সিলেট ১২ই জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২৮শে পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ৩:৫৫ পূর্বাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ১১, ২০২৪
আধুনিক যুগের বাংলা ও বাঙালির, বিশেষতঃ পশ্চিমবঙ্গের বাঙালির সমগ্র সামাজিক জীবন কলকাতা শহরে কেন্দ্রীভূত হয়েছিল। বাংলা তথা ভারতের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখতে পাওয়া যায় যে, অন্য কোনো সময়ে একটি শহর এমন পরিপূর্ণভাবে একটি জাতির জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। কিন্তু এই কলকাতা— হঠাৎ করে গজিয়ে ওঠা কোন ব্যাঙের ছাতা যেমন নয়, তেমনি আবার পরিকল্পনাপ্রসূত একটি সৃষ্টিও নয়। নিরন্তর, নিরবচ্ছেদ, সামাজিক ও অর্থনৈতিক শক্তির তাগিদেই কলকাতা শহর ক্রমে বেড়ে উঠে আধুনিক বাঙালি জীবনের প্রতীকে পরিণত হয়েছে। আর তাই আজও একাধিক দিক থেকে খৃষ্টীয় ঊনিশ শতকের ‘আজব শহর কলকেতা’ আধুনিক বাংলা তথা ভারতীয় সমাজের একটি ঐতিহাসিক দিকচিহ্ন হয়ে রয়েছে। কলকাতার সূত্র ধরে বাঙালি জীবনের এই দ্রুতপরিবর্তমান সমাজের চিত্র ঊনবিংশ শতাব্দীর সাহিত্যে ও সংবাদপত্রে নিপুণভাবেই পাওয়া যায়। ঊনিশ শতকের কলকাতা ও বাংলা কিভাবে চলেছিল, সেটার হিসেব তখনকার সংবাদপত্রে যেভাবে পাওয়া যায়, সেটা নিম্নরূপ—
(১) “১৯ দিসেম্বর শুক্রবার দিবা দশ ঘটিকার সময় শহর কলিকাতায় গৌরীবেড়ে বালিকাদের বিদ্যা পরীক্ষা হইয়াছিল। তাহাতে অনেক সাহেব লোক ও বিবী লোক ছিলেন। এই পরীক্ষাতে হিন্দু মুসলমানের বালিকা সর্ব্ব সুদ্ধা প্রায় দেড় শত পরীক্ষা দিয়াছে।”
(২) “হিন্দু কালেজ। ইংরাজী পাঠশালায় ডিয়রম্যান নামক এক জন গোরা আর ডি রোজী সাহেব এই দুই নূতন শিক্ষক নিযুক্ত হইয়াছেন। এক্ষণে প্রায় ২৫ জন ছাত্র আছে বালকেরা ইংরাজি ভাষায় যেমন উত্তম পরীক্ষা দিয়াছে তদ্রূপ ইহার পূর্ব্বে কখন দেখা যায় নাই। যে সাহেব লোকেরা সেখানে ছিলেন তাঁহারা কহেন যে আমরা এই বালকদের ইংরাজি শুদ্ধ উচ্চারণ শুনিয়া চমকৃত হইয়াছি।”
(৩) “হিন্দু কালেজের একজন ছাত্র মুসলমান রুটিওয়ালার দোকানের, নিকট দিয়া গমনকরত ঐ দোকানঘরে প্রবেশপূর্ব্বক এক বিস্কুট ক্রয় করিয়া ভক্ষণ করেন।”
(৪) “সহমরণ। মোং বাঁশাইনপাড়া গ্রামের রাধাকৃষ্ণ ন্যায়বাচস্পতি কোন্নগর ঘাটে গঙ্গাতীরে পরলোকগত হইয়াছেন এবং তাঁহার পত্নী সহগমন করিয়াছেন।”
