সিলেট ১লা জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ১৭ই আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ১২:৪০ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ২৮, ২০২৩
মূল্যস্ফীতি, ব্যাংকে তারল্য সংকট, টাকার অব্যাহত দরপতনসহ অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) দ্বারস্থ হওয়া বাংলাদেশ অনেক পক্ষের শর্ত মেনে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের (জানুয়ারি-জুন) মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ঘোষিত মুদ্রানীতির মূল্য লক্ষ্য মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কথা উল্লেখ করলেও অর্থনীতিবিদ ও বাজার বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, আইএমএফের ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ পেতে মরিয়া বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস তোলা মূল্যস্ফীতি কমাতে ঘোষিত মুদ্রানীতি আদতে কোনো কাজেই দেবে না। মুদ্রানীতির বিশ্লেষণ ও মূল্যস্ফীতিসহ জাতীয় অর্থনীতির অন্যান্য খাত-ক্ষেত্রে তার প্রভাব নিয়ে কদিন ধরেই বেশ লেখালেখি হচ্ছে। পত্রপত্রিকায় সেসব জ্ঞানগর্ভ বিশ্লেষণ পড়তে পড়তে আমার মাথায় কদিন ধরেই কিছু প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। যেমন বাংলাদেশ ব্যাংকের মূল্যস্ফীতি কমানোর লক্ষ্য কেন খারিজ হচ্ছে? বিজ্ঞ গভর্নর ও তার পরামর্শক বাহিনী কি আসলেই খুব অনভিজ্ঞ যে একযোগে সবাই তাদের আশাবাদের বিপরীতে কথা বলছেন? বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিপ্রণয়ন ও নিয়ন্ত্রণ আসলে কার হাতে? বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর কারা হন? বাংলাদেশ ব্যাংক কি আদৌ কোনো স্বাধীন সত্তা ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রথাগত দৃষ্টিতে এসব প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধান যথেষ্ট কষ্টকর। কেননা, কাগজে-কলমে এসব প্রশ্নের উত্তর আছে। কিন্তু ‘কাজির গরু কেতাবে আছে, গোয়ালে নেই’ বাঙালি জীবনের বহুলশ্রুত এই প্রবাদ তো এখনো বহাল তবিয়তেই টিকে আছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানই এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ হতে পারে। সে যাই হোক, অর্থনীতিশাস্ত্রঘনিষ্ট মানুষ হিসেবে যেকোনো বিষয়ের কার্যকারণ খোঁজা এবং তার অলোকে কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়াই তো যুক্তিসিদ্ধ, তাই এসব প্রশ্ন ইদানীং আমাকে বেশ তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে।
