শহীদ ওমর ফারুক দিবস অাজ: “একাত্তরের সেই মৃত্যুঞ্জয়ীদের চরণ চুমি”

প্রকাশিত: ৫:০৫ পূর্বাহ্ণ, জুন ৪, ২০২০

শহীদ ওমর ফারুক দিবস অাজ: “একাত্তরের সেই মৃত্যুঞ্জয়ীদের চরণ চুমি”

পিরোজপুর, ০৪ জুন ২০২০: আজ ৪ঠা জুন, শহীদ ওমর ফারুকের মৃত্যু দিবস। “সেই মৃত্যুঞ্জয়ীদের চরণ চুমি”।

পিরোজপুরে ২৩ মার্চ ১৯৭১ প্রথম স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়িয়েছিলেন শহীদ ওমর ফারুক।
স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াস গ্রুপের এই ছাত্রনেতা ছিলেন পিরোজপুরে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক। আর এই অভিযোগেই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে ধরা পড়ার পর একটি রডের এক মাথায় সেই পতাকা বেঁধে আরেক মাথা হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় তার মাথায়। এমন নির্মমভাবে হত্যার পরেও দমেনি পাকিস্তানি হানাদাররা। অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের শিক্ষা দিতে তার দেহ ৩ দিন গাছের সঙ্গে লটকে রাখা হয়।

২৯ মে ১৯৭১ সকাল ৬ টায় বাউলাকান্দা ফেরার পথে এক সময়ে পিরোজপুরে কর্মরত পুলিশ সদস্য হানিফ তাকে চিনে ফেল এবং লঞ্চ থেকে তাকে নামিয়ে নিয়ে যায় আলবদরদের সহায়তায়। সেই সময় ওমর ফারুকের সাথে ছিলেন তার ছোট ভাই মুক্তিযোদ্ধা লুৎফর রহমান বাবুল (বর্তমানে অবসর প্রাপ্ত উপ পরিচালক পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর) ভাইয়ের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। ওমর ফারুক আর ফিরে না আসলে ওখান থেকে ফিরে গিয়ে তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। জানা যায় প্রথমে ওমর ফারুককে বরিশাল কোতোয়ালী থানায় নিয়ে যায়। পরদিন (৩০মে ১৯৭১) তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় বরিশাল ৩০ গোডাউনের টর্চার সেলে।

৭১ এর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সভাপতি (১৯৭৬-৭৭ সন) নূরদিদা খালেদ রবি শহীদ ফারুক সম্পর্কে জানান, পিরোজপুর শহরের তৎকালীন টাউন হল (বর্তমানে স্বাধীনতা মঞ্চ) মাঠে শহীদ মিনারের সামনে ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ওমর ফারুক প্রথম উত্তোলন করেন স্বাধীন বাংলার পতাকা। এরপর তিনি ছাত্রদের সংগঠিত করে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকেন।

নূরদিদা খালেদ রবি বলেন, ‘১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ বিকালে টাউন ক্লাব মাঠে সংগ্রাম পরিষদের জনসভা হয়। সভায় সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক তৎকালীন এমএনএ অ্যাডভোকেট এনায়েত হোসেন খান, ডা. আ. হাই এমপিএ, ডা. ক্ষিতিশ চন্দ্র মণ্ডল এমপিএ, আজিজুর রহমান হামদু শিকদার, অ্যাডভোকেট আলী হায়দার খান, এম.এ মান্নান, পিরোজপুর-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও পিরোজপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আলহাজ একেএমএ আউয়াল, ওমর ফারুক, ছালাম সিকদার ও আমি (নূরদিদা খালেদ রবি) বক্তব্য দেই।

এডভোকেট এম এ মান্নান (প্রয়াত) বলেন, রাজাকারদের হাতে ধরা পরার পর ‘সহযোদ্ধাদের নাম এবং অবস্থান জানার জন্য তার ওপর চালানো হয় অমানুষিক নির্যাতন। কিন্তু ওমর ফারুক হানাদার বাহিনীর নির্যাতনের কাছে হার মানেননি। তাকে বলা হয় যদি তিনি ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ বলেন তাহলে তাকে ছেড়ে দেওয়া হবে। কিন্তু ওমর ফারুক মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে অত্যাচার সহ্য করে চিৎকার করে বলেন ‘জয় বাংলা’।
পিরোজপুর জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ডেপুটি কমান্ডার (অর্থ) শহীদুল আলম মন্টু বলেন, ‘ওই নির্যাতন কক্ষে আটক থাকা মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হক স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে জানান, ১৯৭১ সালের ৪ জুন হানাদার বাহিনী ওমর ফারুকের সঙ্গে থাকা ব্যাগ খুলে তল্লাশি চালিয়ে খুঁজে পায় ৭টি স্বাধীন বাংলার পতাকা। এ কারণে পাকিস্তানি বাহিনীর নির্দেশে রাজাকাররা লোহার রডের সঙ্গে স্বাধীন বাংলার পতাকা বেঁধে তা ওমর ফারুকের মাথার মধ্যে হাতুড়ি পেটা করে ঢুকিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে। এরপর বরিশালের টর্চার সেলে আটক থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের শিক্ষা দিতে ৩ দিন গাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখে শহীদ ওমর ফারুকের লাশ।’

শহীদ ওমর ফারুকের বোন পিরোজপুর মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক সালমা রহমান হ্যাপী আমাকে বলেন, ভাইয়ের এই নির্মম মৃত্যুর কথা আমরা প্রথম শুনেছি বঙ্গবন্ধুর মুখে, ১৯৭৩ এ পিরোজপুরের জনসভায়। ‘আমার মা সুস্থ থাকার সময় তিনি কোনওদিন আমাদের ঘরের দরজা বন্ধ করতে দিতেন না, বলতেন, দরজা খুলে রাখ, ফারুক এসে ডাক দিবে। আর দরজা বন্ধ দেখলে সে কষ্ট পাবে।’

হ্যাপী আরও বলেন, ‘মায়ের নির্দেশে আমরা ভাইয়ের জন্য প্রতি বেলাতেই দু’মুঠো ভাত বেশি রান্না করতাম। মা বলত ফারুক কখন এসে বলে, মা ভাত দাও।

হ্যাপী আরো জানান,” সরকারি অনুদানে শহীদ ওমর ফারুকের উপর একটি চলচ্চিত্র নির্মাণের কাজ চলছে, কিন্তু অজ্ঞাত কারণে তা থেমে আছে”। চলচ্চিত্রটি মুক্তি পেলে ইতিহাস বিচ্যুত এই জাতি মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগকে ভুলে গিয়ে যে পাষন্ড জাতিতে পরিনত হয়েছে, তা হয়তো হতো না।
অনুমোদন হওয়া সত্বেও পিরোজপুর স্টেডিয়ামের নামকরণ এখনো শহীদ ওমর ফারুকের নামে করা হয়নি। কেবল পিরোজপুর সদর রাস্তার নাম “শহীদ ওমর ফারুক সড়ক”।

বই’এর পাতায় ত্রিশ লক্ষ শহীদের প্রাণের যে আকুতি চাপা পড়ে আছে, তাকে অলক্ষ্যে রেখে আমরা কোনোদিন সুস্থ্য জাতি গঠনের সঠিক ঠিকানায় পৌঁছতে পারবো না।

বাংলাদেশ, শহীদ ওমর ফারুকের রক্তের ঋণ শোধ করুক……..

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