সিলেট ১লা জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ১৭ই আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ২:৫০ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ৭, ২০২৩
বিশেষ প্রতিনিধি | ঢাকা, ০৭ জানুয়ারি ২০২৩ : বিগত এক বছরে দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৬৮২৯টি। এসব দুর্ঘটনায় নিহত ৭৭১৩ জন এবং আহত ১২,৬১৫ জন। নিহতের মধ্যে নারী ১০৬১, শিশু ১১৪৩। ২৯৭৩টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত ৩০৯১ জন, যা মোট নিহতের ৪০.০৭ শতাংশ। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার হার ৪৩.৫৩ শতাংশ। দুর্ঘটনায় ১৬২৭ জন পথচারী নিহত হয়েছে, যা মোট নিহতের ২১.০৯ শতাংশ। যানবাহনের চালক ও সহকারী নিহত হয়েছেন ১৬৪৮ জন, অর্থাৎ ২১.৩৬ শতাংশ।
এই সময়ে ১৯৭টি নৌ-দুর্ঘটনায় ৩১৯ জন নিহত, ৭৩ জন আহত এবং ৯২ জন নিখোঁজ রয়েছে। ৩৫৪ টি রেলপথ দুর্ঘটনায় ৩২৬ জন নিহত এবং ১১৩ জন আহত হয়েছে।
শনিবার (৭ জানুয়ারি ২০২৩) সকাল সাড়ে ১১টায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনি মিলনায়তনে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন এক সংবাদ সম্মেলনে ২০২২ সালের সড়ক দুর্ঘটনার বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ ও পর্যালোচনা করে। এ প্রতিবেদনে উপরোক্ত তথ্য প্রকাশ পায়। সংবাদ সম্মেলনে সড়ক দুর্ঘটনার বার্ষিক এ প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. এ আই মাহবুব উদ্দিন আহমেদ।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশন ৯টি জাতীয় দৈনিক, ৭টি অনলাইন নিউজ পোর্টাল এবং ইলেক্টনিক গণমাধ্যমের তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে।
দুর্ঘটনার যানবাহনভিত্তিক নিহতের চিত্র:
দুর্ঘটনায় যানবাহনভিত্তিক নিহতের পরিসংখ্যানে দেখা যায়- মোটরসাইকেল চালক ও আরোহী ৩০৯১ জন (৪০.০৭%), বাস যাত্রী ৪২৭ জন (৫.৫৩%), ট্রাক-পিকআপ-কাভার্ডভ্যান-ট্রাক্টর-ট্রলি-লরি আরোহী ৪৫৩ জন (৫.৮৭%), প্রাইভেটকার-মাইক্রোবাস-অ্যাম্বুলেন্স-জীপ যাত্রী ২৬৮ জন (৩.৪৭%), থ্রি-হুইলার যাত্রী (ইজিবাইক-সিএনজি-অটোরিকশা-অটোভ্যান-মিশুক-টেম্পু-লেগুনা) ১২৪৮ জন (১৬.১৮%), স্থানীয়ভাবে তৈরি যানবাহনের যাত্রী (নসিমন-ভটভটি-আলমসাধু-পাখিভ্যান-চান্দের গাড়ি-বোরাক-মাহিন্দ্র-টমটম) ৩৯৩ জন (৫.০৯%) এবং বাইসাইকেল-প্যাডেল রিকশা-রিকশাভ্যান আরোহী ২০৬ জন (২.৬৭%) নিহত হয়েছে।
দুর্ঘটনা সংঘটিত সড়কের ধরন:
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ বলছে, দুর্ঘটনাগুলোর মধ্যে ২৫৯৬টি (৩৮%) জাতীয় মহাসড়কে, ২২০৫টি (৩২.২৮%) আঞ্চলিক সড়কে, ১১৮২টি (১৭.৩০%) গ্রামীণ সড়কে, ৭৮৪টি (১১.৪৮%) শহরের সড়কে এবং অন্যান্য স্থানে ৬২টি (০.৯০%) সংঘটিত হয়েছে।
দুর্ঘটনার ধরন:
দুর্ঘটনাসমূহের ১৩৩১টি (১৯.৪৯%) মুখোমুখি সংঘর্ষ, ২৮৯২টি (৪২.৩৪%) নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে, ১৬৪৮টি (২৪.১৩%) পথচারীকে চাপা/ধাক্কা দেয়া, ৭৮৫টি (১১.৪৯%) যানবাহনের পেছনে আঘাত করা এবং ১৭৩টি (২.৫৩%) অন্যান্য কারণে ঘটেছে।
দুর্ঘটনায় সম্পৃক্ত যানবাহন:
দুর্ঘটনায় সম্পৃক্ত যানবাহনের মধ্যে ট্রাক-পিকআপ-কাভার্ডভ্যান-ড্রামট্রাক ২৫.৪০ শতাংশ, ট্রাক্টর-ট্রলি-লরি তেলবাহী ট্যাংকার, লং ভেহিকেল, বিদ্যুতের খুটিবাহী ট্রাক, কার্গো ট্রাক, সিটি করপোরেশনের ময়লাবাহী ট্রাক ৪.৬৮ শতাংশ, মাইক্রোবাস-প্রাইভেটকার-অ্যাম্বুলেন্স, পাজেরো জীপ, পুলিশ ও র্যাবের পিকআপ, প্রিজনভ্যান, বিজিবি ট্রাক-আর্মি ট্রাক ৫.১১ শতাংশ, যাত্রীবাহী বাস ১২.৩১ শতাংশ, মোটরসাইকেল ২৬.৫৪ শতাংশ, থ্রি-হুইলার (ইজিবাইক-সিএনজি-অটোরিকশা-অটোভ্যান-মিশুক-লেগুনা-টেম্পু) ১৫.৪৪ শতাংশ, স্থানীয়ভাবে তৈরি যানবাহন (নসিমন-করিমন-ভটভটি-আলমসাধু-পাখিভ্যান-মাহিন্দ্র-টমটম-চান্দের গাড়ি) ৬.৪০ শতাংশ, বাইসাইকেল-প্যাডেল রিকশা-রিকশাভ্যান ৩.১৯ শতাংশ এবং অন্যান্য মোটরযান ০.৮৯ শতাংশ (নির্মাণ সামগ্রী মিকচার মেশিন গাড়ি, এক্সাভেটর মেশিন গাড়ি, রেকার, ডাম্পার- ভেম্পার, পাওয়ারটিলার, মাটি কাটার ট্রাক্টর, ইটভাঙ্গার মেশিন গাড়ি ইত্যাদি)।