বাজার অর্থনীতিতে রাজস্বনীতি ও মুদ্রানীতি—উভয়ই নীতিনির্ধারকদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ সামষ্টিক হাতিয়ার। এই দুই নীতির মধ্যে যে স্বাতন্ত্র্য তা অনেকাংশেই প্রাতিষ্ঠানিক, অর্থনৈতিক নয়। বাজেটের আকার, বাজেট ঘাটতি বা উদ্বৃত্তের পরিমাণ এবং অর্থায়নের পদ্ধতির মাধ্যমে কাজ করে রাজস্বনীতি। আর মুদ্রানীতি কাজ করে মুদ্রা সরবরাহ, ঋণ ও সুদের হারের ওপর তার প্রভাবের ভিত্তিতে। তবে উভয় নীতিই মূলত সামগ্রিক চাহিদাকে প্রভাবিত করার মাধ্যমে অর্থনৈতিক কার্যক্রমকে নিয়ন্ত্রিত করে। যেহেতু উভয় নীতি একই ব্যাপ্তিতে কাজ করে, তাই কিছু কিছু ক্ষেত্রে এদের বিকল্প হিসেবেও বিবেচনা করা হয়। এই ধারণা থেকে মুদ্রা ও রাজস্বনীতিকে দুটি নয়, বরং একটি হাতিয়ার হিসেবে গণ্য হয়, যা মূলত অর্থনীতির উৎপাদন ক্ষমতা ব্যবহারের মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনের জন্য ব্যবহৃত হয়। তবে এই দুই নীতি ব্যবহারের ক্ষেত্রে কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে, যেগুলো একেবারেই ভিন্নতর। যেমন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও লেনদেনের ভারসাম্যের ওপর এদের প্রভাব। মূলত এই স্বতন্ত্র পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণেই এই নীতিদ্বয়ের মধ্যে পার্থক্য করা হয় এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াজনিত পৃথক লক্ষ্য অর্জনে নিয়োগ করা হয়। নিয়ম অনুযায়ী, রাজস্বনীতি সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাজ; আর মুদ্রানীতি বাংলাদেশ ব্যাংকের। দেশের মুদ্রা সরবরাহ কত হবে, টাকার মান কতটা বাড়বে, মূল্যস্ফীতির হার কত রাখা হবে এসবই ঠিক করেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষে গভর্নর। মুদ্রানীতির সঙ্গে জড়িত থাকে দেশের প্রতিটি মানুষের জীবনযাপনের মান, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানসহ দৈনন্দিন জীবনের খুঁটিনাটি অনেক বিষয়। তাই মুদ্রানীতি প্রণয়নকারীরদের নিয়ে চিন্তাভাবনার অবকাশ থাকাটাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশ ব্যাংক তার প্রতিটি মুদ্রানীতির ঘোষণায় মূল্যস্ফীতি কমানো ছাড়াও মুদ্রাবাজার ও সুদহারের নিয়ন্ত্রণ, খেলাপি ঋণ কমানো ও সুশাসন নিশ্চিত করার কথা উল্লেখ করে থাকে। ঘোষণায় যা-ই থাকুক, অতীত অভিজ্ঞতায় স্পষ্ট যে বাংলাদেশে মুদ্রাসম্পর্কিত গৃহীত নীতিগুলো কোনোকালেই সঠিকভাবে কাজ করে না। ভালো ভালো লক্ষ্যের কথা বলা হলেও, দিনশেষে সেসবের পরিস্ফুটন ঘটে না। এখানে সঞ্চিত মুদ্রা এবং নীতি সুদহারের মতো মুদ্রানীতির উপাদানগুলোর বাস্তবিক প্রভাব তাত্ত্বিক বর্ণনা থেকে হয় বেশ ভিন্ন। এর কারণ সম্ভবত ব্যাংকের মুদ্রানীতির লক্ষ্যগুলো বাস্তবতার নিরিখে খতিয়ে দেখা হয় না। ফলে মুদ্রানীতির অনেক লক্ষ্যই মেয়াদান্তে অধরাই থেকে যায়, মুদ্রানীতির বড় কোনো প্রভাব সমাজ বা সামগ্রিক অর্থনীতিতে পড়তে দেখা যায় না। আর এবারে আইএমএফের কাছে ঋণের জন্য হাত পাতা বাংলাদেশের মুদ্রানীতির কাঙ্ক্ষিত প্রভাব যে দেশের অর্থনীতিতে পড়বেই না, সে কথা বুঝতে অর্থনীতিশাস্ত্রের পণ্ডিত হতে হয় না।
