কৃষিখাতে থোক বরাদ্দসহ ১০ দফা দাবীতে প্রধানমন্ত্রীর বরাবরে জাতীয় কৃষক সমিতির স্মারকলিপি পেশ

প্রকাশিত: ১:৪৭ অপরাহ্ণ, জুলাই ২৫, ২০২৩

কৃষিখাতে থোক বরাদ্দসহ ১০ দফা দাবীতে প্রধানমন্ত্রীর বরাবরে জাতীয় কৃষক সমিতির স্মারকলিপি পেশ

বিশেষ প্রতিনিধি | শ্রীমঙ্গল (মৌলভীবাজার), ২৫ জুলাই ২০২৩ : কৃষি খাতে বাজেট বৃদ্ধির লক্ষ্যে থোক বরাদ্দ থেকে অর্থ বরাদ্দের দাবীসহ কৃষি ও কৃষক স্বার্থের ১০ দফা দাবীতে জাতীয় কৃষক সমিতি দেশব্যাপী জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী অফিসারের মাধ্যমে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বরাবর মিছিল-সমাবেশ সহকারে স্মারকলিপি পেশ করছে।
কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে আজ মঙ্গলবার (২৫ জুলাই ২০২৩) জাতীয় কৃষক সমিতির কেন্দ্রীয়, মৌলভীবাজার জেলা ও উপজেলা শাখার নেতৃবৃন্দ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বরাবরে প্রেরিত স্মারকলিপিটি শ্রীমঙ্গলে উপজেলা নির্বাহী অফিসার আলী রাজীব মাহমুদ মিঠুন মহোদয়ের নিকট দুপুর ১:৩০টায় উপজেলা প্রশাসনের কার্যালয়ে হস্তান্তর করেন এবং উপজেলা নির্বাহী অফিসার আলী রাজীব মাহমুদ মিঠুন আশ্বস্ত করেন যে, তিনি বিষয়টি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নিকট প্রেরণ করবেন।

এরপর বেলা ২টায় শ্রীমঙ্গল প্রেসক্লাব সংলগ্ন চারুকলা একাডেমীর সম্মুখে এক সংক্ষিপ্ত সমাবেশে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক, ‘৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের সংগঠক, বাংলাদেশ ছাত্রমৈত্রীর সাবেক কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, জাতীয় কৃষক সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির মৌলভীবাজার জেলা সম্পাদক মন্ডলীর সদস্য, সাপ্তাহিক নতুন কথা’র বিশেষ প্রতিনিধি, আরপি নিউজের সম্পাদক ও বিশিষ্ট কলামিস্ট কমরেড সৈয়দ আমিরুজ্জামান স্মারকলিপির দাবিসমূহ উত্থাপন করেন এবং দাবি আদায়ের লক্ষ্যে দেশের কৃষকসমাজসহ সর্বস্তরের জনগণকে সংগঠিত ও ঐক্যবদ্ধ হবার আহ্বান জানান।
এই কর্মসূচীতে সংগঠনের উপজেলা শাখার আহবায়ক সন্তোষ দে’র সভাপতিত্বে তিনি বক্তব্য দেন।

