তালার কৃষক আন্দোলন ও কমরেড ভৈরব মন্ডল

প্রকাশিত: ১২:৩০ পূর্বাহ্ণ, জুলাই ৬, ২০২৩

তালার কৃষক আন্দোলন ও কমরেড ভৈরব মন্ডল

আজিজুর রহমান |

১৯৯৬ সালের শেষদিকে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির ‘নিচের দিকে মুখ ফেরাও’ স্লোগানের আলোকে ১৯৯৭ সালের এপ্রিল মাসে আমরা পার্টির সাতক্ষীরা জেলা ও স্থানীয় কমিটির পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি-অবৈধ লীজ বাতিল, কপোতাক্ষ-শালিখা নদী খনন করা ও জলাবদ্ধতা নিরসনের দাবিতে সাতক্ষীরা জেলার তালা উপজেলার জালালপুর, মাগুরা, খেশরা ও খলিশখালি-এই চারটি ইউনিয়নকে ভিত্তি করে কৃষক আন্দোলন গড়ে তোলার। ঐ চারটি ইউনিয়নের মধ্যদিয়ে প্রবাহিত ৯টি খাল-যা পানি নিষ্কাশনের জন্য চলমান ছিল। ওয়াপদা স্লুইচ গেটের মাধ্যমে কপোতক্ষ নদে ৯টি খালের মাধ্যমে ৫০ হাজার বিঘা আবাদী জমির পানি নিষ্কাশিত হত। ১৯৯৫ সালে তালা উপজেলার দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মকর্তারা স্থানীয় কায়েমী স্বার্থবাদীদের সাথে যোগসাজস করে ঐ ৯টি খালকে আবদ্ধ জলাশয় দেখিয়ে কয়েকজন মৎস্যঘের মালিকের কাছে লিজ দেয়। ঘের মালিকরা নেট-পাঁটা-বাঁধ দিয়ে ঐ খালগুলিকে চিংড়ী মাছের ঘেরে পরিণত করে। ফলে ঐ খালগুলি দিয়ে পানি নিষ্কাশিত হতে না পারায় এলাকাটি পুরোপুরি জলাবদ্ধ হয়ে পড়ে। ঘের মালিকরা ৫০ হাজার বিঘা আবাদী জমিকে জোরপূর্বক মৎস্য ঘেরে পরিণত করায় কৃষকরা ধান চাষের জন্য নিজেদের জমিতে নামতে পারত না। এর ফলে ঐ এলাকাটি একটি বিরান ভূমিতে পরিণত হয় এবং এলাকায় দুর্ভিক্ষজনিত পরিস্থিতি তৈরি হয়। আমরা ঐ অবৈধ লিজ বাতিলের দাবিতে উপরে উল্লেখিত এলাকার কৃষক জনতার মধ্যে একটি প্রচারপত্র বিলি করি। এলাকায় হাটে-হাটে সভা, গ্রাম বৈঠক ও পাড়া বৈঠক শুরু করি। এতে আমরা ঐ এলাকার কৃষকদের মধ্য থেকে বিপুল সাড়া পাই।
আমরা গ্রামে গ্রামে গণবিরোধী লিজ প্রতিরোধ কমিটি গঠন করতে শুরু করি। জালালপুর ইউনিয়নের দোহার, আটুলিয়া ও মাগুরা ইউনিয়নের মাদরা গ্রামের কৃষক জনতা অগ্রণী ভূমিকায় চলে আসে। মাদরা গ্রামে যারা কৃষক জনতাকে সংগঠিত করার কাজে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন-তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন কমরেড ভৈরব মন্ডল। ১৯৯৮ সালের ১ জুলাই সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক ঐ ৯টি খালের ইজারা অবৈধ ও বাতিল বলে ঘোষণা করতে বাধ্য হয়।।-১৯৯৭ সাল থেকে উপর্যপুরি উপজেলার ইউ.এন.ও, ওয়াপদা, ডিসি ও এসপি কার্যালয় ঘেরাও এবং কয়েকবার তালা উপজেলার ওপর দিয়ে যাওয়া পাইকগাছা-খুলনা সড়কটি অবরোধ করার ফলে।
সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক ৯টি খালের লিজ বাতিল করার পরেও যখন ঘের মালিকরা নেট-পাটা-বাঁধ অপসারণ না করে ৪টি ইউনিয়নের চলমান কৃষক আন্দোলনকে চ্যালেঞ্জ করে নতুনভাবে পাহারার জন্য ঘরবাড়ী নির্মাণ করে। আমরা ৩ জুলাই ১৯৯৮ তারিখে গণবিরোধী লিজ প্রতিরোধ কমিটির মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিই যে ১৬ জুলাই সকাল ৯টায় ঘের এলাকা সংলগ্ন গলাভাংগা হাটে লীজ উচ্ছেদের লক্ষ্যে সমাবেশ করা হবে। ঐ সমাবেশ সফল করার জন্য গ্রামে গ্রামে কৃষক জনতার সভা-সমাবেশ শুরু হয়। ১৬ জুলাইয়ের ঘের উচ্ছেদ অভিযানের সমাবেশ সফল করার জন্য যারা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন, তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ভৈরব মন্ডল। ১৬ জুলাইয়ের গলাভাংগা সমাবেশ মহাসমাবেশে পরিণত হয়। ৪টি ইউনিয়ন থেকে প্রায় ২০ হাজার কৃষক-জনতা দা, কুড়াল, খোনতা, কোদাল ও লাঠিসোটা নিয়ে ঐ মহাসমাবেশে হাজির হয়। মহাসমাবেশ কৃষক জনতার গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়। আধ ঘন্টার মতো সময় আমি ঘের উচ্ছেদের দিক নির্দেশনামূলক বক্তব্য রাখি এবং সমাবেশ থেকে ঘের উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনার জন্য একজনকে কমান্ডার করে ৫ জনের কমান্ড গঠন করা হয়। সমাবেশ থেকে আমাকে পলিটিক্যাল কমিশার নিয়োগ করা হয়। সকাল ১০টার মধ্যে ৯টি খালের নেট-পাটা-বাঁধ উচ্ছেদ অভিযান শুরু হয়। ঐদিন বিকাল ৫টার মধ্যে ঘের উচ্ছেদ অভিযান শেষ হয়। এই অভিযানেও কমরেড ভৈরব মন্ডল ছিলেন অন্যতম অগ্রণী নেতা।
১৭ জুলাই ঘের মালিকরা আমাদের নেতা-কর্মীদের নামে ৭৪ লাখ টাকার মাছ লুটের মামলা দেয়। এই মামলায় ২৫ জুলাই ঘেরবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নেতা কমরেড মুস্তফা লুৎফুল্লাহ (বর্তমানে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির পলিটব্যুরোর সদস্য ও জাতীয় সংসদ সদস্য)কে তার সাতক্ষীরার বাসভবন থেকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। এই ঘটনায় ঘেরবিরোধী আন্দোলনরত কৃষক জনতার মধ্যে প্রচণ্ড ক্ষোভ তৈরি হয়। আমরা ২৭ জুলাই কমরেড মুস্তফা লুৎফুল্লাহর মুক্তির দাবিতে এসপি কার্যালয় ঘেরাওয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। ৪টি ইউনিয়নের আন্দোলনরত কৃষক জনতাকে ২৭ জুলাই সকাল ৯টার মধ্যে দলুয়া বাজার থেকে নিজ খরচে বাসে করে সাতক্ষীরার এসপি কার্যালয়ের সামনে হাজির হতে বলা হয়। প্রায় ৫ হাজার কৃষক জনতা-নারীরা ঝাঁটা নিয়ে এবং পুরুষরা লাঠির মাথায় লাল পতাকা বেঁধে রওয়ানা হয়। আমরা সবশেষের বাসে রওয়ানা হই। পথিমধ্যে পাটকেলঘাটা বাজারে আমাদের আগের বাসের ওপর ঘের মালিকদের গুন্ডাবাহিনী হামলা করে বাস ভেংগে দেয় এবং কয়েকজন আহত হয়। আমরা পাটকেলঘাটার কাছে পৌঁছালে জানতে পারি যে আমাদের আগের গাড়ীর ওপর গুন্ডারা হামলা করেছে। তখন আমাদের বাস আর অগ্রসর হতে রাজি না হওয়ায় আমরা সবাই পাশের ইটভাটা থেকে ইটের খোয়া ও লাঠিসোটা নিয়ে সাতক্ষীরার দিকে রওনা দিই। গুন্ডাবাহিনী আমাদের জঙ্গীমিছিল দেখে পালিয়ে যায়। তখন আমরা সাতক্ষীরা মহাসড়ক থেকে একটা ট্রাকে করে এসপি কার্যালয়ে পৌঁছাই। আগের সমস্ত বাসের কৃষকজনতা এসপি কার্যালয়ের সামনে পৌছে গিয়েছিল। আমরা পৌঁছানোর পরপরই এসপি কার্যালয় ঘেরাও অভিযান শুরু হয়। ঘেরাও অভিযানের আগেই ঘটনাচক্রে জেলা প্রশাসক সাহেব এসপি কার্যালয়ে উপস্থিত ছিলেন। তিনি ঘেরাও শুরু হওয়ার পর গাড়ীতে করে তার কার্যালয়ে চলে যাওয়ার চেষ্টা করলে ঝাঁটা সজ্জিত নারীরা জ্যোৎস্না বাছাড়ের নেতৃত্বে গাড়ী অবরোধ করে এবং তারা কমরেড মুস্তফা লুৎফুল্লাহকে