নাজিম হিকমতের পাঁচটি কবিতা

প্রকাশিত: ৬:০৭ পূর্বাহ্ণ, জুন ৭, ২০২৪

নাজিম হিকমতের পাঁচটি কবিতা

আজফার হোসেন |

[নাজিম হিকমতের জন্মের প্রায় ৭০০ বছর আগে আসা কবি ফুজুলি ছাড়া ওই হিকমতকেই তুরস্কের ইতিহাসে সবচাইতে বিপ্লবী কবি হিসেবে চিহ্নিত করার রেওয়াজ এখনও বর্তমান। অবশ্যই একজন ঐতিহাসিক এবং রাজনৈতিকভাবে লিপ্ত কবি হিসেবে তিনি শুধু তুরস্কেই নয়, বিশ্বপরিসরেই বিস্তর স্বীকৃতি ও প্রশংসা অর্জন করেছেন। বাংলা ভাষাসহ পঞ্চাশটিরও বেশি ভাষায় তাঁর কবিতা অনূদিত হয়েছে। একাধিক লিপ্ত ফিলিস্তিনি কবি তাঁদের মননে এবং লড়াইয়ে হিকমতকে সম্মান ও ভালোবাসার স্থান দিয়ে এসেছেন। আর হিকমতের আন্তর্জাতিকতাবোধ এবং বিষয়বস্তুর সর্বজনীনতার কথা বিবেচনায় রেখেই তুর্কি সমালোচক ও মনোবিজ্ঞানী গুন্দুজ ভাস্সাফ একসময় বলেছিলেন এই মর্মে যে, হিকমতের মাতৃভাষা যদি ইংরেজি কিংবা ফরাসি অথবা স্প্যানিশ হতো, তাহলে তিনি জগত জুড়ে খোদ শেকসপিয়রের মতোই গ্রহণযোগ্যতা লাভ করতেন। এও সত্য যে, কম্যুনিজমে তাঁর আস্থা আজীবন অটুট ছিলো, যদিও কম্যুনিজম কোন আরোপিত আদর্শ হিসেবে হাজির হয়ে তাঁর কবিতার নান্দনিক গুণকে ক্ষুণ্ণ করে নাই মোটেই। তিনি একাধিকবার জেল খেটেছেন। রাজনৈতিক কারণেই তিনি মোট তের বছর কাটিয়েছেন কারাগারে এবং আরও তেরো বছর কাটিয়েছেন নির্বাসনেও। কারাগার থেকে তাঁর মুক্তির জ্ন্য দুনিয়াব্যাপী যাঁরা একসময় হিকমতের পক্ষে ওকালতি করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন লড়াকু ফরাসি অস্তিত্ববাদী-মার্কসবাদী দার্শনিক জ্যঁ-পল সার্ত্র এবং মহান হিস্পানি শিল্পী পাবলো পিকাসো। এঁদের সুবাদেই এও বিশেষভাবে বলা দরকার যে, জেল ও নির্বাসনের অভিজ্ঞতা হিকমতের কবিতায় বিভিন্ন অবয়বে ও আয়তনে সঞ্চারিত, প্রতিফলিত ও প্রতিসরিত হয়েছে এবং এমনকি তাঁর কবিতার আঙ্গিককে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করেছে। আমাদের প্রধান কবি কাজী নজরুল ইসলাম এবং লাতিন আমেরিকার প্রধান কবি পাবলো নেরুদার মতোই নাজিম হিকমতকেও ‘জনগণের কবি’ হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়েছে।

নিচে বাংলা তর্জমায় নাজিম হিকমতের পাঁচটি কবিতা পাঠকের কাছে পেশ করলাম। তর্জমা করেছি দুনিয়াব্যাপী বহুল-প্রশংসিত র‍্যানডি ব্লেইজিং ও মুলতু কনুক-এর ইংরেজি অনুবাদ থেকে। বাংলা ভাষার নিজস্ব দাবি মেটাতে ক্ষেত্রবিশেষে ইংরেজি অনুবাদে ব্যবহৃত যতিচিহ্নের এবং পঙ্‌ক্তিসজ্জার কিছু অদলবদল ঘটেছে বর্তমান বাংলা তর্জমায়। আর ইংরেজি অনুবাদেই তাঁর কবিতা যতোই পড়েছি, ততোই মনে হয়েছে যে, হিকমত মানেই হিম্মত, অনেক অর্থেই!]