(৫) “ইউরোপীয় বস্ত্র। এতদ্দেশে ইউরোপীয় বস্ত্রের আমদানী কিরূপে বৎসর বৎসর বৃদ্ধি হইতেছে তাহা নীচের হিসাব দেখিলে সকলেই বোধ করিতে পারিবেন। ১৮১৫—১৪৯০৬৮০০০ … ১৮২৪—১১৩৮১৬৭।”
(৬) “কলিকাতা বাঙ্ক। ওল্ড কোর্ট স্ট্রীটে ৬১ নম্বর ঘরে অর্থাৎ শ্রীযুত পামর কোম্পানি সাহেবের বাটীতে ২ আগষ্ট অবধি কলিকাতা বাঙ্ক নামে এক নূতন বাঙ্ক খুলিয়াছে।”
(৭) “ভাৰ্য্যাবিক্রয়। জিলা বর্দ্ধমানের মধ্যে এক ব্যক্তি কলু … কএক টাকা পাইয়া ভার্যা দিয়া অনায়াসে গৃহে প্রস্থান করিল।”
(৮) “তণ্ডুলসম্পাদক নূতন যন্ত্র। অর্থাৎ ধানভানা কল। তণ্ডুল-নিষ্পাদক এক প্রকার যন্ত্র সকলে দর্শন করিলেন। যন্ত্রে প্রতিদিন কেবল দুইজন লোকে ১০ দশ মোন তণ্ডুল প্রস্তুত করিতে পারে।”
(৯) “কলিকাতার নূতন রাস্থা। মোং কলিকাতাতে ধৰ্ম্মতলা হইতে বহুবাজারে গমনাগমনের কারণ নূতন রাস্থা হইতেছে।”
(১০) “… খিদিরপুরের খালের উপর যে সেতু প্রস্তুত হইবেক … লৌহময় এবং শৃঙ্খল দ্বারা উদ্বন্ধিত।”
(১১) “… কুলীনেরদের বহুবিবাহ বিষয়ে অনেকবার সকলকে জ্ঞাপন করা গিয়াছে এবং ঐ কুব্যবহারেতে কি পর্য্যন্ত দুঃখ জন্মে তাহাও বিলক্ষণ রূপে বর্ণিত হইয়াছে। আমরা এস্থলে কএকজন কুলীনের নাম ও তাঁহারা কে কত বিবাহ করিয়াছেন তাহাও লিখিতেছি …
মায়াপাড়া—রামচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়—৬২
জয়রামপুর—নিমাই মুখোপাধ্যায়—৬০
আড়ুয়া—রমাকান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়—৬০”
(১২) “শ্রীযুক্ত জ্ঞানান্বেষণ সম্পাদক মহাশয়েষু। কলিকাতা শহরের সীমা সংযুক্ত পূর্বাংশবাসি—মুখোপাধ্যায় এক সাহেবের হিন্দুস্থানীয় উপপত্নী ব্রাহ্মণীর কন্যাকে বিবাহ করেন। ঐ কন্যা সাহেবের ঔরসজাতা। …”
(১৩) “শ্রীযুক্ত দর্পণ প্রকাশক মহাশয় সমীপেষু। শ্রীযুক্ত ইঙ্গরেজ বাহাদুরের রাজ্যমধ্যস্থ অনেকানেক জাতীয় স্ত্রীলোকের বৈধব্যাবস্থা হইলে তাঁহারদিগের পুনরায় বিবাহ হয়। কেবল আমারদিগের এই বাঙ্গালা দেশে বাঙ্গালির মধ্যে কায়স্থ ও ব্রাহ্মণের কন্যা বিধবা হইলে পুনরায় বিবাহ হয় না এবং কুলীন ব্রাহ্মণের শুদ্ধ সম মেল না হইলে বিবাহ হয় না।”
(১৪) “… একাদিক্রমে যবনরাজ্যের চিহ্নসকল এতদ্দেশ হইতে লুপ্ত হইয়া যাইতেছে।”
কাঁচড়াপাড়ার কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের রচনায় তখনকার দিনের সামাজিক অবস্থার শ্লেষাত্মক যে বিবরণগুলি পাওয়া যায়, সেসব নিম্নরূপ—
