সিলেট ৩১শে অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৫ই কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ২:৪৩ পূর্বাহ্ণ, জুলাই ১৫, ২০২৩
বিশ্বসাহিত্যের বিস্ময়কর, অপরিহার্য ও অন্যতম সেরা ছোটগল্পকার এবং নাট্যকার আন্তন চেখভের ১৬৩তম জন্মবার্ষিকী আজ।
আন্তন চেখভের মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে এর্যান্ড নামের একটি গল্প লিখেছিলেন আমেরিকান ছোটগল্পকার ও কবি রেমন্ড কারভার। চেখভকে ছোট গল্প লেখকদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ মনে করতেন তিনি।
রেমন্ড কারভার লিখেছেন, চেখভের গল্পগুলো এখনও তেমনই বিস্ময়কর এবং অপরিহার্য, যেমনটা ছিল প্রথম প্রকাশের সময়ে। শুধুমাত্র তাঁর বিপুল সংখ্যক গল্পের সম্ভারই নয় – খুব কম লেখকই, যদি আদৌ তেমন কেউ থেকে থাকেন, তাঁর চেয়ে বেশি লিখেছেন – তিনি যে বিস্ময়জনক হারে সেরা গ্রন্থ ও গল্প রচনা করেছেন তা যেমন আমাদের আধ্যাত্মিক মুক্তির অনুভূতি দেয়, তেমনি আনন্দিত ও আলোড়িতও করে। তাঁর লেখা রচনা আমাদের আবেগ অনুভূতিকে যেভাবে তুলে ধরে তা শুধুমাত্র সত্যিকারের শিল্পকর্মের পক্ষেই সম্ভব।
জননন্দিত রুশ চিকিৎসক আন্তন শেখভের ছোটগল্পগুলো লেখক, সমালোচক সমাজে প্রভূত সমাদর অর্জন করেছে। নাট্যকার হিসেবে পেশাজীবনে চেখভ চারটি ক্ল্যাসিক রচনা করেছেন। সবচেয়ে বেশি সংখ্যক নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে এমন নাট্যকারদের মাঝে শেকসপিয়ার ও ইবসেনের পাশাপাশি চেখভের নামও উল্লেখ করা হয়। এছাড়া মঞ্চনাটকে প্রাক-আধুনিকতার উদ্ভবে অন্যতম তিনজন ব্যক্তিত্বের মধ্যে ইবসেন ও অগুস্ত স্ত্রিন্দবারির পাশাপাশি তার নাম উল্লেখ করা হয়।
১৮৮০ থেকে ১৯০৩ সালের মধ্যে তিনি সর্বমোট ৬০০টি সাহিত্যকর্ম রচনা ও প্রকাশ করেন। শুরুতে নাট্যকার হিসেবে তিনি আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিতি পান থ্রি সিস্টার্স, দ্য সিগাল এবং দ্য চেরি অরচার্ড এই তিনটি নাটকের মাধ্যমে। দ্য সিগাল নাটকটি ১৮৯৬ সালে মঞ্চস্থ হলে সেটি একেবারেই দর্শকপ্রিয়তা অর্জন করতে পারেনি। প্রবল বিশৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে এর মঞ্চায়ন সম্পূর্ণ ব্যর্থ হওয়ার প্রেক্ষিতে চেখভ থিয়েটার বর্জন করেন। পরে ১৮৯৮ সালে এই নাটকটিই কনস্তান্তিন স্তানিস্লাভ্স্কির আগ্রহে মস্কো আর্ট থিয়েটারে মঞ্চস্থ হলে তা ব্যাপক প্রশংসিত হয়। মস্কো আর্ট থিয়েটার চেখভের আঙ্কল ভানিয়া নাটকটি প্রযোজনাসহ তার শেষ দুটি নাটক, থ্রি সিস্টার্স এবং দ্য চেরি অরচার্ড এর প্রথম প্রদর্শনীও করে। চেখভের চারটি নাটক দর্শক ও সকল অভিনয়শিল্পীদের সমন্বিত অভিনয়, এই দুইয়েরই অনেক সময় ও মনোযোগ দাবী করে। কারণ এই নাটকগুলিতে কোনো সনাতন বাহ্যিক নাট্যক্রিয়া নেই, এর পরিবর্তে মামুলি অকিঞ্চিৎকর সব বিষয়ে করা সংলাপে রয়েছে আবেগ, অনুভূতির অন্তঃস্রোতের প্রবাহ।
শুরুতে চেখভের লেখক হওয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিলো না। প্রথমদিকের গল্পগুলো তিনি লিখেছিলেন জীবনযাপন ও পড়ালেখার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ যোগাড় করার উদ্দেশ্যে। কিন্তু পরে তার মধ্যে শিল্পীসুলভ উচ্চাকাঙ্ক্ষা জন্ম নিলে ক্রমে তিনি সাহিত্যচর্চার ভিন্ন রীতি ও প্রবণতার উদ্ভাবন করেন যা আধুনিক ছোটগল্পের বিকাশে বিশেষ প্রভাব রাখে। চেখভের মৌলিকতা নিহিত আছে সাহিত্যচর্চায় তার স্ট্রিম অভ কনশাসনেস (কোনো ব্যক্তির বিরতিহীন চৈতন্যপ্রসূত অভিজ্ঞতা) আঙ্গিক ব্যবহারে, যা পরে গ্রহণ করেছিলেন জেমস জয়েস ও অন্যান্য আধুনিকতাবাদী সাহিত্যিকরা, এবং সনাতন গল্পকাঠামোর নীতিঘটিত পরম অবস্থানকে অস্বীকারের মাঝে। তার মতে, একজন শিল্পীর ভূমিকা হলো প্রশ্নকারীর, প্রশ্নের উত্তর দেয়ার দায়িত্ব নেই তার। চেখভ তার সাহিত্যিক জীবনের বেশিরভাগ সময়ে চিকিৎসা পেশায় নিয়োজিত ছিলেন, যদিও এ থেকে তিনি সামান্যই উপার্জন করতেন। তিনি অধিকাংশ রোগীর চিকিৎসা করতেন বিনামূল্যে। তাই জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের যোগান আসতো তার লেখালেখি থেকে।
শৈশব
আন্তন চেখভ ১৮৬০ সালের ২৯ জানুয়ারি (পুরনো রীতিতে ১৭ই জানুয়ারি) দক্ষিণ রাশিয়ার আজভ সাগর সংলগ্ন বন্দরনগরী তাগানরোগে জন্মগ্রহণ করেন। এটি ছিল সন্ত মহান অ্যান্থনির মৃত্যুবার্ষিকী। ছয় সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। চেখভের পিতা পাভেল জেগোরোভিচ চেখভ (১৮২৫-১৮৯৮) ছিলেন ভরনেজ প্রদেশের ওলহভাৎকা গ্রামের একজন প্রাক্তন ভূমিদাস কৃষক এবং তার মাতা ছিলেন ইউক্রেনীয়। পাভেল চেখভ তাগানরোগে একটি মুদি দোকান চালাতেন। তিনি ছিলেন গির্জার ধর্মসংগীতে নেতৃত্বদানকারী গায়কবৃন্দের পরিচালক এবং একজন ধর্মপ্রাণ গোঁড়াবাদী খ্রিস্টান। পিতা হিসেবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত কঠোর ও রূঢ়। তার সন্তানদের তিনি