মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি সার্বজনীন জনযুদ্ধ’ (৮)

প্রকাশিত: ১০:২৬ অপরাহ্ণ, মে ২২, ২০২০

মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি সার্বজনীন জনযুদ্ধ’ (৮)

হাফিজ সরকার, ২৩ মে ২০২০ : (পূর্বে প্রকাশের পর)। মুক্তিযুদ্ধে কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের কমান্ড ও অবস্থানঃ বামপন্থীদের মধ্যে মতাদর্শিক ভাবে মস্কোপন্থী ও পিকিং এই দুইভাগে বিভাজন ছিলো। কমিউনিস্ট-বিপ্লবী মস্কো ও পিকিং পন্থীদের ১৬ টি দল-গ্রুপ-অংশ ছিল। তাদের বেশীর ভাগই (১৪টি গ্রুপ) নিজেদের মুল্যায়ন সহ যুক্তিযুদ্ধে নিজ নিজ কমান্ডে অংশ গ্রহন করে। দুইটি গ্রুপ বিরোধিতা করে।

মস্কোপন্থী অংশঃ

১) কমিউনিস্ট পার্টি, ২) ন্যাপ (মোজাফ্ফর), ৩) ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া)।

মুজিবনগর সরকারের সমর্থক। সরকারের কাছ থেকে ট্রেনিং নিয়ে স্বাধীন কমান্ডে যুদ্ধ পরিচালনা করে।
আগরতলায় ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের নেতাকর্মীরা ক্র্যাফস হোস্টেলে থাকতেন। এখান থেকে যাঁরা মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করার জন্য সক্রিয় ছিলেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন কমরেড মণি সিংহ, মোজাফ্ফর আহমদ, মোহাম্মদ ফরহাদ, মতিয়া চৌধুরী, জ্ঞান চক্রবর্তী, অনিল মুখার্জি, পঙ্কজ ভট্টাচার্য, মতিউর রহমান, শেখর দত্ত, আবদুল হাদী প্রমুখ। চট্টগ্রামের নেতাদের মধ্যে ছিলেন চৌধুরী হারুনুর রশীদ, আহসান উল্লাহ চৌধুরী, বখতেয়ার নূর সিদ্দিকী, খোরশেদুল ইসলাম প্রমুখ। নারী নেত্রী বেগম মুসতারী শফি ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী মোহাম্মদ বেলালও এই হোস্টেলে কিছুদিন ছিলেন। কমান্ডার আবদুর রউফ ও ড. আনিসুজ্জামান এখানে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করে চলতেন।

কমিউনিস্ট পার্টি, অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের নেতৃত্বাধীন ন্যাপ ও ছাত্র ইউনিয়ন মিলিতভাবে বাহিনী গড়ে তুলেছিল, যা ছিল সরকারি মুক্তিফৌজ থেকে স্বতন্ত্র। ভারত সরকার তাদের স্বতন্ত্রভাবে ট্রেনিং ও অস্ত্র দিয়েছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ভারতের মৈত্রীর কারণে ভারত সরকার এটা করতে বাধ্য হয়েছিল। সিপিবির মনজুরুল আহসান খান এই বাহিনীর একজন কমান্ডার ছিলেন যার নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি গ্রুপের সাতজন সদস্য বেতিয়ারার যুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন।
মস্কোপন্থী কমিউনিস্ট পার্টি ও ন্যাপ, ছাত্র ইউনিয়ন ও কৃষক সমিতির দাবী তারা ৬০০০ কর্মীকে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দেয়।

পিকিংপন্থী অংশঃ

‘জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম সমন্বয় কমিটি’
(মওলানা ভাষানী ও অমল সেনের নেতৃত্বে)
*************************************