(১) “বাধিয়াছে দলাদলি লাগিয়াছে গোল।
বিধবার বিয়ে হবে বাজিয়াছে ঢোল।
শাস্ত্র নয় যুক্তি নয় হবে কি প্রকারে
দেশাচারে ব্যবহারে বাধো বাধো করে।”
(২) “আগে মেয়েগুলো ছিল ভালো
ব্রতধৰ্ম্ম কোর্তো সবে।
একা ‘বেথুন’ এসে শেষ করেছে,
আর কি তাদের তেমন পাবে।”
(৩) “নীলকরের হদ্দ লীলে, নীলে নীলে সকল নিলে,
দেশে উঠেছে এই ভাষ।
যত প্রজার সর্ব্বনাশ।”
(৪) “যত কালের যুবো, যেন সুবো,
ইংরাজী কয় বাঁকা ভাবে।
ধোরে গুরু পুরুত মারে জুতো …
যখন আসবে শমন, কোরবে দমন,
কি বলে তায় বুঝাইবে।
বুঝি ‘হুট’ বলে ‘বুট’ পায়ে দিয়ে,
‘চুরুট’ ফুঁকে স্বর্গে যাবে।”
ঊনিশ শতকের কলকাতার বাঙালি সমাজ জীবনের আরো নিপুণ চিত্র যে দুটি গ্রন্থে পাওয়া যায়, সেগুলি হল— ১৮৫৮ সালে প্রকাশিত ‘আলালের ঘরের দুলাল’ এবং ১৮৬২ সালে প্রকাশিত ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’। এগুলির মধ্যে প্রথমটি হল উপন্যাস এবং অপরটি হল সমাজচিত্র; প্রথমটির লেখক হলেন ‘টেকচাঁদ ঠাকুর’ বা প্যারিচাঁদ মিত্র, এবং অপরটির লেখক হলেন কালীপ্রসন্ন সিংহ। তাঁরা দু’জনেই যেহেতু কলকাতার মানুষ ছিলেন, সেহেতু বিশেষতঃ তৎকালীন কলকাতার জীবনযাত্রা তাঁদের লেখায় নিখুঁতভাবে ফুটে উঠেছিল বলে দেখা যায়। আলোচ্য প্রসঙ্গে প্রথমেই ‘আলালের ঘরের দুলাল’ থেকে উদাহরণগুলো দেখা যাক—
(১) “প্রথম যখন ইংরাজেরা কলিকাতায় বাণিজ্য করিতে আইসেন, সে সময়ে সেট বসাখ বাবুরা সওদাগরি করিতেন, কিন্তু কলিকাতার এক জনও ইংরেজী ভাষা জানিত না। ফ্রেনকো ও আরাতুন পিট্রস প্রভৃতির দেখাদেখি শরবোরণ সাহেব কিছু কাল পরে স্কুল করিয়াছিলেন। ঐ স্কুলে সম্ভ্রান্ত লোকের ছেলেরা পড়িত।”
(২) বৈদ্যবাটির বাবুরাম বাবু বাবু হইয়া বসিয়াছেন। হরে পা টিপিতেছে। এক পাশে দুই একজন ভট্টাচার্য্য বসিয়া শাস্ত্রীয় তর্ক করিতেছেন—আজ লাউ খেতে আছে—কাল বেগুন খেতে নাই … এক পাশে কয়েকজন শতরঞ্চ খেলিতেছে। … দুই একজন গায়ক যন্ত্র মিলাইতেছে … মুহুরিরা বসিয়া খাতা লিখিতেছে—সম্মুখে কর্জদার প্রজা ও মহাজন সকলে দাঁড়াইয়া আছে। …”
(৩) “নৌকা দেখিতে দেখিতে ভাঁটার জোরে বাগবাজারের ঘাটে আসিয়া ভিড়িল। রাত্রি প্রায় শেষ হইয়াছে—কলুরা ঘানি জুড়ে দিয়েছে—বলদেরা গরু লইয়া চলিয়াছে—ধোবার গাধা থপাস ২ করিয়া যাইতেছে—মাছের ও তরকারির বাজরা হু ২ করিয়া আসিতেছে—ব্রাহ্মণপণ্ডিতেরা কোশা লইয়া স্নান করিতে চলিয়াছেন—মেয়েরা ঘাটে সারি সারি হইয়া পরম্পর মনের কথাবার্তা কহিতেছে।”
