নাগাসাকিতে সেদিন কী ঘটেছিল

প্রকাশিত: ৪:৫৬ অপরাহ্ণ, আগস্ট ৯, ২০২৩

নাগাসাকিতে সেদিন কী ঘটেছিল

মনজুরুল হক |

৯ আগস্ট ১৯৪৫। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। এই দিনে জাপানের নাগাসাকি শহরে পারমাণবিক বোমা ফেলে মিত্র বাহিনী। এর তিন দিন আগে ৬ আগস্ট ১৯৪৫ সালে হিরোশিমা শহরেও বোমা নিক্ষেপ করেছিল তারা। বিধ্বস্ত হয়েছিল ওই শহরও। আজ নাগাসাকি দিবসে জানা যাক, এই শহরের কোথায় সেদিন বোমা ফেলা হয়েছিল এবং এই বোমার প্রতিক্রিয়ায় কী কী ঘটেছিল!

জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরের ওপর আণবিক বোমা হামলা এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর সাত দশক অতিক্রান্ত হয়ে গেছে।

জাপানের দুটি শহরকে মাত্র তিন দিনের ব্যবধানে আণবিক বোমা হামলার শিকার হতে হলেও আণবিক বোমার ভয়াবহতা এবং সেই ভয়াবহ পরিণতি এড়িয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে বিশ্বজুড়ে জনমত সৃষ্টি ও প্রচারের বেলায় হিরোশিমার নাম নাগাসাকির চেয়ে অনেক বেশি উচ্চারিত হতে শোনা যায়। শুধু তা-ই নয়, আণবিক বোমা যে মর্মান্তিক পরিণতি নাগরিক জীবনে নিয়ে এসেছিল, সেসব কাহিনির বর্ণনায়ও হিরোশিমা অনেক বেশি উপস্থিত। এর প্রধান কারণ অবশ্যই নাগাসাকির চেয়ে মাত্র তিন দিন আগে (৬ আগস্ট ১৯৪৫) বিশ্বের প্রথম শহর হিসেবে হিরোশিমার আণবিক বোমা হামলার পরিণতি সহ্য করা। তাই বলে নাগাসাকির ক্ষয়ক্ষতি এবং ধ্বংসের বিস্তৃতি কিন্তু হিরোশিমার চেয়ে কোনো অংশেই কম ছিল না।

৭০ বছর আগে ১৯৪৫ সালের ৯ আগস্ট নাগাসাকি শহরের ক্যাথলিক গির্জার ঠিক ওপরে ফেলা আণবিক বোমা সেদিনই ৭০ হাজারের বেশি বেসামরিক নাগরিকের প্রাণ হরণ করেছিল এবং দীর্ঘমেয়াদি সময়ে নিহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল আরও অনেক বেশি। হিরোশিমার মতোই প্রাণে বেঁচে যাওয়া অনেককেই দীর্ঘকাল ধরে সইতে হয়েছে নানা রকম শারীরিক ও সামাজিক প্রতিকূলতা।

কিছুদিন আগেও এমন এক সময় জাপানে ছিলেন ‘হিবাকুশা’ নামে পরিচিত আণবিক বোমা হামলায় প্রাণে বেঁচে যাওয়া লোকজন। তাঁরা তাঁদের দুঃখ আর বেদনার কথা প্রকাশ করতে দ্বিধা বোধ করতেন। যুদ্ধের ঠিক পরপর যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি দখলে জাপানে থাকার সময় আণবিক বোমাসংক্রান্ত সব রকম খবর প্রচারের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা এবং পরবর্তী সময়ে ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনকে সামাজিকভাবে করুণার দৃষ্টিতে দেখার প্রবণতা তাঁদের মধ্যে নিজেকে গুটিয়ে রাখার মনোভাব জাগিয়ে তুলেছিল। ফলে নিজেদের দুঃখের কথা অন্যদের বলায় তাঁদের মধ্যে অনাগ্রহ ছিল।
কিছুদিন আগেও এমন এক সময় জাপানে ছিলেন ‘হিবাকুশা’ নামে পরিচিত আণবিক বোমা হামলায় প্রাণে বেঁচে যাওয়া লোকজন। তাঁরা তাঁদের দুঃখ আর বেদনার কথা প্রকাশ করতে দ্বিধা বোধ করতেন। যুদ্ধের ঠিক পরপর যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি দখলে জাপানে থাকার সময় আণবিক বোমাসংক্রান্ত সব রকম খবর প্রচারের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা এবং পরবর্তী সময়ে ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনকে সামাজিকভাবে করুণার দৃষ্টিতে দেখার প্রবণতা তাঁদের মধ্যে নিজেকে গুটিয়ে রাখার মনোভাব জাগিয়ে তুলেছিল। ফলে নিজেদের দুঃখের কথা অন্যদের বলায় তাঁদের মধ্যে অনাগ্রহ ছিল।