এমনকি শারীরিকভাবেও শাস্তি দিতেন। অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন চেখভের রচিত কপটতাপূর্ণ চরিত্রগুলো তৈরী হয়েছে তার পিতার আদলে। চেকভের মা জেভগেনিয়া জাকোভলেভনা (১৮৩৫-১৯১৯), ছিলেন চমৎকার গল্পকথক। তিনি তার ছেলেমেয়েদের কাছে তার কাপড়-ব্যবসায়ী বাবার সাথে পুরো রাশিয়া ভ্রমণের গল্প বলতেন। চেখভ তার মায়ের কথা স্মরণ করেছেন এভাবে, “আমরা আমাদের মেধা বাবার কাছ থেকে পেয়েছি, কিন্তু হৃদয় পেয়েছি মা’র কাছ থেকে”। পরিণত বয়সে চেখভ তার ভাই আলেকসান্দরের স্ত্রী ও ছেলেমেয়ের প্রতি তার বিরুদ্ধ আচরণের সমালোচনা করতে গিয়ে তাকে তাদের পিতার নির্মম আচরণের কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন: ভুলে যেয়োনা মিথ্যা আর নিষ্ঠুরতা তোমার মায়ের যৌবনকাল ধ্বংস করে দিয়েছে। ওই একই মিথ্যা আর নিষ্ঠুরতা আমাদের শৈশবও নষ্ট করে দিয়েছে, এতটাই যে সে অতীতের কথা স্মরণ করাটাও নিদারুণ বিরক্তির ও ভীতিপ্রদ। ভুলে যেয়োনা সেই বিতৃষ্ণা আর আতঙ্কের কথা, যা আমরা আমাদের বাবার প্রতি অনুভব করতাম যখন তিনি খাবার সময় ক্ষিপ্ত হয়ে উঠতেন এবং স্যুপে বেশি লবণের জন্য মা’কে কটু কথা বলতেন।
তাগানরোগের বাণিজ্যে গ্রিক ব্যবসায়ীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। তাই চেখভের পিতা চেখভকে ও তার এক ভাই নিকলাইকে গ্রিক চার্চ ও গ্রিক স্কুলে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু স্কুলটি অসফলভাবে চলছিল এবং দুই বছর পরেই এটি পরিণত হয় তাগানরোগ শরীরচর্চা কেন্দ্রে, যা বর্তমানে চেখভ জিমনেসিয়াম। স্কুলে চেখভের কৃতিত্ব ছিল গড়পড়তা মানের। পনের বছর বয়স পর্যন্ত চেখভকে একই ক্লাসের পুনরাবৃত্তি করতে হয়েছিল, কেননা তিনি একটি গ্রিক পরীক্ষায় পাশ করতে পারেননি। এই ফলাফল বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে গ্রিক গোঁড়াবাদী গির্জার সমবেত ধর্মীয় সঙ্গীতে অংশগ্রহণ এবং তার পিতার দোকানের কাজে চেখভের নিয়মিত কার্যক্রম। এছাড়াও কারণ হিসেবে যোগ করা যেতে পারে সমকালীন রাশিয়ার কতৃত্বপূর্ণ শিক্ষা ও শিক্ষাদান পদ্ধতি, কেননা চেখভ প্রভূত্বকে তুচ্ছজ্ঞান করতেন, প্রবলভাবে অপছন্দ করতেন। ১৮৯২ সালে লেখা এক চিঠিতে চেখভ তার শৈশব বর্ণনা করতে গিয়ে “দুঃখক্লেশ” শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন।
তিনি তার শৈশবকে স্মরণ করেছেন এভাবে: যখন আমার ভাইয়েরা ও আমি গির্জার মাঝে দাঁড়াতাম এবং ত্রয়ী গাইতাম, “আমার প্রার্থনা হোক মহিমান্বিত” বা “দেবদূতের কণ্ঠস্বর”, সবাই আমাদের দিকে আবেগভরে তাকিয়ে থাকতো আর আমাদের পিতামাতাকে ঈর্ষা করতো। কিন্তু ঐ মুহূর্তে আমরা নিজেরা যেন কিছুটা দণ্ডিত অপরাধীর মতো অনুভব করতাম।
১৮৭৬ সালে একটি নতুন বাড়ি তৈরিতে অনেক বেশি পুঁজি বিনিয়োগের পর চেখভের পিতাকে দেউলিয়া ঘোষণা করা হয়। ঋণ শোধ করতে ব্যর্থ হওয়ায় কারাবাস এড়াতে তিনি মস্কোতে পালিয়ে যান। সেখানে তার বড় দুই ছেলে আলেকসান্দর ও নিকলাই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তো। পরিবারটি মস্কোতে দারিদ্র্যের মাঝে বাস করছিলো। চেখভের মা শারীরিক ও মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েছিলেন। বিষয়সম্পত্তি বিক্রি ও স্কুলের পড়াশোনা শেষ করার জন্য চেখভকে তাগানরোগেই রেখে আসা হয়েছিল।
চেখভ তাগানরোগে আরও তিন বছর ছিলেন। তিনি তাগানরোগে সেলিভানভ নামের এক ব্যক্তির সাথে থাকতেন যিনি চেখভের দ্য চেরি অরচার্ড-এর চরিত্র লোপাখিনের মতোই তাদের বাড়ি কিনে নিয়ে পরিবারটিকে ঋণমুক্ত করেছিলেন। চেখভকে নিজের পড়াশোনার ব্যয় নিজেকেই বহন করতে হতো। এই খরচের ব্যবস্থা করার জন্য তিনি বেশ কয়েকরকমের কাজ করতেন যার মধ্যে একটি ছিল গৃহশিক্ষকতা। এছাড়াও তিনি গোল্ডফিঞ্চ পাখি ধরে বিক্রি করতেন এবং খবরের কাগজে ছোট ছোট স্কেচ এঁকেও অর্থ উপার্জন করতেন। তিনি তার দৈনন্দিন খরচ থেকে সঞ্চিত প্রতিটি রুবল মস্কোতে পাঠিয়ে দিতেন, সেই সাথে পরিবারের সদস্যদের উদ্দীপিত করার জন্যে পাঠাতেন হাস্যরসাত্মক চিঠি। এই সময়টাতে তিনি প্রচুর পরিমাণে পড়েছেন। পড়েছেন বিশ্লেষণাত্মকভাবে। যে লেখকদের লেখা তিনি এই সময়ে পড়েছিলেন তাদের মধ্যে রয়েছেন থের্ভান্তেস, তুর্গেনেভ, গনচারভ এবং শোপনহাওয়ার। একই সময়ে তিনি ফাদারলেস নামের একটি পুরো দৈর্ঘ্যের কমেডি নাটকও লিখেছেন, যেটাকে তার ভাই আলেকজান্ডার বাতিল করে দিয়েছেন “অমার্জনীয়, যদিও নির্দোষ কল্পকাহিনী” হিসেবে। চেখভ বেশ কিছু প্রণয়ঘটিত সম্পর্কেও জড়িয়ে পড়েন। এর মধ্যে একটি সম্পর্ক ছিল শিক্ষকের স্ত্রীর সাথে।
১৮৭৯ সালে চেখভ স্কুলের পড়াশোনা শেষ করে মস্কোতে তার পরিবারের সাথে যোগ দেন। তিনি আই.এম. সেচেনভ ফার্স্ট মস্কো স্টেট মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন।
শিক্ষা ও সাহিত্য
