সিলেট ১৩ই জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২৯শে পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ৩:০৯ পূর্বাহ্ণ, জুন ১২, ২০২৪
নিজস্ব প্রতিবেদক | ঢাকা, ১২ জুন ২০২৪ : পদ্মা সেতু আর স্বপ্ন নয়, বাস্তব। এক সময়ের স্বপ্নের সেতু এখন দৃষ্টিসীমায় দিগন্তজুড়ে দাঁড়িয়ে।
সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে তৈরি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অবকাঠামো হলো পদ্মা সেতু। সেতুটির দৈর্ঘ্য ৬.১৫ কিলোমিটার। দ্বিতল এই সেতুর এক অংশ মুন্সিগঞ্জের মাওয়া এবং অপর অংশ শরীয়তপুরের জাজিরা প্রান্তে যুক্ত। একই সঙ্গে রেল ও গাড়ি চলাচলের ব্যবস্থা রয়েছে এ সেতুতে। নির্মাণে মোট ব্যয় ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা।
অথচ যারা ভাবতেই পারেনি পদ্মাসেতু সম্ভব:
ড. আকবর আলি খান বলেছেন,“দক্ষভাবে সেতুটি নির্মাণের জন্যই বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে” (সূত্র: ‘পদ্মা- সেতু নিয়ে বিশ্বব্যাংক চুক্তি বাতিলে প্রতিক্রিয়া’, দৈনিক সংগ্রাম, ১ জুলাই ২০১২)।
ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেছেন,“…এখনো বিশ্বব্যাংকের ঋণে পদ্মা সেতু নির্মাণ করা সম্ভব এবং সরকারের সেটাই করা উচিত” (সূত্র: “বিশ্বব্যাংকের কাছে ‘দেন-দরবারের’ পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের”, বিডিনিউজ২৪.কম, ১৩ এপ্রিল, ২০১২)।
ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেছেন, “তবু তো আলোচনার দরজাটা খোলা ছিল” (সূত্র: ‘প্রবাসী সেতু হলে ক্ষতি কি?’ বিডিনিউজটুয়েন্টিফোর ডটকম, ২১ জুলাই, ২০১২)। প্রফেসর এম মনিরুজ্জামান মিয়া বলেছেন, “পদ্মা সেতু প্রকল্প থেকে যেহেতু বিশ্বব্যাংক সরে গেছে, কাজেই অন্য দাতা গোষ্ঠীও সরে যাবে‒এটাই স্বাভাবিক”(সূত্র: ‘পদ্মা সেতুর ভাগ্য অনিশ্চিত’, দৈনিক যুগান্তর, ৩ জুলাই ২০১২)।
প্রফেসর ড. এমাজউদ্দীন আহমদ বলেছেন, “…নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু করার বিষয়টি হাস্যকর ও অবাস্তব ব্যাপার” (সূত্র: ‘পদ্মা সেতু: নতুন সরকারের অপেক্ষা’, সাপ্তাহিক সোনার বাংলা, ১৩ জুলাই ২০১২)।
প্রফেসর ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, ‘Cancellation of World Bank funding for the Padma bridge project over alleged corruption in it would have a negative impact on the global donors’ perception of Bangladesh (Source: ‘Ties with lenders, future projects, Economists fear negative impact’, The Daily Star, 1 July 2012) |
ইনাম আহমেদ চৌধুরী বলেছেন,“বস্তুতপক্ষে পদ্মা সেতু নির্মাণ শেষ করতে হলে বিশ্বব্যাংক ও তার সহযোগী সংস্থাগুলোর অর্থায়ন ছাড়া আমাদের গ্রহণযোগ্য গতি নেই”(সূত্র: ‘পদ্মা সেতু ও বাংলাদেশ’, দৈনিক সমকাল, ৫ জুলাই ২০১২)। ড. মাহ্বুব হোসেন বলেছেন, “সরকারের উচিত ছিল আগেই বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে চুকিয়ে ফেলা” (সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ৩ জুলাই ২০১২)।