(৪) “জাব চারনক একজন সতীকে চিতার নিকট হইতে ধরিয়া আনিয়া বিবাহ করিয়াছিলেন … জাব চারনক বটুকখানা অঞ্চল দিয়া যাতায়াত করিতেন, তথায় একটা বৃহৎ বৃক্ষ ছিল তাহার তলায় বসিয়া মধ্যে ২ আরাম করিতেন ও তমাক্ খাইতেন … ঐ গাছের ছায়াতে তাঁহার এমনি মায়া হইল যে সেই স্থানে কুঠি করিতে স্থির করলেন। সুতানুটি গোবিন্দপুর ও কলিকাতা এই তিন গ্রাম একেবারে খরিদ হইয়া আবাদ হইতে আরম্ভ হইল; পরে বাণিজ্য নিমিত্ত নানাজাতীয় লোক আসিয়া বসতি করিল। …”
(৫) “লোকে বলে ইংরাজের ঔরসে ও ব্রাহ্মণীর গর্ভে তাঁহার (ব্লাকিয়র্ সাহেবের) জন্ম হয়।”
(৬) “নীলকর সাহেব দাঙ্গা করিয়া কুঠিতে যাইয়া বিলাতি পানি ফটাস করিয়া ব্রান্ডি দিয়া খাইয়া শিশ দিতে দিতে ‘তাজা বতাজা’ গান করিতে লাগিলেন—কুকুরটা সম্মুখে দৌড়ে ২ খেলা করিতেছে। তিনি মনে জানেন তাঁহাকে কাবু করা বড় কঠিন।”
‘আলালের ঘরের দুলাল’ যেহেতু একটি উপন্যাস সেহেতু গল্পের ধারাই সেখানে প্রাধান্য পেয়েছে। কিন্তু কালীপ্রসন্ন সিংহের ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’ আগাগোড়াই একটি সমাজচিত্র—
(১) “কলকেতা সহরের চারিদিকেই ঢাকের বাজনা শোনা যাচ্ছে, চড়কীর পিঠ সড়সড়, কচ্চে, কামারেরা বাণ, দশলকি, কাঁটা ও বঁটি প্রস্তুত কচ্চে: সর্বাঙ্গে গয়না, পায়ে নূপুর, মাতায় জরির টুপি, কোমোরে চন্দ্রহার, সিপাই পেড়ে ঢাকাই সাড়ি মালকোচা করে পরা, তারকেশ্বরে ছোবান গামছা হাতে, বিশ্বপত্র বাঁদা সূতা গলায় যত ছুতর, গয়লা, গন্ধবেণে ও কাঁসারীর আনন্দের সীমা নাই—‘আমাদের বাবুদের বাড়ী গাজোন।’ …”
(২) “আজকাল সহরের ইংরাজী কেতার বাবুরা দুটি দল হয়েছেন, প্রথম দল ‘উঁচু কেতা সহরের গোবরের বষ্ট’, দ্বিতীয় ‘ফিরিঙ্গীর জঘন্য প্রতিরূপ’।”
(৩) “সকালবেলা সহরের বড়মানুষদের বৈঠকখানা বড় সরগরম থাকে। কোথাও উকিলের বাড়ীর হেড কেরাণী তীর্থের কাকের মত বসে আচেন। কোথাও পাওনাদার, বিলসরকার, উটনোওয়ালা মহাজন খাতা, বিল ও হাতচিঠে নিয়ে তিন মাস হাঁটচে, দেওয়ানজী কেবল আজ না কাল কচ্চেন। … কোথাও পাদরি সাহেব ঝুড়ি ঝুড়ি বাইবেল বিলুচ্চেন … পেন্ট লুন, ট্যাংট্যাঙে চাপকান, মাথায় কালো রঙ্গের চোঙ্গা টুপি। আদালতী সুরে হাতমুখ নেড়ে খ্রীষ্টধর্মের মাহাত্ম্য ব্যক্ত কচ্চেন।”
