অাতঙ্ক ছড়ানো গুলশান হামলার ৪ বছর

প্রকাশিত: ৫:১৮ পূর্বাহ্ণ, জুলাই ১, ২০২০

অাতঙ্ক ছড়ানো গুলশান হামলার ৪ বছর

ঢাকা, ০১ জুলাই ২০২০: আফগানিস্তান, পাকিস্তান, তুরস্ক, ইরাক, সিরিয়ায় বহু প্রাণ কেড়ে নেওয়া জঙ্গি হামলার খবরে শিহরিত হওয়া বাঙালির কাছে একই ধরনের নৃশংসতা সীমাহীন আতঙ্ক নিয়ে এসেছিল চার বছর আগের এই রাতে।

২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে ঢাকার কূটনৈতিকপাড়া গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে নজিরবিহীন ওই জঙ্গি হামলা সাধারণের মতো চমকে দিয়েছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও।

সন্ত্রাস, ছিনতাই, চুরি, ডাকাতি ও বিছিন্ন জঙ্গি হামলার মতো ঘটনা মোকাবেলা করে অভ্যস্ত পুলিশ- র‌্যাবকে ওই প্রথম জঙ্গিদের সরাসরি মোকাবেলার পরীক্ষায় পড়তে হয়। জঙ্গি-সন্ত্রাসবাদ দমনে মাত্র চার মাস আগে গঠন করা ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের সদস্যরাও এই হামলা সম্পর্কে প্রথমে বুঝতেই পারেননি।

তবে সেদিনের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে পরবর্তীতে পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটে জঙ্গি দমনে বিশেষ সেল গঠন করার পাশপাশি ২০১৯ সালের ১৯ নভেম্বর সারা দেশের জন্য এন্টি টেররিজম ইউনিট নামে পৃথক একটি ইউনিট গঠন করা হয়। র‌্যাবেও রয়েছে জঙ্গি নিয়ে কাজ করার পৃথক সেল। কার্যত ওই জঙ্গি হামলা বাংলাদেশকে বদলে দেয় অনেকখানি।

হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার পর গুলশান থানার পরিদর্শকের (তদন্ত) দায়িত্বে ছিলেন বর্তমানে মিরপুরের শাহ আলী থানার ওসি সালাউদ্দিন মিয়া। ঘটনার পর থেকে শেষ পর্যন্ত এই কর্মকর্তা আদ্যোপান্ত রেকর্ড করে রেখেছেন থানার নথিতে।

চার বছর পর মঙ্গলবার তিনি বলেন, “এ ধরনের জঙ্গি হামলা হতে পারে সে সময় পুলিশ বা অন্য কারও ধারণা ছিল না। বা কেউ প্রস্তুত ছিলেন না। সময়ের সাথে সাথে এখন অনেক কিছুর পরিবর্তন এসেছে। জঙ্গিরা পরিকল্পনা করার আগেই ধরা পড়ছে।

“হলি আর্টিজানের পর বিভিন্ন স্থানে জঙ্গিবিরোধী অভিযান সফলভাবেই সম্পন্ন করেছে সিটিটিসি বা এন্টি টেররিজম ইউনিট (এটিইউ)।”

হলি আর্টিজান বেকারির চারপাশে ঘেরা নিরাপত্তা বেষ্টনির বাইরে ২ জুলাই দুপুরে দেখা যায় উদ্বিগ্ন এক জাপানি নারীকে। আগের রাতের হামলায় নিহতদের মধ্যে সাতজন ছিলেন জাপানি।
হলি আর্টিজান বেকারির চারপাশে ঘেরা নিরাপত্তা বেষ্টনির বাইরে ২ জুলাই দুপুরে দেখা যায় উদ্বিগ্ন এক জাপানি নারীকে। আগের রাতের হামলায় নিহতদের মধ্যে সাতজন ছিলেন জাপানি।

হলি আর্টিজান বেকারিতে বাবুর্চির সহকারী ছিলেন কিশোর জাকির হোসেন শাওন। ঘটনার পর তাকে বেকারির কাছ থেকে রক্তাক্ত অবস্থায় গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান ছেলেটি।