একটি ভালো ও কার্যকর মুদ্রানীতির জন্য বিশ্বের অনেক কেন্দ্রীয় ব্যাংকে মনিটরি পলিসি কমিটি নামে একটি সাংগঠনিক কাঠামো থাকে। এই কাঠামোতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তারা ছাড়াও বিশেষজ্ঞরা অন্তর্ভুক্ত থাকেন। তারা বছরে কতবার বৈঠক করবেন, কীভাবে মুদ্রানীতি ঠিক করবেন, কোথায় এর জবাবদিহি করতে হবে তার সবই লিখিতপড়িত থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংকেরও নিশ্চয়ই এমন কোনো কিছু আছে। কিন্তু সেসব নিয়ে তেমন কিছু জানা যায় না। তবে বাংলাদেশে অর্থমন্ত্রীর বার্ষিক আর্থিক বিবরণী বা বাজেট আর গভর্নরের মুদ্রানীতি ঘোষণার মাসখানেক আগে থেকে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফসহ বহুজাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং বড় বড় ব্যবসায়ী সংগঠনের প্রভাবশালী লোকজনকে নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে ‘সৌজন্য স্বাক্ষাতের’ বহর লেগে যেতে দেখা যায়। আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের লোকজন সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ও আর্থিক নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে কতবার মিলিত হয়েছেন, তার হিসাব করতে গেলে ঠগ বাছতে গা উজার হওয়ার দশা হবে। তবে মুদ্রানীতি ঘোষণার দিনকয়েক আগে ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে গভর্নরের সৌজন্য স্বাক্ষাৎ যে ছিল বিশেষ গুরুত্ববহ, তা ঘোষণাপরবর্তী সময়ে ব্যবসায়ী নেতাদের সাধুবাদ আর প্রশংসার নহর বইতে দেখেই স্পষ্ট হয়। ব্যবসায়ী নেতারা ৯ শতাংশের সস্তা ঋণহার বিনিয়োগবান্ধব বলে নিশ্চয়ই গভর্নরকে বুঝিয়ে এসেছিলেন। গভর্নর তাদের কথা রেখেছেন। তাই তারাও দিলখুলে গভর্নরের প্রশংসা করছেন। বিশ্বের দেশে দেশে যখন সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতির দমবন্ধ অবস্থা থেকে জনগণকে পরিত্রাণ দিতে চেষ্টা করা হচ্ছে, সেখানে আমাদের এখানে ধনিক শ্রেণি তোষণ করা মুদ্রানীতি দিয়ে মূল্যস্ফীতি রুখে দেওয়াকে মূল লক্ষ্য বলা হচ্ছে। এসব ভাবতে গেলে মাথাটাই গুলিয়ে যায়। মনে হয়, অর্থনীতিশাস্ত্রের অনেক তত্ত্বকথাই বাংলাদেশের জন্য মোটেও প্রযোজ্য নয়। অর্থনীতিতে অ্যাডাম স্মিথের ‘অদৃশ্য হাত’-এর তত্ত্বীয় প্রয়োগ অনেক আগেই বাতিল হয়েছে ঠিকই, কিন্তু আমাদের দেশে তা ‘অদৃশ্য কালোহাত’ রূপে ঠিকই টিকে আছে। আর এ জন্যেই অনেক দিন ধরেই প্রশ্ন ওঠে আমাদের বাংলাদেশ ব্যাংক কাদের কথায় উঠবস করে, কারা এর নীতিপ্রণয়নে সংশ্লিষ্ট। এক্ষেত্রে বাংলাদেশে অনেকটা ভিন্নধর্মী বা মূলধারার বাইরের গণমানুষের অর্থনীতিবিদ হিসেবে পরিচিত অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত তাঁর ‘বড় পর্দায় সমাজ-অর্থনীতি-রাষ্ট্র: ভাইরাসের মহাবিপর্যয় থেকে শোভন বাংলাদেশের সন্ধানে’ বইয়ে যেসব কথা বলেছেন, তা বেশ প্রণিধানযোগ্য। যেমন: “কেন্দ্রীয় ব্যাংক কি স্বাধীন সত্তা না-কি তা সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীন সত্তা—বিষয়টি পরিষ্কার করতে হবে। জনমনে সাধারণ ধারণা যে, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর মহোদয় অর্থমন্ত্রীর অধীনে