মস্কোতে চলে আসার অল্প কিছুদিন পরেই চেখভ মস্কো স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং এখানেই তার শিক্ষা গ্রহণ চলে ১৮৭৯ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ১৮৮৪ সালের গ্রীষ্ম পর্যন্ত। ঐ গ্রীষ্মে চেখভ ফাইনাল পরীক্ষা দেন। এই সময়ের মধ্যে সাত সদস্যের চেখভ পরিবার কয়েকবার তাদের আবাস বদল করেছে। এবং স্থায়ী আবাসে সবকিছু গুছিয়ে নেয়ার আগের কয়েক মাস তাদেরকে যে অপ্রশস্ত বাসস্থান ও দুর্বিষহ পরিস্থিতিতে বসবাস করতে হয়েছে তা চেখভের পরীক্ষার প্রস্তুতিতে গুরুতর সমস্যার সৃষ্টি করেছিল।
চেখভ তার প্রথম দিকের লেখা গল্প বা অন্যান্য রচনায় যে চরিত্রগুলো সৃষ্টি করেছেন তাদের মধ্যে বিস্ময়কর সব সম্পর্ক পরিলক্ষিত হয়। এই বিস্ময়কর সম্পর্কগুলোর সম্যক উপলব্ধি সম্ভব যদি তার শুরুর দিকে লেখা চিঠিগুলো পর্যবেক্ষণ করা যায়। উদাহরণস্বরূপ, ১৮৮৩ সালের আগস্টে একটি সাময়িকীর সম্পাদককে কিছু গল্পের সাথে পাঠানো এই চিঠির উল্লেখ করা যেতে পারে: আমাদের সর্বোচ্চ কল্পনাশক্তি প্রয়োগ করে যতটা শোচনীয় পরিস্থিতির কথা আমরা ভাবতে পারি, ঠিক ততটাই শোচনীয় পরিস্থিতিতে আমি লেখালেখি করে থাকি । আমাকে নিষ্করুণ বিরক্ত করছে আমার সামনে পড়ে থাকা সাহিত্যের সাথে সম্পর্কহীন কিছু কাজ, লাগোয়া ঘরটিতে এক শিশু বেড়াতে আসা আমার এক আত্মীয়কে দেখে তীব্র চিৎকার করছে, অন্য একটি ঘরে আমার বাবা লেসকভের দ্য সীলড এঞ্জেল থেকে আমার মা’কে উচ্চকণ্ঠে পড়ে শোনাচ্ছেন […] আমার বিছানা দখল করে নিয়েছে বেড়াতে আসা আত্মীয়রা, তাদের কেউ কেউ আমার সাথে চিকিৎসাশাস্ত্র নিয়ে আলোচনা করতে আসছেন […] এক তুলনাহীন পরিস্থিতি। – ১৮৮৩ সালে লেখা আন্তন চেখভের একটি চিঠি থেকে এই অর্ধ-পরিহাসমূলক, অর্ধ-অপ্রসন্নতাবোধক ভাব বিদ্যমান ছিল চেখভের শিক্ষাজীবনে লেখা চিঠিগুলোয় এবং এর পরবর্তী সময়ের চিঠিতেও। শুধুমাত্র ঘিঞ্জি পরিবেশ ও দারিদ্র্যের মধ্যে জীবনযাপনই তার লেখালেখির কাজকে বাধাগ্রস্ত করেনি, বরং অনেক সম্পাদকের উপযুক্ত সম্মানী না দেয়ার মতো অসাধু মনোবৃত্তি, লেখার দৈর্ঘ্যের উপর সীমা আরোপও এক্ষেত্রে প্রভাব রেখেছে। ১৮৮১ সালে একটি সন্ত্রাসবাদী দল জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডারকে গুপ্তহত্যা করলে সরকারের সেন্সর পর্ষদ অত্যন্ত কঠোর অবস্থান নেয় যা চেখভের লেখার কাজ আরও কঠিন করে দেয়। ১৮৮২ সালে চেখভের প্রথম ছোটগল্প সংকলন আ প্র্যাঙ্ক স্থগিত হয় এবং ধরে নেয়া হয় যে এটি হারিয়ে গিয়েছে।
মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়ে চেখভকে পুরো পরিবারের দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়। পরিবারকে সাহায্য করার জন্য এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার খরচ যোগাড় করার জন্য চেখভ সমসাময়িক রুশ জীবন নিয়ে ছোট ছোট হাস্যরসাত্মক নাটক বা রচনা লিখতেন এবং অলঙ্করণমূলক নকশা আঁকতেন। এই নকশাদার চিত্র এবং হাস্যরসাত্মক লেখার অনেকগুলোই তিনি লিখেছিলেন ছদ্মনামে। আন্তোশা চেখন্তে এবং রাগহীন মানব হচ্ছে তেমন দুইটি নাম। তার এই চিত্রাঙ্কণ ও বিদ্রূপাত্মক ধাঁচের লেখার জনপ্রিয়তা তাকে ক্রমে ক্রমে খ্যাতি এনে দেয় রাশিয়ার সাধারণ নাগরিক জীবনের ব্যাঙ্গাত্মক ইতিবৃত্তকার হিসেবে। ১৯৮২ সালের মধ্যেই খ্যাতনামা প্রকাশক নিকোলাই লেইকিনের পত্রিকা অসকোলস্কিতে তিনি লিখতে শুরু করেন। এই সময়টাতে চেখভের লেখা গল্প ও অন্যান্য রচনার অন্তর্নিহিত ভাব বা সুর ছিল তার পরিণত সময়ের গল্প উপন্যাসের চেয়ে বেশি রূঢ়।
১৯৮৪ সালে চেখভ চিকিৎসক হিসেবে পূর্ণ যোগ্যতাপ্রাপ্ত হন। চিকিৎসা পেশাকে তিনি তার প্রধান পেশা হিসেবে বেছে নিলেও এ থেকে তিনি সামান্যই উপার্জন করেছেন। দরিদ্রদের চিকিৎসায় তিনি তাদের কাছ থেকে অর্থ গ্রহণ করেননি। ১৮৮৪ ও ১৮৮৫ সালে চেখভ লক্ষ্য করেন তার কাশির সাথে রক্ত পড়ছে এবং ১৮৮৬ সালে এ অবস্থা আরও খারাপের দিকে যায়। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি তার পরিবার ও বন্ধুদের কাছে স্বীকার করেননি যে তার ক্ষয়রোগ হয়েছে। লেইকিনের কাছে স্বীকার করেছেন, “আমি পরীক্ষানীরিক্ষা করানোর জন্য বন্ধুদের হাতে নিজেকে ছেড়ে দিতে ভয় পাচ্ছি।” তিনি সাপ্তাহিক পত্রিকাগুলিতে লেখালেখি চালিয়ে যেতে থাকলেন এবং এ থেকে তার পরিবারের জন্য উত্তরোত্তর অপেক্ষাকৃত ভাল আবাসের সংস্থান করার মতো পর্যাপ্ত অর্থও উপার্জন করে যাচ্ছিলেন। ১৮৮৬ সালের শুরুর দিকে চেখভ মিলিয়নিয়ার শিল্পপতি আলেক্সি সাভরিনের মালিকানাধীন ও সাভরিনের সম্পাদিত সেন্ট পিটার্সবার্গের অন্যতম জনপ্রিয় পত্রিকা নোভায়া ভ্রেমায়াতে লেখার আমন্ত্রণ পান। লেখার প্রতি লাইনের জন্য লেইকিন যে সম্মানী দিতেন, এই সম্পাদক দিতেন তার দ্বিগুণ এবং লেইকিন পত্রিকার যতটুকু জায়গা জুড়ে চেখভের লেখা ছাপানোর অনুমোদন করতেন, আলেক্সি সাভরিনের অনুমোদন ছিল তার তিনগুণ বেশি স্থানের। সাভরিন চেখভের বন্ধু ছিলেন আজীবন, সম্ভবতঃ সবচেয়ে কাছের বন্ধু ছিলেন তিনি।
