সিলেট ৩১শে অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৫ই কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ১১:২২ পূর্বাহ্ণ, জুলাই ১৮, ২০২৩
সালটা ১৮৯৮। ইংরেজি ক্যালেন্ডারের হিসেবে তারিখ ২৭ জুন। গাঙ্গুলি-বাড়িতে সেদিন শোকের আবহ। সকালেই মারা গেছেন দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়। কিন্তু তাঁর যে কল এসেছে ! এই স্বামীই যে একদিন শিখিয়েছিলেন, রোগীর চেয়ে আগে আর কেউ নয়! এই স্বামীই তাঁর সাফল্যের অন্যতম কারিগর, তাঁর ভরসায় বলীয়ান হয়েই একদিন চিকিৎসাবিদ্যায় সরকারি ডিগ্রি লাভ করেছিলেন তিনি। শুধু দেশেই নয়, বিলেত গিয়েও ডাক্তারি ডিগ্রি এনেছিলেন তিনি।
আজকের মহিলারা যেখানে কাজ আর সংসারের ভারসাম্য বজায় রাখতে হিমশিম খান, উনিশ শতকের শেষে এক মহিলা স্বামী, সন্তানদের রেখে পাড়ি দিয়েছিলেন বিলেতে, মেডিক্যাল ডিগ্রি আনতে। সেই স্বামী আজই গত হয়েছেন। কিন্তু কল পেয়েও যদি তিনি না যান, তাহলে যে শুধু নিজেরই নয়, গোটা সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে মাথা উঁচু করে তাঁর হয়ে দাঁড়ানো দেবতুল্য স্বামীকে অসম্মান করা হয়! মন ঠিক করে নিলেন তিনি। কাছেই জমিদারবাড়ি, সেখানে প্রসব যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন এক হবু-মা। চললেন কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায় (Kadambini Ganguly), পর্দানশীন বাংলায় তিনি ছাড়া সেই আসন্নপ্রসবা তরুণীকে বাঁচানোর আর আছেটাই বা কে!
কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়। ভারতের প্রথম মহিলা ডাক্তার (First woman doctor of India)। উনিশ শতকের রক্ষণশীল বাংলায় যথার্থই বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন তিনি। সেই সময় ভারত তথা সমগ্র ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রথম দুই মহিলা স্নাতকের মধ্যে একজন ছিলেন কাদম্বিনী। ১৯৮৩ সালে বেথুন কলেজ থেকে গণিতে স্নাতক পাশ করার পর কাদম্বিনী ঠিক করেন ডাক্তারি পড়বেন। মেয়ের এমন ইচ্ছার শুনেই তো চমকে ওঠেন সকলে। পুরুষশাসিত সমাজে যেখানে মহিলারা পরপুরুষের সামনে আসা পাপ বলে মনে করেন, সেখানে তাঁদেরই সঙ্গে তালে তাল মিলিয়ে চিকিৎসাশাস্ত্র পড়বে সামান্য এক মেয়ে, লাশ কাটবে একসঙ্গে! কী দুঃসাহস!
চমকাননি দুজন। কাদম্বিনীর বাবা, এবং পিসতুতো দাদা। (Kadambini Ganguly)
সমাজের চোখরাঙানির মাঝে কাদম্বিনীর দুঃসাহসকে আত্মবিশ্বাসে পরিণত করার প্রাথমিক কারিগর ছিলেন তাঁরাই। পরে পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন শিক্ষক-চিকিৎসক দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়। ধর্মবিশ্বাসে ব্রাহ্ম দ্বারকানাথ বরাবরই ছিলেন নারীশিক্ষার একজন প্রবক্তা। গোটা সমাজ তো বটেই, এমনকী মেডিক্যাল কলেজের কিছু শিক্ষক এবং সহপাঠীও যখন কাদম্বিনীর স্পর্ধায় হতবাক, শুধু হতবাকই নয়, একপ্রকার খড়্গহস্ত বলা চলে, তখন তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। তাঁর অবিশ্রাম উৎসাহেই বাকিদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ডাক্তারি পড়া চালিয়ে যান কাদম্বিনী। শোনা যায়, একটিও ক্লাস, লেকচারে নাকি অনুপস্থিত থাকেননি তিনি। এমনকী, ঋতুস্রাবের অসম্ভব যন্ত্রণা উপেক্ষা করেই হাজির হয়ে যেতেন কলেজে।
এই মেডিক্যাল কলেজেই ছিলেন এক বাঙালি অধ্যাপক, তিনি কাদম্বিনীর ডাক্তারি পড়ার বিষয়টি কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি। শোনা যায়, স্নাতক স্তরের পরীক্ষায় নাকি মাত্র ১ নম্বর কম দিয়ে কাদম্বিনীকে ফেল করিয়েছিলেন তিনি। সেই সময় এগিয়ে আসেন ব্রিটিশ চিকিৎসক ডাক্তার জে এম কোটস। তিনি তখন কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ। অভিজ্ঞ এবং উদারমনস্ক এই চিকিৎসক বুঝেছিলেন, কাদম্বিনীর বিরুদ্ধে কী সুনিপুণ ষড়যন্ত্র চলছে। সেকথা অনুধাবন করেই সেনেটের বৈঠকে বিষয়টি উত্থাপন করেন তিনি। তাঁর ঐকান্তিক উদ্যোগেই সেই বৈঠকে সর্বসম্মতিক্রমে কাদম্বিনীকে ‘লাইসেনসিয়েট ইন মেডিসিন এন্ড সার্জারি’ শংসাপত্র দেওয়া হয়।
