কবিতা, পাঠক আর বাতিঘর

প্রকাশিত: ৭:০৭ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ২৩, ২০২১

কবিতা, পাঠক আর বাতিঘর

Manual1 Ad Code

| দীপঙ্কর দাশ |

যে বয়সে পদ্মফুলের ওপর সাপ-ভ্রমরের খেলা দেখে কিংবা তরুণীর গাঢ় নীল চোখের ওপর চোখ রেখে সময়ের কাঁটা ঘোরানোর কথা ছিল, সে-সময় আমরা অর্থাৎ ‘মালঞ্চ’-র বন্ধুরা কবিতার প্রেমে পড়েছিলাম। ‘মালঞ্চ’ মানে, বাংলাদেশের চট্টগ্রামের পটিয়ার সাহিত্য সংগঠন। সেটা বিগত শতকের নব্বই দশকের শুরুতে। প্রতিমাসে কোনো এক বৃহস্পতিবার আমরা নিজেদের লেখা নিয়ে আলোচনা করতাম। দুরন্তপনা কিংবা প্রেমে পড়া, কোনোটাই নিঃসন্দেহে মন্দ কিছু নয়। তবুও সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য যা-ই হোক না কেন, স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, কবিতা আমার প্রথম প্রেম। কবিতা পড়া। বাংলা কবিতা বা বিদেশি কবিতার অনুবাদ। কিছুটা লেখার চেষ্টাও করেছিলাম বটে। ওই সময় যুক্ত হই অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ প্রতিষ্ঠিত বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র-র সঙ্গে। বইপত্রের সঙ্গে এ-সম্পর্কের সূত্রেই ‘বাতিঘর’-এর পোকা মাথায় ঢোকে।

আপনারা হয়তো অনেকে জানেন, বা না-ও জানতে পারেন—আমি গত এক যুগেরও কিছুটা বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে ‘বাতিঘর’ নামে চট্টগ্রাম, ঢাকা আর সিলেটে গ্রন্থবিপণি পরিচালনার কাজে যুক্ত। বিনয়ের সঙ্গে শুধু এটুকু বলব, বাতিঘর বিপুলসংখ্যক পাঠকের ভালোবাসায় ধন্য। অনেক পাঠকের কাছেই এটি স্বপ্নের ঠিকানা।

এই গ্রন্থবিপণি প্রতিষ্ঠা কিংবা পরিচালনা তো বটেই, এমনকী ‘বাতিঘর’ নামকরণেও আমি কবিতার কাছে ঋণী। অনেকে প্রশ্ন করেন, ‘বাতিঘর’ নামটি কার দেওয়া? বা, একটা গ্রন্থবিপণির নাম ‘বাতিঘর’ হতে পারে, সেই ধারণাটিই-বা কোথায় পেলাম? উৎসুক বন্ধুদেরকে আমি সবিনয়ে কবিতার কাছে কৃতজ্ঞতার কথা স্মরণ করিয়ে দেই।

বইবিপণির নাম কী হতে পারে, তার জন্য আমি বেশ ক-টি বাংলা কবিতাসংকলনের আশ্রয় নিয়েছিলাম। কবিতার শরীরে সুন্দর সুন্দর শব্দের সমাহার থাকে। সেখান থেকে কিছু সুন্দর শব্দ আমি আলাদা করে লিখে রাখছিলাম। যতদূর মনে পড়ে, ‘বাতিঘর’ শব্দটি পেয়েছিলাম ত্রিদিব দস্তিদারের কবিতা থেকে। যদিও সেই কবিতাটি আমি পরে খুঁজে পাইনি। যা-ই হোক, প্রিয় কবিতা একসময় মানুষের মুখে মুখে ফেরে। কবির নাম পাঠকের অনেকসময় মনে না-ও থাকতে পারে। কিন্তু কবিতা শাশ্বত ও চিরন্তন। ‘বাতিঘর’ শব্দটি পড়ে আমি খানিকটা থমকে যাই। নাম নির্বাচন নিয়ে বন্ধু, অগ্রজ অনেকের সঙ্গে আলাপ করি। দু-একজন ছাড়া প্রায় সবাই পছন্দ করেছিলেন নামটি।

