সিলেট ৯ই জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২৫শে পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ২:২৫ অপরাহ্ণ, জুন ১, ২০২০
জিয়াউল হক জিয়া, মন্ট্রিয়ল (কানাডা), ০১ জুন ২০২০ : শহীদ জামিল আকতার রতন বাংলাদেশ ছাত্রমৈত্রী রাজশাহী মেডিকেল কলেজ শাখার সাবেক সভাপতি। ১৯৮৮ সনের ৩১ মে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ ক্যাম্পাসে অধ্যক্ষ ও শিক্ষকদের সামনে প্রকাশ্য দিবালোকে জামাত শিবিরের একদল খুনী তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। মধ্যযুগীয় বর্বরতাকে হার মানায় সেই হত্যাকান্ড। তার দুই হাত ও দুই পায়ের রগ প্রথমে কাটে তারপর কিরিচ ও রামদা দিয়ে তার বুকে পেটে উপুর্যপরি আঘাতের মাধ্যমে তার দেহ এফোড় ওফোড় করা হয়েছিল। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রমৈত্রীতে খুবই সক্রিয়। ছাত্রমৈত্রীর কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে যে পোস্টার ও লিফলেট প্রথমে নীলক্ষেত বাবুপুরা দলীয় কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের পাশের প্রেস থেকে তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক নূর আহমদ বকুল ও দপ্তর সম্পাদক আতাউর রহমান আতা দ্রুত প্রকাশ করে তা গোটা দেশে বিতরণ করেছিল, সেই প্রথম লিফলেট ও পোস্টারটি করা হয়েছিল শহীদ জামিলের হাত, পা ও পেট কাটা লাশের ও স্যুট পরিহিত ছবি দিয়ে। শ্লোগান ছিল ‘ঘুমাও শান্তিতে জামিল, আমরা জেগে আছি অবিচল’। শহীদ জামিলের মৃত্যুতে গোটা দেশে জামাত-শিবির বিরোধী ছাত্র-যুব-শ্রমিক ও অন্যান্য শ্রেণী পেশার মানুষ সহ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সকল দলগুলো বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিল। সেদিন ঐ বিক্ষোভ দাবানলে রূপ নিয়েছিল সমগ্র দেশে। কেন্দ্রীয় পর্যায়ে তাৎক্ষনিকভাবে ছাত্রমৈত্রী এবং ছাত্রলীগ, জাসদ ছাত্রলীগ, ছাত্রইউনিয়ন, ছাত্রফ্রন্ট সহ ১৬টি সংগঠনের কেন্দ্রীয় প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয় জিপিও সংলগ্ন জাসদ কার্যালযের সামনে। ছাত্রমৈত্রীর তৎকালীন সভাপতি জহির উদ্দীন স্বপন ছিল সেই সভার সভাপতি।
১৯৮৮ সনের এপ্রিলে যখন জেনারেল এরশাদ সংসদে সংবিধানে ৮ম সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্র ধর্ম বিল ইসলাম ‘The Religion of the republic is Islam, but other religions may be practiced in peace and harmony’ নিয়ে আসে তখন দেশব্যাপী এই সাম্প্রদায়িক বিলের বিরুদ্ধে প্রগতিশীল সংগঠনগুলো প্রতিবাদ করে। তখন দেশের জনগোষ্ঠীর ১১% তথা প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ ছিল হিন্দু জনগোষ্ঠী, তাদেরকে দ্বিজাতিতত্ত্বের সেই পুরান ফটকে আটকে কার্যতঃ বাংলাদেশে অধিকারবিহীন সংখ্যালঘু নাগরিক হিসেবে বেঁচে থাকার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেয়া হয় ইসলামকে রাষ্ট্রের একমাত্র ধর্ম স্বীকৃতি দেয়ার মাধ্যমে ।
মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের ’৭২ এর সংবিধানের চারমূলনীতির একটি ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা, তাকে গলাটিপে হত্যা করাই ছিল এই রাষ্ট্র ধর্ম বিলের মূল উদ্দেশ্য। আমরা ছাত্রসমাজ সেদিন গোটা দেশে ব্যাপক আন্দোলনের সূচনা করেছিলাম। সাম্প্রদায়িকতা ও স্বৈরাচারের চরিত্র ‘এক ও অভিন্ন’ এই মন্ত্রকে ধারণ করে যে লড়াই করেছিলাম সেই লড়াইয়ের তীব্রতায় জামাত-শিবিরের ভিত কেঁপে উঠেছিল। শহীদ জামিল ছিল সেই আন্দোলনের অন্যতম এক যোদ্ধা। আর সেই নিরস্ত্র কিন্তু আদর্শে বলীয়ান অসীম সাহসী যোদ্ধাকে হায়েনার দল খুন করে নৃশংসভাবে। জামিল হত্যার ৭ দিন পরেই ৭ জুন ১৯৮৮ সনে জেনারেল এরশাদ সংবিধানে ৮ম সংশোধনী এনে রাষ্ট্রধর্ম বিলটি ২৫৪-০ ভোটে পাশ করে আর তখন থেকে এই আইন আজও সংবিধানে বহাল।
শহীদ জামিলকে হত্যার পূর্বে এবং পরে জামাত-শিবিরের খুনিরা আওয়ামী ছাত্রলীগ, জাসদ ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়নেরও বেশ কয়েকজন নেতাকে দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে খুন করে।
আমি ছাত্রমৈত্রীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও পরবর্তীতে কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন কালের শেষ অবধি শিবিরের হাতে ছাত্রমৈত্রীর চারজন বীর জামিল, ফারুক, রিমু ও রূপমকে হত্যার প্রতিবাদের আন্দোলনে সরাসরি যোগদান ও নেতৃত্ব দেয়া আমার সৌভাগ্য হয়েছিল। শহীদ জামিল আকতার রতনের বাবা ইঞ্জিনিয়ার খাজা আহমেদ ছিলেন টিএন্ডটি ঢাকার চীফ ইঞ্জিনিয়ার এবং তাদের বাড়ী ছিল মীরপুরের গাবতলী সংলগ্ন শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতি সৌধের রাস্তায়। ১৯৮৭ সনের ১০ নভেম্বর স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী উত্তাল আন্দোলনের সময় রাজশাহীর শিক্ষা প্রাতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে জামিল সেই সময় তার ঢাকার বাসায় অবস্থান করছিল। নভেম্বরে ঐ আন্দোলনের সময় সে আমাদের পল্টন বিজয় নগরে তৎকালীন বিপ্লবী ছাত্রমৈত্রীর কেন্দ্রীয় অফিসে এসেছিল নেতাদের সাথে সাক্ষাৎ করতে। তখন তার সাথে আমার অনেক কথা হয়। সেদিন ভাবিনি জামিলের সাথে আর কখনো দেখা হবে না। ১৯৯০এর ২২ ডিসেম্বর চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রমৈত্রীর সহ সভাপতি ফারুকুজ্জামান ফারুককে শিবির ক্যাম্পাসে হত্যা করে। ১৯৯৩ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রমৈত্রী নেতা জুবাযের চৌধুরী রিমুকে হত্যা এবং সর্বশেষ হত্যাকান্ডটি ঘটায় একই ক্যাম্পাস শাখার সহ সভাপতি দেবাশীষ ভট্টাচার্য রূপমকে ১৯৯৫ সনের ১৩ ফেব্রুয়ারীর রাতে। রুপম হত্যার খবর পেয়ে ঐ রাতেই ঢাকা থেকে রওয়ানা দিয়ে প্রত্যুষে রূপমের বাড়ি পাবনাতে যাই। সেখানে দেখেছিলাম রূপমের মেরুদন্ড খন্ডিত বিকৃত লাশ।