কিন্তু সেই ঘটনার পর ফাইনাল পরীক্ষার সময় ফের ফেল করানো হয় তাঁকে। এরপর আবারও নিজের ক্ষমতা প্রয়োগ করেন ডাঃ কোটস। কাদম্বিনীকে ‘গ্রাজুয়েট অফ বেঙ্গল মেডিক্যাল কলেজ’ ডিগ্রি দেন তিনি, যার ফলে একজন পেশাদার চিকিৎসক হিসেবে পাশ করার ছাড়পত্র পান কাদম্বিনী।
সেই ছাড়পত্র পাওয়ার পর পেশাদার চিকিৎসক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন কাদম্বিনী। তিনি অস্ত্রোপচার করতেন পুরোদমে, প্রাইভেট প্র্যাকটিসও করতেন। রাত হোক বা দিন, রোগীর বাড়ি থেকে কল এলে সময় দেখতেন না তিনি, টাট্টু ঘোড়ার গাড়িতে চেপে হাজির হয়ে যেতেন সেখানে। এমনকী, রোগী দেখার জন্য সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দিতেন তিনি।
সেসবের জন্য অবশ্য কম অপমান সইতে হয়নি তাঁকে। মৌখিক অপমান তো ছিলই, শারীরিক হেনস্থারও শিকার হতে হয়েছিল এই মহিয়সীকে। এমনকী, তাঁর গায়ে মানুষের বিষ্ঠা ছোড়া হয়েছিল বলেও শোনা যায়। সেসব কিছুই অবশ্য কাদম্বিনীর মনে দাগ কাটেনি। কর্তব্যে বরাবর অবিচল ছিলেন তিনি। মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাশ করার পরেই নিজের পছন্দে বিয়ে সেরেছিলেন বিপত্নীক দ্বারকানাথের সঙ্গে। সেই স্বামী আমৃত্যু পাশে থেকেছেন। এমনকী, ৮ সন্তানকে রেখে যখন একা বিলেত গিয়ে ডাক্তারি ডিগ্রি আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন কাদম্বিনী, তখনও ভরসা জুগিয়েছিলেন দ্বারকানাথই। ৩ মাসে ৩টি ডাক্তারি ডিগ্রি নিয়ে যখন দেশে ফেরেন কাদম্বিনী, তখন একদিন যারা মেডিক্যাল কলেজে ফেল করার কারণে তাঁর ডাক্তারি পড়ার যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল, তারাই সেদিন হতবাক হয়ে গিয়েছিল। বিলেত যাওয়ার সময় কাদম্বিনীর ছোট ছেলে ছিল একেবারেই কোলের সন্তান। মা বিদেশ থেকে ফেরার পর নাকি তাঁকে চিনতেই পারেনি সে।
সেই কষ্ট বুকে চেপেই ফের রোগী দেখতে বেরিয়ে পড়েছিলেন কাদম্বিনী। রাতবিরেতে কলে যাওয়ার জন্য তাঁকে ‘বেশ্যা’ বলে দেগে দিতেও কসুর করেনি সমাজ। বলা হত, টাকা ফেললেই নাকি যুবতী ডাক্তারের সেবা মিলবে। বঙ্গবাসী পত্রিকায় তাঁকে ও তাঁর স্বামীকে নিয়ে কুৎসিত কার্টুন ছাপা হয়েছিল, পতিতার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছিল কাদম্বিনীকে। দ্বারকানাথকে সেই কার্টুনে ভেড়া-রূপে আঁকা হয়েছিল। নিজের অপমান অনেকটাই গা-সওয়া হয়েছিল তাঁর। তবে ঈশ্বরতুল্য স্বামীর এমন সম্মানহানি দেখে রাগে, ঘেন্নায় গা রি রি করে উঠেছিল কাদম্বিনীর। সটান আদালতে ছুটেছিলেন তিনি। সম্পাদককে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে গিয়েছিলেন আদালতে। বিচারে বঙ্গবাসী পত্রিকার সম্পাদকের ৬ মাসের জেল এবং জরিমানা হয়। তারপর শান্ত হন কাদম্বিনী।
শুধু স্বামীর মৃত্যুর দিন নয়, নিজের মৃত্যুর দিন সকালেও রোগী দেখেছিলেন কাদম্বিনী। ১৯২৩ সালের ২৩ অক্টোবর। সেদিন সকালেও একটি অস্ত্রোপচার করেছিলেন তিনি। পরে হঠাৎ করেই অসুস্থ বোধ করতে শুরু করেন। বড় বৌমাকে বলেনও সেকথা। তার কিছুক্ষণের মধ্যেই হৃদযন্ত্র বিকল হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন তিনি। তাঁর সঙ্গেই সঙ্গেই সেদিন অবসান ঘটে বাংলার বিপ্লবের একটি অধ্যায়ের। তবে নিজের জীবন দিয়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মহিলাদের জন্য মেডিক্যাল কলেজ তথা চিকিৎসাবিদ্যা পড়ার দরজা চিরতরে খুলে রেখে গিয়েছিলেন কাদম্বিনী।
.
✍️ : অলকানন্দা পাল
সৌজন্যে : The Wall
সম্পাদক : সৈয়দ আমিরুজ্জামান
ইমেইল : rpnewsbd@gmail.com
মোবাইল +8801716599589
৩১/এফ, তোপখানা রোড, ঢাকা-১০০০।
© RP News 24.com 2013-2020
Design and developed by M-W-D