কৃষি ও কৃষকের স্বার্থে বিভিন্ন দাবী প্রসঙ্গে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বরাবরে জাতীয় কৃষক সমিতির স্মারকলিপিতে বলা হয়, দেশের আপামর কৃষকের অধিকার আদায়ের লড়াকু সংগঠন জাতীয় কৃষক সমিতির কেন্দ্রীয়, মৌলভীবাজার জেলা ও শ্রীমঙ্গল উপজেলা কমিটির পক্ষ থেকে আপনাকে এবং আপনার সরকারকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাচ্ছি।
১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী বাংলাদেশের আপামর কৃষকসমাজ ও জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী এবং আপনার দল ও রাজনৈতিক জোটের নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী দেশে কৃষিখাতের অভূতপূর্ব উন্নতি সাধিত হয়েছে, এবং এই উন্নয়নের অগ্রযাত্রা ক্রমান্নয়ে অব্যাহত থাকবে। কৃষি খাতে অব্যাহত উন্নতির ফলেই করোনা মহামারীকালীন দেশকে খাদ্য নিরাপত্তা দিয়েছে এদেশের কৃষক সমাজ। করোনা পরবর্তী বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক দুরবস্থা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে যে অর্থনৈতিক সংকট চলছে তা মোকাবেলা করতে কৃষিখাতের ওপর বিশেষ নজরদারির কোন বিকল্প নেই। কৃষির এই অগ্রযাত্রাকে অব্যাহত রাখতে প্রয়োজন কৃষিবান্ধব সুনির্দিষ্ট নীতি ও পরিকল্পনা এবং সেই সকল পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় অর্থের বরাদ্দ। কিন্তু আমরা লক্ষ্য করলাম সরকার নিজেদের কৃষিবান্ধব কর্মসূচী গ্রহণ করলেও কৃষিখাতে বরাদ্দ পূর্বের তুলনায় কমেছে। জাতীয় সংসদে যে বাজেট পাশ হয়েছে তাতে (২০২৩-২৪ অর্থবছর) কৃষি খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৩৫ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা। যা মোট বাজেটের ৪ দশমিক ৬৪ শতাংশ। এ খাতে গত অর্থবছরে (২০২২-২৩) বরাদ্দ ছিল ৩৩ হাজার ৬৯৮ কোটি টাকা।যা মোট বাজেটের ৪ দশমিক ৯৭ শতাংশ। অর্থাৎ টাকার অঙ্কে বাড়লেও খাতওয়ারি বরাদ্দের হিসাবে এবারের বাজেটে কৃষি খাতে বরাদ্দ আগের থেকে কমেছে। খাতওয়ারি বরাদ্দের নিরিখে এবার এই খাতে বরাদ্দ শতকরা দশমিক ৩৩ ভাগ কমেছে। মুদ্রাস্ফীতি বিবেচনা করলে তা আরও কমবে।একদিকে সার, ডিজেল, সেচসহ কৃষি উপকরণের দাম বাড়ছে; অপর দিকে কৃষক উৎপাদিত ফসলের দাম না পেয়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন। অন্যদিকে ভোক্তা পর্যায়ে বাজার ব্যবস্থাকে সংহত রাখতে আমদানি নির্ভর সিন্ডিকেটের হাতে বন্দি হচ্ছে সাধারণ জনগণ। বাজেটে অনুৎপাদনশীল খাতে অর্থ বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে। অথচ মানুষের খাদ্যনিরাপত্তা দিচ্ছে যে কৃষি খাত, সে খাতে আগের তুলনায় বরাদ্দ বাস্তবে আরও কমেছে। দীর্ঘদিন ধরে কৃষক, খেতমজুর, ভূমিহীনসহ গ্রামীণ শ্রমজীবী মানুষের কাজ ও খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আমাদের সংগঠন জাতীয় কৃষক সমিতি থেকে সকলের জন্য রেশনিং ব্যবস্থা চালুর দাবি জানিয়ে আসছি। কিন্তু বাজেটে এ খাতে কোনো বরাদ্দ নেই।