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে কমরেড অমল সেনকে যশোর জেল ভেঙ্গে বের করা হয়। কিছুদিন আত্মগোপনে থেকে ভারতে চলে যান । তিনি নকশালপন্থার ভ্রান্ত লাইনকে বিরোধিতা করেননি শুধু, এসবের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনে অনন্য ভূমিকা রাখেন। এক্ষেত্রে কমরেড অমল সেন কমিউনিস্ট ও বামপন্থী দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করে মওলানা ভাষানীকে সভাপতি করে ‘জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম সমন্বয় কমিটি’ গড়ে তুলতে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মৌলানা ভাষানীকে দিল্লিতে অন্তরীন করে রাখা হয়। সেই সময় ভাষানীর সাথে যোগাযোগ রক্ষাকরে কমরেড অমল সেন ‘জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম সমন্বয় কমিটি’র প্রধান নেতৃত্বে অবতির্ন হন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে এ সমন্বয় কমিটির ভূমিকা নানা প্রচারে কিছুটা বিস্মৃত অধ্যায়ে পরিণত হয়।

৪) ‘কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের সমন্বয় কমিটি ‘ :         (জাফর-মেনন-হায়দার-রনো) :

মাওলানা ভাসানীকে চেয়ারম্যান ঘোষণা করে কোলকাতায় ‘জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি’ গঠন করে ও মুজিবনগর সরকারের নিকট অস্ত্রের আবেদন করে।

এটা বাস্তব যে সেদিন ঢাকার অদূরে মান্নান ভূঁইয়ার নেতৃত্বে  নরসিংদীর শিবপুর অঞ্চলকে কেন্দ্র করে দেশের অভ্যন্তরে প্রায় চৌদ্দটি স্থানে প্রতিরোধ ঘাঁটি গড়ে উঠেছিল। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন সেক্টরের সঙ্গেও এই সমন্বয় কমিটি ঐক্য গড়ে তুলেছিল। এ অঞ্চলের বামপন্থী বিপ্লবীরাই ডিসেম্বরে নরসিংদীতে অবস্থিত পাকিস্তানের মিলিটারি ক্যাম্প দখল করেছিলেন। শিবপুরের যুদ্ধ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক বিশিষ্ট স্থান দখল করে আছে। সমন্বয় কমিটির যুদ্ধ কৌশল ছিল দ্বিবিধ। এক. দেশের অভ্যন্তরে গেরিলা ঘাটি গড়ে যুদ্ধ করা। সেক্ষেত্রে প্রধানত শত্রুর কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া অস্ত্রই ছিল তাদের অস্ত্র সংগ্রহের প্রধান উৎস। তারা ভারত সরকারের কোনো রকম সাহায্য পাইনি। দ্বিতীয়ত, বিভিন্ন সেক্টর কমান্ডারের সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করে মুক্তিবাহিনীর মধ্যে কর্মীদের ঢুকিয়ে দেয়া। কারণ মুক্তিবাহিনীতে রিক্রুট করার ক্ষেত্রে বাম কমিউনিস্ট ন্যাপ কর্মীদের বাদ দেয়ার নির্দেশ ছিল।
তবে জিয়াউর রহমান, খালেদ মোশাররফ, কর্নেল নুরুজ্জামান (তিনি নিজেও মার্কসবাদে বিশ্বাসী ছিলেন), মেজর জলিল, মেজর মনজুর আহমেদ প্রমুখের যথেষ্ট সহযোগিতা করেছেন। তারা বামপন্থীদের ঘাটি এলাকায় অস্ত্র সরবরাহ পর্যন্ত করেছিলেন। বামপন্থীদের পক্ষে সবচেয়ে আন্তরিক ছিলেন সেক্টর কমান্ডার কর্নেল নুরুজ্জামান।

কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের সমন্বয় কমিটি (জাফর-মেনন-হায়দার-রনো) এর দাবী তারা ১২০০০ কর্মীকে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দেয়।

৫) পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি (দেবেন-বাসার-আফতাব) :