তবে পরবর্তী সময়ে অবশ্য বিশ্বজুড়ে পারমাণবিক অস্ত্রবিরোধী আন্দোলন আরও অনেক বেশি জোরালো হয়ে ওঠার মুখে জাপানেও সেই ঢেউ এসে লাগে এবং অনেকেই আণবিক বোমা হামলার সরাসরি শিকার যাঁদের হতে হয়েছিল, তাঁদের মুখ থেকে সেই মর্মান্তিক অভিজ্ঞতার কথা শুনতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। সে রকম অনুকূল পরিবেশ ‘কাতারিবে’ নামে পরিচিত কথক বা বোমা হামলার শিকার লোকজনের গল্প বলার সুযোগ করে দিয়েছিল, অনেকটা নিয়মিতভাবে যাঁরা এখন, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের কাছে তাঁদের সেই দুর্দশার স্মৃতি তুলে ধরছেন। তবে তাঁদের মধ্যে যাঁরা এখনো জীবিত, তাঁরা সবাই বয়োবৃদ্ধ হয়ে পড়ায় সেই স্মৃতি মানুষের কাছে কথা বলার মধ্য দিয়ে পৌঁছে দেওয়ার লোকজন অল্প কয়েক বছর পর আর হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না। সেই অভাব পূরণ করতেই হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরের কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান অবশ্য তরুণদের প্রতি সেই দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাচ্ছে। হিবাকুশাদের কাছ থেকে তাঁদের অভিজ্ঞতার বর্ণনা শুনে নিয়ে ঠিক সেভাবে মানুষের কাছে তা বলার চর্চা যাঁরা এখন করছেন। ফলে হিবাকুশাদের চলে যাওয়ার পরও তাঁদের স্মৃতি অম্লান রাখার কাজ জাপানে ঠিকই এগিয়ে চলেছে।

আণবিক বোমা হামলার ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টি জাপানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঠিক পর থেকে বেশ কিছুকাল নিষিদ্ধ একটি বিষয় হিসেবে গণ্য ছিল। ম্যানহাটন প্রকল্প নামে পরিচিত যুক্তরাষ্ট্রের আণবিক বোমা তৈরির গবেষণার প্রধান যিনি ছিলেন, সেই মার্কিন জেনারেল লেসলি গ্রোভস যেমন মার্কিন সিনেটের এক শুনানিতে বলেছিলেন যে উচ্চমাত্রার তেজস্ক্রিয়তার সংস্পর্শে এসে মৃত্যুবরণ করা কার্যত হচ্ছে, মাত্রাতিরিক্ত যন্ত্রণা ভোগ না করে মারা যাওয়া এবং সত্যিকার অর্থে সেভাবে মারা যাওয়া হচ্ছে বেশ সুখকর এক অভিজ্ঞতা। যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চপর্যায়ের সামরিক–বেসামরিক কর্মকর্তা ও নীতিনির্ধারকেরা বাস্তবিক অর্থেই বিশ্বকে সে ধারণা দিতে চেয়েছিলেন বলেই হিরোশিমা-নাগাসাকির মর্মান্তিকতার ঘটনা চেপে রাখা তাঁদের জন্য আবশ্যক হয়ে দেখা দিয়েছিল।