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, “নিজস্ব অর্থায়নে সরকার পদ্মা সেতু করার যে পরিকল্পনা করছে তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। তবে সরকার ইচ্ছা করলে পদ্মা সেতু প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করতে পারবে, কিন্তু শেষ করতে পারবে না” (সূত্র: ‘পদ্মা সেতু: নতুন সরকারের অপেক্ষা’, সাপ্তাহিক সোনার বাংলা, ১৩ জুলাই ২০১২)।
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, “তাড়াহুড়া না করে আরেকটু রয়েসয়ে পদ্মা সেতু প্রকল্প নিয়ে আরেকবার ভাবতে হবে এবং আগের দাতাদেরই এ প্রকল্পে ধরে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে” (সূত্র: ‘পদ্মা সেতু: নতুন সরকারের অপেক্ষা’, সাপ্তাহিক সোনার বাংলা, ১৩ জুলাই ২০১২)।
ড. আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, “শুরু করতে পারলেও শেষ করার কোনো গ্যারান্টি থাকবে না” (সূত্র: ‘পদ্মা সেতু: নতুন সরকারের অপেক্ষা’, সাপ্তাহিক সোনার বাংলা, ১৩ জুলাই ২০১২)। ড. বিনায়ক সেন, “গত এক বছরে আলাপ-আলোচনা করে বিশ্বব্যাংকের আস্থা আনতে পারতো সরকার” (সূত্র: ‘তিন অর্থনীতিবিদের প্রতিক্রিয়া’, প্রথম আলো, ১ জুলাই ২০১২)।
ড. সাদিক আহমেদ বলেছেন, “…তাহলে পদ্মা সেতু তো হবেই না, দেশ-বিদেশে সবাই বিশ্বাস করবে অভিযোগ যথার্থ এবং এর পরিণতি হবে বর্তমানে ক্ষমতাসীনদের জন্য অভাবনীয়” (সূত্র: ‘পদ্মা সেতু: উইন উইন নাকি লস লস?’, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই), ৩ অক্টোবর, ২০১২)।
অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেছেন,“…পদ্মা সেতু হলে ওই অঞ্চলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়ত। অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি বাড়ত। এখন সেটা বন্ধ হয়ে গেল” (সূত্র: ‘বিশ্বব্যাংকের সিদ্ধান্তে সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়বে’, দৈনিক সংবাদ, ১ জুলাই ২০১২)। সিরাজুর রহমান বলেছেন,“…নিজস্ব সম্পদ থেকে পদ্মা সেতু তৈরির কথাবার্তা আকাশ-কুসুম কল্পনামাত্র” (সূত্র: স্বপ্নের কুসুম দিয়ে মহাকাশে সেতু তৈরি করবেন প্রধানমন্ত্রী, বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১২ জুলাই ২০১২)।
সাদেক খান বলেছেন,“ পদ্মা সেতু ঋণচুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্ত সঠিকভাবে নেওয়া হয়েছে” (সূত্র: ‘জাতিরাষ্ট্রের উন্নয়ন ভাগ্য নিয়ে তামাসা’, বাংলাদেশ প্রতিদিন, ৭ জুলাই ২০১২)। আমানউল্লাহ কবির বলেছেন, “নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণে সরকার অন্তত দেখাতে চায় যে তারা পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করতে পেরেছে” (সূত্র: পদ্মা সেতু: নিজস্ব অর্থায়ন কী আসলে চমক?, বিবিসি বাংলা, ১৬ জুলাই ২০১২)।
অধ্যাপক ড. শাহ্দীন মালিক বলেছেন, “…পদ্মা সেতু দেশি অর্থায়নে হবে না। সম্ভব নয়” (সূত্র: ‘বীরদর্পে ভোঁ-দৌড়’, প্রথম আলো, ১৫ আগস্ট ২০১২)। ড. জায়েদ বখত বলেছেন, “মনে হচ্ছে, বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে নতুন করে চুক্তি করতে হলে এ সরকারের মেয়াদকালে আর সম্ভব হবে না” (সূত্র: ‘পদ্মা সেতু : নতুন সরকারের অপেক্ষা’, সাপ্তাহিক সোনার বাংলা, ১৩ জুলাই ২০১২)।
অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত বলেছেন, “পদ্মা সেতুর মতো বড় প্রকল্পগুলোর ঠিকাদারদের সঙ্গে চুক্তির দলিলাদি সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা না হলে ভবিষ্যতে খারাপ হবে” (সূত্র: ‘নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের বাস্তবায়নযোগ্যতা নিয়ে সংশয়’, প্রথম আলো, ৩০ জুলাই ২০১২)।
ড. মুহাম্মদ আব্দুল মজিদ বলেছেন, ‘ Having looked into the pros and cons of self-financing, I will try to show that self-financing the biggest bridge of the country does not sound realistic at all’ (Source: ‘Padma Bridge: Dream Vs Reality; Self-financing the Padma bridge sounds more like a chimera than a realistic plan’, The Daily Star, 8 August 2012)| ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, ‘That would practically drag the process beyond the tenure of the present government” (Source: ‘Padma Bridge: Between denial and dadagiri?’ The Daily Star, 25 December, 2012) |
বদরুদ্দীন উমর বলেছেন, “…নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ কোন ব্যাপারই নয় বলে প্রধানমন্ত্রী যে আস্ফালন করেছিলেন সেটা যে কত হাস্যকর এবং অবাস্তব ছিল, এ নিয়ে এখন আর কারও দ্বিমত থাকার উপায় নেই” (সূত্র: ‘সব শর্ত পূরণের পর বিশ্বব্যাংক ফিরে এলো’, দৈনিক যুগান্তর, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১২)।
ফরহাদ মজহার বলেছেন, “এটাকে শুধু কেলেঙ্কারি বলা যাবে না এটা একটা গুরুতর রাজনৈতিক ও নৈতিক অপরাধও বটে” (সূত্র: ‘দুর্নীতি হয়েছে এটা বিশ্বব্যাংক একা বলেনি’, বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম, ১৫ জুলাই ২০১২)।
অধ্যাপক ড. স্বপন আদনান বলেছেন, “বিশ্ব ব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্প থেকে সরে গেলে বাংলাদেশের পক্ষে আপাতত অগ্রসর হওয়া কঠিন” (সূত্র: ‘নিজস্ব অর্থায়ন হলেও পদ্মা সেতু গড়া কঠিন’, ডয়েচে ভেলে কোলন, জার্মানি, ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৩)। ফয়জুল কবির খান বলেছেন, “দেশীয় অর্থ থেকে পদ্মা সেতু করলে শিক্ষা, স্বাস্থ্যের মতো অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ খাত ক্ষতিগ্রস্ত হবে” (সূত্র: দেশীয় অর্থে পদ্মা সেতু: দায় নিয়ে ভাবনা কম, দৈনিক প্রথম আলো, ১৪ জুলাই ২০১২)।
বেগম খালেদা জিয়া বলেছেন,“পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন বাতিল করায় পদ্মা সেতু না হওয়ার জন্য সরকার, প্রধানমন্ত্রী এবং প্রধানমন্ত্রীর পরিবার দায়ী” (সূত্র: ‘এ সরকারের আমলে আর পদ্মা সেতু হবে না: খালেদা’, দৈনিক মানবজমিন, ৩০ জুন ২০১২)। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেছেন,“নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু করার কল্পনা বিলাস বাদ দিন” (সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, ১১ জুলাই ২০১২)।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন,’ The government decision to construct Padma bridge with local fund is unrealistic and it would not be able to build the bridge’ (Source: ‘Padma bridge with local fund is not feasible’, The Daily Star, 12 July 2012)| এছাড়া আরো অনেকেই ওই সময় বিশ্ব ব্যাংকের সহায়তা ছাড়া বা নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু নির্মাণ সম্ভব নয় বলে মত প্রকাশ করেন।