(৪) “কলকেতার কেরাঞ্চি গাড়ি বেতো রোগীর পক্ষে বড় উপকারক … সেকেলে আসমানি দোলদার ছক্কড় যেন হিন্দুধর্মের সঙ্গেই কলকেতা থেকে গাঢাকা হয়েচে। …”
(৫) “পূর্বে চুঁচড়োর মতো বারোইয়ারি পূজো আর কোথাও হতোনা, ‘আচাভো’, ‘বোম্বাচাক’ প্রভৃতি সং প্রস্তুত হতো; সহরের ও নানাস্থানের বাবুরা বোট, বজরা, পিনেস ও ভাউলে ভাড়া করে সং দেখতে যেতেন। …”
(৬) “এখন আর সে কাল নেই … গোলাপজল দিয়ে জলশৌচ, ঢাকাই কাপড়ের পাড় ছিঁড়ে পরা, মুক্তাভস্মের চুন দিয়ে পান খাওয়া আর শোনা যায় না।”
(৭) “নবাবী আমল শীতকালের সূর্য্যের মত অন্ত গ্যালো। মেঘান্তের রৌদ্রের মত ইংরাজদের প্রতাপ বেড়ে উঠলো। বড় বড় বাঁশঝাড় সমূলে উচ্ছেদ হলো। কঞ্চিতে বংশলোচন জন্মাতে লাগলো। … পুঁটে তেলি রাজা হলো। কৃষ্ণচন্দ্র, রাজবল্লত, মানসিংহ, নন্দকুমার, জগৎশেঠ প্রভৃতি বড় বড় ঘর উৎসন্ন যেতে লাগলো। … হাফ আখড়াই, ফুল আখড়াই, পাঁচালি ও যাত্রার দলেরা জন্মগ্রহণ কল্পে। … পেঁচো মল্লিক ও ছুঁচো শীল কলকেতার কায়েত বামুনের মুরুব্বী ও সহরের প্রধান হয়ে উঠলো।”
(৮) “পূর্বের বড়মানুষরা এখনকার বড়মানুষদের মত ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান এসোশিয়েসন, এড্রেস্, মিটিং ও ছাপাখানা নিয়ে বিব্রত ছিলেন না। বেলা দুপুরের পর উঠতেন, আহ্নিকের আড়ম্বরটাও বড় ছিল … তেল মাখতেও ঝাড়া চার ঘণ্টা লাগতো … সেই সময় বিষয়কর্ম দেখা, কাগজপত্রে সইমোহর চলতো … রামমোহন রায়, গুপিমোহন দেব, গুপিমোহন ঠাকুর, দ্বারিকানাথ ঠাকুর, জয়কৃষ্ণ সিংহের আমোল অবধি এই সকল প্রথা ক্রমে ক্রমে অন্তর্দ্ধান হতে আরম্ভ হলো।”
(৯) “সহরের অনেক বড়মানুষ—তাঁরা যে বাঙালীর ছেলে, ইটি স্বীকার কত্তে লজ্জিত হন। বাবু চুণোগলির অ্যান্ডরু পিদ্রুসের পৌত্তর বল্লে তাঁরা বড় খুসি হন। …”
(১০) “মিউটিনির হুজুক শেষ হলো—বাঙালিরা ফাঁসি ছেঁড়া আসামীর মত সে যাত্রা প্রাণে প্রাণে মান বাঁচালেন। …”
(১১) “কলকেতার ব্রাহ্মণভোজন দেখতে বেশ—হুজুররা আঁতুড়ের ক্ষুদে মেয়েটিকেও বাড়ীতে রেখে ফলার কত্তে আসেন না—যার যে কটি ছেলেপুলে আছে ফলারের দিন সেগুলি সব বেরোবে। …”
(১২) “কলকেতায় প্রথম বিধবাবিবাহের দিন বিস্তর ভট্টচাযিরা সভাস্থ হন—ফলার ও বিদেয় মারেন, তারপর ক্রমে গাঢাকা হতে আরম্ভ হন, অনেকে গোবর খান … যতদিন এই মহাপুরুষদের প্রাদুর্ভাব ততদিন বাঙালীর ভদ্রস্থতা নাই।”