দুর্ঘটনায় সম্পৃক্ত যানবাহনের সংখ্যা:
দুর্ঘটনায় সম্পৃক্ত যানবাহনের সংখ্যা ১২,২২৯টি। (ট্রাক ২১২৪, বাস ১৫০৬, কাভার্ডভ্যান ৩২৮, পিকআপ ৫৫১, ট্রলি ১৯৮, লরি ১৪৪, ট্রাক্টর ১৯৫, ড্রাম ট্রাক ১০৪, মাইক্রোবাস ২২১, প্রাইভেটকার ২৬৮, অ্যাম্বুলেন্স ৮৭, পাজেরো জীপ ২৩, মোটরসাইকেল ৩২৪৬, পুলিশ ও র্যাবের পিকআপ ১৭, প্রিজনভ্যান ৬, বিজিবি ট্রাক ১, আর্মি ট্রাক ২, তেলবাহী ট্যাংকার ১৯, লং ভেহিকেল ১, বিদ্যুতের খুটিবাহী ট্রাক ৯, কার্গো ট্রাক ১, সিটি করপোরেশনের ময়লাবাহী ট্রাক ৬, থ্রি-হুইলার ১৮৮৯ (ইজিবাইক-সিএনজি-অটোরিকশা-অটোভ্যান-মিশুক-লেগুনা-টেম্পু), স্থানীয়ভাবে তৈরি যানবাহন ৭৮৩ (নসিমন-ভটভটি-আলমসাধু- পাখিভ্যান-মাহিন্দ্র-টমটম-চান্দের গাড়ি), বাইসাইকেল-প্যাডেল রিকশা-রিকশাভ্যান ৩৯১ এবং অন্যান্য মোটরযান ১০৯টি (মিকচার মেশিন গাড়ি, এক্সাভেটর মেশিন গাড়ি, রেকার, ডাম্পার- ভেম্পার, পাওয়ারটিলার, মাটি কাটার ট্রাক্টর, ইটভাঙ্গার মেশিন গাড়ি)।
দুর্ঘটনার সময় বিশ্লেষণ:
সময় বিশ্লেষণে দেখা যায়, দুর্ঘটনাসমূহ ঘটেছে ভোরে ৩৭৬টি (৫.৫০%), সকালে ২০৩৩টি (২৯.৭৭%), দুপুরে ১৪০২টি (২০.৫৩%), বিকালে ১১৪৬টি (১৬.৭৮%), সন্ধ্যায় ৫৯৯টি (৮.৭৭%) এবং রাতে ১২৭৩টি (১৮.৬৪%)।
দুর্ঘটনার বিভাগওয়ারী পরিসংখ্যান:
দুর্ঘটনার বিভাগওয়ারী পরিসংখ্যান বলছে, ঢাকা বিভাগে দুর্ঘটনা ২৬.৯৫%, প্রাণহানি ২৬.৫০%, রাজশাহী বিভাগে দুর্ঘটনা ১৫.১৫%, প্রাণহানি ১৫.০৫%, চট্টগ্রাম বিভাগে দুর্ঘটনা ২০.১২%, প্রাণহানি ২০.০৪%, খুলনা বিভাগে দুর্ঘটনা ১২.৫৭%, প্রাণহানি ১১.৭৭%, বরিশাল বিভাগে দুর্ঘটনা ৬.২৯%, প্রাণহানি ৬.৬২%, সিলেট বিভাগে দুর্ঘটনা ৪.৫৮%, প্রাণহানি ৪.৮৬%, রংপুর বিভাগে দুর্ঘটনা ৮%, প্রাণহানি ৮.৬৪% এবং ময়মনসিংহ বিভাগে দুর্ঘটনা ৬.৩১%, প্রাণহানি ৬.৪৫% ঘটেছে।
ঢাকা বিভাগে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটেছে। ১৮৪১ টি দুর্ঘটনায় নিহত ২০৪৪ জন। সবচেয়ে কম সিলেট বিভাগে। ৩১৩ টি দুর্ঘটনায় নিহত ৩৭৫ জন।
রেল ক্রসিং দুর্ঘটনা:
সারা দেশে ৮২ শতাংশ রেল ক্রসিং অরক্ষিত। গত বছরে এসব রেল ক্রসিংয়ে ৫১টি দুর্ঘটনায় ৭৯ জন নিহত হয়েছে। বাকি ৩০৩টি দুর্ঘটনা ঘটেছে রেল ট্র্যাকে ও ট্রেন থেকে পড়ে যেয়ে। এসব দুর্ঘটনায় ২৪৭ জনের প্রাণহানি হয়েছে। সবগুলো ঘটনা-ই দায়িত্বহীনতা ও অসচেতনতার কারণে ঘটেছে। (মোট ৩৫৪টি রেলপথ দুর্ঘটনায় ৩২৬ জন নিহত এবং ১১৩ জন আহত হয়েছে)।
সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের পরিচিতি:
গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায়, নিহতদের মধ্যে পুলিশ সদস্য ৬৩ জন, সেনা সদস্য ৭ জন, বিমান বাহিনী সদস্য ২ জন, নৌ-বাহিনী সদস্য ২ জন, র্যাব সদস্য ৪ জন, বিজিবি সদস্য ৭ জন, এনএসআই সদস্য ২ জন, ফায়্যার সার্ভিস সদস্য ৩ জন, আনসার সদস্য ৫ জন, স্কুল-কলেজ-মাদরাসা ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ১৮৯ জন, পরমাণু শক্তি কমিশনের বিজ্ঞানী ২ জন, বিএডিসি’র যুগ্ম পরিচালক ১ জন, চিকিৎসক ৩৩ জন, স্বাস্থ্যকর্মী ১৩ জন, প্রকৌশলী ২৭ জন, আইনজীবী ৩১ জন, সাংবাদিক ৪৪ জন, ব্যাংক কর্মকর্তা-কর্মচারী ১০৬ জন, এনজিও কর্মকর্তা-কর্মচারী ১৪৭ জন, কারারক্ষী ২ জন, পোশাক শ্রমিক ৯৮ জন, নির্মাণ শ্রমিক ৪২ জন, ইটভাটা শ্রমিক ২১ জন, ধানকাটা শ্রমিক ৩২ জন, মাটি কাটা শ্রমিক ৯ জন, রাজমিস্ত্রি ১৪ জন, কাঠমিস্ত্রি ১৩ জন, রংমিস্ত্রি ১১ জন, রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রের শ্রমিক ৭ জন, সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মী ২ জন, মানসিক ও শারীরিক প্রতিবন্ধী ৩৭ জন, ঔষধ ও বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী বিক্রয় প্রতিনিধি ২৮৭ জন, স্থানীয় পর্যায়ের বিভিন্ন ব্যবসায়ী ৩৮৪ জন, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ১৬৯ জন এবং দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ১২৩৭ জন শিক্ষার্থী নিহত হয়েছে।