মাওলানা ভাসানীকে চেয়ারম্যান ঘোষণা করে কোলকাতায় “মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি” গঠন ও মুজিবনগর সরকারের নিকট অস্ত্রের আবেদন করে।

দেবেন শিকদার, আবুল বশারের নেতৃত্বাধীন বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির বিএম কলিমুল্লাহর নেতৃত্বে চাঁদপুরে এক বিশাল বাহিনী ও ঘাটি এলাকা গড়ে উঠেছিল।  ঢাকায় যুদ্ধরত ক্র্যাক প্লাটুনেও ছিলেন বামপন্থী ছাত্র কর্মীরা।
এই দলের দাবী তারা ৫,০০০ সদস্যের লাল গেরিলা বাহিনী গড়ে তুলেছিল।

৬) কমিউনিস্ট সংহতি কেন্দ্র (অমল সেন – নজরুল) :

মাওলানা ভাসানীকে চেয়ারম্যান ঘোষণা করে কোলকাতায় “মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি” গঠন ও মুজিবনগর সরকারের নিকট অস্ত্রের আবেদন করে।

খুলনা, যশোর, কুষ্টিয়ে অঞ্চলসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কমিউনিস্ট সংহতি কেন্দ্রের নেতৃত্বে শত শত মুক্তাঞ্চল গড়ে উঠে। দেশের অভ্যন্তরে পুলিশ লাইনের অস্ত্রাগার, থানা, ব্যাংক, ইপিআর, গ্রাম ও শহরের লাইসেন্স করা অস্ত্র সংগ্রহ করে। তারা বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর, পুলিশের স্বপক্ষ ত্যাগ করা সদস্যের কাছ থেকে অস্ত্র চালনা ট্রেনিং গ্রহন করে। পরে বিভিন্ন সেক্টরে কমান্ডারের যৌথ নেতৃত্বে স্বাধীন ভাবে যুদ্ধ পরিচালনা করে। বরিশাল অঞ্চলের যুদ্ধ (অধ্যাপক আবদুস সাত্তারের নেতৃত্বাধীন), কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম অঞ্চলের যুদ্ধ, বাগেরহাটে রফিকুল ইসলাম খোকনের নেতৃত্বাধীন যুদ্ধ ও বিশাল গেরিলা বাহিনী এবং সাতক্ষীরার তালা থানায় কামেল বখতের নেতৃত্বাধীন গেরিলা সংগ্রাম বিশেষ আলোচনার দাবি রাখে। কামেল বখত নিহত হয়েছেন। শোনা গেছে স্থানীয় আওয়ামী লীগের কোনো অংশ ঘুমন্ত অবস্থায় তাকে গুলি করে হত্যা করেছিল বিশ্বাসঘাতকতা করে।
কমিউনিস্ট সংহতি কেন্দ্রের দাবী তারা  ১৫,০০০ সদস্যের গেরিলা বাহিনী গড়ে তুলেছিল।

৭) কমিউনিস্ট কর্মী সংঘ (সাইফুর-মারুফ-দাউদ) :

মাওলানা ভাসানীকে চেয়ারম্যান ঘোষণা করে কোলকাতায় “মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি” গঠন ও মুজিবনগর সরকারের নিকট অস্ত্রের আবেদন

৮) বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (হাতিয়ারগ্রুপ) – নাসিম আলী -শুভ রহমান :

মাওলানা ভাসানীকে চেয়ারম্যান ঘোষণা করে কোলকাতায় “মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি” গঠন ও মুজিবনগর সরকারের নিকট অস্ত্রের আবেদন

৯) ন্যাপ (ভাসানী) :

মাওলানা ভাসানীকে চেয়ারম্যান ঘোষণা করে কোলকাতায় “মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি” গঠন ও মুজিবনগর সরকারের নিকট অস্ত্রের আবেদন

১০) পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (অচিন্ত্য-দীলিপ) :

“মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি”র সমর্থক
অচিন্ত-দিলীপবড়ুয়ারা পুর্বপাকিস্তান কম্যুনিস্ট পার্টির সাথে ছিলেন। এ দলটি হক-তোয়াহার পরিচালনায় ছিল। দলটির পরিচালনায় বৃহত্তর যশোর, খুলনা,কুস্টিয়া, ফরিদপুর,নোয়াখালী অঞ্চলে এপ্রিল মাস থেকে আগাস্ট সেপ্টেম্বর মাস অবধি লড়াই চালিয়ে গেছে। পরে পাক বাহিনী ও মুজিববাহিনীর আক্রমনের মুখে ছত্রভংগ হয়ে যায়।

১১) পূর্ব বাংলার ছাত্র ইউনিয়ন (মাহাবুব উল্লাহ) :

“মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি”র সমর্থক

১২) পূর্ব বাংলার বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন (হায়দার আকবর খান রনো) :

পূর্ব বাংলার মাটিতে থেকে মুক্তিযুদ্ধ

১৩) পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল)-তোয়াহা :

বাংলাদেশের মাটিতে থেকে মুক্তিযুদ্ধ, ভারতের সমর্থনে নয়।
যুদ্ধ সম্পর্কে মূল্যায়নে ভ্রান্তি থাকলেও ইপিসিপি-এর বিভিন্ন অংশও বিচ্ছিন্নভাবে সাহসী যুদ্ধ করেছেন। যেমন নোয়াখালীর বিস্তীর্ণ এলাকায় যথা চর জঙ্গলিয়া ইউনিয়নকে কেন্দ্র করে ঘাটি এলাকা তৈরি হয়েছিল মহম্মদ তোয়াহার নেতৃত্বে।  সশস্ত্র তৎপরতা রামগতি ও সুধারাম থানা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।

১৪)
সিরাজ শিকদারঃ

পূর্ব বাংলার শ্রমিক আন্দোলন :

১৯৬৮ সালের ৫ মে। সেদিন ছিল কার্ল মার্কসের জন্মদিন। সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বে পূর্ববাংলার শ্রমিক আন্দোলন ঢাকায় অবস্থিত ‘পাকিস্থান কাউন্সিল’-এ সশস্ত্র হামলা চালায়। এদেশের নিপীড়িত জাতি ও জনগণের শত্রু পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের শোষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের প্রতীক হিসেবেই এই হামলা। পাকিস্থানি শোসকদের বিরুদ্ধে জনগণের প্রথম সংগঠিত হামলা। এর পরই জনগণের ক্ষমতা দখলে গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরাওয়ের কৌশল সম্পর্কে ভ্রাতৃপ্রতীম পার্টি কমরেডদের সঙ্গে অভিজ্ঞতা বিনিময়ের জন্য সিরাজ সিকদার মিয়ানমারে যান। সেখান থেকে ফিরে জনগণের সংগ্রামের ঘাঁটি গড়ে তুলতে পাহাড় অঞ্চলের বাস্তবতা পরীক্ষা করতে পার্বত্য এলাকায় যান। পাহাড়ি এলাকার জনশূন্য পরিস্থিতি বিচার করে বিশেষভাবে পার্বত্য এলাকায় কাজ করার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন। এরপরই আসন্ন হয়ে উঠে ঊনসত্তর এর গণঅভ্যুত্থান। তিনি বুঝতে পারেন জনগণের মধ্যে পশ্চিম পাকিস্থানি শাসকদের বিরুদ্ধে জমানো ক্ষোভ বিস্ফোরণম্মুখ হয়ে আছে।

১৯৭০ সালে সর্বপ্রথম দেশের বিভিন্ন স্থানে জাতীয় পতাকা ওড়ানো হয়ঃ
———————————————————————–