১) আমি তোমায় ভালোবাসি

আমি হাঁটু গেড়ে বসি : তাকিয়ে থাকি মাটির দিকে
ঘাস
পোকামাকড়
নীল আভা নিয়ে ফুটে-ওঠা ছোটো ছোট কাণ্ড
তুমি যেন বসন্তের মাটি, হে প্রিয়তমা,
আমি তাকিয়ে থাকছি তোমার দিকে।

আমি চিৎ হয়ে শুয়ে থাকি, দেখি আকাশ
একটা গাছের শাখা
ডানায় ভর-করা সারস
একটা জেগে-ওঠা স্বপ্ন।
তুমি যেন বসন্তের আকাশ, হে প্রিয়তমা,
আমি তোমাকে দেখি।

রাতে আমি কাঠ দিয়ে জ্বালাই আগুন : আমি স্পর্শ করি আগুন
জল
বস্ত্র
রুপা
তুমি যেন নক্ষত্রের নিচে জ্বলা আগুন
আমি তোমাকে স্পর্শ করি।

আমি জনতার মাঝে মিশে যাই : আমি ভালবাসি গণমানুষ
তৎপরতা
চিন্তা
সংগ্রাম।
তুমি আমার সংগ্রামে শরিক হওয়া মানুষ,
আমি তোমায় ভালোবাসি।

(১৯৪৭)

২) বাঁচা নিয়ে


বেঁচে থাকা মোটেই যা-তা ব্যাপার নয়—
তোমাকে বাঁচতে হবে দারুণ নিষ্ঠায়
যেমন ধরো কাঠবিড়ালি বাঁচে—
মানে, বাঁচার বাইরে বা ওপরে কোনো কিছুর দিকে না তাকিয়েই
মানে, বাঁচাটাই হবে তোমার চব্বিশ ঘণ্টার কাজ।
বেঁচে থাকা মোটেই যা-তা ব্যপার নয় :
তোমাকে বাঁচতে হবে দারুণ নিষ্ঠায়।
এমন ভাবে এবং এতোটাই যে,
ধরো, তোমার হাত বাঁধা আছে তোমার পিঠে
তোমার পিঠ দেয়ালে
অথবা তুমি আছো পরীক্ষাগারে
তোমার ফকফকে শাদা কোট আর নিরাপত্তার জন্য বিশেষ চশমা পরে। তুমি জান দিয়ে লড়তে পারো জনতার জন্য—
এমনকি তাদের জন্য যাদের মুখ তোমার কখনও দেখা হয় নাই,
এমনকি এই জেনেও যে, বেঁচে থাকাটাই
সবচেয়ে বাস্তব, সবচেয়ে সুন্দর।

মানে, তোমাকে বাঁচতে হবে এতটা নিষ্ঠায়
ধরো, সত্তরে তোমাকে গাছ লাগাতে হচ্ছে,
তা আবার তোমার কেবল সন্তানসন্ততির জন্য নয়।
হয়তো মৃত্যুকে তুমি ভয় পাও কিন্তু তুমি বিশ্বাস করো না মৃত্যুতে।
কারণ বেঁচে থাকা ভয়ানক মৃত্যুর চেয়েও কঠিন, কিন্তু সুন্দর।


ধরা যাক আমরা ভীষণ অসুখে আক্রান্ত, যেতে হবে সেই শাদা অপারেশন টেবিলে
সেখান থেকে হয়তো আমরা আর উঠবো না।
একটু আগেভাগে চলে যাওয়ার জন্য
বিষণ্ণ না হওয়াটা অসম্ভব হলেও
কৌতুক কিংবা রসিকতায় আমরা জীবনকে ভরিয়ে রাখবো টুকরো টুকরো হাসিতে,
জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখবো বৃষ্টি ঝরছে কিনা,
অথবা এমনকি গভীর আগ্রহে অপেক্ষা করবো
সর্বশেষ সংবাদটির জন্য…
ধরা যাক, আমরা আছি যুদ্ধের ময়দানে, একেবারে সামনে—
লড়াই করছি যথার্থ কারণেই, ধরা যাক।
সেখানে, প্রথম আঘাতেই, সেই বিশেষ দিনে,
আমাদের মারাত্মক ভুলের কারণে আমরা মুখ থুবরে পড়ে গেছি, মৃত।
আমরা জানবো সেটা এক অস্বাভাবিক ক্রোধ নিয়ে
কিন্তু যে যুদ্ধ চলতে পারে বছরের পর বছর, সেই যুদ্ধের
পরিণতি জানার জন্য আমরা মরিয়া হয়ে উঠবো।
ধরা যাক, আমরা আছি বন্দিশালায়
আর আমাদের বয়স পঞ্চাশ ছুঁইছুঁই করছে
আর আমাদের আছে আরো আঠারো বছর
কারাগারের লৌহ দরোজা খোলার আগে।
তারপরও আমরা বেঁচে থাকবো বাইরের সঙ্গেই,
তার জনতা আর জীবজন্তুর, তার সংগ্রাম আর সমীরের সঙ্গে—
মানে, প্রাচীরের বাইরে পৃথিবীর সঙ্গে।
মানে, যেভাবেই হোক এবং যেখানেই থাকি না কেনো,
বাঁচবো এমন তুমুলভাবে যেনো মৃত্যু নেই।