সড়ক দুর্ঘটনা বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা:
২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে দুর্ঘটনা বেড়েছে ০.৮৯ শতাংশ, প্রাণহানি বেড়েছে ৪.২২ শতাংশ এবং আহত বেড়েছে ৩.৮৮ শতাংশ। ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে দুর্ঘটনা বেড়েছে ১৩.৪৩ শতাংশ, প্রাণহানি বেড়েছে ১৫.৭০ শতাংশ এবং আহত বেড়েছে ১.২০ শতাংশ। ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে দুর্ঘটনা বেড়েছে ২৭.১৪ শতাংশ, প্রাণহানি বেড়েছে ২২.৭৪ শতাংশ এবং আহত বেড়েছে ৬৮.৯২ শতাংশ। অর্থাৎ গত ৪ বছরের মধ্যে ২০২২ সালে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির মাত্রা সর্বোচ্চ।
বছর দুর্ঘটনা নিহত আহত
২০১৯ ৪৬৯৩টি ৫২১১ ৭১০৩ জন
২০২০ ৪৭৩৫টি ৫৪৩১ ৭৩৭৯ জন
২০২১ ৫৩৭১টি ৬২৮৪ ৭৪৬৮ জন
২০২২ ৬৮২৯টি ৭৭১৩ ১২,৬১৫ জন
উল্লেখ্য ২০১৯, ২০২০, ২০২১ এবং ২০২২ এই ৪ বছরে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ছাড়া অন্যান্য দুর্ঘটনা এবং প্রাণহানির সংখ্যা প্রায় সমান। খুব কম-বেশি হয়নি। মূলত ক্রমবর্ধমান মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির কারণেই ২০২০, ২০২১ এবং ২০২২ সালের দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির মোট সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে।
মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার তুলনামূলক চিত্র:
বছর দুর্ঘটনা নিহত
২০১৯ ১১৮৯টি ৯৪৫ জন
২০২০ ১৩৮১টি ১৪৬৩ জন
২০২১ ২০৭৮টি ২২১৪ জন
২০২২ ২৯৭৩টি ৩০৯১ জন
২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বেড়েছে ১৬.১৪ শতাংশ এবং প্রাণহানি বেড়েছে ৫৪.৮১ শতাংশ। ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বেড়েছে ৫০.৪৭ শতাংশ এবং প্রাণহানি বেড়েছে ৫১.৩৩ শতাংশ। ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বেড়েছে ৪৩.০৭ শতাংশ এবং প্রাণহানি বেড়েছে ৩৯.৬১ শতাংশ।
২০২২ সালের মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার বিশ্লেষণ:
২০২২ সালে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ঘটেছে ২৯৭৩টি, নিহত হয়েছে ৩০৯১ জন এবং আহত ২১৫৪ জন। নিহতের মধ্যে ৭৬.৪১ শতাংশ ১৪ থেকে ৪৫ বছর বয়সী।
অন্য যানবাহনের সাথে মোটরসাইকেলের মুখোমুখি সংঘর্ষ ঘটেছে ২১.২৬%, মোটরসাইকেল নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুর্ঘটনা ঘটেছে ৩২.২২%, মোটরসাইকেলে ভারী যানবাহনের চাপা ও ধাক্কা দেয়ার ঘটনা ঘটেছে ৪৪.৮৭% এবং অন্যান্য কারণে দুর্ঘটনা ঘটেছে ১.৬৫%।
৩৮.৩১% দুর্ঘটনার জন্য মোটরসাইকেল চালক এককভাবে দায়ী ছিল। দুর্ঘটনার জন্য বাসের চালক দায়ী ১১.৯৭%, ট্রাক চালক দায়ী ২৯.১৬%, কাভার্ডভ্যান-পিকআপ-ট্রাক্টর-ট্রলি-লরি-ট্যাংকার চালক দায়ী ৯.১১%, প্রাইভেটকার-মাইক্রোবাস চালক দায়ী ২.৮৪%, থ্রি-হুইলার ৩.৬৭%, বাইসাইকেল, প্যাডেল রিকশা, রিকশাভ্যান চালক দায়ী ০.৯৪%, পথচারী দায়ী ৩.৫৬% এবং অন্যান্য কারণ দায়ী ০.৪৩%।
৩২.৩৫% মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ঘটেছে জাতীয় মহাসড়কে, ৪১.১৩% ঘটেছে আঞ্চলিক সড়কে, ১৫.২৮% ঘটেছে গ্রামীণ সড়কে এবং ১১.২৪% দুর্ঘটনা ঘটেছে শহরের সড়কে।
মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি বৃদ্ধির পেছনে অনেকগুলো কারণ কাজ করেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, মোটরসাইকেল চালকদের বিরাট অংশ কিশোর ও যুবক। এদের মধ্যে ট্রাফিক আইন না জানা এবং না মানার বিষয়টি প্রবল। কিশোর-যুবকরা বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালিয়ে নিজেরা দুর্ঘটনায় আক্রান্ত হচ্ছে এবং অন্যদেরকে আক্রান্ত করছে।