জামাত-শিবির বিরোধী আন্দোলনে ছাত্রমৈত্রীর এই চারজন বীরের আত্মদানের মধ্য দিয়ে মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িক অপশক্তি বিরোধী যে আন্দোলনের উত্তাপ সৃষ্টি হয়েছিল দেশব্যাপী, সেই উত্তাপে জীবনের চলার প্রতিটি পাতায় আমরা ছাত্রমৈত্রীর সৈনিকেরা ছিলাম সব সময়ের জন্য উত্তপ্ত এবং উদ্দীপ্ত। এই উত্তাপ ছিল শ্লোগানে, মিছিলে এবং রাজপথে। কোন শৈত্য প্রবাহ আমাদের উত্তাপকে শীতল করতে পারেনি। শহীদ জামিলের মত জামাত-শিবির বিরোধী সকল শহীদের লাল রক্তের স্রোতধারায় আমরা উজান টেনেছি একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন প্রতিষ্ঠার জন্য। স্বাভাবিক নিয়মেই আমি বিদায় নিয়েছি শহীদ জামিলের প্রিয় সংগঠন থেকে। কিন্তু তার ও আমাদের সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে পারিনি। আমার পূর্ব ও উত্তরসূরী অনেক ছাত্রনেতা জীবন বাজি রেখে লড়াই করেছে এবং এখনও করছে সেই শ্লোগানকে বুকে ধারণ করে। কিন্তু জামিলের সেই স্বপ্ন, ’৭২ এর সংবিধানের মূল চরিত্র ধর্মনিরক্ষেতায় ফিরে যাওয়া এবং ৮ম সংশোধনী বাতিল করা এখনও সম্ভব হয়নি। জামাত-শিবিরের নিবন্ধন বাতিল হলেও বাংলাদেশে অন্যান্য রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক ইসলামিক মৌলবাদী দলগুলোর লেবাসে এই অপশক্তির শেকড় বিস্তৃত হচ্ছে সর্বত্র। এখন রাষ্ট্র থেকে পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে মৌলবাদীরা এবং সমাজ সংস্কৃতির রন্ধ্রে রন্ধ্রে রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের মূল মন্ত্র গ্রোথিত। এটি আজ আর নাম সর্বস্ব রাষ্ট্র ধর্ম নয়, এ যেন একটা সংগ্রামী জাতির জাতীয় বিশ্বাসে রূপ নিচ্ছে প্রতিনিয়ত। রাষ্ট্র সংসারের কর্তা ব্যক্তিদের মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি ও সাম্প্রদায়িক শক্তি বিরোধী কিছু কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ তাদের আপততঃ দমন করতে সক্ষম হলেও অন্যান্য মৌলবাদীদের পৃষ্ঠপোষকতা করার কারণে অবদমিত জামাত জেহাদী রূপ নিয়ে হয়তো জেগে উঠবে একদিন। সেদিন আমাদের ভুলের কারণে এই রাষ্ট্রের হাল বর্তমান রাষ্ট্র নায়করা আর ধরে রাখতে পারবে কিনা সন্দেহ। তাই দেশ ও জাতি বাঁচাতে হলে ধর্মীয় রাজনীতির সামাজিকীকরন বন্ধ করতে হবে। মৌলবাদীর শেকড় উপড়ে ফেলতে হবে। রাষ্ট্রকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে ’৭২ এর সংবিধানের মূল ধারায়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন আর মৌলবাদ- সাম্প্রদায়িকতা তোষনের রাজনীতি একসাথে চললে অপশক্তিই কালসাপ হয়ে ফিরে আসবে একদিন। এটিই হচ্ছে রাজনীতির সরল সমীকরণ। শহীদ জামিলের ৩২তম মৃত্যুবার্ষিকীতে তার প্রতি আমার জীবনের সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা ও সালাম। তার আত্মদানের সিঁড়ি বেয়ে এই সংগঠনের সর্বোচ্চ দায়িত্ব পালনের একজন গর্বিত সৈনিক হিসেবে বলতে চাই জামিলের খুনী ও তাদের প্রেতাত্মাদের রক্তচক্ষু কোনদিন আমাদের ভীত সন্ত্রস্ত করতে পারেনি। পারেনি জামিলের লালিত স্বপ্নের ভিত কাঁপাতেও। আজও আছি সেই ধারায়, থাকবো শেষ অবধি। ঘুমাও শান্তিতে জামিল, আমরা জেগে আছি অবিচল।
জিয়াউল হক জিয়া
সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি
বাংলাদেশ ছাত্রমৈত্রী
৩১ মে, ২০২০, মন্ট্রিয়ল
সম্পাদক : সৈয়দ আমিরুজ্জামান
ইমেইল : rpnewsbd@gmail.com
মোবাইল +8801716599589
৩১/এফ, তোপখানা রোড, ঢাকা-১০০০।
© RP News 24.com 2013-2020
Design and developed by M-W-D