Manual7 Ad Code

কবিতা পড়া বা লেখা যেটাই হোক না কেন, তার সঙ্গে অর্থযোগের সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। তার ওপর বিপণন আরও কঠিন কর্ম। এ-কথা সত্যি যে, সাহিত্যচর্চার শুরুতে, বিশেষত তরুণ বয়সে বেশিরভাগ লেখকই কবিতা দিয়ে শুরু করেন। লিখতে গেলে পড়তে হয়, তা অনেকে বলেন। কবিতা পড়ব, সেটা ঠিক আছে। কিন্তু কার কবিতা, কোন কবিতা ভালো লাগবে, তা পাঠকের নিজস্ব ব্যাপার। অনেকে হয়তো ভাবেন, কবিতার পাঠক অনেক। বাস্তবতা হল, কবিতার বই-এর ক্রেতা খুব বেশি নয়, সীমিত। বড়ো কবিদের ব্যাপারটা অবশ্যই আলাদা।

Manual5 Ad Code

তবুও আমরা বাতিঘরের মতো বইবিপণিতে অনেক বড়ো অংশ জুড়ে কবিতার বই রাখি। সাধারণভাবে মানুষ আর সব শিল্পী-সাহিত্যিকের মধ্যেও কবিদের আলাদা শ্রদ্ধা করে। এটা বিশেষ কিছু অবশ্যই। এ কারণে সীমিত হলেও কবিতার পাঠককে আমরা খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। কবিতাপ্রেমী পাঠক এবং কবি নিজেও খুবই সংবেদনশীল। কবির প্রতি সমাজ কিংবা রাষ্ট্রের শ্রদ্ধা বা ঘৃণা, পছন্দ বা অপছন্দ যুগে যুগে ছিল। থাকবেও হয়তো। যতদিন বীজ থেকে অঙ্কুরোদ্গম বন্ধ না হবে, ততদিন পর্যন্ত কবিতার মৃত্যু নেই বলে আমার ধারণা। এসব অবশ্য আমার বলার বিষয় নয়। আবার ভাবছি, কীই-বা বলব। আমি বিপণনের ছাত্রও নই যে কবিতার বিপণনের চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে পারব। শুধু অনুভব, উপলব্ধি কিংবা অভিজ্ঞতা বিনিময় করতে পারি বড়োজোর।

কবিতা পাঠ কিংবা রচনা অনেকটা নীরব এক আন্দোলনের মতো। শঙ্খ ঘোষের ঘুমিয়ে পড়া অ্যালবাম বই-এ পড়েছি, সুভাষ মুখোপাধ্যায় যখন নাজিম হিকমতের কবিতা অনুবাদ করছেন কিংবা বাঙালি পাঠক যখন নাজিম হিকমতের কবিতার বাংলা অনুবাদ পড়ছেন, তুরস্কে সেইসময় অবধি নাজিম হিকমতের কোনো কাব্য গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়নি। আসলে, কবিরা এক অদৃশ্য মিছিলের সঙ্গী— সেই মিছিলের প্রতিটি স্লোগান বা কণ্ঠস্বর যদিও আলাদা, তবুও সকলে একই তীর্থের যাত্রী। কবিতার পাঠকও তা-ই। সুন্দরের পথে এই যাত্রা অনন্তকাল ধরে চলবে।

