সিলেট ৯ই জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ২৫শে পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ২:১৮ অপরাহ্ণ, জুন ৪, ২০২০
আমিনুর রশীদ কাদেরী , ০৪ জুন ২০২০ : আজ ৪ঠা জুন। চা শিল্পের জন্য একটি ঐতিহাসিক দিন। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, মহান নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫৪ সালে পাকিস্তান সরকারের প্রাদেশিক বাণিজ্য শ্রম ও শিল্প মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রীর দায়িত্ব প্রাপ্ত হন। তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকারের স্মারক নং-৩৩৫/৯১৩/৫৬ সিপি তারিখ ৪ জুন, ১৯৫৭ খ্রিঃ মূলে বঙ্গবন্ধুকে চা বোর্ডের চেয়ারম্যান পদে মনোনীত করা হয়। তিনি ৪ জুন, ১৯৫৭ খ্রিঃ থেকে ২৩ অক্টোবর, ১৯৫৮ খ্রিঃ পর্যন্ত চা বোর্ডের চেয়ারম্যান পদে দায়িত্ব পালন করেন। তার আগে চা বোর্ড চেয়ারম্যান ছিলেন বিশিষ্ট শিল্পপতি জনাব এম এম ইসপাহানী। চা বোর্ডের চেয়ারম্যান পদে দায়িত্বে থাকাকালীন তিনি লক্ষ করলেন যে, এদেশের চা বাগানগুলো অবহেলিত। তখন চা বাগানের মাটি পরীক্ষা, পোকামাকড় ও রোগদমন, উপদেশমূলক পরামর্শ ইত্যাদি গবেষণামূলক কাজ ভারতের টোকলাই টি রিসার্চ স্টেশনের সহায়তা নেয়া হতো। এরূপ পরনির্ভরশীলতা বঙ্গবন্ধুর বিবেককে নাড়া দেয়। তিনি এদেশে একটি চা গবেষণা কেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তাঁর অকান্ত পরিশ্রম ও প্রচেষ্টায় ১৯৫৭ সালে মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গলে মনোরম পরিবেশে চা গবেষণা স্টেশন (টিআরএস) প্রতিষ্ঠিত করেন। বঙ্গবন্ধুর প্রচেষ্টায় এই প্রতিষ্ঠানটির গবেষণা কার্যক্রমে দ্রুত গতি লাভ করে। ১৯৫৮ সালে তিন জন সিনিয়র সায়েন্টিফিক অফিসার এবং কিছুসংখ্যক সহযোগী স্টাফ নিয়োগের মাধ্যম বঙ্গবন্ধুই এদেশের চা শিল্পের গবেষণা কাজে গতিশীলতা আনয়ন করেন। বিজ্ঞানীদের স্বাাধীনভাবে গবেষণা করার সুবিধা তিনিই করে দেন। বঙ্গবন্ধু গবেষণাকে খুবই গুরুত্ব দিতেন এবং গবেষণার সুবিধার্থে তাঁরই আমলে একটি লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করা হয়। এছাড়া ভারত, সিংহল, পূর্ব আফ্রিকা এবং যুক্তরাজ্য থেকে দুর্লভ প্রকাশনা সংগ্রহ করে লাইব্রেরিটিকে সমৃদ্ধ করেন। বঙ্গবন্ধু রিসার্চ কমিটির নাম পরিবর্তন করে প্রোডাকশন এন্ড রিসার্চ কমিটি নামকরণ করেন এবং গবেষণা কাজে আরো গতিশীলতা আনয়ন করেন। তাঁরই নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হলে তিনি এদেশের রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত হন। তাঁর নিজ হাতে গড়া এ গবেষণা প্রতিষ্ঠানটির কথা তিনি ভুলে যাননি। যুদ্ধ বিধ্ধস্ত এদেশের ক্ষতিগ্রস্ত চা বাগানগুলো পুনঃগঠনের জন্যে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। দেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৭৩ সালে চা গবেষণা স্টেশনটির নাম পরিবর্তন করে বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিটিআরআই) নামকরণ করেন। বর্তমানে এ প্রতিষ্ঠানটি আটটি গবেষণা বিভাগ এবং চারটি উপকেন্দ্র নিয়ে ১৬৪ টি চা বাগান (তথ্য: চা বোর্ডের সূত্রানুযায়ী) ও অসংখ্য ক্ষুদ্র চা বাগানের মাটির রাসায়নিক পরীক্ষা, রোগবালাই নির্ণয়, পোকামাকড় দমন, উপদেশমূলক পরামর্শ, ক্লোন আবিষ্কার, প্রশিক্ষণ, টি টেস্টিং, উন্নত জাতের বীজ ও কাটিং সরবরাহ, চা উৎপাদনে উপদেশমূলক পরামর্শে চা শিল্পে গতিশীলতা এনেছে। চা বোর্ডের চেয়ারম্যান হওয়ার পর গবেষণাকে তিনি সর্বোচ্চ গুরচত্ব দেন এবং চা শিল্পের প্রতি তাঁর সরাসরি নির্দেশনায় চা শিল্পের উপর ব্যাপক গবেষণার কার্যক্রম শুরু হয়। এরই ধারাবাহিকতায় এ পর্যন্ত ২০টি উন্নত জাতের ক্লোন এবং গুণগত মানসম্পন্ন ৪টি বাইক্লোনাল ও ১টি পলিক্লোনাল বীজজাত উদ্ভাবন করা হয়েছে ; যা রোপণের মাধ্যমে চা সমপ্রসারণ আবাদে ব্যাপক সফলতা এসেছে। বঙ্গবন্ধু ছিলেন চা শ্রমিকদের নিকট একজন প্রাণ প্রিয় ব্যক্তিত্ব। এদেশের চা শ্রমিকরা ছিল অবহেলিত, বঞ্চিত। তিনি লক্ষ করলেন, এদের কোন ভোটাধিকার নেই। এটি তাঁর মনে খুবই কষ্ট দেয়। তিনিই ১৯৭৩ সালে জাতীয় নির্বাচনে প্রথম ভোটাধিকার প্রদান করার মাধ্যমে চা শ্রমিকদের নাগরিকত্ব প্রদান করেন। তিনি চা শ্রমিকদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও চিকিৎসার বিষয়ে ছিলেন নিবেদিত প্রাণ। প্রতিটি বাগানে বাধ্যতামূলকভাবে চিকিৎসাকেন্দ্রে স্থাপন, চিকিৎসক নিয়োগ, বিশুদ্ধ পানীয় জলের ব্যবস্থা, পয়ঃনিষ্কাশন এর সুবিধা, বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা ইত্যাদি বিষয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তাইতো চা শ্রমিকরা আজও তাঁকে স্মরণ করে শ্রদ্ধার সঙ্গে এবং হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছে আপন করে। চা বোর্ডের চেয়ারম্যান থাকাকালীন অনেক চা বাগানের স্বত্বাধিকারী, প্লান্টার্স, ম্যানেজার, এমন কি চা শ্রমিকদের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত সুসম্পর্ক গড়ে উঠে। ফলে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় চা বাগানের স্বত্বাধিকারী, ম্যানেজার ও চা শ্রমিকগণ মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভবে অংশ নেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধে ই.পি.আর এবং মুক্তিযোদ্ধারা কৌশলগত কারণে বিভিন্ন চা বাগানে আশ্রয় নেয়। চা বাগান শ্রমিকরা পাকিস্তান বিরোধী প্রতিরোধ গড়ে তোলে। নিজেদের পারিবারিক নিরাপত্তা ও আর্থিক অসচ্ছলতা সত্ত্বেও ই.পি.