সিলেট ১৫ই অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৩০শে আশ্বিন, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ১২:৫৩ পূর্বাহ্ণ, ডিসেম্বর ১৯, ২০২৪
মনোজ কুমার সাহা | টুঙ্গিপাড়া (গোপালগঞ্জ), ১৯ ডিসেম্বর ২০২৪ : আজ ১৯ ডিসেম্বর কাশিয়ানী মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এইদিনে গোপালগঞ্জ জেলার কাশিয়ানী উপজেলা হানাদার মুক্ত হয়।
১৯৪৮ সাল থেকে ৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৫৪’র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন ও ২১ দফার সংগ্রাম, ৬২’র শিক্ষার আন্দোলন, ৬৬’র ছয় দফা, ছাত্রদের ১১ দফার আন্দোলন ও ৬৯’র গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের ২২ ফেব্রুয়ারী কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের সমন্বয় কমিটির একাংশের নেতৃত্বে পল্টনের বিশাল জনসভা থেকে ‘স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা’র কর্মসূচি ও ঘোষণা প্রকাশ্যে উত্থাপন, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ও ১৯৭১ সালের ৯ মার্চ ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) আয়োজিত এক বিশাল জনসভায় বাঙালির স্বাধীনতা আন্দলন ও বঙ্গবন্ধুর সিদ্ধান্তের প্রতি মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর একাত্মতা ঘোষণা, ২৫ মার্চে গণহত্যা শুরু হলে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা, ১০ এপ্রিল স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র (অন্তর্বর্তী সংবিধান প্রণয়ন), ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠন এবং রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে ৩০ লাখ শহীদ ও দু’লাখ মা-বোনের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয় স্বাধীনতা। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাক সেনাদের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়। সেই হিসাবে বিজয়ের ৫৩ বছর পূর্ণ হয়েছে এবার।
বাঙালির স্বাধীনতা আন্দলন ও বঙ্গবন্ধুর সিদ্ধান্তের প্রতি মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর একাত্মতা ঘোষণার পর জাতিগত নিপীড়ন-শোষণ-বৈষম্য-বঞ্চনার শিকার মুক্তিপাগল বাঙালি যুদ্ধের জন্য তৈরিই ছিলো বলা যায়।
১৯৭১ সালের ১ ও ২ জুন কলকাতার বেলেঘাটায় যুদ্ধরত কমিউনিস্ট ও বামপন্থী দল এবং গণসংগঠনসমূহ মিলিত হয়ে গঠন করেছিল বাংলাদেশ জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি। এ সম্মেলনে গৃহীত ঘোষণাপত্র তখন আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় প্রচারিত হয়েছিল। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকার করেই সমন্বয় কমিটি সরকারকে সহযোগিতাও যেমন করবে, তেমনি স্বতন্ত্রভাবেও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করবে। এ সমন্বয় কমিটির মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ দল ছিল ন্যাপ (ভাসানী) ও ‘কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটি’ যার নেতৃত্বে সারাদেশে ১৪টি সশস্ত্র ঘাটি এলাকা ছিল।
জাতির সূর্য সন্তান, ৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে তিরিশ লাখ শহীদ ও সকল শহীদ বুদ্ধিজীবী, সম্ভ্রম হারানো ২ লক্ষ মা-বোন, নির্যাতিত পনের লাখেরও বেশি মানুষ, সর্বস্ব হারানো ১ কোটি মানুষসহ গোটা জনগণের লড়াই-সংগ্রাম-ত্যাগ তিতিক্ষা অার অবদানের জন্য তাঁদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা ও অভিবাদন!
মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর আক্রমনে পাকিস্তানি বাহিনীর দখলে থাকা কাশিয়ানীর ভাটিয়াপাড়া ওয়্যারলেস স্টেশনের ক্যান্টনমেন্টের পতন ঘটে এইদিনে। দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয় ১৬ ডিসেম্বর অর্জিত হলেও কশিয়ানীর ভাটিয়াপাড়ায় স্বাধীন বাংলাদেশের লাল-সবুজের পতাকা ওড়ে ১৯ ডিসেম্বর সকালে।
ভাটিয়াপাড়া শহীদ স্মৃতিস্তম্ভে শ্রদ্ধা নিবেদন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী জনতার সমাবেশ মধ্যদিয়ে দিবসটি উদযাপন করবে কাশিয়ানী উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।