দেশে দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতির পৃষ্ঠপোষকতায় মোটসাইকেল সংস্কৃতি চরমভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব মোটসাইকেল চালক সড়ক-মহাসড়কে বেপরোয়াভাবে চলাচল করছে। এদের বেপরোয়া মোটরসাইকেলের ধাক্কায় পথচারী নিহতের ঘটনাও বাড়ছে।
মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার একটি ব্যাপক অংশ ঘটছে ট্রাক, কাভার্ডভ্যান, পিকআপ ও বাসের ধাক্কা, চাপা এবং মুখোমুখি সংঘর্ষে। এসব দ্রুত গতির যানবাহনের চালকদের অধিকাংশই অদক্ষ ও অসুস্থ। তাদের বেপরোয়াভাবে যানবাহন চালানোর ফলে যারা সাবধানে মোটরসাইকেল চালাচ্ছেন তারাও দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন।
মোটরসাইকেল ৪ চাকার যানবাহনের তুলনায় ৩০ গুণ বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু দেশে গণপরিবহন ব্যবস্থা উন্নত ও সহজলভ্য না হওয়া এবং যানজটের কারণে মানুষ মোটরসাইকেল ব্যবহারে উৎসাহিত হচ্ছে এবং দুর্ঘটনা বাড়ছে।
পথচারী নিহতের দুর্ঘটনা বিশ্লেষণ:
২০২২ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় ১৬২৭ জন পথচারী নিহত হয়েছে। রাস্তায় হাঁটার সময় দুর্ঘটনা ঘটেছে ৪৮.৭৪ শতাংশ এবং রাস্তা পারাপারের সময় ঘটেছে ৫১.২৫ শতাংশ। ৫৯.৭৮ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটেছে যানবাহনের বেপরোয়া গতির কারণে এবং ৪০.২১ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটেছে পথচারীদের অসতর্কতার কারণে।
পথচারী নিহতের ঘটনা মহাসড়কে ২৩.৬০%, আঞ্চলিক সড়কে ৩২.১৪%, গ্রামীণ সড়কে ২৫.৩৩%, শহরের সড়কে ১৮.২৬% এবং অন্যান্য স্থানে ঘটেছে ০.৬৭%।
দুর্ঘটনায় পথচারী নিহতের ঘটনা ভোরে ২.৯%, সকালে ২৯.৩৬%, দুপুরে ১৯.৫%, বিকালে ২৩.১১%, সন্ধ্যায় ১০.৩৯% এবং রাতে ১৪.৭৩% ঘটেছে।
পথচারী হিসেবে ৩ থেকে ১১ বছর বয়সী ৪৭৯টি শিশু নিহত হয়েছে। স্কুলে যাওয়া-আসার পথে, বাড়ির নিকটে খেলাধুলা ও রাস্তা পারাপারের সময় এরা যানবাহনের চাপা/ধাক্কায় নিহত হয়েছে।
যানবাহনের অতিরিক্ত গতি, সড়কের সাইন-মার্কিং-জেব্রা ক্রসিং চালক এবং পথচারীদের না জানা ও না মানার প্রবণতা, যথাস্থানে সঠিকভাবে ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ না করা এবং ব্যবহার উপযোগী না থাকা, রাস্তায় হাঁটা ও পারাপারের সময় মোবাইল ফোনে কথা বলা, হেডফোনে গান শোনা, চ্যাটিং করা এবং সড়ক ঘেঁষে বসতবাড়ি নির্মাণ ও সড়কের উপরে হাট-বাজার গড়ে উঠা ইত্যাদি কারণে পথচারী নিহতের ঘটনা বাড়ছে।
রাজধানীর সড়ক দুর্ঘটনা বিশ্লেষণ:
রাজধানীতে ২৫৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২৪৬ জন নিহত এবং ২২৭ জন আহত হয়েছে। নিহতদের মধ্যে পথচারী ৬০.৫৩%। মোটরসাইকেল আরোহী ২৬.৪৯% এবং বাস, রিকশা, বাইসাইকেল ইত্যাদির আরোহী ১২.৯৭%। গত বছরের তুলনায় রাজধানীতে দুর্ঘটনা বেড়েছে ৯৭.৭০% এবং প্রাণহানি বেড়েছে ৭৯.৫৬%।
রাজধানীতে যানবাহনের চাপায়-ধাক্কায় পথচারী বেশি হতাহত হয়েছে। এসব দুর্ঘটনা রাতে এবং ভোরে বেশি ঘটেছে। বাইপাস রোড না থাকার কারণে রাত ১০টা থেকে ভোর পর্যন্ত রাজধানীতে মালবাহী ভারী যানবাহন বেপরোয়া গতিতে চলাচল করে। ফলে রাস্তা পারাপারে পথচারীরা নিহত হচ্ছে। এছাড়া দীর্ঘ সময় যানজটের কারণে যানবাহন চালকদের আচরণে অসহিষ্ণুতা ও ধৈর্য্যহানি ঘটছে, যা সড়ক দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে কাজ করছে। ফলে সকালে কর্মস্থলে যাবার সময় বেশি দুর্ঘটনা ঘটছে। রাজধানীতে দুর্ঘটনার সময়চিত্র দেখলে বিষয়টি বুঝা যাবে। ভোরে ২১.৬২%, সকালে ১৭.৩১%, দুপুরে ১০.১৬%, বিকালে ১১.৯৭%, সন্ধ্যায় ৪.৮০% এবং রাতে ৩৪.১৩% দুর্ঘটনা ঘটেছে। রাজধানীতে যানবাহনের তুলনায় অপ্রতুল সড়ক, একই সড়কে যান্ত্রিক-অযান্ত্রিক, স্বল্প ও দ্রুত গতির যানবাহনের চলাচল, ফুটপাত হকারের দখলে থাকা, ফুটওভার ব্রিজ যথাস্থানে নির্মাণ না হওয়া ও ব্যবহার উপযোগী না থাকা এবং সড়ক ব্যবহারকারীদের মধ্যে অসচেতনতার কারণে অতিমাত্রায় দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটছে।
সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণসমূহ:
১. ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন; ২. বেপরোয়া গতি; ৩. চালকদের অদক্ষতা ও শারীরিক-মানসিক অসুস্থতা; ৪. চালকদের বেতন-কর্মঘন্টা নির্দিষ্ট না থাকা; ৫. মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন চলাচল; ৬. তরুণ-যুবদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানো; ৭. জনসাধারণের মধ্যে ট্রাফিক আইন না জানা ও না মানার প্রবণতা; ৮. দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা; ৯. বিআরটিএ’র সক্ষমতার ঘাটতি; ১০. গণপরিবহন খাতে চাঁদাবাজি।
সুপারিশসমূহ:
১. দক্ষ চালক তৈরির উদ্যোগ বৃদ্ধি করতে হবে; ২. চালকদের বেতন-কর্মঘন্টা নির্দিষ্ট করতে হবে; ৩. বিআরটিএ’র সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে; ৪. পরিবহন মালিক-শ্রমিক, যাত্রী ও পথচারীদের প্রতি ট্রাফিক আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে; ৫. মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন বন্ধ করে এগুলোর জন্য আলাদা রাস্তা (সার্ভিস লেন) তৈরি করতে হবে; ৬. পর্যায়ক্রমে সকল মহাসড়কে রোড ডিভাইডার নির্মাণ করতে হবে; ৭. গণপরিবহনে চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে; ৮. রেল ও নৌ-পথ সংস্কার করে সড়ক পথের উপর চাপ কমাতে হবে; ৯. টেকসই পরিবহন কৌশল প্রণয়ন করতে হবে; ১০. “সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮” বাধাহীনভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।
দেশে যথেষ্ট উন্নত সড়ক অবকাঠামো তৈরি হয়েছে। ফলে নানা প্রকার যানবাহন যেমন বেড়েছে, তেমনি যানবাহনের গতিও বেড়েছে। কিন্তু গতি নিয়ন্ত্রণে কর্তৃপক্ষের প্রযুক্তিগত সক্ষমতার অভাব বা প্রযুক্তি ব্যবহারে অনিচ্ছার কারণে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি বাড়ছে।
২০২২ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় যে পরিমাণ মানব সম্পদের ক্ষতি হয়েছে তার আর্থিক মূল্য ১৮ হাজার ৪৬ কোটি টাকার মতো। যেহেতু সড়ক দুর্ঘটনার অনেক তথ্য অপ্রকাশিত থাকে, সেজন্য এই হিসাবের সাথে আরও ৩০% যোগ করতে হবে। iRAP (International Road Assessment Program) এর method অনুযায়ী হিসাবটি করা হয়েছে। দুর্ঘটনায় যে পরিমাণ যানবাহন বা প্রপার্টি ড্যামেজ হয়েছে তার তথ্য না পাওয়ার কারণে প্রপার্টি ড্যামেজের আর্থিক পরিমাপ নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি। উল্লেখ্য, গণমাধ্যমে যে তথ্য প্রকাশিত হয়েছে, প্রকৃত ঘটনা তার চেয়ে ৩/৪ গুণ বেশি। এই বিবেচনায় এবছর সড়ক দুর্ঘটনায় আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ আমাদের জিডিপি’র ১.৫ শতাংশের বেশি হতে পারে।
২০২২ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় ১৮ থেকে ৬৫ বছর বয়সী কর্মক্ষম মানুষ নিহত হয়েছেন ৬২৭৬ জন, অর্থাৎ ৮১.৩৬ শতাংশ।
রাজধানীতে রুট ফ্রাঞ্চাইজ পদ্ধতির মাধ্যমে কোম্পানীভিত্তিক যাত্রীবান্ধব গণপরিবহন চালুর পরিকল্পনা করা হয়েছিল বেশ কয়েক বছর আগে। রাজধানীর পুরাতন মেয়াদোত্তীর্ণ বাস প্রত্যাহার করে ৪ হাজার নতুন বাস দ্বারা এই সার্ভিস চালু করার কথা ছিল। এটি করা হলে রাজধানীর গণপরিবহনে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হতো। কিন্তু পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের আপত্তি ও অসহযোগিতার কারণে সম্ভব হয়নি। তবে রাজধানীর ২/৩টি রুটে অল্প সংখ্যাক পুরাতন বাস দ্বারা “নগর পরিবহন” নামে একটি বাস সার্ভিস চালু করা হয়েছে। খুবই অপরিকল্পিত ও দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে এই সার্ভিস যাত্রীসেবাই তেমন প্রভাব ফেলতে পারছে না।