এর অনেক আগে থেকেই চেখভ সাধারণ মানুষের কাছে যেমন গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছেন, জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন, তেমনি বিখ্যাত সাহিত্যিকদেরও মনোযোগ আকর্ষণ করেছেন তার লেখার সাহিত্যগুণের জন্য। চৌষট্টি বছর বয়স্ক নামকরা প্রবীণ রুশ লেখক দিমিত্রি গ্রিগোভিচ চেখভের ছোটগল্প দ্য হান্টসম্যান পড়ে চেখভকে লিখেছিলেন, “তোমার সত্যিকারের প্রতিভা আছে – এমন এক প্রতিভা, যা তোমাকে নতুন প্রজন্মের লেখকদের সামনের সারিতে জায়গা করে দিতে পারবে।” তিনি চেখভকে লেখালেখির পরিমাণ কমিয়ে লেখার সাহিত্যমানের প্রতি মনোযোগ দেয়ার উপদেশ দেন।
দিমিত্রি গ্রিগোভিচের চিঠির প্রতুত্তরে চেখভ লিখেছিলেন যে এ চিঠি তাকে আঘাত করেছে যেন বজ্রপাতের মতো এবং স্বীকার করেছেন, “আমি আমার গল্পগুলো লিখেছি এমনভাবে, যেমন করে প্রতিবেদকরা কোথাও আগুন লাগলে তার বিবরণ লিখেন – যান্ত্রিক, অর্ধ-সচেতন এবং পাঠক ও আমার নিজের কোনো কিছুর প্রতি কোনো গুরুত্ব না দিয়ে।” এই স্বীকারোক্তি হয়তো চেখভের জন্য ক্ষতিকর ছিল, কারণ তার পূর্ববর্তী পাণ্ডুলিপিগুলো এটাই প্রকাশ করে যে তিনি বেশিরভাগ সময়েই লিখেছেন অত্যন্ত যত্নের সাথে, লেখার পরিমার্জনা করেছেন বারবার। তথাপি গ্রিগোভিচের উপদেশ ছাব্বিশ বছর বয়সের তরুণ চেখভকে আরো গভীর, শৈল্পিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা পোষণ করতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। ১৮৮৭ সালে গ্রিগোভিচের গোপন প্রভাবের সামান্য প্রয়োগে চেখভের ছোটগল্প সংকলন অ্যাট ডাস্ক বহু আকাঙ্ক্ষিত পুশকিন পুরস্কার জিতে নেয় “সর্বোৎকৃষ্ট সাহিত্যকর্মের জন্য, যা উচ্চ শৈল্পিক মূল্যগুণে স্বতন্ত্র।”
জীবনের সন্ধিক্ষণে
অতিরিক্ত পরিশ্রমের দরুন ক্লান্ত ও অসুস্থ চেখভ বর্তমান ইউক্রেনের বিস্তীর্ন স্তেপ অঞ্চলে সফরে বের হন ১৮৮৭ সালের বসন্তে। তিনি তাগানরোগে তাদের পুরোনো বাড়ি এবং দক্ষিণ রাশিয়ার কিছু শহর ও বর্তমান ইউক্রেন ভ্রমণ করেন। ভ্রমণকালে স্তেপ অঞ্চলের সুন্দর দৃশ্যাবলী তার স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারে সহায়তা করে। ফিরে আসার পর তিনি উপন্যাসিকা-ব্যাপ্তির একটি ছোট গল্প ‘দ্য স্তেপ’ লিখতে শুরু করেন যা ছাপা হয় প্রভাবশালী সাহিত্য সাময়িকী ‘সাভের্ন ভেস্টনিক’ (দ্য নর্দার্ণ হেরাল্ড)-এ। গল্পের চরিত্রগুলোর চিন্তাপ্রক্রিয়ার সাথে একই সমান্তরালে প্রবাহিত হয়ে যাওয়া এই উপাখ্যানে চেখভ একটি অল্পবয়সী বালকের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে জাগিয়ে তুলেছেন স্তেপ অঞ্চলের এপার হতে ওপারে যাওয়া এক প্রমোদভ্রমণকে। এই অল্পবয়সী বালকটিকে তার বাড়ি থেকে দূরে বসবাস করার জন্য পাঠানো হয়েছিল এবং তার সঙ্গী ছিল এক পুরোহিত ও এক বণিক। দ্য স্তেপ, যাকে বলা হতো “চেখভের কাব্যশাস্ত্রের অভিধান”, সাহিত্যজগতে চেখভের গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতির প্রতিনিধিত্ব করেছে। এই গল্পটিই চেখভের পূর্ণাঙ্গ, পরিণতমানের লেখাগুলোর বৈশিষ্টমূলক গুণের বেশিরভাগের পরিচয় তুলে ধরে এবং চেখভের জন্য এনে দেয় দৈনিক পত্রিকার পরিবর্তে সাহিত্য সাময়িকীতে প্রকাশনার সুযোগ।
১৮৮৭ সালের শরতে কোর্শ নামের এক থিয়েটার ব্যবস্থাপক চেখভকে একটি নাটক লিখতে বলেন যার প্রেক্ষিতে চেখভ এক পক্ষকালের মধ্যে ইভানভ রচনা করেন। নাটকটি সেই নভেম্বরেই মঞ্চস্থ হয় এবং এর মঞ্চস্থকরণের অভিজ্ঞতা ছিল চেখভের জন্য অত্যন্ত বিরক্তিকর। তিনি তার ভাই আলেকজান্ডারকে এই বিশৃংখল ঘটনাবলীর কৌতুকপ্রদ বর্ণনা দিয়ে একটি চিঠি লিখেন। তবে বিস্ময়করভাবে এই নাটকটি অনেক জনপ্রিয় হয় এবং প্রশংসিত হয় একটি অভিনব ও মৌলিক কাজ হিসাবে। মিখাইল চেখভ ইভানভকে বিবেচনা করেছেন তার সহোদরের সাহিত্য পেশার ও বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নয়নের এক গুরূত্বপূর্ণ মুহূর্ত হিসাবে। এই নির্দিষ্ট সময়কালের মধ্যে লেখা চেখভের গল্প, উপন্যাসগুলো থেকে একটি পর্যবেক্ষণ পাওয়া যায়, যা পরে “চেখভ’স গান” হিসাবে পরিচিত হয়। ইলিয়া গারল্যান্ডের একটি কথোপকথন থেকে উল্লেখ্য: “যদি নাটকের কোনো অঙ্কে একটি বন্দুককে দেয়ালে ঝুলতে দেখতে পাও, তাহলে নাটকের শেষ অঙ্কে অবশ্যই এটি গুলিবর্ষণ করবে।”
১৮৮৯ সালে ক্ষয়রোগে চেখভের সহোদর নিকোলাই এর মৃত্যুর ঘটনা প্রভাবিত করে তার এ ড্রিয়েরি স্টোরি গল্পটিকে। ঐ বছরের সেপ্টেম্বরে সমাপ্ত গল্পটি চিত্রিত করেছে একজন ব্যক্তিকে যিনি জীবনের শেষ সীমায় উপনীত হয়ে উপলব্ধি করেছেন যে তার জীবন ছিল একেবারে উদ্দেশ্যবিহীন। নিকোলাই এর মৃত্যুর পর চেখভের অস্থিরতা এবং বিষাদগ্রস্ততার বিবরণ দিয়েছেন মিখাইল চেখভ। এই সময়টাতে মিখাইল চেখভ আইনশিক্ষার অংশ হিসেবে কারাগার নিয়ে গবেষণা করছিলেন, এবং ঐ একই সময়ে আন্তন চেখভ তার নিজের জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সন্ধান করছিলেন। এই অবস্থায় অল্পকালের মধ্যেই তিনি কারাগার সংস্কার সম্বন্ধীয় বিষয়গুলি নিয়ে পুরোপুরি আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন।