সামাজিক সুরক্ষা খাতের জন্য যে বরাদ্দ রাখা হয়েছে, তার অধিকাংশই সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পেনশনের জন্য ব্যয় করা হয়। উপরন্তু কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর জন্য নতুন কোনো পরিকল্পনা নেয়া হয় নি। তবে আগামী অর্থবছরেও সেচের বিদ্যুৎ বিলে ২০ শতাংশ রেয়াত দেয়ার ঘোষণাকে আমরা সাধুবাদ জানাই। কিন্তু সার, বীজ, কীটনাশকসহ কৃষি উপকরণ আমদানিতে শুল্ক হার অপরিবর্তিত রাখার ফলে কৃষি উৎপাদনের খরচ বেড়ে যাবে। নতুন অর্থবছরে কৃষিতে ভর্তুকি বাড়ানো না হলেও কৃষি উপকরণ সহায়তা কার্ডের মাধ্যমে কৃষকদের কৃষি উপকরণ ও ঋণ সহায়তা প্রদান করার ঘোষণা দেয়া হয়েেেছ এবং কার্ডের আওতায় ২ কোটি কৃষককে আনার কথা বলো হয়েেেছ। সব কৃষককেই স্মার্ট কার্ড দেওয়ার উদ্যোগের কথাও বলা হয়েছে। একইসাথে বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়, পাহাড়ি ঢল ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে নিতে কৃষকদের ভর্তুকির পাশাপাশি প্রণোদনা ও পুনর্বাসন সুবিধা দেওয়ার কথাও বলা হয়েছে। এই অর্থবছরেও হাওর এলাকার কৃষকদের জন্য শতকরা ৭০ ভাগ এবং অন্য এলাকার কৃষকদের জন্য ৫০ ভাগ সহায়তা দিয়ে ৫১ হাজার ৩০০টি কৃষিযন্ত্র সরবরাহ করার প্রস্তাাব দেয়া হয়েছে। ব্যবসা বাণিজ্য সহজীকরণ ও উৎপাদন ব্যয় কমানোর লক্ষ্যে কৃষি কাজে ব্যবহৃত রাইস ট্রান্সপ্লান্টার, সকল প্রকার স্পেয়ার মেশিন এবং পটেটো প্লান্টার আমদানির ক্ষেত্রে আগাম কর অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। এই সকল উদ্যোগ সঠিকভাবে বাস্তাবায়িত হলে কৃষক সমাজ উপকৃত হবে এবং এর জন্য আপনার সরকার ধন্যবাদ প্রাপ্য। কিন্তু করোনাকালীন প্রণোদনার ইতিহাস ভিন্ন কথা বলে, তখন শিল্প খাতকে যতটা প্রণোদনা দেয়া হয়েছে কৃষিকে ততটা গুরুত্ব দেয়া হয় নি।
এ অবস্থায় দেশের আপামর কৃষক সমাজের পক্ষ থেকে আমরা আপনার এবং আপনার সরকারের কাছে দাবি করছি।
দাবিসমূহ হচ্ছে, ১। বাজেটে কৃষি খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধির লক্ষ্যে থোক বরাদ্দ থেকে প্রদান করতে হবে।। বাজেটে কৃষি খাতে (কৃষি, খাদ্য এবং মৎস ও প্রাণী সম্পদ) বরাদ্দকৃত সকল অর্থ সঠিকভাবে ব্যয়ের নিশ্চয়তা দিতে হবে। কৃষি পণ্যের লাভজনক মূল্য প্রদান ও কৃষি উপকরনের মূল্য কমাতে হবে। ব্যাংক ঋণের সুদ কমিয়ে সরল সুদে কৃষকদের ব্যাংক ঋণ দিতে হবে। এনজিও ঋণের সুদ কমাতে হবে। মহাজনের ঋণের অত্যাচার বন্ধ করতে হবে।
২। সরকারী হিসাবে আমাদের দেশে প্রায় ৫০ লক্ষ একর খাস জমি ও জলা আছে। তা অবিলম্বে গণতান্ত্রিক ভূ-সংস্কার নীতিমালার অধীনে এই জমির উপর ভূমিহীন কৃষক ও মৎস্যজীবীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। একইসঙ্গে সিলিং উদ্বৃত্ত জমি খাসের আওতায় আনতে হবে।
৩। দেশের যে সকল নদী-বিল-হাওর আছে তা সংস্কার করতে হবে। যাতে ভূ-উপরস্থ পানি সেচ কাজে ব্যবহার করা যায়। ভূ-নিম্নস্থ পানির স্তর অনেক নিচে নেমে গেছে, তাই এই পানি সেচ কাজে ব্যবহারে উৎপাদন খরচ অনেক বেশি পড়ে। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জলাবদ্ধতা নিরসন ও নদী {াটরোধে সরকারের ডেল্টা প্লান অনুযায়ী {াট নদীসমূহ খনন করে জোয়রের পানিতে আসা পলি ব্যবস্থাপনার জন্য ঞজগ (ঞরফধষ জরাবৎং ঝরষঃ গধহধমবসবহঃ) প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে।