এসব ছিল ঊনিশ শতকের কলকাতার ছবি, কিন্তু খাতায় কলমে কলকাতার অস্তিত্বের সংবাদ আরো অনেক আগে পাওয়া যায়। খৃষ্টীয় পনেরো শতকের শেষেরদিকে রচিত ‘মনসা মঙ্গল’ ও খৃষ্টীয় ষোড়শ শতাব্দীর শেষেরদিকে রচিত ‘আইন-ই-আকবরি’ একথারই ঐতিহাসিক প্রমাণ দেয়। তবে জোব চার্নকের কলকাতার ব্যাপারটা অবশ্য একটু আলাদা ছিল।
মধ্যযুগের বাংলার বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে সপ্তগ্রাম যখন নির্জীব হয়ে গিয়েছিল, ঠিক তখনই হুগলির প্রতিপত্তি শুরু হয়েছিল। কিন্তু নদীর মুখে পর্তুগীজ ও আরাকানী জলদস্যুদের উপদ্রবে মুঘল সম্রাট শাজাহানের আক্রোশ গিয়ে পড়েছিল হুগলির ওপরে। আর এরপরেই কলকাতা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিল। যদিও বৈদেশিক বাণিজ্য আগেই কিছু শুরু হয়ে গিয়েছিল, তবুও কলকাতা মাথা চাড়া দেওয়ার পরে শেঠ বসাকরা আরো সুবিধা পেয়ে গিয়েছিলেন। তখন চার্নকের নজর গিয়ে পড়েছিল সুতানুটির ওপরে; কারণ— সেই গ্রামটিতে বসে তখন উত্তর ভারতের জলপথের বাণিজ্য সহজেই আয়ত্তে আনা সম্ভব ছিল। তাছাড়া সেকালে চিৎপুর থেকে কালিঘাট পর্যন্ত তীর্থযাত্রীদের জন্য যে পথটি ছিল, সেটার সুবিধার কথাও চার্নক চিন্তা করেছিলেন। বাস্তবে ১৬৯০ সালে কলকাতার বৈঠকখানা অঞ্চলে তখনকার বিখ্যাত গাছের তলায় বসে অন্যান্য ব্যবসাদারদের সঙ্গে গল্পগুজবের সময়ে এবং ধূমপানের অবকাশে চার্নক অনেক কিছুই চিন্তা করেছিলেন। এবিষয়ে চার্নকের ডায়ারিতে যে তথ্য পাওয়া যায়, সেটার বঙ্গানুবাদ করলে হয়—
‘আগস্ট ২৪, ১৬৯০। কাপ্তেন ব্রুককে তাঁর জাহাজ নিয়ে সুতানুটিতে চলে আসতে বলেছিলাম। দুপুর বেলায় পৌঁছে দেখি অবস্থা শোচনীয়। মাথা গোঁজবার জায়গা নেই। সারাদিন ও রাত্রি জুড়ে বৃষ্টির উৎপাতে নৌকাতেই উঠতে হল।’
কিন্তু চার্নক নিরাশ না হয়ে— সুতানুটি, গোবিন্দপুর ও কলিকাতা— এই তিনটি গ্রাম দখল করে ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলেন। ক্রমে সুতানুটিতে নদীর কাছে অবস্থিত একটি মাটির ঘরে ভবিষ্যতের মহানগরী কলকাতার বীজ রোপিত হয়েছিল। মাঝখান থেকে হারিয়ে গিয়েছিলেন শেঠ বসাকেরা, যাঁদের হাতে শহর কলকাতার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়েছিল। কথিত রয়েছে যে, চার্নক নাকি সহমরণের চিতা থেকে ছিনিয়ে নিয়ে এক বিধবাকে বিবাহ করেছিলেন। যদিও এই কাহিনীর কোন ঐতিহাসিক ভিত্তি এখনও পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায়নি, তবে একথা সত্যি যে— নিজের সেই স্ত্রীর মৃত্যুর পরে প্রত্যেক বছর তিনি তাঁর সমাধিতে একটি করে মোরগ বলি দিতেন।
