এম এন রায়: মেক্সিকো-প্রবাসের স্মৃতি-১

প্রকাশিত: ৫:২৭ অপরাহ্ণ, আগস্ট ২৪, ২০২৩

এম এন রায়: মেক্সিকো-প্রবাসের স্মৃতি-১

প্রিসিলা রাজ |

মেক্সিকো সফর তার জীবনে গুরুত্বপূর্ণ এক ঘটনা। এক অর্থে তার রাজনৈতিক চিন্তার ক্ষেত্রে যেমন, তেমনি এই দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসেও মানবেন্দ্রনাথের মেক্সিকো-সফর বড় ধরনের বাঁক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে।

ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামী, কমিউনিস্ট বিপ্লবী ও তাত্ত্বিক মানবেন্দ্রনাথ রায়ের সমধিক পরিচিতি উদার মানবতাবাদের (radical humanism) তাত্ত্বিক ও প্রবক্তা হিসেবে। বিপ্লবী জীবনে তাঁকে বহু ছদ্মনাম নিতে হয়েছিল। মানবেন্দ্রনাথ রায় তারই একটি। তাঁর আসল নাম নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য।

ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগণা জেলার আরবেলিয়া গ্রামে শাক্ত ব্রাহ্মণ ভট্টাচার্য পরিবারে ১৮৮৭ সালে জন্ম নরেন্দ্রনাথের। বাবা দীনবন্ধু ভট্টাচার্য, মা বসন্তকুমারী দেবী। আট সন্তানের মধ্যে নরেন্দ্রনাথ ছিলেন চতুর্থ। স্কুল ও কলেজ শেষ করার পর তিনি বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটে (এখন যা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়) প্রকৌশল ও রসায়ন বিষয়ে পড়ার জন্য ভর্তি হন।

স্বামী বিবেকানন্দ এবং বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের রচনায় উদ্দীপিত নরেন্দ্রনাথ ছাত্রজীবনেই ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র বিপ্লবী দল অনুশীলন সমিতিতে যোগ দেন। এখানে যুক্ত থাকার সময় বিপ্লবী বাঘা যতীনের সংস্পর্শে আসেন যাঁর ব্যক্তিত্ব তাঁকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল।

ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রাম এগিয়ে নিতে তরুণ নরেন্দ্রনাথ জার্মানির কাছ থেকে অস্ত্র ও অর্থ সংগ্রহের জন্য প্রশান্ত মহাসাগরে পাড়ি জমান। ইন্দোনেশিয়া, চীন ও জাপান হয়ে একসময় জাহাজে চেপে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পৌঁছে যান। গ্রেপ্তার এড়াতে সেখানেই তিনি মানবেন্দ্রনাথ রায় (এম.এন. রায়) নাম নেন। সান ফ্রান্সিসকোয় ইভলিন লিওনোরা ট্রেন্টের সঙ্গে প্রেম ও বিয়ে হয়। এ সময় পড়াশোনার মধ্য দিয়ে মার্কসবাদে আগ্রহী হয়ে ওঠেন মানবেন্দ্রনাথ। ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের এড়াতে এই দম্পতি ১৯১৭ সালের জুলাইতে মেক্সিকোয় পাড়ি জমান।

মেক্সিকো সরকার তাঁকে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসেবে স্বাগত জানায়। তবে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য অর্থ ও অস্ত্র সংগ্রহের যাবতীয় চেষ্টা শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়। সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে ভারতকে স্বাধীন করার ব্যাপারে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিতেও ব্যাপক পরিবর্তন আসে। মার্কসবাদের ওপর পড়াশোনা আরো গভীর হয়। সতীর্থদের নিয়ে তিনি সোশ্যালিস্ট পার্টি গঠন করেন যা ১৯১৯ সালে কমিউনিস্ট পার্টি অব মেক্সিকোতে রূপান্তরিত হয়। এটি ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের বাইরে প্রথম কমিউনিস্ট পার্টি। এর সুবাদে ১৯২০ সালের গ্রীষ্মে মস্কোয় অনুষ্ঠিতব্য কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালের সম্মেলনে অংশগ্রহণের জন্য ডাক পান।

সম্মেলনের কয়েকদিন আগে মানবেন্দ্রনাথকে মস্কোয় সাদরে স্বাগত জানান লেনিন স্বয়ং। লেনিন তাঁকে তাঁর জাতীয় ও ঔপনিবেশিক প্রশ্নে প্রাথমিক খসড়া থিসিস-এর সম্পূরক একটি দলিল প্রস্তুত করতে বলেন। তাসখন্দে বসেই মানবেন্দ্রনাথ কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া (তাসখন্দ) গঠন করেন। স্ট্যালিনের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটলে ১৯২৮ সালে জার্মানিতে চলে যান।