তার বোন সোনিয়া বলেন, তার ভাইকে জঙ্গি হিসাবে গ্রেপ্তার করা হলেও পুলিশ ‘প্রমাণ করতে পারেনি’। কিন্তু তার মৃত্যুর কারণে তাদের যে ক্ষতি হয়ে গেছে তা অপূরণীয়। সরকার বা কারও পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত কোনো সহায়তা দেওয়া হয়নি।

“শাওন আজ বেঁচে থাকলে আমাদের পরিবারের অনেক উন্নতি হত। কেননা পরিবারের সদস্যবৃন্দের কথা সব সময় চিন্তা করত।”

একই ঘটনা ঘটেছে ওই ক্যাফের পাচক সাইফুল ইসলাম চৌকিদারের ক্ষেত্রেও। জঙ্গি ধরেই মামলার আসামি করা হয়েছিল নিহত এই ব্যক্তিকে। পরে তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হন।

ছোট্ট হাসানের বিশ্বাস, বাবা বাড়ি ফিরবে

জঙ্গি হামলার ১১ ঘণ্টা পর ২ জুলাই সকাল সাড়ে ৭টার দিকে অভিযানে নামে সামরিক বাহিনীর কমান্ডো দল।

ফিরে দেখা: হলি আর্টিজানে হামলা

যা ঘটেছিল সেই রাতে

গুলশান-২ এর ৭৯ নম্বর সড়কের শেষ মাথায় লেকের তীরে হলি আর্টিজান বেকারির সবুজ লন ছিল বিদেশিদের কাছে খুবই জনপ্রিয়। রোজার ঈদের মাত্র এক সপ্তাহ আগে যেদিন ওই হামলা হয়, সেদিন ছিল শুক্রবার। পিস্তল, সাব মেশিনগান আর ধারালো অস্ত্র হাতে পাঁচ তরুণ রাত পৌনে ৯টার দিকে ওই ক্যাফেতে ঢুকে শুরু করে নৃশংসতা।

গোলাগুলির খবর পেয়ে সেখানে ছুটে যান গুলশান থানা পুলিশের সদস্যরা। ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনি দিয়ে রেস্তোরাঁর ভেতরে এলোপাতাড়ি গুলির খবর মুহূর্তেই পুলিশের ওয়্যারলেসে ছড়িয়ে পড়ে।

ঘটনাস্থল থেকে নিরাপদ দূরত্বে পুলিশের দেওয়া ব্যারিকেডের পাশে ভিড় করে শত শত উৎসুক জনতা।
ঘটনাস্থল থেকে নিরাপদ দূরত্বে পুলিশের দেওয়া ব্যারিকেডের পাশে ভিড় করে শত শত উৎসুক জনতা।

থানা পুলিশ ছাড়াও র‌্যাব, সদ্য গঠিত কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের শীর্ষ কর্মকর্তারাসহ সব সদস্য ছুটে আসেন। সবার দৃষ্টি চলে যায় এই রেস্তোরাঁ ঘিরে। সবাই নিশ্চিত হয় এটা জঙ্গিদের হামলা।

রাতেই তাদের দমনে অভিযান চালাতে গিয়ে বনানী থানার ওসি সালাউদ্দিন এবং গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী কমিশনার রবিউল ইসলাম মারা যান। আহত হন অনেক পুলিশ সদস্য।

আছাদুজ্জামান মিয়ার বয়ানে ওই রাতে পুলিশের ভূমিকা

গুলশান হামলা: প্রত্যক্ষদর্শী পুলিশ কর্মকর্তাদের বর্ণনায় সেই রাত

এরপর কিছুটা পিছু হটে ওই বেকারি ঘিরে নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করে রাখেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। রাতভর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা বৈঠকের পর বৈঠক চালিয়ে যান।

এদিকে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট-আইএস এই হামলার দায় স্বীকার করে বিবৃতি দেয়। তাদের বরাত দিয়ে হামলাকারী এবং সেখানে নিহতদের ছবিও প্রকাশ করে জঙ্গি তৎপরতা পর্যবেক্ষণকারী যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ওয়েবসাইট সাইট ইন্টেলিজেন্স।

