সিলেট ১৫ই অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৩০শে আশ্বিন, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ১২:৩৪ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ২৪, ২০২৪
বিজ্ঞানের অভাবনীয় উন্নতির ফলে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ক্ষেত্রেও যথেষ্ট অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। পৃথিবীর এমন কোনো প্রান্ত পাওয়া যাবে না যেখানে এ তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়ন চোখে পড়বে না। মানুষের ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের অতি গুরুত্বপূর্ণ কাজেও রয়েছে তথ্যপ্রযুক্তির ছোঁয়া। মানুষের জীবনের কাজের গতি এবং খরচ দুই-ই কমে গেছে এ তথ্যপ্রযুক্তির উৎকর্ষ সাধনের কারণে।
বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছে বাংলাদেশ। তথ্যপ্রযুক্তির এ উন্নয়নের মিছিলে বাংলাদেশও শামিল হয়েছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ নামক বাস্তবতার ওপর ভর করে বাংলাদেশ আজ এগিয়ে যাচ্ছে উন্নয়নের সিঁড়ি বেয়ে।
দিন যত যাচ্ছে মানুষের জীবনযাত্রা তত বেশি প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে পড়ছে।
দেশে তথ্যপ্রযুক্তির ছোঁয়ায় পরিবর্তনের সুবাতাস বইছে। মানুষের জীবনের এমন কোনো পর্যায় নেই যেখানে এ তথ্যপ্রযুক্তির ছোঁয়া লাগেনি। বিশেষ করে করোনা মহামারীর অভিঘাতের ওই সময়কালে মানুষকে কয়েক গুণ বেশি প্রযুক্তিনির্ভর করে ফেলেছিল। আগে যেসব ক্ষেত্রে চিন্তাও করা যেত না সেসব ক্ষেত্রেও বেড়েছে প্রযুক্তির নির্ভরশীলতা।
এ প্রযুক্তিনির্ভরশীলতা একদিকে মানুষের জীবন সহজ করেছে, জীবনযাত্রার ব্যয় সংকোচন করেছে; তেমনি তথ্যপ্রযুক্তির অবাধ ব্যবহারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে সাইবার অপরাধ। উগ্র সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গিবাদ, গুজব, মিথ্যা খবর, কিশোর অপরাধ, আত্মহত্যা, পর্নোগ্রাফি, সাইবার বুলিং, জালিয়াতি, ব্যাংক ডাকাতি, চাঁদাবাজি, পাইরেসি, অস্ত্র ও মাদক ব্যবসা- সবই হচ্ছে এ প্রযুক্তি ব্যবহার করে। তাই যখন অপরাধের প্রশ্ন এসে যায় তখনই প্রয়োজন হয় সচেতনতার।
সাইবার ক্রাইমের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সাইবার ক্রাইম একটি বাউন্ডারিলেস ক্রাইম। কারণ এ ধরনের অপরাধের ক্ষেত্রে এক দেশে বসে অপরাধ সংঘটিত করে আরেক দেশের নাগরিকদের ভিকটিম বানানো সম্ভব।
প্রযুক্তির উৎকর্ষতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে সাইবার ক্রাইম। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, একদিকে অনলাইনে কেনাকাটা যেমন জনপ্রিয় হচ্ছে ঠিক তেমনি এ অনলাইনে কেনাকাটাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে প্রতারক চক্র। তাই এ ধরনের অপরাধের বিরুদ্ধে সচেতনতার কার্যক্রম কোনো পরিসীমার মধ্যে আবদ্ধ রাখা সম্ভব নয়। আমরা যদি একটু পরিসংখ্যানের দিকে তাকাই তাহলে বাংলাদেশের সাইবার ক্রাইম সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়া যাবে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ টেলিরেগুলেটরি কমিশনের (বিটিআরসি) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, জুলাই ২০২২ পর্যন্ত ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১২৭.৫৫ মিলিয়ন। যার মধ্যে মোবাইলের মাধ্যমে ইন্টারনেট ব্যবহার করছেন ১১৬.৪১ মিলিয়ন, আইএসপি ও ব্রডব্যান্ডের মাধ্যমে ইন্টারনেট ব্যবহার করছেন ১১.১৪ মিলিয়ন। উপরোক্ত তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর একটা বিশাল অংশ ইন্টারনেট ব্যবহারকারী এবং এ ব্যবহারকারীর সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। তবে ইন্টারনেট গ্রাহকের সংখ্যা যেভাবে বেড়ে যাচ্ছে সে অনুপাতে সচেতন গ্রাহকের সংখ্যা বাড়ছে না। যার কারণে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় অনেক ব্যবহারকারী জড়িয়ে পড়ছে সাইবার ক্রাইমের জালে।