২০১২ থেকে ২০১৭ সময়ে এই সেতু প্রকল্প নিয়ে বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যমের ভূমিকা ছিল বেশ ‘চমৎকার’। আমরা যেভাবে পদ্মাসেতু প্রকল্পের ‘দুর্নীতি’ তুলে ধরতে মরিয়া ছিলাম- সেটা বলতে গেলে অনেকটাই মানুষকে প্রাণপণ বোঝানোর চেষ্টা যে, ‘বিশ্বাস করেন, হইলেও হইতে পারে’- টাইপ একটা বিষয়।
পদ্মা বহুমুখি সেতুর সবশেষ স্প্যানটি বসানো হয়েছে ১০ ডিসেম্বর। অর্থাৎ সেতুর মূল কাঠামো নির্মাণ শেষ হয়। এরপর খুঁটিনাটি কাজও শেষ হলো। সেতু চালু হলো উদ্বোধনের পর।
গোটা পৃথিবীর মানুষ তাকিয়ে দেখেছে, বাস্তবেই পদ্মা নদীর বুকে বাংলাদেশ নিজের টাকায় একটা ব্রিজ বানাল, অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি! কেনো একটা সেতু নির্মাণ নিয়ে এত আলোচনা-সমালোচনা হয়ত আর হয়নি দেশের ইতিহাসে। পদ্মা সেতু ঘিরে কিসের এই আবেগ, কিসের এত যন্ত্রণা? – মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার, মর্যাদার প্রশ্ন, প্রশ্ন ছিল সক্ষমতা নিয়ে।
ভাবুন তো একবার- একপক্ষে বঙ্গবন্ধুর মেয়ে গোপালগঞ্জের শেখ হাসিনা, সঙ্গে রাজপথের দীর্ঘ রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রবীণ সহযোদ্ধারা, ‘ঘুষ-দুর্নীতির অভিযোগে প্রশ্নবিদ্ধ’ সরকারি কর্মকর্তার দল আর প্রতিপক্ষ বিশ্বব্যাংক, বাংলাদেশের প্রথম নোবেল পুরস্কার বিজয়ী মোহাম্মদ ইউনুস, তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন, ওবামা প্রশাসনের একাংশ এবং তাদের বিশ্বজোড়া প্রভাব-প্রতিপত্তি, বিএনপি-জামায়াত ও তাদের সমমনা দলগুলোর সমালোচনা ও রাজনৈতিক কানেকশন। শেখ হাসিনা মূলত একাই লড়লেন, অস্বীকার করার উপায় নেই যে, জনগণের সমর্থন ছিল, কিন্তু বিরোধিতাও কম ছিল না। জেদ, পদ্মার বুক চিরে যে সেতু বানানো হয় সেটা সম্ভব হলো ‘টাকা’ দিয়ে।
বলতে চাইছি বাংলাদেশের নিজের পকেটের টাকায় এত বড় সেতু বানানোর সিদ্ধান্ত নেয়াটা ২০১৩ সালেও অনেকের চোখেই ‘আহাম্মকি’ ছাড়া কিছু না। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এবং তাদের সহযোগীরা ব্যাপক সমালোচনায় মুখর ছিলেন। সভা-সমাবেশে বিএনপির প্রধান খালেদা জিয়ার প্রতিশ্রুতি তারা ক্ষমতায় গেলে পদ্মায় দুটি সেতু গড়বেন। শেখ হাসিনার সরকার কতটা ‘দুর্নীতিবাজ’ তার ফিরিস্তি বয়ানেও পিছপা নন। সব সমালোচনা উপেক্ষা করে জেদি শেখ হাসিনা অটল। পদ্মা সেতুর স্বপ্ন হলো সত্যি!
পদ্মা বহুমুখি সেতু প্রকল্পের নির্মাণ যজ্ঞের একজন সাক্ষী হয়ত আমিও, দূরতম অর্থে হলেও। পেশাগত কারণেই- সাংবাদিকতা। ২০০৯ সালের ভোটে জিতে আওয়ামী লীগ শাসন ক্ষমতায়। ২০১১ সালে পদ্মা সেতুর ঋণচুক্তি হয় বিশ্বব্যাংক, এডিবি, আইডিবি ও জাইকার সঙ্গে। এরপরই ওঠে দুর্নীতির অভিযোগ। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগে ঘুষ লেনদেন চেষ্টার অভিযোগে জেগে ওঠে দেশ ও বিশ্বের সংবাদ মাধ্যম। বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ ওঠায় সরকার বিষয়টি নিয়ে তদন্তে নামে। দায়িত্ব পায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