রাজধানীর যানজট কমানো এবং যাতায়াতের সুবিধার জন্য সরকার একটি মেট্রোরেল এবং ২টি সাবওয়ে নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে মেট্রোরেল আংশিক চালু হয়েছে। সাবওয়ে দু’টির নির্মাণ কাজ শীঘ্রই শুরু হবে। উল্লেখ্য, রাজধানীতে যে পরিমাণে মানুষের চাপ বাড়ছে, তাতে মেট্রোরেল এবং সাবওয়ে রাজধানীর যানজট খুব বেশি কমাতে পারবে না। একটি পরিসংখ্যান দিলে বিষয়টি বুঝা যাবে। মেট্রোরেল এবং সাবওয়ে যে পরিমাণ যাত্রী বহন করবে তার চেয়ে সাড়ে ৩ গুণ বেশি মানুষ যাতায়াত করবে সারফেস রুটের বাস সার্ভিসে। অর্থাৎ বাসের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং মানোন্নয়ন ছাড়া রাজধানীর সামগ্রিক যাতায়াত ব্যবস্থায় উন্নতি ও গতিশীলতা আসবে না। মেট্রোরেল ও সাবওয়েতে কয়েক লক্ষ কোটি টাকা ব্যয় করা হচ্ছে এবং হবে। এই বিপুল অর্থ ব্যয়ের সাথে আর মাত্র ১০/১২ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে রাজধানীর সকল পুরানো বাস প্রত্যাহার করে ৪ হাজার আধুনিক নতুন বাস এসি, নন/এসি দুই ক্যাটাগরীতে বিভক্ত করে পরিচালনা করলে এবং বাসের জন্য আলাদা লেন ব্যবস্থা করলে প্রাইভেট গাড়ি ব্যবহারকারী বহু মানুষ বাসে চলাচল করবেন। এতে প্রাইভেটগাড়ি নিরুৎসাহিত হবে। ফলে যানজট একেবারেই নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। যানজট কমলে মোটরসাইকেলও ব্যাপকভাবে হ্রাস পাবে। একইসাথে প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ এবং মফস্বল শহরকেন্দ্রিক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করলে রাজধানীমুখি জনস্রোত কমবে। এসব সমন্বিত ও টেকসই উদ্যোগের ফলে রাজধানীর যানজট ব্যাপক মাত্রায় হ্রাস পাবে। এভাবে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথ ধরে দেশ এগিয়ে যাবে।
গণপরিবহন নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা প্রতিষ্ঠান BRTA, BRTC, DTCA- এর শীর্ষ পদে যাদের নিয়োগ দেওয়া হয় তাদের পরিবহন বিষয়ে তেমন কোনো প্র্যাক্টিক্যাল এবং একাডেমিক জ্ঞান থাকে না। নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে তারা কিছুদিন রুটিন কাজ করেন, তারপর অন্যত্র বদলি হন কিংবা অবসরে যান। ফলে এসব জনগুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় কোনো উন্নতি হয় না। আমরা মনে করি, সড়ক ও গণপরিবহন পরিচালনা বিষয়ে যাদের একাডেমিক জ্ঞান আছে, গবেষণা আছে, দেশে-বিদেশে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে- এমন ব্যক্তিদের এসব প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদে নিয়োগ দেওয়া উচিত। একইসাথে তাদের কাজের সুবিধার জন্য যথেষ্ট সংখ্যক প্রশিক্ষিত ও অভিজ্ঞ সহযোগী কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন। একটি ব্যাংক পরিচালনার জন্য যদি ১৫/২০ লাখ টাকা বেতনে অভিজ্ঞ CEO নিয়োগ দেওয়া যায়, তাহলে BRTA, BRTC, DTCA পরিচালনায় উচ্চ বেতনে বিশ^মানের অভিজ্ঞ ব্যক্তিকে নিয়োগ দেওয়া যাবে না কেন? যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির সাথে তো দেশের আর্থিক অগ্রগতির বিষয়টি নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত।