এই পৃথিবী শীতল হয়ে উঠবে
নক্ষত্রদের মাঝে এক নক্ষত্র
এবং সবচেয়ে ছোটোগুলোর একটি
নীল মখমলের ওপর সোনার পাতে মোড়া এক জ্বলজ্বলে বিন্দু—
মানে, আমি বোঝাচ্ছি আমাদের এই মহান দুনিয়াকে।
এই পৃথিবী শীতল হয়ে উঠবে একদিন
কোনো বরফের টুকরোর মতো নয়
অথবা এমনকি কোনো মৃত মেঘের মতো নয়
কিন্তু একটি ফাঁকা আখরোটের মতো সে গড়িয়ে চলে যাবে
আলকাতরার মতো কুচকুচে কালো এক স্পেসে…
এর জন্য ঠিক এই মুহূর্তেই তোমাকে শোকে কাতর হতে হবে
—তোমাকে এখনই এই দুঃখকে অনুভব করতে হবে—
মানে,পৃথিবীটাকে ভালবাসতে হবে এতো বেশি
যদি তুমি বলে যেতে চাও “আমি বেঁচেছিলাম“…

(১৯৪৮)

৩) বিষয়টা এমনই

আমি দাঁড়িয়ে আছি এগিয়ে-চলা আলোর ভেতর
আমার হাত দুটো ক্ষুধার্ত, পৃথিবী সুন্দর।

গাছগুলো বিস্তর দেখেও আমার চোখের সাধ মেটে না—
তারা এতো আশায় সজীব, এতো সবুজ।

একটা রোদেলা রাস্তা তুঁত গাছগুলোর মাঝখান চিরে বেরিয়ে গেছে
আমি দাঁড়িয়ে আছি জেলখানার হাসপাতালের জানালায়।

আমি ওষুধের কোনো গন্ধ পাইনা—
কেননা কাছেই ফুটেছে লাল রঙের সুগন্ধি ফুলগুলো।

বিষয়টা এমনই :
বন্দী হওয়া কোনো বিষয় নয়
বিষয় হলো আত্মসমর্পণ না করা।

(১৯৪৮)

৪) পেশা

আমার ষাঁড়ের শিঙের ওপর ভোর ফুটতেই
আমি জমি চষি স্থির অহংকারে।
আমার খালি পা স্পর্শ করে ভেজা গরম মাটি।

সারা সকাল লোহা পেটাই—
লালে লাল হয়ে ওঠে অন্ধকার।

বিকেলের উত্তাপে আমি জলপাই তুলি’
সবুজের সবচাইতে অনুপম পত্রালিঃ
আমি মাথা থেকে পা পর্যন্ত হালকা বোধ করি।

প্রতিটি সন্ধ্যায় আসে অতিথি অব্যর্থ
উষ্ণ আহবানে আমার দরজা উন্মুক্ত থাকে
সকল গানের জন্য।

রাতে আমি হাঁটুজল পার হয়ে
সাগর থেকে টেনে আনি জাল
যখন মাছগুলো মিশে যায় নক্ষত্রদের সাথে।

এখন আমি দায়ী
পৃথিবী্র অবস্থার জন্য :
জনতা আর জমিন, অন্ধকার আর আলো।

তাহলে তুমি দেখ কিভাবে আমি আমার কাজে ডুবে থাকি।
চুপ, হে আমার গোলাপ, চুপ—
তোমার প্রেমে পড়ে আমি ব্যস্ত এখন।

(১৯৪৮)

৫) ছয়টা বাজে

সকাল ছয়টা।
আমি দিনের দরজা খুলে ভেতরে পা ফেললাম—
জানালায় শুভেচ্ছা জানালো তরুণ নীলাভার স্বাদ,
গতকাল থেকে শার্শিতে রয়ে গেল আমার বলিরেখা,
আর আমার পেছনে এক নারীকণ্ঠ ভেসে এলো
পীচ ফলের লোমের চেয়েও কোমল হয়ে
আর রেডিওতে বেজে উঠলো আমার দেশের খবর
এবং আমার লোভ এখন ভরপুর হয়ে উপচে পড়ছে,
গাছ থেকে গাছে দৌড়াবো আমি প্রহরের বাগানে
এবং সূর্য অস্ত যাবে, হে প্রিয়তমা,
আর আমি আশা করি, রাতের ওপারে
এক নতুন নীলের স্বাদ আমার জন্য অপেক্ষা করবে, আমি আশা করি।

(১৯৬০)

#

আজফার হোসেন
অনুবাদক, লেখক

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