চাকরি করেন অথবা গভর্নর-ডেপুটি গভর্নররা নিযুক্তি পান বড় বড় জোম্বি কর্পোরেশনের তদবির-লবিংয়ের জোরে—এসব বিষয় স্পষ্টকরণ জরুরি। আরো স্পষ্ট করা প্রয়োজন যে আমরাই আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মালিক কি-না? এ ধরনের সিরিয়াস প্রশ্ন উত্থাপন করে চার্লি রবিনসন তালিকা প্রকাশ করেছেন যে পৃথিবীর ১৫৪টি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মালিক আসলে রথচাইল্ড ফ্যামিলি।”; “বাংলাদেশ ব্যাংক যখন টাকা ছাপায়, তখন কে তাকে অনুমতি দেয় এবং সে অনুমতি অর্থনৈতিক ও নৈতিক যুক্তিতে বিধিসাপেক্ষ কি না?”; “বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ-এর লোকজন প্রায়ই বাংলাদেশ ব্যাংকে আসেন (সুপারভাইজারি মিশন ইত্যাদি বহু নামে)। কে তাদের অনুমতি দেয়, কেন তারা আসেন, তাদের আসাতে আমাদের কী উপকার হয়?” অধ্যাপক বারকাতের মতো অনেকের কাছেই এখনো এসব প্রশ্নের সদুত্তর জানা নেই। অথচ মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে চাইলে, ২০৪১ সালের মধ্যে ধনী রাষ্ট্র হতে চাইলে এসবের উত্তর জানা জরুরি। কিন্তু উত্তর দেওয়ার যে কেউ নেই। তাই যার-যার অবস্থান থেকে এসবের উত্তর খুঁজে নিতে হয়।
ইউরোপের শক্তিশালী কোনো দেশের মুদ্রানীতি দিয়ে বাংলাদেশের মুদ্রানীতির তুলনা করলে প্রকৃত চিত্র পাওয়া সম্ভব না, এ কথা সত্যি। তবে এও তো সত্যি যে, ব্যবসায়ী-ধনিক শ্রেণি আর আন্তর্জাতিক অর্থদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর পরামর্শ-দাবি ন্যায্য হতো, যদি দেখা যেত মূল্যস্ফীতি লাগামের মধ্যে আছে, অর্থপাচার‑কালোটাকা‑ঋণখেলাপির জেঁকে বসা সংস্কৃতির ব্যাপ্তি কিছুটা হলেও কমেছে। একদিকে বড় ব্যবসায়ীদের জন্য ঋণের প্রবাহ উন্মুক্ত রাখা, অন্যদিকে ছোট উদ্যোক্তাদের ঋণের অভাবে সম্ভবনাময় উদ্যোগের পড়ে পড়ে মার খাওয়া নিশ্চয়ই রাজস্বনীতি ও মুদ্রানীতির সাফল্যের পরিচায়ক নয়। বাংলাদেশের বর্তমান মূল্যস্ফীতিকে ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণ এবং তা থেকে তেল ও পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি, চীনের অস্পষ্ট করোনা নীতি আর যুক্তরাষ্ট্রসহ বড় বড় অর্থনীতির দেশে মূল্যস্ফীতির বাড়বাড়ন্ত অবস্থার প্রভাব বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। একই কথা বারবার শুনতে শুনতে সাধারণ মানুষও এসবের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিচ্ছেন। তবে নীতিনির্ধারকদের বোঝা উচিত যে জনগণের সহ্যেরও তো সীমা আছে, জনগণকে তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে একেবারে বোকা ভাবাও ঠিক না। রাজস্বনীতি ও মুদ্রানীতি ঘোষণার প্রাক্কালে জনগণের ভাগ্যনির্ধারকদের সঙ্গে সৌজন্য বৈঠকে বসেন বিদেশি ঋণদাতা গোষ্ঠী আর বড় বড় ব্যবসায়ী নেতা ও তাদের সংগঠন-প্রতিনিধিরা। সবারই চা-নাশতা আপ্যায়নের ফাঁকে ফাঁকে কথা বলার সুযোগ হয়। তবে সেখানে কৃষক-শ্রমিক-জনতার কথা শোনার প্রয়োজন কেউ কখনো বোধ করেন না। অথচ এরাই দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ। এসব কারণেই বাজেট আর মুদ্রানীতি নিয়ে আমজনতার কোনো আগ্রহ থাকে না। তারা শুধু দেখেন তার নিত্যপ্রয়োজনীয় চাহিদায় কতটা-কি প্রভাব পড়ল এবং একসময় সবকিছুর সঙ্গে মুখবুঁজে নিজেকে মানিয়ে নেন।