সাখালিন
১৮৯০ সালে, ট্রেনে ও ঘোড়ার গাড়িতে এবং নদীপথে স্টিমারে করে এক কষ্টকর ভ্রমণে বের হন চেখভ। তিনি দূরপ্রাচ্যের রাশিয়া-অংশে (বৈকাল হ্রদ ও প্রশান্ত মহাসাগরের মাঝামাঝি) ও জাপানের উত্তরে সাখালিন দ্বীপের কাতোর্গা বা বন্দীশিবির দর্শন করেন। এখানে তিনি একটি আদমশুমারির জন্য কয়েদিদের ও বসতি স্থাপনকারীদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে তিন মাস কাটান। সাখালিনে আড়াই মাস যাবত ভ্রমণকালে লেখা চিঠিগুলোকেই তার লেখা সেরা চিঠি হিসেবে গণ্য করা হয়। তোমস্ক শহরটি সম্পর্কে তিনি তার বোনকে যে মন্তব্যটি করেছিলেন তা ছিল এমন: “তোমস্ক একটি ক্লান্তিকর নিষ্প্রভ শহর। নেশাগ্রস্ত যে ব্যক্তিদের সাথে আমার পরিচয় হয়েছে এবং যে ধীশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তিগণ আমার সাথে সাক্ষাৎ করে আমাকে সম্মান জানিয়েছেন তাদের থেকে এই শহরের অধিবাসীদের মূল্যায়ন করে বলতে পারি, এর বাসিন্দারাও বিরক্তিকর।”
তোমস্কের অধিবাসীরা চেখভের একটি বিদ্রূপাত্মক প্রতিমূর্তি নির্মাণ ও স্থাপন করে এর শোধ নিয়েছিলেন।
সাখালিনে কয়েদিদের বেত, চাবুক দিয়ে নির্দয়ভাবে প্রহার করা হতো, প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির সরবরাহ আত্মসাৎ এবং নারীদেরকে জোরপূর্বক পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করা হতো যা চেখভ সেখানে গিয়ে প্রত্যক্ষ করেছিলেন। এই ব্যাপারগুলো চেখভকে প্রচণ্ডভাবে আঘাত করেছিল এবং তাকে ক্রুদ্ধ করে তুলেছিল। তিনি লিখেছিলেন, “এমন সব সময় ছিল যখন আমার মনে হতো যে আমি আমার সামনে ব্যক্তির চরম মাত্রার মর্যাদাহানি দেখছি।” বিশেষ করে বন্দীশিবিরে বাবা-মা’র সাথে বাস করা শিশুদের দুর্দশা তাকে বিচলিত করেছিল। উদাহরণস্বরূপ: “আমুর নদীতে স্টিমার চলছে সাখালিনের দিকে। পায়ে বেড়ি পরা এক কয়েদি ছিল সেখানে, যে তার স্ত্রীকে হত্যা করেছে। তার সাথে তার ছয় বছর বয়সী ছোট মেয়েটি ছিল। আমি লক্ষ্য করলাম যে, যখনই কয়েদিটি নড়েচড়ে দাঁড়াচ্ছে এবং হাঁটছে, তার মেয়েটি দ্রুত ছুটে যাচ্ছে তার দিকে এবং হাত দিয়ে পায়ের বেড়ি ধরে রাখছে। রাতের বেলায় শিশুটি কয়েদি এবং সৈন্যদের গাদার মাঝেই ঘুমিয়ে পড়লো।”
পরবর্তীকালে চেখভ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, বদান্যতা ও চাঁদার মাধ্যমে অর্থদানই এ অবস্থার সমাধান নয়, বরং কয়েদিদের প্রতি মানবিক আচরণ ও তাদের সুচিকিৎসার জন্য অর্থ সংস্থান করার দায়িত্ব সরকারেরই। তাঁর এই অনুসন্ধানের ফলাফল ১৯৮৩ এবং ১৯৮৪ সালে প্রকাশিত হয়েছিল অস্ট্রোভ সাখালিন (সাখালিন দ্বীপ) নামে, যা কিনা সাহিত্য নয় – সমাজবিজ্ঞানের কাজ -মূল্যবান ও তথ্যবহুল। চেখভের অপেক্ষাকৃত বড় দৈর্ঘ্যের ছোট গল্প দ্য মার্ডারার এর শেষ অণুচ্ছেদে রয়েছে সাখালিন, যেখানে ফেলে আসা নিজের বাড়ির জন্যে আকুল আকাঙ্ক্ষারত খুনি লোকটি রাতের বেলায় কয়লা বোঝাই করে।
মেলিখোভো
১৮৯২ সালে মস্কোর চল্লিশ মাইল দক্ষিণে মেলিখোভোতে একটি ছোট জমিদারি কিনে পরিবারসহ চেখভ সেখানেই বসবাস করেন ১৮৯৯ সাল পর্যন্ত। “জমিদার হওয়ার ব্যাপারটি চমৎকার”, শ্চেগ্লোভকে ঠাট্টার ছলে বলেছিলেন তিনি। কৌতুক করলেও ভূম্যধিকারী হিসেবে তার দায়িত্ব তিনি আন্তরিকতার সাথেই গ্রহণ করেছিলেন এবং স্থানীয় কৃষকদের মাঝে অল্পকালের মধ্যেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন নির্ভরযোগ্য ও প্রয়োজনীয়। ১৮৯২ সালের কলেরা প্রাদুর্ভাব এবং দুর্ভিক্ষ উপদ্রুতদের জন্য ত্রাণের বন্দোবস্ত করা সহ চেখভ মেলিখোভোতে তিনটি বিদ্যালয়, একটি দমকল স্টেশন ও একটি বেসরকারি চিকিৎসালয় নির্মাণ করেছিলেন। ক্ষয়রোগের নিয়মিত পুনরাবৃত্তি সত্ত্বেও তা উপেক্ষা করে তিনি মাইলের পর মাইল ঘুরে কৃষকদের চিকিৎসা করেছেন।
মেলিখোভোতে চেখভ পরিবারের এক সদস্য, মিখাইল চেখভ, তার ভাইয়ের চিকিৎসাসেবা দানের ব্যাপ্তি বা পরিমাণের বিবরণ দিয়েছেন এভাবে: চেখভ মেলিখোভোতে যাবার প্রথম দিন থেকেই বিশ মাইল দূরের স্থান থেকেও অসুস্থ মানুষেরা দলে দলে আসতে শুরু করেছিল। কেউ এসেছিল পায়ে হেঁটে, কেউবা দুই চাকার ঘোড়ার গাড়িতে করে, এবং তাঁকে প্রায়ই রোগী দেখার জন্য দূরে যেতে হতো। কখনো কখনো খুব সকাল থেকেই কৃষক নারীরা ও তাদের শিশুরা চেখভের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে তাঁর জন্য অপেক্ষা করতো।
