত্তি হয়েছে।
হিন্দু ধর্ম ও সংস্কৃতিঃ
* আদিম শ্রেণীপূর্ব সমাজের যুগপৎ প্রকৃতিকে ভয় পাবার এবং তাকে পরাজিত করবার কাল্পনিক ইচ্ছা শক্তির ইন্দ্রজালের সংমিশ্রণের ধারাকে ধরেই শ্রেণী সমাজে বণিকশ্রেণীর স্বার্থে ধর্মের উৎপত্তি ও প্রসার হয়। হিন্দুধর্মও এর ব্যতিক্রম নয়। রাজা বা গোষ্টীপতির উপর দেবত্ব আরোপ এরই অঙ্গ।
* রাজনীতির উপরি কাঠামো হিসেবে শিল্প সংস্কৃতিও যুগে যুগে রাজনীতির সাথে পরিবর্তিত হয়েছে। চিরকালই সংস্কৃতির দুই ধারা লক্ষ্য করা যায়। একটা অন্ধবিশ্বাসের, অন্যটা স্বাধীন চিন্তার, প্রথমটা চায় মানতে আর দ্বিতীয়টা চায় জানতে।
* হিন্দু সংস্কৃতির মূলাধার বেদ এবং পুরাণেও এই দুই প্রস্তুতির টানাপোড়েন দেখতে পাওয়া যায়। গীতায় আছে “ওঁ তৎসিদিত নির্দেশা ব্রাহ্মণ ত্রিবিধ স্মৃতঃ। ব্রহ্মণাস্তের বেদাশ্চ যজ্ঞাশ্চ বিহিতাঃপুরা॥” (অর্থাৎ ওঁ তৎসহ, এই ত্রিশদ পরমাত্মার নাম, ইহাই শাস্ত্রে কথিত আছে। ইহার দ্বারাই ব্রহ্মা সৃষ্টির প্রথমে যজ্ঞকর্তা ব্রাহ্মণ ও যজ্ঞের হেতু বেদসৃষ্টি করেছিলেন।) কিন্তু ঈশ্বরের এই চরম আজ্ঞা হল “সর্বধর্মাণ্ পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্রজ॥”(প্রশ্ন কর’না, আমায় অনুসরণ কর)। কিন্তু বৈদিক যুগ থেকেই পৃথিবীর এই সৃষ্টি রহস্য অনেকে মানতে চাননি, মানতে চাননি ঈশ্বরকে বিশ্বের সৃষ্টি কর্তা রূপে। তাই দেখি গীতায় কৃষ্ণকে খেদ ভরে বলতে হয়েছে “অসত্যম প্রতিষ্ঠং তে জগদাহুরণীশ্বরম্। অপরস্পর সম্ভূতং কিমন্যং কাম হৈতুকম্॥” {তাহারা (অসুর) বলে যে এই জগৎ মিথ্যা। ইহার কোন ধর্ম বা অধর্ম নেই, কোন ঈশ্বর নাই। স্ত্রী পুরুষের মিলনে ইহার সৃষ্টি হইয়াছে}।
দেবতাঃ
বেদের অসদ্ সূক্তে মানুষ প্রশ্ন করেছেঃ এই সৃষ্টির আদি কি, অন্য কি? “সে আঙ্গ বেদ, ইয়াদিইয়্যান বেদ” বেদ সম্ভবত তা জানে কিংবা জানে না। এই যে সংশয়বাদিতা তা ক্রমাণ্যয়েসাংখ্য এবং লোকায়ত দর্শনের মাধ্যমে বিকশিত হল ও শেষ পর্যন্ত সমস্ত সংস্কার এমন কি ঈশ্বরের অস্তিত্বকেই চ্যালেঞ্জ জানাল। কখনও কখনও অন্ধ সংস্কার বিশ্বাস প্রবল হয়েছে। কখনও হয়েছে যুক্তির জয়। কখনও চেষ্টা হয়েছে এই দুয়ের মাঝামাঝি মীমাংসায়। এই ভাবেই লোকায়ত দর্শন, কপিলের সংখ্যা, চার্বাক দর্শন, কনাদের বিজ্ঞান, আর্যভট্টের জ্যোতির্বিজ্ঞান, সুশ্রুতের শল্য চিকিৎসা মানব সভ্যতার প্রথম সারিতে ভারতবর্ষকে দাঁড় করিয়েছিল। আবার পরবর্তী পুরন, অদৃষ্টবাদ, তন্ত্রবাদ মুক্ত চিন্তার গলাটিপে ভারতীয় সমাজকে পিছু হটিয়ে দেয়।
মানবের মানসলোকই প্রথম ঈশ্বরের জন্ম দেয়। তাকে কেউ বলেছে ভগবান, কেউ আল্লা, কেউ বা গড। পৃথিবীর সব দেশেই মানুষ তাদের ঈশ্বর দেবদেবীর মূর্তি কল্পনা করে। সেগুলিও তারা করেছে নিজেদের মন থেকেই। প্রাণী জগতের মধ্যে মানুষের মস্তিষ্ক, চিন্তা করার ক্ষমতাও সূক্ষ্ম কাজ করার দক্ষতা সবচেয়ে বেশী। তাই তাদের কল্পনাকে তারা বাস্তবে রূপ দিতে পেরেছে। যদি বানর, ঘোড়া বা সিংহের হাত থাকত এবং মানুষের
(চলবে)
সংগ্রহ ও সম্পাদনাঃ
হাফিজ সরকার
তথ্যসূত্রঃ
অমর ভট্টাচার্য
সম্পাদক : সৈয়দ আমিরুজ্জামান
ইমেইল : rpnewsbd@gmail.com
মোবাইল +8801716599589
৩১/এফ, তোপখানা রোড, ঢাকা-১০০০।
© RP News 24.com 2013-2020
Design and developed by ওয়েব নেষ্ট বিডি