৪। (ক) সারাদেশে পূর্ণ রেশনিং চালু করতে হবে, (খ) ৬০ বছর বয়সের কৃষক ও খেত মজুরদের জন্য জমা বিহীন পেনশন স্কিম চালু করতে হবে। বৃদ্ধ ভাতা, বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, মাতৃকালীন ভাতাসহ সকল ভাতার পরিমাণ ও সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে।
৫। পচনশীল কৃষি পণ্য রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সরকারের উদ্যোগে হিমাগর নির্মাণ করতে হবে। এবং অন্যান্য কৃষি পণ্য বছরব্যাপী সংরক্ষণের জন্য সরকারি সংরক্ষণাগারের পরিমাণ জেলা-উপজেলায় বাড়াতে হবে।
৬। বরেন্দ্র অঞ্চলকে মরুকরণ থেকে রক্ষা করতে ফারাক্কা চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন করতে হবে। পদ্মা ও এর শাখা নদীসমূহের নাব্যতা বৃদ্ধিতে খনন কাজ পরিচালনার উদ্যোগ নিতে হবে।
৭। মুজিব বর্ষ উপলক্ষে সরকার যে সমস্ত গৃহীনদের ঘর দিচ্ছে সেইবণ্টনে প্রচুর দুর্নীতি হচ্ছে, তা অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। তাছাড়া ঘরের মানও সরকারি পরিকল্পনা মাফিক হচ্ছে না এই বিষয়টিও সরকারকে খতিয়ে দেখতে হবে।
৮। প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থায় কৃষিকে যান্ত্রিকীকরণের জন্য প্রকৃত কৃষকরা লাভবান হচ্ছে না, লাভবান হচ্ছে জোতদার ধনী কৃষক, লাভবান হচ্ছে পুঁজিপতি কোম্পানিগুলো। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে গরিব কৃষক ও খেতমজুর। অবিলম্বে সরকারি উদ্যোগে কৃষক সমবায় গঠন করে কৃষিকে যান্ত্রিকীকরণের কাজ করতে হবে।
৯। তিস্তা নদীর পানি নিয়ে বাংলাদেশের সাথে ভারতের যে চুক্তি হওয়ার কথা ছিল সেই চুক্তি অবিলম্বে সম্পাদন ও বাস্তবায়ন করতে হবে। কেননা,খরা মৌসুমে পানির অভাবে সেচকার্য ব্যাহত হয় আবার বর্ষাকালে ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়, নদী ভাঙ্গনের প্রচুর মানুষ গৃহহারা হয়। ‘তিস্তাবাঁচাও নদী বাঁচাও’ তিস্তা পাড়ের মানুষের যে আন্দোলন করছে তার প্রতি সংগঠন পূর্ণ সমর্থন ঘোষণা করছে। তিস্তা নদী নিয়ে সরকার যে প্রজেক্ট প্রস্তুত করেছে নিজেদের অর্থায়নে এই প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করতে হবে। বাংলাদেশের সাথে আন্তর্জাতিক নদী আছে ৫৭টি। ৫৪টি ভারতের সাথে, ৩টি মায়ানমারের সাথে। আন্তর্জাতিক নীতিমালা অনুযায়ী এই নদীগুলো থেকে পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় করতে হবে।
১০। বর্তমান বাজেট ব্যবস্থা মধ্যস্বত্তভোগী সিন্ডিকেটের স্বার্থে, তা ভেঙ্গে কৃষকদের স্বার্থে বাজার ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।
জাতীয় কৃষক সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির উদ্যোগে এ সকল দাবিতে দেশব্যাপী জেলা/উপজেলায় কৃষক সমাবেশ করেছি। আমরা আশাকরি, দেশের আপামর কৃষক সমাজের এই প্রাণের দাবিসমূহ বাস্তবায়ন করতে আপনি এবং আপনার সরকার কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করবেন।

 

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