বাংলাদেশ সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশনের ২০২২ সালের গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে বৃদ্ধি পাওয়া সাইবার অপরাধের মধ্যে রয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপপ্রচার, অনলাইনে পণ্য কিনতে গিয়ে প্রতারণার শিকার, পর্নোগ্রাফি, কপিরাইট অপরাধ ইত্যাদি। প্রতিবেদনের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ভুক্তভোগীর বেশিরভাগই সাইবার বুলিংয়ের শিকার। ২০২২ সালের প্রতিবেদনে সাইবার বুলিংয়ের শিকার ভুক্তভোগী কিছুটা বেড়ে ৫০.২৭ শতাংশ হয়েছে, যা ২০২১ সালের প্রতিবেদনে ছিল ৫০.১৬ শতাংশ। এ ছাড়া যৌন হয়রানিমূলক একান্ত ব্যক্তিগত মুহূর্তের ছবি/ভিডিও (পর্নোগ্রাফি) ব্যবহার করে হয়রানি এবং ফটোশপে ভুক্তভোগীর ছবি বিকৃত করে হয়রানির ঘটনা উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। যৌন হয়রানিমূলক একান্ত ব্যক্তিগত মুহূর্তের ছবি/ভিডিও (পর্নোগ্রাফি) ব্যবহার করে হয়রানির পরিমাণ ২০২১ সালের প্রতিবেদনে ৭ দশমিক ৬৯ শতাংশ ছিল কিন্তু সেটা ২০২২ সালে বেড়ে গিয়ে দাঁড়ায় ৯ দশমিক ৩৪ শতাংশে এবং ফটোশপে ভুক্তভোগীর ছবি বিকৃত করে হয়রানির ঘটনা ২০২১ সালের প্রতিবেদনে ৫ দশমিক ৮৫ শতাংশ পাওয়া গেলেও ২০২২ সালে তা ১ দশমিক ৮ শতাংশ বেড়ে গিয়ে দাঁড়ায় ৬ দশমিক ৯৩ শতাংশে।
তবে এ গবেষণা প্রতিবেদনে আরও দুটি চরম উদ্বেগজনক বিষয় পরিলক্ষিত হয়েছে। তা হচ্ছে, ভুক্তভোগীর বয়স ও জেন্ডার। সাইবার অপরাধের বয়সভিত্তিক বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ভুক্তভোগীর বেশির ভাগের বয়স ১৮-৩০ বছর এবং এ বয়সসীমার ভুক্তভোগীর হার ৮০ দশমিক ৯০ শতাংশ। প্রতিবেদনে সাইবার অপরাধের ভুক্তভোগীদের জেন্ডারভিত্তিক পার্থক্য দেখলে দেখা যায়, ভুক্তভোগীর মধ্যে নারীর সংখ্যা ৫৬.৭৮%। তার মানে বোঝা যাচ্ছে মোট ভুক্তভোগীর অর্ধেকের বেশি নারী। অর্থাৎ নারীই সাইবার অপরাধীদের মূল টার্গেট। এখন যে প্রশ্নটি জাগে তা হচ্ছে, এ সাইবার ক্রাইম কি অপ্রতিরোধ্য? এ সাইবার ক্রাইম কি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়? উত্তর হচ্ছে, এ সাইবার ক্রাইম মোটেও অপ্রতিরোধ্য নয়। এ সাইবার ক্রাইম নিয়ন্ত্রণে চাই সর্বস্তরে সচেতনতা। এ সচেতনতা বিস্তারে চাই ব্যক্তি থেকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের সদিচ্ছা। সচেতনতা তৈরির কাজে রাষ্ট্র থেকে ব্যক্তি সবার দায় আছে। ব্যক্তিকে যেমন তার পারিবারিক পর্যায় থেকে সচেতনতা তৈরির কাজ করতে হবে, পরিবারের কেউ ভুক্তভোগী হলে তার পাশে থেকে সহাতুভূতির হাত বাড়িয়ে তার ন্যায়বিচার নিশ্চিতে কাজ করে যেতে হবে ঠিক তেমনি রাষ্ট্রকে ব্যাপক আকারে এ সাইবার অপরাধের বিরুদ্ধে জনমত তৈরিতে মনোনিবেশ করতে হবে।
লেখক : পিএইচডি গবেষক ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাজ্য
সম্পাদক : সৈয়দ আমিরুজ্জামান
ইমেইল : rpnewsbd@gmail.com
মোবাইল +8801716599589
৩১/এফ, তোপখানা রোড, ঢাকা-১০০০।
© RP News 24.com 2013-2020
Design and developed by ওয়েব নেষ্ট বিডি