১৬৬৮ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তিনটি গ্রাম ১৩০০ টাকা দিয়ে কিনে নিয়েছিল, আর ১৬৯১ সাল থেকে শুরু প্রায় ৫০ বছরের মধ্যে কলকাতার শ্রীবৃদ্ধি হতে শুরু করেছিল। এরপরে ১৭৩৭ সাল থেকে ১৭৫৭ সালের মধ্যে এসেছিল বিপর্যয়ের পালা— ঝড়, ভূমিকম্প, মারাঠা আক্রমণের আতঙ্ক, সিরাজের সঙ্গে কোম্পানির বিরোধ ইত্যাদি। এরপরে আবার কলকাতার শ্রীবৃদ্ধি শুরু হয়েছিল এবং কলকাতা কোম্পানি শাসিত ভারতীয় সাম্রাজ্যের রাজধানী হয়ে উঠেছিল। শেষে বিশ শতকের প্রথম দশকের শেষেরদিকে রাজধানী দিল্লিতে স্থানান্তরিত হয়েছিল।
১৭৮৪ সালের ‘ইণ্ডিয়ান গেজেট’ পত্রিকার একটি সংবাদ থেকে জানা যায় যে, কোম্পানির কলকাতা কাউন্সিলের সভ্যেরা তখন— পায়জামা, মসলিনের সার্ট, আর সাদা টুপি পরিধান করতেন। সাহেবদের মধ্যে তখন হুঁকায় তামাক খাওয়া সুপ্রচলিত ছিল, এমনকি মেমসাহেবরাও হুঁকায় তামাক সেবন করতেন। সেকালের ইংরেজদের বর্বর বিলাসিতা এতটাই দৃষ্টিকটু হয়ে উঠেছিল যে ম্যাক্রাবি লিখেছিলেন—
‘চারটি লোকের একটি ছোট পরিবারে দাসদাসীর সংখ্যা ছিল ১১০ জন।’
অবশেষে বিংশ শতকে পৌঁছে কলকাতা ইংরেজেদের বিষদৃষ্টিতে পড়েছিল, আর তখন থেকেই দিল্লি ও বোম্বের উপরে তাঁরা মধুবর্ষণ করতে শুরু করেছিলেন। ফলে অনাথ শহর ক্রমে আয়ত্তের বাইরে চলে গিয়েছিল, এবং জনস্রোতে ও স্বার্থের তরঙ্গে কলকাতা মহানগরী প্লাবিত হয়ে গিয়েছিল। একাধারে রাজ্ঞী ও গণিকা— কলকাতা আজও সারা ভারতের যেমন শরণ ও সমস্যা, তেমনি আশা ও আতঙ্ক। কলকাতা নামক দানবীর মোহে আকৃষ্ট হয়ে অনেক রাজা যেমন ফকির হয়েছেন, তেমনি আবার কলকাতার কল্যাণেই অনেক ভিখারি ধনিক হয়ে গিয়েছেন। আজও কলকাতার প্রায় গলিত দেহের অসংখ্য শিরা-উপশিরার মত পথে আর গলিতে জীবাণুর মত মানুষের সংঘাতময় জীবনের প্রতি মুহূর্তে ভবিষ্যতের অজস্র বীজ সৃষ্টি হচ্ছে। আজও মায়াবিনী কলকাতা অনেকের চোখের ঘুম কেড়ে নেয় ও স্বপ্নে হাতছানি দিয়ে ডাকে। আর তাই আজও ইংরেজদের আশীর্বাদ ও অভিশাপ হল— ‘আজব শহর কলকেতা’।
সম্পাদক : সৈয়দ আমিরুজ্জামান
ইমেইল : rpnewsbd@gmail.com
মোবাইল +8801716599589
৩১/এফ, তোপখানা রোড, ঢাকা-১০০০।
© RP News 24.com 2013-2020
Design and developed by M-W-D