কবিতার বিপণনের কথাও আমরা নিশ্চয় ভাবব। তবে এ এক মরীচিকার মতো বলে আমার ধারণা। কবিতার প্রকৃত পাঠক কে? এটা সুনির্দিষ্ট করা খুবই কঠিন। আবার, কবিতার পাঠক কে নয়? পাঠককে আলাদা করা মুশকিল। জীবনে কবিতা শোনেননি এমন মানুষ সত্যিই দুর্লভ। তবু সত্যিকার অর্থে, আগ্রহী পাঠক কবির কাছে খুবই আকাঙ্ক্ষিত এক মানুষ। কীভাবে কবিতাকে সেই প্রকৃত পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়, তা হয়তো কেউ ভাবেন, কেউ ভাবেন না।

প্রসঙ্গত বলি, কাব্যালোচনার বিষয়টি এক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন মাধ্যমে কবিতা বিষয়ক আলোচনা প্রকাশ পেলে তা থেকে পাঠকেরা ভালো কবিতা সম্পর্কে ধারণা পেতে পারেন। কবিতা নিয়ে আলাপ-আলোচনার ভেতর দিয়েই একজন কবি প্রকৃত পাঠকের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন। এভাবে সাধারণ পাঠকও নতুন নতুন কবির কবিতা নিয়ে আগ্রহী হয়ে উঠতে পারেন। প্রসঙ্গটা কবিতার বই বিপণনের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত হয়তো নয়। কিন্তু এ-প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে একজন কবি নিশ্চয় অনেক বেশি পাঠকের কাছে গ্রহণযোগ্যতা ও পরিচিতি অর্জন করবেন। কবিতার বই বিপণনে যার ব্যাপক ভূমিকা অনস্বীকার্য।

তথ্যপ্রযুক্তি কিংবা আরও পরিষ্কার করে বললে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে বেশিরভাগ লেখক কিংবা কবির সঙ্গে পাঠকের এক ধরনের সরাসরি যোগাযোগ ঘটছে। খুব কম মানুষই ইদানীং আড়ালে থাকতে পারছেন বা থাকতে পছন্দ করছেন। ফলে কবিতার পাঠকদের সঙ্গে বেশিরভাগ কবির এক ধরনের সরাসরি যোগাযোগ থাকছে বলা চলে। তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে কিছু অনলাইন বুকশপও চালু হয়েছে। ফলে পাঠকের কাছে কবি কিংবা কবিতার সংযোগ আর খুব দুঃসাধ্য নয়। অদূর ভবিষ্যতে একজন লেখক বা পাঠকও এই সামাজিক যোগাযোগের বাইরে থাকবেন বা থাকতে পারবেন কি না আমার সন্দেহ। ফলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সুবিধাগুলি আমাদের গ্রহণ করা প্রয়োজন। এই মাধ্যমের ব্যাপ্তির ফলে কিছু নতুন পাঠক এবং নতুন লেখকও তৈরি হচ্ছেন। এ নিয়ে হয়তো বিতর্ক থাকতে পারে, কিন্তু তথ্যপ্রযুক্তির এই বাস্তবতা এখন অস্বীকার বা উপেক্ষা করা খুবই কঠিন।

Manual5 Ad Code

বলা যেতে পারে, প্রকাশিত কোনো কিছুই আর গোপন থাকছে না। কবিতার বই প্রকাশিত হলে আগ্রহী পাঠকের কাছে সে খবর পৌঁছোনো অনেক সহজ। বাতিঘরও সেই কাজটিই গুরুত্ব সহকারে করার চেষ্টা করে এসেছে। আজও করছে। কবি ও কবিতা বাতিঘরের কাছে বিশেষ কিছু, গুরুত্বপূর্ণ তো বটেই। কবিতার বই বিক্রি করে অর্থোপার্জন না হলেও বাতিঘরের দর্শনীয় স্থানে কবিতার বই সবসময়ই শোভা পাবে।
#
বিশেষ দ্রষ্টব্য : বোধশব্দ সম্পাদক সুস্নাত চৌধুরীর নিরন্তর তাগাদা আর উৎসাহে ২০১৭ সালের কোনো একসময় লিখেছিলাম। আমি লেখক নই। ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন।

– – – – – – – – – – – – – – – –

Manual1 Ad Code

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