হাতে চলে আসে তদন্তের বেশ কিছু নথি, বিশেষত কানাডার পারমর্শক প্রতিষ্ঠান এসএনসি-লাভালিন-এর কর্মকর্তা ‘রমেশ শাহর ডায়েরির পাতা’। যার ওপর ভিত্তি করে পরে দেশের বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে ফলাও সংবাদ প্রচার হয়। দেশের মানুষ অনেকটাই ‘নিশ্চিত’ হয়ে যায় তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেন এবং সাবেক প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান সরাসরি দুর্নীতিতে জড়িত। বিশ্বব্যাংকের চাপের মুখে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ পড়েন আবুল হোসেন। মামলা হয় প্রকল্পে জড়িত সরকারি ও বিদেশি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। তদন্তে নামে কানাডার সরকারও।
আমরা জাগ্রত, শিহরিত, পদ্মা সেতু নিয়ে একের পর এক প্রতিবেদন। ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে কানাডার আদালত রায় দেয় পদ্মা সেতুতে দুর্নীতি চেষ্টার অভিযোগের প্রমাণ মেলেনি। আর তাতেই যেন পানি ঢালা হয় জ্বলন্ত উনুনে। তবে ২০১২ থেকে ২০১৭ সময়ে এই সেতু প্রকল্প নিয়ে বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যমের ভূমিকা ছিল বেশ ‘চমৎকার’। আমরা যেভাবে পদ্মাসেতু প্রকল্পের ‘দুর্নীতি’ তুলে ধরতে মরিয়া ছিলাম- সেটা বলতে গেলে অনেকটাই মানুষকে প্রাণপণ বোঝানোর চেষ্টা যে ‘বিশ্বাস করেন, হইলেও হইতে পারে’- টাইপ একটা বিষয়।
আবুল হোসেন, আবুল হাসানরা এখনও সেই ‘ধাক্কা’ সামলে উঠতে পারেন নাই। বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যম অভিযুক্তদের কাউকেই সেসময় একটুও ছেড়ে কথা বলেনি। কানাডার আদালতের রায়ের পর অবশ্য এই জোশ আর কাজ করেনি। তবে সে সময়ের সাংবাদিকতা নিয়ে দায় স্বীকার করার মনোভাবও কারো ভেতরে দেখা যায়নি বলেই মনে হয়। কিন্তু তাতে অবশ্য পদ্মা সেতুর নির্মাণ থেমে থাকেনি।
শেখ হাসিনা যা করে দেখালেন তা ক্রিকেটে স্লগ ওভার ব্যাটিংয়ের মতো। বিশ্বব্যাংক, জাইকা, আইডিবি আর এডিবি সরে যাওয়ার পর মালয়েশিয়ার সরকার আগ্রহ দেখায়, কিন্তু শর্ত মানার মতো ছিল না। চীন এগিয়ে আসে। কিন্তু ঋণচুক্তির শর্ত নিয়ে দর কষাকষিতে তারাও সরে পড়ে। বঙ্গবন্ধু কন্যা ঘোষণা দেন বাংলাদেশ নিজের টাকায় সেতুটি নির্মাণের। আর তাতেই দেশ-বিদেশে হাসির রোল, ফেসবুক-টুইটারে ট্রল। ‘দুর্নীতির অভিযোগগ্রস্ত’ সহকর্মী আর সহমর্মীদের সঙ্গে নিয়ে তিনি এগিয়ে চললেন সেতুর পথে। লাইমলাইটে মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
পদ্মা বহুমুখি সেতু প্রকল্প বাস্তবায়ন নিয়ে বাংলাদেশ সরকারকে যেসব বাধা পেরুতে হয়েছে তার সবকিছু লিখে বোঝানো হয়ত সম্ভব না। শেখ হাসিনার টানা তৃতীয় মেয়াদের তখন মাত্র প্রথমটি পার হচ্ছে। তখনও বিডিআর বিদ্রোহের ‘আফটার এফেক্ট’ চলছে। মাঠে বিরোধীরা দারুণ সক্রিয়, জ্বালাও-পোড়াও আর ককটেল বোমা তো ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। ২০১৪ সালের জানুয়ারির নির্বাচনের আগে ২০১৩ সালের অনেকটা জুড়েই সংবাদ মাধ্যমে আলোচনায় ছিল পদ্মা সেতু প্রকল্প নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ। ২০১৪ সালে দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতা নেয়ার পরেও শেখ হাসিনা বা তার সরকার রেহাই পায়নি এই বিতর্ক থেকে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সমালোচনা, সংবাদ মাধ্যমে নিরবচ্ছিন্ন ‘দুর্নীতির অভিযোগ’ প্রচার, জনগণের একাংশের অসন্তোষ এবং সর্বোপরি সেতু প্রকল্পে অর্থায়ন নিয়ে বাধাগুলো ছোট নয়। এই সেতু প্রকল্প ঘিরে বিশ্ব পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি প্রশ্নবিদ্ধ, উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে পরিচিত সবচেয়ে বড় ঋণদাতা- বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সরকারের সম্পর্কে টানাপোড়েন, বড় দাতা সংস্থাগুলোর সন্দেহ, অবিশ্বাস, বিশ্ব ক্ষমতার কেন্দ্র ওয়াশিংটনের সঙ্গে ঢাকার দূরত্ব- মোটের ওপর শেখ হাসিনা কীভাবে এসব সামলেছেন একমাত্র তিনিই বলতে পারবেন।
শেখ হাসিনা করে দেখিয়েছেন, বাংলাদেশ অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে থেকে দেশকে নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন আর গড়ে চলেছেন একের পর এক উদাহরণ- তবু আমরা খুবই সন্দেহপ্রবণ জনগণ। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মেয়ে এগিয়ে গেছেন তার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে। সেতু প্রকল্পের বাজেট বেড়েছে হু হু করে। বাংলাদেশ টাকা জুগিয়ে গেছে। এক-দুই টাকা না, হাজার হাজার কোটি টাকা (৩০ হাজার কোটি টাকার বেশি) পদ্মার পানিতে ঢেলে এই সেতুকে জাগিয়ে তোলা হয়েছে। গত ১৪ বছরে (২০০৮-২০২২) বাংলাদেশের যত অর্জন, তা কিন্তু এক কথায় অনন্য! অবশ্য এর পেছনে সবচেয়ে বেশি যারা অবদান রেখে যাচ্ছেন- দেশের কৃষক, শ্রমিক ও প্রবাসী শ্রমিক তাদের আমরা গোণায় ধরি না। আর এই কৃষক-শ্রমিক গোষ্ঠীর শ্রম-ঘামকে কিছুটা হলেও সাফল্যে অনুবাদ করার যে প্রক্রিয়া, সেই প্রক্রিয়ার নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন শেখ হাসিনা।
টানা পঞ্চম মেয়াদে তার সরকার এখন সময় পার করছে। অর্থনীতির সূচকে এরইমধ্যে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ পাকিস্তানকে পেছেন ফেলেছে- ভারতকেও অস্বস্তিতে রেখেছে। এই যে এগিয়ে চলা- এরজন্য দরকার ছিল একটি দৃঢ় নেতৃত্ব, শেখ হাসিনা সেটাই দিয়েছেন দেশের মানুষকে, অন্তত তার সমর্থকদের। দুর্নীতি আর স্বজনপ্রীতির বাংলাদেশ নিয়ে তার যে অভিযাত্রা, বলতে গেলে শ্রমজীবীদের সঙ্গে নিয়ে একাই ঢেকে ফেলেছেন সব সমালোচনা। তাই পদ্মাসেতুর মূল কাঠামো সম্পূর্ণ হওয়ার পর একটি বিজয় অর্জিত হয়েছে তার। তারপরেও সন্দেহ রয়ে গেছে সমালোচকদের, ‘জোড়াতালি’র সেতু হয়ত টিকবে না- পুরো টাকাটাই জলে গেল।
আমরা অপেক্ষায় ছিলাম পদ্মা সেতু উদ্বোধনের। এর উদ্বোধনও দেখেছে গোটা বিশ্ব। তবে অস্বীকার করার সুযোগ নেই, পদ্মা সেতুর নির্মাণ নিয়ে যে লড়াই তাতে জিতে গেছেন শেখ হাসিনা। বাংলাদেশের জন্য সক্ষমতা প্রমাণের সবচেয়ে বড় প্রতীক হয়ে উঠলো পদ্মা সেতু। বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাড়ানোর যে প্রয়াস তাতে আরেকটি অর্জন এই সেতু।
সম্পাদক : সৈয়দ আমিরুজ্জামান
ইমেইল : rpnewsbd@gmail.com
মোবাইল +8801716599589
৩১/এফ, তোপখানা রোড, ঢাকা-১০০০।
© RP News 24.com 2013-2020
Design and developed by M-W-D