সারা দেশের গ্রামে-গঞ্জে সড়ক অবকাঠামো গড়ে উঠলেও আধুনিক নিরাপদ যানবাহন ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। ফলে মানুষের প্রয়োজনের তাগিদেই ইজিবাইক, অটোরিকশা, অটোভ্যানের মতো থ্রি-হুইলার জাতীয় যানবাহনের প্রচলন ঘটেছে। আদালত দেশব্যাপী চলাচলকারী ৪০ লাখ থ্রি-হুইলার বন্ধের যে রায় দিয়েছেন, তা বাস্তবায়ন হলে প্রায় ৫০ লাখ থ্রি-হুইলার চালক কর্মহীন হয়ে পড়বে। বিপুল অর্থের বিনিয়োগ হুমকিতে পড়বে। এসব যানবাহন সংযোজন ও মেরামতকেন্দ্রিক যে ব্যবসা ও কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে তা বন্ধ হয়ে যাবে। গ্রাম ও মফস্বল শহরে স্বল্প দূরত্বে চলাচলকারী মানুষের যাতায়াত বাধাগ্রস্ত হবে। ফলে গ্রামীণ অর্থনীতি ভেঙ্গে পড়বে। সবমিলে আর্থ-সামাজিক সংকট তৈরি হবে। তাই আমরা মনে করি, এসব যানবাহন নিবন্ধনের আওতায় আনতে হবে, চালকদের স্বল্পমেয়াদী প্রশিক্ষণ দিতে হবে এবং যানবাহনের নিরাপত্তা বিষয়ক যান্ত্রিক উন্নয়ন করতে হবে। এতে সরকারের রাজস্ব বাড়বে, দুর্ঘটনা কমবে। একইসাথে এ ধরনের যানবাহন চলাচলের জন্য নতুন করে রোড ডিজাইন করতে হবে। টেকসই বিকল্প ব্যবস্থা না করে কোনোভাবেই থ্রি-হুইলার বন্ধ করা উচিত হবে না।
সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের অধিকাংশই হতদরিদ্র, নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। ক্ষতিগ্রস্তদের ৭৫-৮২ শতাংশই কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, সড়ক দুর্ঘটনায় আহত-নিহতরা তাদের পরিবারের প্রধান বা একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। ফলে এসব পরিবার আর্থিকভাবে বিপন্ন হয়ে পড়ছে। সামাজিক অর্থনীতির মূল ¯্রােত থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। ১৯৮৩ সালের “মোটরযান অধ্যাদেশ এ্যাক্ট”- এ সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য মোটরযানে “তৃতীয় পক্ষীয় ঝুঁকি বীমা” বাধ্যতামূলক ছিল, যদিও সেই ঝুঁকি বীমার মাধ্যমে কেউ ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন এমন ইতিহাস খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। “সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮”- তে মোটরযানের “তৃতীয় পক্ষীয় ঝুঁকি বীমা” উঠিয়ে দিয়ে দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য “ট্রাস্ট ফান্ড” নামে একটি তহবিলের বিধান রাখা হয়েছে। কয়েকদিন আগে সরকার এই তহবিল পরিচালনা বিষয়ে বিধিমালা প্রণয়ন করেছে। অনেক দেরিতে হলেও কাজটি করার জন্য সরকারকে ধন্যবাদ জানাই। তবে এই ট্রাস্ট ফান্ডের সাংগঠনিক কাঠামো, পরিচালনা পদ্ধতি এবং ক্ষতিপূরণের পরিমাণ ইত্যাদি বিষয়ে আমাদের আপত্তি রয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তরা এই তহবিল থেকে খুব সহজে ক্ষতিপূরণ পাবেন না বলে আমাদের আশঙ্কা। এক জেলার মানুষ অন্য জেলায় দুর্ঘটনায় আক্রান্ত হবে, এটা নিয়ে বিভিন্ন সংস্থা ও দপ্তরের তদন্ত চলবে। ফলে ব্যাপক আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রিতা তৈরি হবে। বাস্তবতা হলো, সমাজের দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ দুর্ঘটনায় সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে এবং অর্থের অভাবে তারা তাৎক্ষণিকভাবে উপযুক্ত চিকিৎসা গ্রহণ করতে না পারার কারণে মৃত্যুবরণ ও পঙ্গুত্ববরণ করছে। এই প্রেক্ষাপটে সরকারের ট্রাস্ট ফান্ড দুর্ঘটনাক্রান্তদের চিকিৎসার মাধ্যমে মৃত্যু হ্রাস ও পঙ্গুত্ববরণ রোধে কোনো কাজে আসবে না। তাই আমরা সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য একটি “ইন্ডিপেনডেন্ট ফান্ড” গঠনের দাবি জানাচ্ছি। এই ফান্ডের মাধ্যমে দুর্ঘটনা সংঘটিত হওয়ার তাৎক্ষণিক পরেই আহতদের চিকিৎসা শুরু করা সম্ভব। একইসাথে আমরা মোটরযানের “তৃতীয় পক্ষীয় ঝুঁকিবীমা” কার্যকরভাবে ফেরত চাই।