লেখার শুরুতে চিন্তায় উদয় হওয়া কিছু প্রশ্নের কথা বলেছিলাম। আসলে সেসবের উত্তর খোঁজা অবান্তর। কেননা এসব প্রশ্ন অনেকেই অনেকবার করেছেন। কেউ উত্তর দেওয়ার জন্য এগিয়ে আসেননি। তবে এবারের মুদ্রানীতির ঘোষণার পর একটি প্রশ্নের উত্তর কমবেশি পাওয়া গেছে। যেমন ব্যবসায়ী আর আমলানির্ভর আমাদের নীতিনির্ধারকদের কাছে অর্থনীতিশাস্ত্রের লোকজন অথবা অর্থনীতিবিদ ও বাজার বিশ্লেষকদের এখন আর তেমন কোনো মূল্য নেই। জুন ১০, ২০১৫ পরিকল্পনা কমিশনের এনইসি সম্মেলনে কক্ষে মিট দ্য প্রেস অনুষ্ঠানে নিজেকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকর্মী অর্থনীতিবিদ হিসেবে আখ্যায়িত করে তৎকালীন পরিকল্পনামন্ত্রী এবং বর্তমান অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল মূলধারার অর্থনীতিবিদদের উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, “এরা সবাই চিন্তাশীল অর্থনীতিবিদ। এরা অনেকেই পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে ছিলেন কিন্তু শূন্যহাতে ফিরে গেছেন। কেউ কিছুই করে দেখাতে পারেনি। আমিও অর্থনীতিবিদ তবে আমি মূল্যায়নকারী অর্থনীতিবিদ কারণ আমি অ্যাকাউন্টসের ছাত্র। চিন্তাশীল অর্থনীতিবিদ ও মোদির মধ্যে আমি পার্থক্য খুঁজে বের করবো। এই দুই ধরনের অর্থনীতিবিদের মূল্যায়ন করবো” (বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম, জুন ১০, ২০১৫)। দেশের অর্থনীতির সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) আয়োজিত এক সেমিনারে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম ১৪ আগস্ট ২০২২ বলেছিলেন, “১৯৭৪-৭৫ সালে হক কথা পত্রিকা দেশের অনেক ক্ষতি করেছে। তারা একেক দিন মিথ্যার ঝুড়ি নিয়ে আসত। সেই হক কথার ভূমিকা যেন কেউ আর না নিতে পারে, সে জন্য গণমাধ্যমকে সহনশীল আচরণ করতে হবে।” সরকারের অন্য মন্ত্রী-নেতাদের কথা বাদই দিলাম, দেশের অর্থ ও পরিকল্পনাসংশ্লিষ্ট এই দুই নীতিনির্ধারকের মনে গেঁথে যাওয়া দৃষ্টিভঙ্গিতে নিশ্চয়ই কিছু একটা প্রমাণ হয়। মূল্যস্ফীতির ও নানামাত্রিক বৈষম্যের চাপে যাদের জীবন দিশেহারা, তাদের জন্যে কিছু বলতে চাওয়া এখন আসলেই খুব ঝুঁকিপূর্ণ। আমাদের নীতিনির্ধারকেরা হয়তো ধরেই নিয়েছেন যে অর্থনীতিশাস্ত্রিক-অর্থনীতিবিদ, অর্থমন্ত্রীর দৃষ্টিতে যারা ‘চিন্তাশীল’ তাদের পড়াশোনা আর চাকরিবাকরির বাইরে তেমন কোনো কাজ নেই। নীতিনির্ধারকদেরই বা খুব বেশি দোষ দিই কী করে, অর্থনীতিশাস্ত্রই তো এখন অনেক কিছুর ঠিকঠাক করে জবাব দিতে পারে না। এ নিয়ে অধ্যাপক ড. আবুল বারকাতের ‘অর্থনীতিশাস্ত্রে দর্শনের দারিদ্র্য’ শিরোনামে অসাধারণ একটি বই আছে, যেখানে তিনি বলেছেন, “শাস্ত্রীয় দারিদ্র্য থেকে পরিত্রাণের প্রধান পথ হলো বহুশাস্ত্রীয় কাঠামোতে অর্থনীতিশাস্ত্রকে প্রতিস্থাপন করা।” উন্নত ও অগ্রসর দেশগুলোয় এ নিয়ে অনেক কাজ হলেও আমাদের অর্থনীতিবিদেরা কতটা তা করেছেন, সে নিয়ে প্রশ্ন তোলাই যায়।