ঔষধের জন্য চেখভের যা খরচ হতো পরিমাণের দিক থেকে তা খুব বেশি না হলেও অসুস্থদের দেখতে যাওয়ার জন্য কয়েক ঘণ্টা যাবত যাত্রায় তাকে যথেষ্ট খরচ স্বীকার করতে হতো। আর এটা তার লেখার সময়কেও কমিয়ে দিয়েছিল। যাইহোক, এই চিকিৎসক-বৃত্তির কারণেই চেখভ রুশ সমাজের সব স্তরের মানুষের ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে যেতে পেরেছিলেন যা পরিণামে তার লেখালেখিকে আরও সমৃদ্ধ করেছিল। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, তিনি স্বচক্ষে কৃষকদের যে অস্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা প্রত্যক্ষ করেছিলেন তা স্মরণ করেছেন তার কৃষকেরা ছোট গল্পে। অভিজাত শ্রেণীর সংস্পর্শেও এসেছেন চেখভ, যার বিবরণ পাওয়া যায় তার নোটবইয়ে: “অভিজাত শ্রেণীর লোকেরা? সেই একই কদর্য ব্যক্তিরা এবং শারীরিক অশুচিতা, সেই একই দন্তহীন বৃদ্ধ বয়স এবং নিদারুণ বিরক্তিকর মৃত্যু, যেমনটা হয় বাজারে-মেয়েদের।”
মেলিখোভোর ফলবাগানে নির্মিত তার বাড়িতে চেখভ দ্য সীগাল নাটকটি লিখতে শুরু করেন। সেটা ছিল ১৮৯৪ সাল। মেলিখোভোর এস্টেটে চলে আসার দুই বছরের মধ্যে তিনি বাড়িটিকে আবার ঝকঝকে ও পরিচ্ছন্ন করে সাজিয়ে তুলেছেন, কৃষিকাজ ও উদ্যানবিদ্যা নিয়ে পড়েছেন, পুকুর ও ফলবাগানের তত্ত্বাবধান করেছেন, এবং অনেক গাছ লাগিয়েছেন, যা কিনা মিখাইলের মতে, তিনি “দেখাশোনা করেছেন … এমনভাবে যেন ওগুলো তাঁর সন্তান। তাঁর থ্রী সিস্টার্স গল্পটির কর্নেল ভার্শিনিন এর মতোই যখনই তিনি তাঁর রোপণ করা গাছগুলোর দিকে তাকিয়েছেন, তিনশ বা চারশ বছর পরে এই গাছগুলিই কেমন হবে এ নিয়ে স্বপ্ন দেখেছেন।”
১৮৯৬ সালের ১৭ই অক্টোবর পিটার্সবার্গের আলেক্সান্দ্রিনস্কি থিয়েটারে দ্য সীগাল নাটকটির প্রথম প্রদর্শনী হয়। দর্শকদের অবজ্ঞাসূচক ধ্বনির মাঝে পরিবেশিত নাটকটির প্রথম রাতটি ছিল চরম ব্যর্থ। এরই প্রেক্ষিতে ক্ষুব্ধ চেখভ আনুষ্ঠানিকভাবে থিয়েটার পরিত্যাগ করেন। কিন্তু এই নাটকটিই থিয়েটার পরিচালক ভ্লাদিমির নেমিরোভিচ-ড্যানচেঙ্কোর মনে এতোটাই রেখাপাত করেছিল যে তিনি তার সহকর্মী কনস্ট্যান্টিন স্ট্যানিস্লাভস্কিকে মস্কো আর্ট থিয়েটারে নাটকটি পরিচালনা করতে রাজি করান। এটা ১৮৯৮ সালের কথা। মনস্তাত্ত্বিক বাস্তববাদ ও দলের সামগ্রিক অভিনয়ের শৈল্পিক ঐক্যের প্রতি স্ট্যানিস্লাভস্কির মনোযোগ লেখার মূল পাঠে লুকিয়ে থাকা সূক্ষ্ণতার উপস্থিতির বিষয়ে প্ররোচনা দিয়েছে এবং চেখভকে ফিরিয়ে দিয়েছে নাটক লেখার আগ্রহ। এরপরে মস্কো আর্ট থিয়েটার চেখভকে আরও নাটক লেখার দায়িত্ব দেয় এবং এর পরের বছরে মঞ্চস্থ হয় আঙ্কল ভানিয়া। এই নাটকটি তিনি লিখে শেষ করেছিলেন ১৮৯৬ সালে।
ইয়াল্টা
১৮৯৭ সালের মার্চে মস্কোতে থাকাকালীন সময়ে চেখভ ফুসফুসে রক্তক্ষরণ-জনিত সমস্যায় ভুগতে থাকেন। তারপরেও অনেক চেষ্টার পর তাকে হাসপাতালে যেতে রাজি করানো সম্ভব হয়। তার ফুসফুসের উপরের অংশে ক্ষয়রোগ ধরা পড়ে। ফলশ্রুতিতে ডাক্তার তাকে জীবনযাপনের ধারা বদলাতে বলেন।
১৮৯৮ সালে পিতার মৃত্যুর পরে চেখভ ইয়াল্টাতে শহরের প্রান্তদেশে একখণ্ড জমি কিনে তাতে একটি বাগানবাড়ি তৈরী করেন। এর পরের বছরেই মা ও বোনের সাথে তিনি এই বাড়িতে চলে আসেন। যদিও চেখভ ইয়াল্টাতে ফুলগাছসহ নানাবিধ গাছ লাগিয়েছেন, কুকুর পুষেছেন, পোষ মানিয়েছেন সারস পাখি এবং অতিথি হিসেবে পেয়েছেন লিও টলস্টয় ও ম্যাক্সিম গোর্কির মতো সাহিত্যিকদের, তারপরেও ইয়াল্টার অতি উষ্ণ আবহাওয়া নিয়ে তার অভিযোগ ছিল এবং ইয়াল্টা ছেড়ে মস্কো ও অন্যান্য স্থানে ভ্রমণ করে তিনি স্বস্তি পেয়েছেন। এমনকি তাগানরোগে পানি সরবরাহের ব্যবস্থা সংস্থাপনের সাথে সাথে তিনি সেখানে ফিরে যাবেন, এমন প্রতিজ্ঞাও করেছিলেন। ইয়াল্টা থাকাকালীন তিনি আর্ট থিয়েটারের জন্য আরও দুটি নাটক রচনা করেন। তবে এ দুটি নাটক রচনা করতে তাকে বেশ কষ্ট করতে হয় যেখানে তিনি আগের দিনগুলিতে লেখালেখির ব্যাপারে, “যেভাবে আমি এখন একটি প্যানকেক খাই, তেমনি স্থির ও শান্তিপূর্ণভাবে লিখতাম”, এমন মত প্রকাশ করেছেন। থ্রি সিস্টার্স ও দ্য চেরি অর্চার্ড, এ দুইটির প্রতিটি লিখতে তিনি এক বছর করে সময় নিয়েছিলেন।
বিয়েতে তার ভীতিকে স্বীকার করে নিয়েই চেখভ ১৯০১ সালের ২৫ মে তারিখে ওলগা নিপারকে বিয়ে করেন। নেমিরোভিচ-ডানচেঙ্কোর অনুগ্রহভাজন ও কোনো এক সময়ে তার প্রণয়ী এই ওলগা নিপারের সাথে চেখভের প্রথম দেখা হয় দ্য সীগাল নাটকের মহড়ায়। এর আগে পর্যন্ত চেখভকে বলা হতো, “রাশিয়ার সবচেয়ে পলায়নপর সাহিত্যিক অকৃতদার।” তিনি একবার সাভরিনকে লিখেছিলেন: তুমি যদি চাও তো আমি অবশ্যই বিয়ে করবো। তবে এই শর্তেঃ সবকিছু তেমনই থাকবে যেমনটা আছে এখন পর্যন্ত, মানে তাকে অবশ্যই মস্কোতে থাকতে হবে যখন আমি গ্রামে থাকবো, এবং আমি তাকে দেখতে আসবো… আমাকে এমন একজন স্ত্রী দাও যে হবে চাঁদের মতো, আমার আকাশে উঠবে না প্রতিদিন।