নতুন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের কথা মাথায় রেখে পূর্ববাংলার শ্রমিক আন্দোলন এর ২য় প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে, ৮ জানুয়ারি, নতুন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের কথা মাথায় রেখে পূর্ববাংলার শ্রমিক আন্দোলন এর ২য় প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে, ৮ জানুয়ারি, ১৯৭০ সালে সর্বপ্রথম দেশের বিভিন্ন স্থানে জাতীয় পতাকা ওড়ানো হয়। এর মধ্যে ঢাকা, মুন্সীগঞ্জ ও ময়মনসিংহ অন্যতম। পূর্ববাংলার নরম্যান বেথুন খ্যাত তাহের আজমীর নেতৃত্বে পূর্ব বাংলার শ্রমিক আন্দোলনের কর্মীরা পতাকার ডিজাইন করেন। ডিজাইনে সবুজ জমিনের মাঝে রক্ত লাল সূর্য, সুর্যের মাঝে তিনটি মশাল তিন সংখ্যালঘুর প্রতিনিধিত্ব হিসাবে রাখা হয়েছিল। যার মধ্যে ছিল জাতিগত, ভাষাগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু। ক্ষমতায় এসে আওয়ামীলীগ সরকার মূল নকশার মশাল তিনটি বাদ দিয়ে এই পতাকাকেই জাতীয় পতাকা হিসেবে নেয়। আর চাপা দেয় এর প্রকৃত ইতিহাসকে।

১ম স্বাধীনতার ঘোষনা ও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহনঃ
==========================

১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে সিরাজ সিকদারের বিপ্লবী পরিষদ বিভিন্ন জেলায় পাকিস্তানী প্রশাসন ও শ্রেণি শত্রুর বিরুদ্ধে গেরিলা অপারেশন চালায়। ঐ বছরের ৮ জানুয়ারি তারা ঢাকা, মুন্সিগঞ্জ জেলা ও ময়মনসিংহে ওড়ায় স্বাধীন পূর্ব বাংলার পতাকা। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ২ মার্চ এই বিপ্লবী পরিষদ শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগের উদ্দেশে একটি খোলা চিঠি লেখে, যা লিফলেট আকারে সারাদেশে প্রচার করা হয়। এর চার নাম্বার দফাটি ছিল পূর্ব বাংলার দেশ প্রেমিক রাজনৈতিক পার্টি ও ব্যক্তিদের প্রতিনিধি সমন্বয়ে জাতীয় মুক্তি পরিষদ বা জাতীয় মুক্তি ফ্রন্ট গঠন করেন।
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী পূর্ব বাংলায় ব্যাপক গণহত্যা শুরু করলে সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বে ‘পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন’ বরিশাল-মাদারীপুর-নরসিংদী-পাবনা-টাঙ্গাইল সহ আটটি ফ্রন্ট এলাকায় পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আত্মনির্ভরশীলতার ভিত্তিতে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ শুরু করেন। তিনি ব্যক্তিগতভাবে বরিশালের পেয়ারা বাগানে পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ শুরু করেন। তাঁর প্রত্যক্ষ নেতৃত্বে পেয়ারা বাগানে পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রায় শূন্য থেকে বিরাট বাহিনী ও বিস্তীর্ণ মুক্তাঞ্চল গড়ে ওঠে।

পাক বাহিনীর ব্যাপক ঘেরাও-দমনের মুখে পেয়ারা বাগান থেকে পিছু হটে তিনি দেশব্যাপী দীর্ঘস্থায়ী গণযুদ্ধ পরিচালনার প্রচেষ্টা চালান। কিন্তু এ সময়ে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের সমর্থনপুষ্ট আওয়ামী মুক্তি বাহিনীর হত্যা-নিপীড়নে তাঁর পার্টি ও বাহিনীর ব্যাপক ক্ষতি হয়।
মুক্তিযুদ্ধে যার যা অবদান তা যেন আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ রাখি। বামপন্থীদের ভূমিকাসহ সবার ভূমিকাকেই ইতিহাসের পাতায় স্থান দিতে হবে। ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে অবিকৃত ইতিহাস তুলে ধরার কাজটিই হবে ইতিহাসবিদ, গবেষক ও সৎ রাজনীতিবিদদের কর্তব্য।