আর সদস্য এবং মুক্তিবাহিনীর আশ্রয় পানাহাররের ব্যবস্থা করার মত দুঃসাহসিক কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন। এতে প্রতিশোধ সপৃহায় উন্মত্ত পাক সেনারা চা শ্রমিকদের উপর নির্যাতন নিপীড়ন ও বর্বরোচিত আচরণ করে। বোমা মেরে আগুন জ্বালিয়ে শ্রমিকদের আবাসিক কলোনী, কারখানা, বাংলো, অফিস ও বাগানের আবাদি এলাকা ধ্বংস করে দেয়। চা গাছের সবুজ কুঁড়ি আগুনে ঝলসে যায়। শ্রমিকদের অনেকে গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারায়। বাঙালি ম্যানেজার, কর্মকর্তা বন্দি হয়ে নির্যাতনের শিকার হন। চোখের সামনে আত্মীয় পরিজনদের অপহরণ লুটপাট ও বেয়নেটের আঘাতে আঘাতে রক্তপাতে মানুষের হাহাকারে ক্য্যামেলিয়ার সবুজ রাজ্য শ্মশানে পরিণত হয়। ১৬ ডিসেম্বর দেশ মুক্ত হয়। মরতে মরতে বেঁচে যাওয়া ক্ষত বিক্ষত মানুষেরা আবারো থমকে দাঁড়ায়। ঝলসে যাওয়া পুড়ে যাওয়া শতবর্ষজীবী ক্য্যামেলিয়ার বুকে আবারো নতুন কুঁড়ি গজায়।
১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় আমাদের দেশে চা বাগানগুলো প্রায় বিধ্বস্ত হয়ে যায়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই শিল্পকে টেকসই খাতের উপর দাঁড় করানোর জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তিনি চা বাগানে নগদ ভর্তুকি ও ভর্তুকি মূল্যে সার সরবরাহ করেন। চা কারখানাগুলোর পুনর্বাসনের জন্য ইন্ডাস্ট্রিয়াল ব্যাংক অব ইন্ডিয়া থেকে অর্থ ঋণ নিয়ে চা শিল্পের জন্য যন্ত্রপাতি আমদানি করেন। তিনি বাগানের মালিকদের ১০০ বিঘা পর্যন্ত জমির মালিকানা সংরক্ষণের অনুমতি দেন। সুষ্ঠুভাবে চা বাগান পরিচালনার জন্য অধিগ্রহনকৃত বাঙালি মালিকানাধীন চা বাগানসমূহ স্ব স্ব মালিকানায় ফিরিয়ে দেন। বাংলাদেশ চা বোর্ড কর্তৃক উন্নয়নের পথনকশা : বাংলাদেশ চা শিল্প শিরোনামে একটি মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়েছে; যা চা শিল্পকে ভবিষ্যতে দেশের একটি গুরচত্বপূর্ণ স্থানে পৌঁছাতে কার্যকরী ভূমিকা পালন করবে। বাংলাদেশের চা শিল্পের উন্নয়নের জন্য গৃহীত সরকারের এই কৌশলগত মহাপরিল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ২০২৫ সালের মধ্যে দেশে চায়ের উৎপাদন ১৪০ মিলিয়ন কেজিতে উন্নীত করার পাশাপাশি চা চাষ সম্প্রসারণ, চা শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়ন এবং চা শিল্পকে একটি টেকসই ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠার কর্মসূচি ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। এ ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে আগামীতে আমাদেরকে চা আমদানি করতে হবে না বরং নতুন করে আবার রপ্তানির ক্ষেত্র তৈরি হবে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চা শিল্পকে নিয়ে যে স্বপ্ন দেখতেন তা সার্থক হবে এবং গড়ে উঠবে সোনার বাংলাদেশ।
লেখক : চা গবেষক, প্রাবন্ধিক
সম্পাদক : সৈয়দ আমিরুজ্জামান
ইমেইল : rpnewsbd@gmail.com
মোবাইল +8801716599589
৩১/এফ, তোপখানা রোড, ঢাকা-১০০০।
© RP News 24.com 2013-2020
Design and developed by M-W-D