পরিশেষে আমরা বলতে চাই, দেশের সড়ক পরিবহন খাতে যে অব্যবস্থাপনা, দুনীতি, চাঁদাবাজি ও নৈরাজ্য চলছে তা বন্ধ করতে হবে। এ বিষয়ে শুধু কমিটি গঠন এবং সুপারিশমালা তৈরির চক্র থেকে বেরিয়ে একটি টেকসই জনবান্ধব পরিবহন কৌশল প্রণয়ন করতে হবে। এটা জাতীয় অগ্রগতির স্বার্থেই জরুরি। এজন্য প্রয়োজন সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের ভাইস চেয়ারম্যান ও লিগ্যাল ইকোনোমিস্ট মোহাম্মদ শাহজাহান সিদ্দিকী, রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের ভাইস চেয়ারম্যান, গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বারভিডার সাবেক প্রেসিডেন্ট আব্দুল হামিদ শরীফ; রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক হাসিনা বেগম, রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান, রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের জয়েন্ট সেক্রেটারী ও সমাজ গবেষক ড. জাহিদুল ইসলাম, সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্টের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেকুজ্জামান লিপন ও দৈনিক মানব জমিনের সাংবাদিক তারিক চয়ন।
প্রতিবেদকের প্রতিক্রিয়া ও সুপারিশ :
এ বিষয়ে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির মৌলভীবাজার জেলা সম্পাদক মন্ডলীর সদস্য, সাপ্তাহিক নতুন কথা’র বিশেষ প্রতিনিধি, আরপি নিউজের সম্পাদক ও বিশিষ্ট কলামিস্ট কমরেড সৈয়দ আমিরুজ্জামান বলেন, “দুর্ঘটনার এই চিত্র বাংলাদেশের সড়কে নিরাপত্তাহীনতা ও সীমাহীন অব্যবস্থার চিত্রই প্রকাশ পেয়েছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গাড়ি চালনার প্রাথমিক শিক্ষা কোর্স (ব্যবহারিক সহ) চালু করাসহ দক্ষ চালক তৈরির উদ্যোগ বৃদ্ধি করা, চালকের বেতন ও কর্মঘন্টা নির্দিষ্ট করা, বিআরটিএ’র সক্ষমতা বৃদ্ধি করা,পরিবহনের মালিক-শ্রমিক, যাত্রী ও পথচারীদের প্রতি ট্রাফিক আইনের বাধাহীন প্রয়োগ নিশ্চিত করা, মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন চলাচল বন্ধ করে এগুলোর জন্য আলাদা পার্শ্ব রাস্তা (সার্ভিস রোড) তৈরি করা, সকল সড়ক-মহাসড়কে রোড ডিভাইডার নির্মাণ করা, যানবাহনের গতি নিয়ন্ত্রণে প্রযুক্তির ব্যবহার করা, গণপরিবহনে চাঁদাবাজি বন্ধ করা, রেল ও নৌ-পথ সংস্কার ও সম্প্রসারণ করে সড়ক পথের উপর চাপ কমানো, গণপরিবহন উন্নত, সহজলভ্য ও সাশ্রয়ী করে মোটরসাইকেল ব্যবহার নিরুৎসাহিত করা, সড়ক, নৌ ও রেলপথে কঠোর মনিটরিং ব্যবস্থা নিশ্চিত করা, টেকসই পরিবহন কৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করাসহ
সড়ক পরিবহন আইন ও বিধিমালা যথাযথ বাস্তবায়নে নতুন নতুন কৌশল ও ডিজিটালাইজড উদ্ভাবনকে কাজে লাগাতে হবে। সর্বোপরি ট্রাফিক ব্যবস্থাপনাকে আধুনিক ও ডিজিটাইজড করতে হবে। এ বিষয়ে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স থেকে প্রায় দুই বছর আগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে উন্নয়ন প্রজেক্ট পাঠানো হয়েছে, তা বাস্তবায়ন জরুরি।
যাত্রী ও পথচারীদের ব্যক্তি নিরাপত্তা ও বিধি-বিধান প্রতিপালনে সচেতন হতে হবে। নাগরিকদের মধ্যে আইন ও শৃঙ্খলা মানার সংস্কৃতি সৃষ্টি করতে হবে। সাংবাদিক, সরকারি কর্মকর্তা, শ্রমিক নেতা, রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের যথাযথ আইন প্রয়োগে সহায়তা প্রদান করতে হবে।
প্রশাসন, পুলিশ, বিআরটিএ, সিটি করপোরেশন, সড়ক ও জনপথ, মালিক, চালক ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের যৌথ উদ্যোগে দুর্ঘটনা কমানো সম্ভব। সংশ্লিষ্ট সংস্থার প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে জাতীয়ভাবে সেল তৈরি করে এবং প্রতি বিভাগ ও জেলায় একইভাবে সেল গঠন করে নিয়মিত মনিটরিং ও পরামর্শ প্রদানের ব্যবস্থা থাকতে হবে এবং এ সেলকে সর্বদাই সক্রিয়ভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে। এভাবেই সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাস করা সম্ভব।
সম্পাদক : সৈয়দ আমিরুজ্জামান
ইমেইল : rpnewsbd@gmail.com
মোবাইল +8801716599589
৩১/এফ, তোপখানা রোড, ঢাকা-১০০০।
© RP News 24.com 2013-2020
Design and developed by M-W-D