জন হার্সির লেখা হিরোশিমার বোমা হামলা-পরবর্তী সময়ের মর্মান্তিক বিবরণ সারা বিশ্বের পাঠক জেনে যাওয়ার পরও নিষিদ্ধ হওয়ার কারণে জাপানি পাঠকেরা অনেক দিন ধরে বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা সেই বই পাঠ করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত ছিলেন। তবে মার্কিন দখলদারির অবসানের পর থেকে ধীরে ধীরে সেই নিষিদ্ধ দুয়ার উন্মোচিত হয় এবং এখন অনেকেই আগ্রহ নিয়ে হিবাকুশা ও তাঁদের মধ্যে যাঁরা আবার গল্পের আকারে সেই মর্মান্তিক ঘটনার বর্ণনা তুলে ধরতে পারদর্শী, তাঁদের মুখ থেকে সরাসরি সেই ইতিহাস জেনে নিতে আগ্রহী হয়ে উঠছেন। পাশাপাশি হিরোশিমা আর নাগাসাকি দুই শহরই স্মৃতি ধরে রাখা এবং পারমাণবিক অস্ত্র বিশ্ব থেকে বিলুপ্ত করার বার্তা পৌঁছে দেওয়ার নানা রকম উদ্যোগ নিয়মিতভাবে গ্রহণ করে চলেছে। হিরোশিমার বিধ্বস্ত গম্বুজ তো এখন অনেকটাই যেন পরমাণুমুক্ত বিশ্ব গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তার এক প্রতীক হয়ে উঠেছে।

নাগাসাকির সে রকম ব্যতিক্রমী একটি উদ্যোগ হচ্ছে, শহরের কেন্দ্রস্থলে গড়ে ওঠা শান্তি পার্ক। পার্কের পরিচিত প্রতীক হলো, ১৯৫৫ সালে আণবিক বোমা হামলার দশম বার্ষিকীতে সেখানে স্থাপন করা ১০ মিটার উঁচু এক ভাস্কর্য। এক হাত প্রসারিত করে এবং অন্য হাত আকাশের দিকে সোজা উঁচু করে ধরে রেখে যে ভাস্কর্য একই সঙ্গে পরমাণু অস্ত্রের হুমকি, শান্তি ও স্থিতিশীলতার প্রয়োজনীয়তার কথা বলছে। ভাস্কর্যটির নকশা করেছেন সেইবো কিতামুরা। জাপান ও বিশ্বের অন্যান্য দেশের মানুষের কাছ থেকে পাওয়া অর্থসহায়তায় এটি তৈরি করা হয়।

এই ভাস্কর্যকে ঘিরে গড়ে ওঠা উদ্যানটি হলো নাগাসাকির শান্তি উদ্যান। নাগাসাকি নগর কর্তৃপক্ষ উদ্যানের আন্তর্জাতিক আকার দেওয়ার জন্য ১৯৭৮ সালে সেখানে শান্তি ভাস্কর্য স্থাপনের আহ্বান বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রতি জানিয়েছিল। সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে একই বছর প্রথম সেখানে শান্তির প্রতীক ভাস্কর্য স্থাপন করে পতুর্গালের পোর্তো নগরী। পোর্তোর সঙ্গে নাগাসাকির রয়েছে সিস্টার সিটি বা সহোদরা শহর চুক্তি। উল্লেখ্য, পতুর্গিজরাই ছিল প্রথম বিদেশি, নাগাসাকিতে যারা প্রথম গড়ে তুলেছিল বাণিজ্য ঘাঁটি। যদিও অল্প কিছুকাল পরই সেখান থেকে তাদের বিতাড়িত করা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে আরও প্রায় ১৫টি দেশ ও শহর সেখানে ভাস্কর্য স্থাপন করায় নাগাসাকির শান্তি উদ্যান পেয়েছে ভিন্ন এক আন্তর্জাতিক চেহারা।

সূত্র: ‘হিরোশিমা নাগাসাকির কথা’, লেখক: মনজুরুল হক, প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৮। নিবন্ধটি উল্লিখিত বইয়ের ‘হিরোশিমা-নাগাসাকি: সাত দশকের ট্র্যাজেডি’ অধ্যায়ের নির্বাচিত অংশ।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