মানবেন্দ্রনাথ ভারতে ফিরে আসেন ১৯৩০-এর ডিসেম্বরে। পরের বছর জুলাই মাসে তিনি পুরানো এক রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় গ্রেপ্তার হন। বিচারে তাঁর ১২ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয় তবে পাঁচ বছর পর ছাড়া পান। জেলে থাকাকালে গুরুতর শারীরিক অসুস্থতা সত্ত্বেও লেখালেখি চালিয়ে যেতে থাকেন। অন্যান্য বহু লেখার পাশাপাশি তিন হাজার পৃষ্ঠার একটি পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করেন যার প্রাথমিক নাম ছিল দ্য ফিলসফিক্যাল কনসিকোয়েন্স অব মডার্ন সায়েন্স।

ভারতে আসার পর এলেন গটসচ্যাকের সঙ্গে প্রেম ও বিয়ে হয় মানবেন্দ্রনাথের। দেরাদূনে স্থায়ী বাস গড়েন তাঁরা। বুর্জোয়া গণতন্ত্র ও কমিউনিজম উভয় রাজনৈতিক আদর্শের প্রতি ক্রমশ আস্থা হারিয়ে ফেলেন মানবেন্দ্রনাথ। নতুন যে আদর্শের প্রতি আস্থা গড়ে ওঠে তার নামকরণ করেন উদার মানবতাবাদ বা র‌্যাডিক্যাল হিউম্যানিজম। এ সম্পর্কে তিনি বিস্তারিত আলোচনা করেছেন রিজন, রোমান্টিসিজম অ্যান্ড রেভোলুশ্যন বইয়ে।

১৯৫৪ সালের ২৫শে জানুয়ারি প্রয়াত হন এই মনিষী। ১৯৮৭ সালে অক্সফোর্ড ইউনির্ভাসিটি প্রেস তাঁর নির্বাচিত রচনাবলি প্রকাশ করতে শুরু করে। চারটি খণ্ড প্রকাশিত হওয়ার পর ২০০৮ সালে প্রকল্প সম্পাদক প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী শিবনারায়ণ রায়ের মৃত্যু ঘটে। প্রকল্পটির ইতি ঘটে সেখানেই।

মেক্সিকো সিটির যে বাড়িটির বাসিন্দা ছিলেন মানবেন্দ্রনাথ সেটি এখন অভিজাত এক নাইট ক্লাব। ক্লাবের নাম- এম.এন. রায়।

মেক্সিকো সফর তার জীবনে গুরুত্বপূর্ণ এক ঘটনা। এক অর্থে তার রাজনৈতিক চিন্তার ক্ষেত্রে যেমন, তেমনি এই দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসেও মানবেন্দ্রনাথের মেক্সিকো-সফর বড় ধরনের বাঁক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। ইংরেজিতে লিখিত তাঁর স্মৃতিকথা Memoirs ১৯৬৪ সালে দিল্লী থেকে প্রকাশিত হয়। ৬২৮ পৃষ্ঠার এই দীর্ঘ স্মৃতিকথার শতাধিক পৃষ্ঠা জুড়ে রয়েছে মেক্সিকো বাসের রোমাঞ্চকর ও ঘটনাবহুল স্মৃতি। মূল গ্রন্থের ৫ম অধ্যায় থেকে ২৯ অধ্যায় পর্যন্ত বিস্তৃত সেই স্মৃতিচারণ। স্মৃতিকথার এই নির্বাচিত অংশ কলামিস্ট অনুবাদক প্রিসিলা রাজ-এর অনুবাদে ধারাবাহিকভাবে বাংলা ভাষায় প্রথমবারের মতো প্রকাশিত হতে যাচ্ছে। আজ থাকছে মেক্সিকো সফরের সূচনা ও কার্যকারণ পর্ব। এই অনুবাদে মূল বইয়ের পর্ব-বিন্যাস অনুসরণ ও উল্লেখ করা হয়েছে।
-বিভাগীয় সম্পাদক

[৫ম অধ্যায়ের শেষাংশ]

