রশীদ করীম শুধু সাহিত্যের উত্তম পুরুষ নন সমাজের গ্লানিবোধেরও কথক!

প্রকাশিত: ৩:৪০ অপরাহ্ণ, আগস্ট ২৮, ২০২৩

রশীদ করীম শুধু সাহিত্যের উত্তম পুরুষ নন সমাজের গ্লানিবোধেরও কথক!

শরীফ শমশির |

রশীদ করীম (১৯২৫-২০১১); কলকাতায় জন্মগ্রহণকারী এই সাহিত্যিক ১৯৪৭ এ পূর্ব পাকিস্তানে হিজরত করেছিলেন অন্য অনেকের মতো; কারণ পাকিস্তানে জাতি পরিচয় ও কর্মসংস্থান গ্রহণের অপশন নিয়ে।
কলকাতায় লেখালেখির শুরু, ভাই আবু রুশদও পাকা লেখক ছিলেন। কলকাতার উঁচুমানের লেখক যেমন আবু সায়ীদ আইয়ুব প্রমুখের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ছিল। পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশে এসে কিছুদিন লেখেননি, লিখলেন ১৯৬০-এর দিকে, প্রকাশিত হলো ‘উত্তম পুরুষ’। কলকাতার মুসলিম সমাজের চুম্বকচিত্র। সমাজের এক তরুণের অতৃপ্তির বয়ানে আধুনিক মুসলিম মানসের বয়ান। এর আগে যেসব মুসলিম লেখক মুসলিম সমাজের চিত্র উপন্যাস ও গল্পে তুলে ধরেছেন তার প্রেক্ষাপট ছিল, গ্রাম, গ্রামসমাজের দ্বন্দ্বের বর্ণনা। রশীদ করীম আধুনিক এই অর্থেও, মনস্তস্ত্বও তিনি এনেছিলেন।
এই উপন্যাস তাঁকে খ্যাতি ও স্বীকৃতি এনে দেয় রাষ্ট্রের উঁচু মহল থেকেও।
এখানে একটা কথা মনে করিয়ে দিতে চাই তা হলো; পাকিস্তান সৃষ্টির পর অপশন দিয়ে শুধু বিহার থেকে নয়, পশ্চিমবঙ্গের নানান জায়গা থেকেও বাঙালিরা এসেছিলেন। বিহারি বলে যারা পরিচিত শুরু থেকেই বাঙালিদের সাথে তাদের দ্বন্দ্ব হয়, বসত ও চাকরির প্রাধান্য নিয়ে কারণ তারা উর্দু ও হিন্দি ভাষাভাষী হিসেবে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকদের মিত্রে পরিনত হয়েছিলেন। পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি মুসলিম যারা এসেছিলেন তাদের অনেকেই বসতবাড়ি বিনিময় বা চাকরির অপসন নিয়ে এসেছিলেন। পূর্ববঙ্গের অবস্থা অনেকটা গ্রামীণ থাকায় তাদেরও অনেক অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। তাঁরা সবাই ঢাকা এসেছিলেন তা নয় তারা বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকায় বসতি স্থাপন করেছেন। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও অন্যান্য শহরে যারা থিতু হয়েছিলেন তারা অনেকেই শিক্ষিত হওয়ায় চাকরিতে সুবিধাজনক অবস্থায় ছিলেন। এরা বাংলাদেশের রাজনীতির পর্যবেক্ষক ছিলেন, প্রগতিশীলরা ভাষা আন্দোলন থেকে অন্যান্য আন্দোলনে যুক্ত হন। পূর্ববঙ্গের তথা বাংলাদেশের মুসলমান যখন স্বাধীনতার প্রশ্নকে সামনে নিয়ে আসে তখনই পশ্চিমবঙ্গ থেকে আগত মুসলমানগণ মানসিক সংকটে নিপতিত হন। পাকিস্তান ধারণাকে ধারণ করে তারা পূর্ববঙ্গে এসেছিলেন, সেই ধারণা থেকে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ফসল বাংলাদেশের স্বাধীনতার সমর্থক কীভাবে হন! এই মনস্তাত্ত্বিক সংকট স্বাভাবিক। বিহারি উর্দুভাষীগণ পশ্চিম পাকিস্তানের সমর্থক হিসেবে মুষ্টিমেয় কয়েকজন ছাড়া অধিকাংশই বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে সশস্ত্র অবস্থান নেন, সে কাহিনিতে