এই চিঠির কথাগুলো চেখভ ও ওলগার বিবাহিত জীবনে ভবিষ্যদ্বাণীর মতো ফলে গিয়েছিল। তিনি বেশিরভাগ সময়ে ইয়াল্টাতেই থাকতেন। ওলগা থাকতেন মস্কোতে, সেখানে তিনি তার অভিনয় পেশা চালিয়ে গিয়েছেন। ১৯০২ সালে সন্তানসম্ভবা ওলগার গর্ভপাত ঘটে। অধ্যাপক ডোনাল্ড রেফিল্ড, যিনি রুশ লেখকদের নিয়ে লেখা বইয়ের সম্পাদক এবং রুশ সাহিত্য-সম্বন্ধীয় বইয়ের লেখক, এই দম্পতির লেখা চিঠির ওপর ভিত্তি করে সাক্ষ্যপ্রমাণ দেয়ার চেষ্টা করেন যে ওলগা যখন সন্তানসম্ভবা হন তখন চেখভ ও ওলগা একইস্থানে বসবাস করছিলেন না। যদিও রুশ পণ্ডিতেরা ডোনাল্ডের এই দাবি তর্কাতীতভাবে ভুল প্রমাণ করেছেন। তবে একে অপরের থেকে দূরে থাকার সময়ে তাদের মধ্যে যে চিঠি বিনিময় ঘটে, তার মাধ্যমেই সংরক্ষিত হয়েছে থিয়েটারের ইতিহাসের কিছু তথ্য ও ঘটনা যা মণিরত্নের মতোই দামি। এর মধ্যে রয়েছে স্তানিস্লাভস্কির পরিচালনা পদ্ধতি সম্পর্কে তাদের পারস্পরিক অভিযোগ ও চেখভের নাটকগুলিতে ওলগাকে অভিনয়ের পরামর্শদান।
ইয়াল্টাতে চেখভ তার একটি বিখ্যাত গল্প দ্য লেডি উইদ দ্য ডগ রচনা করেন। একজন বিবাহিত পুরুষ ও এক বিবাহিত নারীর মধ্যেকার আপাতদৃষ্টিতে অপরিকল্পিত ও অনিয়মিত যোগাযোগ নিয়েই এই গল্প। গল্পের নারী ও পুরুষটি তাদের সম্পর্ক স্থায়ী হবে এমন আশা করছে না, আবার সেই সাথে এটাও আবিষ্কার করছে যে এই পারস্পরিক আকর্ষণ তাদের নিজ নিজ পারিবারিক জীবন ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে।
মৃত্যু
১৯০৪ সালের মে মাসের মধ্যেই চেখভ প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে পড়েন। ক্ষয়রোগ চরম অবস্থায় পৌঁছে যায়। সেই অবস্থার কথা মিখাইল চেখভ এভাবে স্মরণ করেছেন, “যারা তাঁকে দেখতো তাদের প্রত্যেকেই গোপনে ভাবতো যে শেষ সময়ের আর বেশি দেরী নেই, কিন্তু শেষ সময়টা যতই নিকটবর্তী হচ্ছিলো তিনি যেন এটি ততটাই কম হৃদয়ঙ্গম করছিলেন।” জুনের তিন তারিখে তিনি ওলগার সাথে জার্মানির ব্ল্যাক ফরেস্টের ব্যাডেনওয়েইলার শহরের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেন। এই শহরটিতে থাকার সময় তিনি তার বোন মাশাকে শহরের খাবার ও পারিপার্শ্বিক অবস্থার বর্ণনা দিয়ে বাহ্যত আনন্দপূর্ণ কিছু চিঠি লিখেন। চিঠির মাধ্যমে তিনি তার মা ও বোনকে এই নিশ্চয়তা দেন যে শারীরিকভাবে তিনি আগের চেয়ে ভালো বোধ করছেন। তার শেষ চিঠিতে তিনি এমনকি জার্মান মেয়েদের পোশাক পরার ধরন নিয়েও অভিযোগ করেছেন।
চেখভের মৃত্যুর ঘটনাটি পরিণত হয় সাহিত্যের ইতিহাসে এক অসামান্য দৃশ্যপটের পরম্পরায়। যা তার মৃত্যুর পর থেকে বহুবার বর্ণিত হয়েছে। প্রতিবার নতুন করে ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় বিশদ বর্ণনাসহ চেখভের শেষ সময়ের ঘটনাবলী লেখা হয়েছে। কখনো কখনো এতে যুক্ত হয়েছে কাল্পনিক খুঁটিনাটি, ফলে কিছুটা হলেও বদলে গেছে প্রকৃত তথ্য। এ বিষয়ে আমেরিকান লেখক ও কবি রেমন্ড কারভারের এর্যাণ্ড ছোটগল্পটি উল্লেখযোগ্য। ১৯০৮ সালে ওলগা তার স্বামীর শেষ মুহূর্তগুলো নিয়ে লিখেছেন: খুব অদ্ভুতভাবে আন্তন শায়িত অবস্থা থেকে একেবারে সোজা হয়ে উঠে বসলেন এবং জার্মান ভাষায় (অথচ তিনি জার্মান ভাষা বলতে গেলে জানতেনই না) স্পষ্ট ও জোরগলায় বলে উঠলেন, “আমি মারা যাচ্ছি।” ডাক্তার তাঁকে শান্ত করলেন। একটি সিরিঞ্জের সাহায্যে তাঁকে কর্পূরের ইঞ্জেকশন প্রয়োগ করলেন এবং আদেশ দিলেন শ্যাম্পেন আনার জন্য। চেখভ একটি পুরো গ্লাস ভর্তি শ্যাম্পেন নিয়ে তা পরীক্ষা করলেন কিছুক্ষণ, মৃদু হেসে আমাকে বললেন, “বহুদিন হলো আমি শ্যাম্পেন পান করিনা।” শ্যাম্পেন শেষ করে তিনি নীরবে শুয়ে পড়লেন এবং আমি শুধুমাত্র বিছানায় ঝুঁকে পড়ে তাঁর নাম ধরে ডাকার সময়টুকু পেলাম। কিন্তু ততক্ষণে তাঁর জীবনের সমাপ্তি ঘটেছে। একটি শিশুর মতো শান্ত হয়ে তিনি ঘুমাচ্ছেন…
চেখভের মরদেহ মস্কোতে বহন করে আনা হয়। নোভোদেভিচে সমাধিক্ষেত্রে তার পিতার পাশেই চেখভকে সমাহিত করা হয়।
স্বীকৃতি
মৃত্যুর কয়েকমাস আগে চেখভ লেখক ইভান বুনিনকে বলেছিলেন যে তার ধারণা লোকে তার লেখা আর সাত বছর পড়বে। বুনিনের প্রশ্ন ছিল, “সাত কেন?” “ঠিক আছে, সাড়ে সাত”, চেখভের জবাব। “মন্দ নয়। আমি বেঁচে আছি আর বছর ছয়েক।”
বিনয়ী ও নিরহঙ্কারী চেখভ তার মরণোত্তর খ্যাতির এই ব্যাপ্তির কথা কল্পনাও করতে পারেননি। যে বছর তিনি মৃত্যুবরণ করেন, সে বছরে দ্য চেরি অরচার্ডের বিপুল সংবর্ধনা এ কথাই প্রকাশ করে যে রুশ জনগণের মনের কতটা উচ্চাসনে তিনি স্থান করে নিয়েছেন। সেই সময়ে সাহিত্য জগতের কীর্তিমান ব্যক্তিদের মধ্যে চেখভ ছিলেন দ্বিতীয়। তলস্তয়ের পরপরই ছিল তার অবস্থান। কনস্ট্যান্স গার্নেট তার লেখা অনুবাদ করেছেন, ফলে তিনি পেয়েছেন ইংরেজি-ভাষী পাঠক এবং জেমস জয়েস, ভার্জিনিয়া উলফ, ক্যাথরিন ম্যান্সফিল্ডের মতো লেখকদের প্রশংসা ও শ্রদ্ধা। ১৯১০ সালে লেখা ম্যান্সফিল্ডের দ্য চাইল্ড হু ওয়জ টায়ার্ড আর চেখভের স্লিপি’র মধ্যেকার সাদৃশ্য নিয়ে আলোচনা করেছেন উইলিয়াম এইচ নিউ তার রিডিং ম্যান্সফিল্ড ও মেটাফর অভ রিফর্ম এ। ইংল্যান্ডবাসী রুশ সমালোচক দিমিত্রি পেত্রোভিচ মার্স্কি সে দেশে চেখভের জনপ্রিয়তাকে ব্যাখ্যা করেছেন “আমরা যেটাকে বীরোচিত মূল্যবোধ বলি, প্রথাবিরুদ্ধভাবে তার সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যান” এর মাধ্যমে।