মুক্তিযুদ্ধ কালীন কাশিয়ানী উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার এনায়েত হোসেন জানান, গোপালগঞ্জ-ফরিদপুর-নড়াইল জেলার সীমান্তে অবস্থিত এবং ভৌগলিক ও যুদ্ধের দিক থেকে গুরুত্বপূর্ন রেলস্টেশন ও নদী বন্দর ভাটিয়াপাড়া দখল নিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে লড়াই হয় কয়েক দফা। পাকিস্তানি বাহিনীর ভাটিয়াপাড়া মিনি ক্যান্টনমেন্টটি গোপালগঞ্জ জেলার অন্তর্ভূক্ত হলেও ফরিদপুর-নড়াইল-গোপালগঞ্জ অঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধাদের লক্ষ্যবস্তু ছিলো ভাটিয়াপাড়ার ওই মিনি ক্যান্টনমেন্টটি। তাই এখানে তুমুল লড়াই হয়।
কাশিয়ানী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বীরমুক্তিযোদ্ধা মোক্তার হোসেন বলেন, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ১৯৭১ সালের মে মাসে এখানে ওই অয়্যারলেস স্টেশনে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করে। দীর্ঘ ৭ মাসব্যাপী ৬৫ পাকিস্তানি সেনার শক্তিশালী একটি গ্রুপ এখানে অবস্থান করে এলাকার নিরীহ মুক্তিকামী মানুষের উপর নির্যতন, নিপীড়ন ও গণহত্যাযজ্ঞ চালায়। অনেক মুক্তিকামী মানুষকে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী লাশ ভাটিয়াড়ার দিয়ে প্রবাহিত মধুমতি নদীতে ভাসিয়ে দিতো। পাকিস্তানি বাহিনীর একটি দল গোপালগঞ্জ সদর উপজেলা সংলগ্ন জয়বাংলা পুকুরপাড়ের মিনি ক্যান্টনমেন্টন থেকে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ৬ ডিসেম্বর রাতে পালিয়ে গিয়ে ভাটিয়াপাড়ার ওই ক্যাম্পে অবস্থান নেয়।
ভাটিয়াপাড়ার পাকিস্তানি বাহিনীর মিনি ক্যন্টনমেন্টটি দখলে নিয়ে ৬ নভেম্বর দু’টি মারাত্মক যুদ্ধ হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে টানা ১৫ ঘন্টা পাকিস্তানি বাহিনীর যুদ্ধ হয়। এ সময় মুক্তিযোদ্ধাদের ঘায়েল করতে পাকিস্তানি বাহিনী আকাশ পথে বিমান থেকে গুলি ও বোমা বর্ষণ করতে থাকে। কিন্তু সেদিন অসীম সাহসী মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটেনি। এ যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনী যথেষ্ট ঘায়েল হয়। সে সময় মুক্তিযোদ্ধা মীর মহিউল হক মিন্টু , সাধুহাটির এ কিউএম জয়নুল অবেদীন শহীদ হন।
মোক্তার হোসেন বলেন, ওই অয়্যারলেস ক্যাম্প দখল নিয়ে দ্বিতীয় দফায় যুদ্ধ হয় ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের দিনে। তিনদিন যুদ্ধের পর ১৯ ডিসেম্বর খুব ভোরে নড়াইল গোপালগঞ্জ ও ফরিদপুরের দিক থেকে মুক্তিবাহিনীর কমান্ডারগণ সম্মিলিতভাবে ভাটিয়াপাড়া ক্যান্টনমেন্টে আক্রমন চালায়। মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বাত্মক এ হামলা ও বীরোচিত সাহসী যুদ্ধে অবশেষে ১৯ ডিসেম্বর সকাল ১০টার দিকে মুক্তি ও মিত্রবাহিনীর যৌথ কমান্ডের কাছে ৬৫ জন পাকিস্তানি সেনা আত্মসমার্পন করে। এ যুদ্ধে ৬ পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। অপরদিকে মুক্তিযোদ্ধা মশিউর রহমান সিকদার, অনিল কুমার বিশ্বাস, মজিবর রহমান, মোহাম্মদ হান্নান শেখ নিহত হয়।
এরপর ভাটিয়াপাড়ার ওয়্যারলেস স্টেশনের মিনি ক্যান্টনমেন্টে উড়ানো হয় বাংলাদেশের মানচিত্র ও লাল সূর্য খচিত গাঢ় সবুজ জমিনের বিজয় পতাকা। এরই মধ্যদিয়ে হানাদার মুক্ত হয় কাশিয়ানীর ভাটিয়াপাড়াসহ সমগ্র গোপালগঞ্জ অঞ্চল। মুক্তিযোদ্ধারা আনন্দে আত্মহারা হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে বিজয় মিছিল বের করেন। হাজার-হাজার মুক্তিকামী মানুষ এ বিজয় মিছিলে অংশ নিয়ে অনন্দ উল্ল¬াসে মাতোয়ারা হয়ে ওঠেন।
কাশিয়ানী উপজেলা নির্বাহী অফিসার ফারজানা জান্নাত বলেন, ভাটিয়াপাড়া যুদ্ধক্ষেত্রের স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হবে। এরপর ভাটিয়াড়া যুদ্ধক্ষেত্রের শহীদ ও মহান মুক্তিযুদ্ধে আত্মউৎসর্গকারী ৩০ লাখ শহীদের আত্মার শান্তি কামনায় দোয়া-মোনাজাত করা হবে। এতে উপজেলা প্রশাসন, পরিষদ, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, বীরমুক্তিযোদ্ধাসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ অংশ নেবেন।
সম্পাদক : সৈয়দ আমিরুজ্জামান
ইমেইল : rpnewsbd@gmail.com
মোবাইল +8801716599589
৩১/এফ, তোপখানা রোড, ঢাকা-১০০০।
© RP News 24.com 2013-2020
Design and developed by ওয়েব নেষ্ট বিডি