সিলেট ৩১শে অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৫ই কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ৭:৩৬ অপরাহ্ণ, মে ৩০, ২০২০
আনোয়ারুল ইসলাম জাবেদ, ৩১ মে ২০২০ : কমরেড সৈয়দ আবু জাফর আহমদ: এক পেশাদার স্বপ্নচাষি। তিনি একজন পেশদার রাজনীতিক। রাজনীতিতেই ব্যয় করেছেন পুরো জীবন। তাও স্রোতের বিপরীতেই তরী বেয়ে গেছেন। তিনি বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাবেক সাধারণ সম্পাদক। মৃত্যুকালে ছিলেন প্রেসিডিয়াম মেম্বার। ২৯ মে ছিল তার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী।
আমাদের এ প্রিয় স্বদেশ যখন পরাধিনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ, স্বাধীনতা স্বপ্নে বিভোর বাঙ্গলীর স্বপ্নগুলো বুলেট-বেয়নে রক্তাক্ত হতে হতে বার বার মাথা তুলে সুর্যের দিকে মুখ করে ঘুরে দাঁড়াচ্ছিল, সেই ঘোর অমানিশার কালে বিপন্ন স্বদেশের স্বাধীনতার স্বপ্নে বিভোর হয়ে অনেকেই রাজপথে নেমে ছিলেন। তাদের একজন ছিলেন সৈয়দ আবু জাফর আহমদ। কেবল স্বাধীনতার স্বপ্নতেই আবদ্ধ ছিলেন না তিনি। তার মননে চেতনায় একদিকে স্বদেশের স্বাধীনতা অন্যদিকে মানুষের কল্যাণের মন্ত্র সমাজতন্ত্র। এ দুয়ে মগ্ন হয়েই অগ্নিঝরা রাজপথে লড়াই সংগ্রামে কাটিয়েছেন কৈশোর-যৌবন, আমৃত্যু।
মাটির মানুষ। মানুষের গুণ বাচক এক উপমা। এ উপমার অর্থটা কি? মাটির তৈরী মানুষ, মাটির মতো মানুষ নাকি মাটির কাছাকাছি থাকা মানুষ। সৈয়দ আবু জাফর আহমদের ক্ষেত্রে হয়তো শেষোক্তটিই প্রযোজ্য। যে মানুষগুলো মাটি কর্ষণ করে, যে মানুষগুলোর সুর্যালোকের তেজ থেকে শরীরের প্রয়োজনীয় মিটামিন ডি নিয়ে নিজের সক্ষমতাকে বাড়িয়ে সেই সূর্যের অতি বেগুনী রশ্মি আর চামড়া পোড়া তাপকে অগ্রাহ্য করে নিজের স্বপ্নের বীজ বুনে ফসলের মাঠে, তিনি সেসব মাটির মানুষদের বুকে ধারণ করেছিলেন। মাটি সংলগ্ন গা জ্বলা-পা ফাটা মানুষগুলো ছিলো তার অতি আপনজন। প্রান্তিক কৃষকের স্বপ্নের ফসল যখন মধ্যস্বত্ব ভোগীর ভাড়ারে গিয়ে উঠতো, কৃষক ফসলের নায্য মুল্য থেকে বঞ্চিত হতো, তখন তিনি চিৎকার করতেন। শ্রমিকের নায্য পাওনার জন্য বজ্রমুষ্টি আওয়াজ তোলতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন মানুষের উপর মানুষের শোষণ অব্যাহত রেখে প্রকৃত গণতন্ত্র, মানবতা ও মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। তিনি স্বপ্ন দেখতেন একটি ইনসাফ ভিত্তিক সমাজের, যেখানে কৃষক তার ফসলের নায্য মুল্য পাবে, শ্রমিক নায্য মজুরি পাবে, দিন মজুর কাজের নিশ্চয়তা পাবে আর বেকার পাচ্ছে চাকুরি। প্রান্তিক জনগোষ্টি অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের নিশ্চয়তা পাবে রাষ্টীয় পৃষ্টপোষকতায়। এজন্য তিনি আমৃত্যু লড়াই করে গেছেন। রাজনীতির দূর্বিত্তায়ণ ও বাণিজ্যায়নের বিরুদ্ধে কথা বলে গেছেন। সিপিবির ক্রান্তিকালে পার্টির আদর্শগত ভিত্তি, শ্রেণি চরিত্র ও শ্রেণি ভিত্তি পার্টির লক্ষ্য উদ্দেশ্য সমাজতন্ত্র -সাম্যবাদকে বিসর্জন দিয়ে সিপিবিতে বিলোপবাদীতার যে ঢেউ উঠেছিল সেই দূ:সময়ে যে ১৩ জন কমরেড সিপিবিকে মুল ধারায় ঠিকিয়ে রাখতে যে ভিন্ন মতের দলিল পেশ করেছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন সৈয়দ আবু জাফর আহমদ। তার অনন্য গুণাবলীর মধ্যে ছিল কর্মীকে বুঝার এবং কর্মীকে বুঝানোর ক্ষমতা। তিনি বলতেন কম, শুনতেন বেশী কিন্তু রাগ করতেন না। তিনি রাজনীতিতে সার্বক্ষণিক সময় ব্যয় করতেন কিন্তু রাজনীতির নামে ব্যবসা করতেন না। পরিবেশ পরিস্থিতি বিবেচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে তার তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণ ক্ষমতা সমষ্টিগত আন্দোলন সংগ্রামে নীতি-নির্ধারকের ভুমিকায় অধিষ্টিত করেছে বার বার। একাধিকবার দলীয় প্রতীক কাস্তে নিয়ে নির্বাচন করলেও ভোটের স্রোতে জায়গা হয়নি নীতিবান, আদর্শবান এ রাজনীতিকের। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তিনি নির্বাচনের বৈতরণী পার হতে চাননি কখনই। কিন্তু তিনি যখন মঞ্চে দাঁড়াতেন মানুষ তার কথা শুনতো মন্ত্রমুগ্ধের মতো। কারণ তিনি মানুষের কথা বলতেন, মানবিকতার কথা বলতেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধের কথা, অসাম্প্রদায়িকতার কথা যেমন বলতেন তেমনি গরিব কৃষক, শ্রমিক, দিন মজুরের নায্য দাবির কথা বলতেন। সমেবেত লোকজন মনে করতো এতো তারই কথা, তাদেরই দাবি একজন সৈয়দ আবু জাফরের মুখ দিয়ে উচ্চারিত হচ্ছে। কিন্তু স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে তার এ আওয়াজ একসময় বাতাসে মিলিয়ে যেত। মানুষ স্রোতের দিকেই ধাবিত হয় বিদ্যমান বাস্তবতায়।
রাজনীতি ছিল তার ধ্যান-জ্ঞান। তিনি রাজনীতিকে মানব সেবা হিসেবেই বিশ্বাস করতেন। তাই পেশা হিসাবে তিনি রাজনীতিকেই বেঁচে নিয়েছিলেন। কিন্তু এই পেশা হিসাবে রাজনীতি নিয়ে এক সময় বিপত্তিও ঘটে। সম্ভবত নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে প্রথম যখন ছবিসহ ভোটার আইডি কার্ড তৈরী করা হয় তখন নির্বাচন কমিশনের প্রেসক্রাইব ফর্মে পেশা হিসেবে রাজনীতি ছিল না। কিন্তু সৈয়দ আবু জাফর আহমদের দাবি রাজনীতি ছাড়া তার কোন পেশা নেই। তিনি মিথ্যা পেশা উল্লেখ করবেন না। তিনি ছিলেন সিদ্ধান্তে অনড়। পেশা হিসাবে রাজনীতিই লিখবেন। বিষয়টি নির্বাচন কমিশন পর্যন্ত গড়ায়। রাজনীতি করার নামে নিজের সুবিধার পাল্লা ভারি করতে চাননি কখনোই। মানুষের প্রতি, এই সমাজের প্রতি তার অফুরন্ত ভালোবাসা, নিখাদ কাদা-মাটিতে গড়া সাধারণ জীবন যাপন, ত্যাগ-তিতীক্ষা, দেশের জন্য, শ্রমজীবী মানুষের জন্য, সমাজতন্ত্র – সাম্যবাদের প্রতি প্রতিশ্রুতিশীল কর্মী ব্রিগেড গড়ে তোলার জন্য নিরলস শ্রম আর সততা তাকে তার কর্মের চেয়েও আনেক বেশি মহান করে তুলেছিল। একজন পরিচ্ছন্ন প্রতিশ্রুতিশীল আদর্শবান রাজনীতিকের চারিত্রিক গুণাবলী আমরা বার বার খোঁজে পেয়েছি সৈয়দ আবু জাফর আহমদের মাঝে। এক্ষেত্রে তিনি ছিলেন দ্যোতি ছড়ানো উজ্জল এক মানুষ। এ উজ্জলতা চারপাশের মানুষকে আলোকিত করতো মেধা ও মননে। এখানে রাজনীতি, দল-মত, জাতি বেধের কোন বালাই ছিল না। নীতিতে আটল এ রাজনীতিকের ঘনিষ্ট বিদগ্ধ জনের তালিকাও ছিল বহু মত-পথের সমৃদ্ধ গুণিজনে।
জন্ম ১৯৫৪ সালে মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জের রঘুনাথপুরে। লেখাপড়ার শুরুটা মৌলভীবাজার শহরে। মামা সৈয়দ মতিউর রহমান ছিলেন বাম রাজনীতিক। মামার প্রভাবে ভাগ্নে তখন ১৫ বছর বয়সে স্কুল জীবনেই পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন। উনসত্তোরের গণঅভ্যুত্থানে শ্লোগান ধরেন। ১৯৭০ সালে মৌলভীবাজার কলেজের ছাত্র সংসদের নির্বাচিত সাহিত্য সম্পাদক ও ১৯৭৩ সালে সাধারণ সম্পাদক (জিএস) নির্বাচিত হন। মহান মুক্তিযুদ্ধকালে ন্যাপ-কমিউনিস্টপার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের গ্যারিলা বাহিনী গঠনে সংগঠক হিসাবে এবং দেশের অভ্যন্তরে থেকে জীবন বাজী রেখে মুক্তিযোদ্ধাদের শত্রুর উপর আক্রমণে তথ্য উপাত্ত প্রদান এবং আক্রমণে তাদের সহযোগি শক্তি হিসাবে কাজ করেছেন মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ আবু জাফর আহমদ। তখন তিনি সবেমাত্র কলেজ ছাত্র ছিলেন। এদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে একজন সংগ্রামী মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ আবু জাফর আহমদ বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর মৌলভীবাজারে প্রতিবাদ করার অভিযোগে সামরিক শাসকের নির্দেশে সামরিক সরকারের বিশেষ নিরাপত্তা আইনে ডিটেনশনে ১৯৭৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে এক বছর সিলেট জেলে কারাবাস করেন। এ সময় তৎকালীন সরকারের উন্নয়ন কর্মকান্ডে যোগ দেওয়ার নানা প্রলোভনও তাকে তার আদর্শ থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। শাসকের কথা না শুনলে যা হয় তার অনেক কিছুই ঘটেছিল তাঁর ললাটে। এরই মধ্যে ফাাঁসির আসামিদের জন্য নির্ধারিত কনডেম সেলে রাখা হয়েছিল কিছু দিন। কিন্তু রাজনৈতিক আদর্শের প্রতি অবিচল সৈয়দ আবু জাফর আহমদকে আদর্শ চ্যুত করানো যায়নি। সৈয়দ আবু জাফর আহমদের আন্দোলন সংগ্রামের ইতিহাস তার জীবনের চেয়েও দীর্ঘ। একাধারে রাজনীতিক, সাংস্কৃতিক কর্মী, পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়ন, ছাত্র-যুব আন্দোলন, কৃষক আন্দোলন, চা শ্রমিকের নায্য অধিকার আদায়ের সংগ্রাম, দেশের সম্পদ তেল-গ্যাস প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষার আন্দোলন, স্থানীয় সমস্যা ভিত্তিক আন্দোলনে সন্ত্রাস, সাম্প্রদায়িকতা, যোদ্ধাপরাধিদের বিচারের দাবিতে আন্দোলন সর্বত্রই ছিলেন নেতৃত্বের আসনে। ২৯ মে ২০১৯ ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন সৈয়দ আবু জাফর আহমদ। ভাইরা তাঁর বৃটেন আর কানাডার বাসিন্দা। সেখানে গিয়ে অনায়াসে উন্নত দেশের চিকিৎসা নিতে পারতেন তিনি। কিন্তু দেশেই চিকিৎসা নেবেন- এটা ছিল তার জেদ। সোজা যুক্তি সাধারণ মানুষের যেখানে চিকিৎসা হয়, আমারও সেখানেই হবে। আমাদের নীতি নির্ধারক রাজনীতিকরা যদি সৈয়দ আবু জাফর আহমদের মতো দেশে চিকিৎসা নিয়ে আগে থেকে এভাবে চিন্তা করতেন, দেশে চিকিৎসা নিতে অভ্যস্থ থাকতেন, তাহলে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা আজ অনেক উন্নত হতো।
সৈয়দ আবু জাফর ছিলেন একজন স্বপ্নবাজ মানুষ। নিজের বিশ্বাস আর আদর্শে অবিচল থেকে দিনের পর দিন সে স্বপ্নকে অগণিত সারথির বুকে সঞ্চারিত করেছেন। রক্তে রক্তে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে সঞ্চারিত করেছে দিন বদলের সংগ্রামের ঘুম তাড়ানো এ স্বপ্নকে। যে স্বপ্ন ঘুমিয়ে নয়, জেগে জেগেই দেখতে হয়। দেখছে সমাজ বদলের সৈনিকেরা। রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ লিখেছিলেন, দ্বন্ধময় সভ্যতার গতিশীল শ্রুতের ধারায় আগামীর স্বপ্নে মুগ্ধ বুনে যাবো সমতার বীজ। এমনই এক বীজ বুননের চাষি সৈয়দ আবু জাফর আহমদ। অগণিত স্বপ্ন সারথিদের মাঝে সমতার বীজ বুনার স্বপ্ন ছড়িয়ে মানুষকে মনুষত্ব বিকাশের মধ্যদিয়ে মানুষ পরিচয় ধারণ করার মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করে গেছেন। উদ্বুদ্ধ করেছেন, কৃষক শ্রমিক মেহনতি জনতার মুক্তি, অসাম্প্রদায়িক শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থা নির্মাণের মিছিলে সামিল হওয়ার। ২৯ মে ২০২০ তাঁর প্রথম মৃত্যু বার্ষিকীতে শতত শ্রদ্ধা।
আনোয়ারুল ইসলাম জাবেদ
আইনজীবী ও সংবাদকর্মী।
সম্পাদক : সৈয়দ আমিরুজ্জামান
ইমেইল : rpnewsbd@gmail.com
মোবাইল +8801716599589
৩১/এফ, তোপখানা রোড, ঢাকা-১০০০।
© RP News 24.com 2013-2020
Design and developed by M-W-D