অ-রুশ ব্যক্তিদের মধ্যে সর্বপ্রথম যারা চেখভের নাটকের প্রশংসা করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন জর্জ বার্নার্ড শ’। “রুশ পদ্ধতিতে ইংরেজদের বিষয়বস্তুর ওপর রচিত এক উদ্ভট শিল্পকর্ম”, এই ছিল তাঁর হার্টব্রেক হাউস নাটকটির উপশিরোনামা। তিনি ব্রিটিশ জমিদার এবং অনুরূপ রুশদের মধ্যেকার সাদৃশ্যও লক্ষ্য করেছেন যা চেখভের বর্ণনায় “সেই একই শোভন ও রুচিবাগীশ ব্যক্তিবর্গ, সেই একই নিরেট অন্তঃসারশূন্যতা।”
আমেরিকাতে চেখভের নাম যশ ছড়িয়ে পড়ে আরও পরে, অংশত স্তানিস্লাভস্কির সাবটেক্সট-এর ধারণাযুক্ত অভিনয় পদ্ধতির প্রভাবে। স্তানিস্লাভস্কি লিখেছেন, “প্রায়শই চেখভ তাঁর চিন্তাভাবনার প্রকাশ ঘটাতেন কথার মাধ্যমে নয়, বরং কথাবার্তার মাঝের সাময়িক বিরতির মাধ্যমে অথবা একের পর এক বাক্য-সারির মাঝে অথবা এক শব্দের কোনো জবাবের মাধ্যমে………তাঁর সৃষ্ট চরিত্রেরা যা নিয়ে ভাবে এবং যা অনুভব করে তার প্রকাশ ঘটতে দেখা যায় না সেইসব চরিত্রের বলা কথায়।” সাবটেক্সট নির্ভর নাটকের এই ধারণা সম্প্রসারিত হয়েছে, বিশেষভাবে, নিউইয়র্কের গ্রুপ থিয়েটারের সাহায্যে। এর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন ক্লিফোর্ড ওডেটস, এলিয়া কাজান এবং লি স্ট্র্যাসবার্গসহ পরবর্তী প্রজন্মের আমেরিকান নাট্যকার, চিত্রনাট্যকার এবং অভিনেতাগণ। আবার পরবর্তীকালে স্ট্র্যাসবার্গের অ্যাক্টরস স্টুডিও এবং মেথড অ্যাক্টিং এর ধারণা প্রভাবিত করেছে আরও অনেক অভিনেতাকে, যাদের মধ্যে রয়েছেন মার্লোন ব্রান্ডো এবং রবার্ট ডি নিরো। ১৯৮১ সালে নাট্যকার টেনেসি উইলিয়ামস চেখভের দ্য সীগালকে ঈষৎ পরিবর্তিত করে লিখেছেন দ্য নোটবুক অভ ট্রিগোরিন।
যদিও চেখভের খ্যাতি ছিল মূলত নাট্যকার হিসেবে, তা সত্ত্বেও কিছু লেখক বিশ্বাস করেন যে তাঁর ছোটগল্পগুলোই প্রকৃতপক্ষে তাঁর মহৎ কৃতির প্রতিনিধিত্ব করে।
মার্কিন সাহিত্যিক রেমন্ড কারভার, চেখভের মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে এর্যান্ড নামের একটি গল্প লিখেছিলেন যিনি, চেখভকে ছোট গল্প লেখকদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ মনে করতেন: চেখভের গল্পগুলো এখনও তেমনই বিস্ময়কর (এবং অপরিহার্য), যেমনটা ছিল প্রথম প্রকাশের সময়ে। শুধুমাত্র তাঁর বিপুল সংখ্যক গল্পের সম্ভারই নয় – খুব কম লেখকই, যদি আদৌ তেমন কেউ থেকে থাকেন, তাঁর চেয়ে বেশি লিখেছেন – তিনি যে বিস্ময়জনক হারে সেরা গ্রন্থ ও গল্প রচনা করেছেন তা যেমন আমাদের আধ্যাত্মিক মুক্তির অনুভূতি দেয়, তেমনি আনন্দিত ও আলোড়িতও করে। তাঁর লেখা রচনা আমাদের আবেগ অনুভূতিকে যেভাবে তুলে ধরে তা শুধুমাত্র সত্যিকারের শিল্পকর্মের পক্ষেই সম্ভব।
চেখভ-প্রভাবিত আরেকজন লেখক আর্নেস্ট হেমিংওয়ের মতে, “চেখভ প্রায় ছয়টির মতো ভাল গল্প লিখেছেন। কিন্তু তিনি ছিলেন একজন শৌখিন লেখক।” ভ্লাদিমির নবোকভ কোনো এক সময়ে চেখভের “অপ্রীতিকর গতানুগতিক গদ্যময় রচনাশৈলী, মামুলি বিশেষণ ও পুনরাবৃত্তির জগাখিচুড়ি” নিয়ে অভিযোগও করেছেন। কিন্তু তিনি সুস্পষ্টভাবে এও জানিয়েছেন যে চেখভের দ্য লেডি উইদ দ্য ডগ এ যাবতকালের মধ্যে রচিত সর্বশ্রেষ্ঠ গল্পগুলোর একটি।
সুপ্রিয় পাঠক, মহান ও কীর্তিমান মানুষদের নিয়ে সব সময়ই লেখা যায় আমরা এটা বিশ্বাস করি।
পরিশেষে, সমাজতন্ত্র অভিমুখী অসাম্প্রদায়িক জনগণতান্ত্রিক ও বৈষম্যহীন ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রত্যয়ে সমতা-ন্যায্যতার প্রশ্নে বাংলাদেশকে এগিয়ে নেওয়ার প্রয়োজনেই বিশ্বজনীন মহান এই গুণীর সাহিত্য, জীবন সংগ্রাম, কীর্তি, ইতিহাস, তত্ত্ব ও অনুশীলন সম্পর্কে পাঠ প্রাসঙ্গিক ও জরুরী।
#
সৈয়দ আমিরুজ্জামান
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট;
বিশেষ প্রতিনিধি, সাপ্তাহিক নতুনকথা;
সম্পাদক, আরপি নিউজ;
কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, জাতীয় কৃষক সমিতি;
সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, মৌলভীবাজার জেলা;
‘৯০-এর মহান গণঅভ্যুত্থানের সংগঠক ও সাবেক কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, বাংলাদেশ ছাত্রমৈত্রী।
সাবেক কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, বাংলাদেশ খেতমজুর ইউনিয়ন।
সাধারণ সম্পাদক, মাগুরছড়ার গ্যাস সম্পদ ও পরিবেশ ধ্বংসের ক্ষতিপূরণ আদায় জাতীয় কমিটি।
প্রাক্তন সভাপতি, বাংলাদেশ আইন ছাত্র ফেডারেশন।
E-mail : syedzaman.62@gmail.com
WhatsApp : 01716599589
মুঠোফোন: ০১৭১৬৫৯৯৫৮৯
Bikash number : +8801716599589 (personal)
সম্পাদক : সৈয়দ আমিরুজ্জামান
ইমেইল : rpnewsbd@gmail.com
মোবাইল +8801716599589
৩১/এফ, তোপখানা রোড, ঢাকা-১০০০।
© RP News 24.com 2013-2020
Design and developed by M-W-D