হারিয়ে যাওয়া এক আগুণ পাখি

প্রকাশিত: ১২:১৬ পূর্বাহ্ণ, জানুয়ারি ১২, ২০২৫

হারিয়ে যাওয়া এক আগুণ পাখি

Manual3 Ad Code

বিশেষ প্রতিবেদন | ঢাকা, ১২ জানুয়ারি ২০২৫ : “ইতিহাসের বই খুঁজলে মিলবে না কিছুতেই। তার চেয়ে বড় কথা মিলবে না টিটাগড় ষড়যন্ত্র মামলার কথাটাই। আর থাকলেও এক লাইন, দু লাইন আর এক বুক নীরবতা। আরও হাজারও ভুলে যাওয়ার মত এও এক।

Manual5 Ad Code

সাল ১৯২৯। বিপ্লবীদের গোপন ডেরা টিটাগড়ে। আরও অনেকগুলো ডেরার মত এটাও ছিল একটা। পূর্ণানন্দ দাশগুপ্তের হাত ধরে সংগঠনে যোগ দেন পারুল।

Manual5 Ad Code

পারুল মুখার্জি। নেতা পূর্ণানন্দ এবং শ্যামবিনোদ পালচৌধুরী ছাড়া আর কেউই বোধহয় জানতেন না পারুলের আসল নাম”— লিখছেন রক্তিম ঘোষ
কোন নামে ডাকা যায় তাকে? নীহার, শান্তি, আরতি, রানী, খুকি, শোভারানী, সুরমাদেবী যে কোন নাম বেছে নেওয়া যায়। বিপ্লবীদের নামে কিবা আসে যায়? আবার এমনও নয় যে আসল নামটা বললে লোকে লুফে নেবে। সে যাই হোক না কেন ১৯৩৫ এর ৩১ শে অক্টোবর এর স্পেশাল ট্রাইবুনালে যে ৩১ জনের বিচার শুরু হল তার মধ্যে পারুলেরও নাম ছিল।

Manual8 Ad Code

পারুল মুখার্জি। নেতা পূর্ণানন্দ এবং শ্যামবিনোদ পালচৌধুরী ছাড়া আর কেউই বোধহয় জানতেন না পারুলের আসল নাম। অগ্নিযুগের গোপন বিপ্লবী সংগঠনের ছিল এমনই রীতি। তখন মরণ পাগল যুগ। দেশের যুবসম্প্রদায়ের একটা বড় অংশের রক্তে তখন সর্বনাশের নেশা। পরাধীনতার চেয়ে বড় অভিশাপ আর কিই বা হতে পারে একটা দেশের কাছে? যতীন দাসের মৃতদেহ নিয়ে বিশাল মিছিল দেখেছে কোলকাতা। লাহোর জেলে বন্দী ভগত সিং ও তাঁর সাথীরা তখন আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে ঘোষণা করছেন প্রকৃত স্বাধীন ভারতের কথা, সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন আঘাত হানছে স্থবির বৃদ্ধ অক্ষম আপোশপন্থী রাজনীতিকদের। ঠিক তখনই সাড়া দিল চট্টগ্রাম, মাস্টারদার নেতৃত্বে যুব অভ্যুত্থান, রোজ রোজ খবর আসতে লাগলো নতুন ইতিহাস তৈরির। ঠিক তখনই টিটাগড়ের গোয়ালপাড়ার বিপ্লবী ডেরা কাম অস্ত্রের ঘাঁটি সামলাচ্ছিলেন পারুল। অস্ত্রচালাতে তিনিও জানতেন। বিস্ফোরক দিয়ে বোমা বাঁধা থেকে শুরু করে আগ্নেয়াস্ত্র চালানোর তালিম সবটাই ছিল তাঁর। আর বিপ্লবী আখড়ার চিরাচরিত লাঠিখেলা? তাতেও পিছপা ছিলেন না তিনি। তাঁর বিপ্লবের জন্য আত্মত্যাগ এবং শৃঙ্খলাপরায়নতার জন্য সকলের কাছেই তিনি ছিলেন বিশেষ শ্রদ্ধার পাত্রী।

১৯৩৫ সালে হঠাৎই পুলিশী হানায় ধরা পড়ে যান পারুল। সাথে ধরা পড়ে সালফিউরিক অ্যাসিড, নাইট্রিক অ্যাসিড, মেটা নাইট্রানিলিন সহ বহু বিস্ফোরক। বিপ্লবী নেতা শ্যামবিনোদ পালচৌধুরী তখন আখড়াতেই ছিলেন, ধরা পরলেন তিনিও। অন্যান্যদের সাথে পারুলকেও বিস্ফোরক আইনের ৫ এ ধারায় অভিযুক্ত করে পুলিশ, সাথে জুড়ে দেয় আরও অনেক অভিযোগ। কিন্তু পারুল ভেঙে যান নি একটুও। পুরুষ সহকর্মীদের সাথে কাঠগড়ায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থেকেছেন দিনের পর দিন। আর আদালতে শুনানির দিনগুলোয় ভিড় উপচে পড়ত মানুষের। এক মহিলা বিপ্লবীকে দেখবার উৎসাহ এবং বিস্ময় মিশ্রিত শ্রদ্ধা মিশে গেছিল একসাথে। সত্যিই তো সেই চল্লিশের দশকে পুলিশের, গোয়েন্দার চোখ এড়িয়ে, পরিবার পরিজন ছেড়ে কটা মেয়েই বা এভাবে জীবন উৎসর্গ করার কথা ভাবতে পারতো?

হাজার বছর ধরে মেয়েরা যে ঘরে সাজানোর পুতুল হয়েছিল, তার বাঁধ ভেঙে দিতে কাউকে না কাউকে তো এগিয়ে আসতেই হত দৃষ্টান্ত হয়ে। পারুল সেই বিরল দৃষ্টান্ত গড়েছিলেন প্রীতিলতার মতই দৃঢ়তার সাথে। পুলিশের কৌশল কম ছিল না তাঁকে ভাঙবার জন্য। জোর করে তাঁর নামে মিথ্যে স্বীকারোক্তি আদালতে পেশ করে চেষ্টা ছিল তাঁকে বিশ্বাসঘাতক প্রতিপন্ন করার। পারুল আদালতে দাঁড়িয়ে পুলিশের সেই দাবী অস্বীকার করে বলে স্বেচ্ছায় তিনি কোন স্বীকারোক্তি দেননি। কিভাবে শহীদের রক্তকে, বিপ্লবের আদর্শকে ছোট হতে দেবেন তিনি? দেশ টুকরো করে গদির লোভে যারা আন্দোলন আন্দোলন খেলা করছিলেন, তাঁদের দলে নাম লেখানোর মত ছোট তিনি নন। নাই বা থাকল নাম ইতিহাসের পাতায়। কিবা আসে যায় তাতে? ছোট ছোট এই আত্মত্যাগগুলোই জমাট বেঁধে এগিয়ে নিয়ে যায় মানুষের ইতিহাস। সেখানে পারুল মুখার্জির ছোট পায়ের ছাপ মিশে গেল, যেমন মিশে গেছে আরও আরও হাজার হাজার মেয়ের, পুরুষ কমরেড এর সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে।।

তথ্যসুত্র:
স্বাধীনতা আন্দোলনে সশস্ত্র বিপ্লবী নারী, চিন্ময় চৌধুরী, দে’জ পাবলিশিং

Manual7 Ad Code

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

 


Follow for More!

Manual1 Ad Code
Manual6 Ad Code