আমেরিকায় আমি এসেছিলাম জার্মানি যাওয়ার পথে। আমেরিকার জার্মান জনগোষ্ঠী বা বার্লিনের ভারতীয় বিপ্লবী কমিটির প্রতিনিধিদের কাছ থেকে আমার উদ্দেশ্য ফলপ্রসূ করার জন্য কোনো সাহায্য পাওয়া যাবে না এই বিষয়টি যখন পরিষ্কার হয়ে গেল আমি তখন দ্রুত অন্যান্য সুযোগগুলো ধরার জন্য সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। পাশের দেশ মেক্সিকোয় তখন একটা স্থায়ী বিপ্লব পরিস্থিতি বিরাজ করছিল। আমার কাছে তখন মেক্সিকোকেই প্রতিশ্রুতির ভূমি বলে মনে হচ্ছিল। যে কাজে এসেছি তাতে খুব বেশি এগোতে না পারলে আমি মেক্সিকোতে থিতু হয়ে সেখানেই বিপ্লব সংঘটনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করতে পারি। আমি তখন আর শুধুমাত্র ভারতের চিন্তা করছিলাম না। বিপ্লব যে একটি আন্তর্জাতিক সামাজিক প্রয়োজন এই চিন্তাধারার সঙ্গে তখন আমার সবে পরিচয় ঘটছে। নিউ ইয়র্কে পরিচিত সমাজতন্ত্রীদের কাছ থেকে জানতে পেরেছি মেক্সিকো তখন বিপ্লবের প্রসববেদনায় কাতর। আরো জানলাম জনৈক জেনারেল আলভারাদো ইইকাতান প্রদেশে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির প্রতিষ্ঠা করেছেন। এই ইউকাতানই মায়া সভ্যতার পীঠস্থান। সমাজতান্ত্রিক আদর্শে আমার দীক্ষা তখনও যথেষ্ট পোক্ত হয়নি। ফলে প্রাগৈতিহাসিক কালের কোনো এক সন্ধিক্ষণে ভারতীয়রাই মহাসাগর পেরিয়ে মেক্সিকোয় উপনিবেশ স্থাপন করেছিল দেশপ্রেমিকসুলভ আগমার্কা এসব ধারণা থেকে আমি তখনও বেরুতে পারিনি। এর ফলে মেক্সিকোর আকর্ষণ আমার জন্য অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠল।

ইন্দো-জার্মান ষড়যন্ত্র ফাঁস হয়ে যাওয়ার আগেই স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট ডেভিড স্টার জর্ডনের কাছ থেকে জেনারেল আলভারাদোর কাছে লেখা আমার পরিচয়সূচক একটা হাতচিঠি নিয়ে নিলাম। ডেভিড স্টার জর্ডন সেসময় আমেরিকার সবচেয়ে খ্যাতনামা শান্তিবাদী নেতা ছিলেন। তখন চম্পট দেওয়াটাই সবচেয়ে জরুরি হয়ে উঠল। কিন্তু যেদেশে কালো মানুষদের সবচেয়ে দ্রুত চিহ্নিত করা যায় সেখানে পুলিশের চোখে ধুলো দেবো কীভাবে সেটাই কঠিন প্রশ্ন হয়ে দেখা দিল। বাড়ি বসে যেসব পদ্ধতির চর্চা করেছি তার কোনোটাই কাজে লাগবে না। স্রেফ সুযোগ নিতে হবে আমাকে। বাঁধনছেঁড়া দুঃসাহস নিয়ে ঝাঁপ দিতে হবে। এটাই একমাত্র পন্থা। এজন্য প্রথমেই বাসা বদল করতে হবে। নতুন বাসাটা নিলাম একটা ভীড়ভাট্টায় ভরা এলাকায়। কিন্তু নতুন বাসায় যাওয়ার সময় কারো কোনো গোয়েন্দাগিরি চোখে পড়ল না। তাহলে কি পুরোটাই ধাপ্পা? কিন্তু আর সময় নষ্ট করা ঠিক হবে না। টিকটিকিরা আমার পাত্তা হয়তো সাময়িকভাবে হারিয়ে ফেলেছে, কিন্তু সেটা ধরে ফেলতে বেশি সময় লাগবে না। এক সন্ধ্যায় নতুন বাসা থেকে বেরিয়ে কাছেই একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাওয়াদাওয়া সেরে নিলাম। তারপর আরেক দরজা দিয়ে বেরিয়ে ট্যাক্সি ডেকে সোজা রেলস্টেশনে পৌঁছালাম। তার আগে, আমি নিজেকে জানিয়েছিলাম সন্ধ্যার কিছু পরে একটা ট্রেন সীমান্ত শহর সান আন্তোনিওর দিকে গেছে। দক্ষিণের কয়েকটা স্টেশনের ওপর দিয়ে গেলেও খয়েরি চামড়ার কারণে কোনো ঝামেলায় পড়তে হয়নি আমাকে। তৃতীয় দিন দুপুরবেলা ট্রেনটা সীমান্তের স্টেশনে এসে থামল। শেষ মুহূর্তে কিছু ঝামেলা হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু স্রেফ চাপা পিটিয়ে বেরিয়ে গেলাম। শেষমেশ রিও গ্রান্দে পৌঁছালাম। মার্কিন চরদের বুড়ো আঙুল দেখানোর পুলকে আমার মুখে তখন চওড়া হাসি।

(চলবে)

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