———————–
গনমানুষে তথ্য:

* কিশোরগঞ্জ জেলার বাজিতপুর নিকলী এলাকায় সাম্যবাদী দলের নেতা অধ্যাপক ইয়াকুব মিয়া ও আনিসুর রহমান প্রমুখের নেতৃত্বে  মুক্তি যুদ্ধ সংগটিত হয়।

* তিনি (আব্দুল মান্নান ভুঁইয়া) আসলে তো, নরসিংদীর আবদুল হাই সাহেব, ফজলুল হক খন্দকার সাহেবরা নাই কেন?

* অচিন্ত-দিলীপবড়ুয়ারা পুর্বপাকিস্তান কম্যুনিস্ট পার্টির সাথে ছিলেন। এ দলটি হক-তোয়াহার পরিচালনায় ছিল। দলটির পরিচালনায় বৃহত্তর যশোর, খুলনা,কুস্টিয়া, ফরিদপুর,নোয়াখালী অঞ্চলে এপ্রিল মাস থেকে আগাস্ট সেপ্টেম্বর মাস অবধি লড়াই চালিয়ে গেছে। পরে পাক বাহিনী ও মুজিববাহিনীর আক্রমনের মুখে ছত্রভংগ হয়ে যায়।

তথ্যসুত্রঃ

১) মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর আর্কাইভ

২) ‘আমি বিজয় দেখেছি’ ও ‘মুক্তিযুদ্ধের গবেষনা পত্র’ এম আর আখতার মুকুল।

৩) মওলানা ভাষানীর কর্ম-জীবন ও রাজনীতি বিষয়ক গবেষণা পত্র

৪) কমরেড অমল সেন স্মারক গ্রন্থ

৫) হায়দার আকবর খান রনোর ‘মুক্তিযুদ্ধে বামপন্থীদের ভুমিকা’ শির্ষক প্রবন্ধ

৬) হায়দার আনোয়ার খান জুনোর ‘একাত্তরের রণাঙ্গন শিবপুর’ ও ‘আগুন ঝরা সেই দিনগুলি’

৭)  ‘জনযুদ্ধের অগ্রদূত’ ও ‘শ্রাবণ’ কর্তৃক প্রকাশিত ‘সিরাজ সিকদার রচনা সংগ্রহ’.

৮) দ্বন্দ্ব ডট কম।

৯) অমি রহমান পিয়ালের প্রবন্ধ

১০) সিরাজুল হোসেন খান, উপমহাদেশের সামাজিক রাজনৈতিক ইতিবৃত্ত, ঢাকা, ২০০২, পৃ ১১৯

http://banglapedia.search.com.bd/HT/B_0464.htm

    Politics – Political Parties — http://web.archive.org/20011206032510/members.tripod.com/scohel Muktadhara © Tito Scohel & Scyma Hesser May 2001

১১) ‘মুক্তিযুদ্ধে ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ইউনিয়নের ভূমিকা’ বিষয়ক প্রবন্ধ।

১২) তালুকদার মনিরুজ্জামান, The Bangladesh Revolution and its Aftermath. UPL, 2003

১৩) বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, ১৫ খন্ড।

১৪) বেসামরিক বিমান ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেননের কলাম

১৫)  মুক্তিযুদ্ধে সশস্ত্র বাহিনীর ইতিহাস

১৬) ১৯৬৮ : পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন, পার্বত্য চট্টগ্রামে সুরঙ্গ কাটা অভিযান, পুরানো কমরেডদের সঙ্গে বিচ্ছেদ ও লাল ঝাণ্ডার প্রকাশনা ,আ কেইস স্টাডি অব পূর্ববাংলা সর্বহারা পার্টি ,দ্য সান ইজ রেড।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