কারাগার থেকে মুক্ত করে এখানে হাজির করার দাবী জানায়। তা না করা পর্যন্ত জেলা প্রশাসক সাহেবকে যেতে দেওয়া হবে না। তখন জেলা প্রশাসক সাহেব বাধ্য হয়ে দোতালায় এসপির কার্যালয়ে যান এবং এক ঘন্টার মধ্যে মুস্তফা লুৎফুল্লাহকে মুক্ত অবস্থায় অবরোধস্থলে হাজির করা হয়। আমরা অবরোধ তুলে নিই। এসপি কার্যালয় ঘেরাও করার জন্য যারা অগ্রগামী ভূমিকা পালন করেছিলেন, তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন এই ভৈরব মন্ডল।
ঘেরবিরোধী আন্দোলনে কমরেড ভৈরব মন্ডল সাহসী ও অগ্রণী ভূমিকা নেওয়ায় ঘের মালিকদের কোপানলে পড়ে। ১৯৯৮ সালের ১৪ আগস্ট তারিখে বিকাল বেলায় পার্শ্ববর্তী গ্রাম বালিয়াদহ বাজারে তিনি বাজার করতে গিয়েছিলেন। বাজার থেকে ফেরার পথে ফাঁকা মাঠের মধ্যে ঘের মালিক মুকিত মেম্বারের নেতৃত্বে গুন্ডাবাহিনী ভৈরব মন্ডলকে বেধড়ক প্রহার করে রাস্তার পাশে ফেলে যায়। কিছুক্ষণ পর মাদরা গ্রামের অনেকে বাজার থেকে ফেরার সময় কমরেড ভৈরব মন্ডলকে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে। এদের মধ্যে একজন দৌড়ে গিয়ে গ্রামে খবর দিলে প্রায় হাজার খানেক মানুষ লাঠিসোটা নিয়ে ওখানে হাজির হয় এবং কমরেড ভৈরব মন্ডলকে উদ্ধার করে বাড়ীতে নিয়ে আসে। তার বামপায়ের হাটুর নিচের হাড় ভেঙ্গে গিয়েছিল। চিকিৎসা করে পা ভালো হয়ে গেলেও ঐ ঘটনার পর থেকে কমরেড ভৈরব মন্ডল হৃদরোগে ভুগতে থাকেন। অনেক চিকিৎসা নেওয়ার পরও তিনি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠতে পারেননি। ২০২০ সালের ২৯ জুন সকাল ৯টা ২০ মিনিটে নিজের বাড়ীতেই হঠাৎ হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর সময় তার বয়স হয়েছিল ৬২ বছর। তিনি ২ পুত্র-ধীরাজ মন্ডল ও সৌরভ মন্ডল ও এক কন্যা-রোহিনী মন্ডল এবং স্ত্রী কমলা রাণী মন্ডলকে রেখে গেছেন।
ভৈরব মন্ডল আমাদের পার্টি ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগের মাদরা শাখা কমিটির সদস্য ছিলেন। তিনি আমৃত্যু সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদের অভিমুখে জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের স্বপ্ন দেখেছেন। তিনি ছিলেন পার্টি অন্তঃপ্রাণ। তার সমগ্র পরিবারটি ছিল পার্টি কমরেডদের প্রতি আন্তরিক ও যত্নশীল। আমরা তার বাড়ীতে গেলে ভৈরব মন্ডল ও তার পরিবার আমাদের আদর যত্নের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়তেন। আমরা কমরেড ভৈরব মন্ডল ও তার পরিবারের কথা ভুলব না। আমরা কমরেড ভৈরব মন্ডলকে জানাই বিদায়ী লাল সালাম এবং সাথে সাথে মাদরার সংগ্রামী কৃষক-জনতাকে জানাই লাল সালাম।
আসুন, আমরা সকলে বাংলাদেশকে একটি শোষণমুক্ত বাংলাদেশে পরিণত করার সংগ্রাম বেগবান করি এবং কমরেড ভৈরব মন্ডলদের মতো শত শত প্রয়াত ও শহীদ কমরেডদের রক্তে রঞ্জিত পতাকা নিয়ে অগ্রসর হই এবং কমরেড ভৈরব মন্ডলের স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ি।

লেখক: সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটি, বাংলাদেশের ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগ।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