মুদ্রানীতি আর দেশের আর্থিক অবস্থার পক্ষে-বিপক্ষে নানা কিছু শুনতে শুনতে চিন্তায় জট পাকিয়ে যাওয়ার অন্যতম এক সমস্যা হচ্ছে, কী প্রসঙ্গে বলতে চেয়েছিলাম তা হারিয়ে যাওয়া। সবকিছু ওলটপালট হওয়ার আগে ছোট্ট কয়েকটি পরিসংখ্যান তুলে ধরে লেখাটি শেষ করলেই বুঝি ভালো হয়। বাংলাদেশ ৫০ বছরে ইতিহাসে এখন পর্যন্ত ১২ জন গভর্নর পেয়েছে, যাদের মধ্যে পেশাগত শ্রেণিভাগ করলে দেখা যায়, প্রথম গভর্নরসহ তিনজন ছিলেন ব্যাংকার, একজন অর্থনীতির শিক্ষক এবং আটজন সরকারি আমলা। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রথম গভর্নর আ ন ম হামিদুল্লাহ (১৯৭২-৭৪) ছিলেন পাকিস্তানের ইস্টার্ন ব্যাংকিং করপোরেশনের (পরে উত্তরা ব্যাংক) ব্যবস্থাপনা পরিচালক। আর বর্তমান অর্থাৎ দ্বাদশ গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার একজন আদ্যোপান্ত আমলা। বিশ্বের শক্তিশালী ও প্রভাবশালী কোনো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান পদে এখন আর আমলাদের নিয়োগ দিতে দেখা যায় না। অবশ্য এর মানে এই না যে, আমলাদের মধ্যে যোগ্য লোক তারা খুঁজে পাচ্ছে না। আসলে জটিল ও সদাপরিবর্তনশীল বর্তমান বিশ্ব অর্থনীতিতে ব্যাংকিং ও অর্থনীতিতে অভিজ্ঞ লোকজনই বেশি কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছেন। এই যেমন ২০২৩ সালে বিশ্বের সেরা গভর্নরে পুরস্কৃত হওয়া মাত্র ২৭ বিলিয়ন ডলার ও ৩ লাখ ৭৬ হাজার ২৪৮ জনসংখ্যার দেশ আইসল্যান্ডের সেন্ট্রাল ব্যাংকের গর্ভনর ড. অ্যাসগেইর জনসন পেশায় একজন অর্থনীতির শিক্ষক। করোনার অভিঘাত ও মূল্যস্ফীতি থেকে অর্থনীতিকে বাঁচাতে তিনি সব পক্ষের মতামত অগ্রাহ্য করে সুদের হার ধারাবাহিকভাবে বাড়ানোর পাশাপাশি অন্যান্য সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিয়ে বিশ্বের সেরা গভর্নরে পরিণত হয়েছেন। আর বাংলাদেশ ব্যাংকিং নীতিমালার প্রধান নিয়োগে সরকারি আমলারা এতটাই প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছেন যে তাদের জন্য আইন পরিবর্তন করে, আগাম অবসর নিয়ে মাঠ প্রস্তুত করা হয়। অথচ বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা হিসেবে এ এফ এম নুরুল মতিন (পরে ডেপুটি গভর্নর) সত্তরের দশকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অযাচিত হস্তক্ষেপের প্রতিবাদে লিখেছিলেন, “মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব হলো মন্ত্রণা দেওয়া, যন্ত্রণা দেওয়া নয়।”
লেখক : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি।
সম্পাদক : সৈয়দ আমিরুজ্জামান
ইমেইল : rpnewsbd@gmail.com
মোবাইল +8801716599589
৩১/এফ, তোপখানা রোড, ঢাকা-১০০০।
© RP News 24.com 2013-2020
Design and developed by M-W-D