যাব না। আবদ্ধ থাকবো, পশ্চিমবঙ্গ থেকে আগত বাঙালি মুসলমানদের মনোভাবে। তাঁরা বাংলাদেশ চান! কিন্তু মুসলিম রাষ্ট্রের কি হবে! কারণ, তাঁরা ভারতসমর্থক নন। এই যে দোলাচল তার সার্থক রূপায়ন দেখি সেই রশীদ করীমের স্বাধীনতাত্তোর কালের উপন্যাসে, ‘আমার যত গ্লানি ‘- তে। ঢাকার অভিজাত যাদের হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টাল-এ যাতায়াতের ক্ষমতা ছিল। উল্লেখ্য, এই হোটেলে ভুট্টাে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বিষোদগার করেছিলেন আবার এই হোটেলে অবস্থানরত আন্তর্জাতিক সাংবাদিকগণ পঁচিশে মার্চের গণহত্যার ছবি ও সংবাদ বিশ্বময় ছড়িয়ে দিয়েছিল। যাই হোক, রশীদ করীম বাংলাদেশের পরিমণ্ডলে বাংলা উপন্যাসের আধুনিক লেখক। তাঁর লেখায় নরনারীর প্রণয় বা সমাজের বৈপ্লবিক পরিস্থিতিতে নায়কের মনস্তাপ শুদ্ধ শৈলীতে ধরা পড়েছে। বশীদ করীম শুদ্ধবাদী লেখক, শিল্পের জন্য শিল্পের সমর্থক হলে দেশভাগের ফলে বাঙালি মুসলমানদের রাষ্ট্রচেতনার আবেগের দ্বন্দ্ব ও স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষার প্রবল মোহের চিত্রকর।
তিনি নতুনের জয়গানও করেন। শামসুর রাহমান যেমন তাঁর পছন্দের তেমনি নতুনরাও যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য লিখেছেন তাঁরাও। তবে তিনি কঠোর সমালোচকও ছিলেন, সত্যটা বা তাঁর মনের কথাটি স্পষ্ট করে বলতেন। বর্তমান বাংলাদেশে তাঁর প্রাসঙ্গিকতা কি! এই প্রশ্নের জবাবের জন্যই রশীদ করীমকে নিয়ে লেখা। আমাদের ভোটের রাজনীতিতে পশ্চিমবঙ্গ থেকে আগত বাঙালি মুসলমানদের ঘনবসতি যেখানে অর্থাৎ সীমান্তবর্তী এলাকার ভোটারদের মনঃসমীক্ষা করলে বোঝা যাবে। এরা বাংলাদেশের বাঙালি মুসলমান কিন্তু জাতীয়তাবাদী বাঙালি নন, প্রবীণদের মধ্যে পাকিস্তান রাষ্ট্রের স্বপ্ন মরীচিকার মতো রয়ে গেছে। রশীদ করীমের মত মহৎ সাহিত্যিক থাকলে এই বিষয়ে আলোকপাত করতে পারতেন। বাঙালি মুসলমানের মনের অনেক বাঁক যেমন আছে তেমনি বহু শুকনো তটরেখাও আছে। রাজনীতিতে যা প্রবল তা সাহিত্যে, সমাজতত্ত্বে তত প্রতিফলিত নয়। একাজ কে করবে!
রশীদ করীম বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোর সমর্থক ছিলেন, একটি আধুনিক বাংলাদেশের কথা ভাবতেন যেখানে শুধু সংখ্যার বিচারে নয়, ধর্মের পরিচয়ে নয় বা জাতপাতের বিচারে নয় মানুষ পরিচয়ে সবাই থাকবেন; আর যার যার ধর্ম হবে তার তার আত্মার শান্তি, সংঘর্ষ ও ঘৃণার নয়।
এই বয়ান রশীদ করীমকে চেনানোর জন্যে যতটুকু তার চেয়ে বেশি হলো, বাংলাদেশের মুসলিম জনগোষ্ঠীর নানা মিশ্রণ ও কতটুকু তারা মিশেছেন তার হদিস খোঁজা। বাংলাদেশের বাঙালির মনস্তত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব, সাহিত্য ও রাজনীতি বোঝার কাতরতা।
রশীদ করীম যতটুকু বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন তার থেকেও তা এগিয়ে যাক!

#
শরীফ শমশির
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক, লেখক
২৮, আগস্ট, ২০২৩। ঢাকা।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