হলি আর্টিজান থেকে সেই রাতে যেভাবে ছবি পাঠিয়েছিল জঙ্গিরা

কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ওই হামলার খবর আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোর শিরোনামে চলে আসে; তখনও অনেকে হলি আর্টিজানের ভেতরে কার্যত জিম্মি হয়ে ছিলেন।

রুদ্ধশ্বাস রাত পেরিয়ে ভোরে সেনাবাহিনীর কমান্ডোরা নামে অভিযানে; ‘থান্ডারবোল্ট’ নামের সেই অভিযানে হামলায় সরাসরি অংশ নেওয়া পাঁচ তরুণের সবাই মারা পড়ে। তখনই দেখা যায়, রাতে ১৭ বিদেশিসহ ২০ জনকে গলাকেটে হত্যা করেছে জঙ্গিরা। বেকারির ভেতর থেকে ১৩ জনকে উদ্ধার করা হয়।

এরা এখন স্মৃতির পাতায়; গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলায় নিহত হয়েছিলেন তারা।

যে পাঁচ জঙ্গি নিহত হন তারা হলেন- মীর সামেহ মোবাশ্বের, রোহান ইবনে ইমতিয়াজ ওরফে মামুন, নিবরাজ ইসলাম, খায়রুল ইসলাম পায়েল ও শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল।

এই ঘটনায় গুলশান থানার এসআই রিপন কুমার দাস সন্ত্রাসবিরোধী আইনে একটি মামলা করেন। মামলাটি তদন্ত করে নবগঠিত কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট।

মামলা তদন্তের মধ্যেই দেশের বিভিন্ন জায়গায় জঙ্গিবিরোধী অভিযান শুরু করেন কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের সদস্যরা। একইসঙ্গে র‌্যাবও চালাতে থাকে জঙ্গিবিরোধী অভিযান। র‌্যাব ও পুলিশ কর্মকর্তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, প্রতিটি অভিযানেই সফল হয়েছেন তারা। জঙ্গিদের অনেক তৎপরতা অঙ্কুরেই নস্যাৎ করতে সক্ষম হয়েছেন।

দুই বছর পর ২০১৮ সালের ২৩ জুলাই মামলায় অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। হামলায় ২১ জনকে চিহ্নিত করা হলেও জীবিত আটজনকে আসামি করা হয়।

এই আটজন হলেন- মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব গান্ধী ওরফে সুভাষ ওরফে শান্ত ওরফে টাইগার ওরফে আদিল ওরফে জাহিদ, মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজান, রাফিউল ইসলাম ওরফে রাকিবুল হাসান ওরফে রিগ্যান, মো. আব্দুস সবুর খান ওরফে হাসান ওরফে হাতকাটা সোহেল মাহফুজ ওরফে মুসাফির ওরফে জয় ওরফে নসুরুল্লাহ, হাদিসুর রহমান সাগর, মো. আসলাম হোসেন ওরফে রাশেদ ইসলাম ওরফে আবু জাররা ওরফে র‌্যাশ, শরিফুল ইসলাম ওরফে খালেদ এবং মামুনুর রশীদ ওরফে রিপন।

জিম্মিদের উদ্ধারে কমান্ডো অভিযানে সেনাবাহিনীর সাঁজোয়া যান। গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার ১১ ঘণ্টা পর এ অভিযান শুরু হয়।

কমান্ডো অভিযানে হলি আর্টিজান থেকে উদ্ধার হাসনাত রেজাউল করিম ও তাহমিদ হাসিব খানকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে আনা হলেও তাদের ‘সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি’ জানিয়ে অভিযোগপত্র থেকে বাদ দেওয়া হয়।

হলি আর্টিজানে হামলার পর তদন্ত করতে গিয়ে হামলায় জড়িত অনেকের নাম পায় কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। তাদের মধ্যে তামিম আহমেদ চৌধুরী, নুরুল ইসলাম মারজান, সারোয়ার জাহান, তানভীর কাদের, বাশারুজ্জামান চকলেট, জাহিদুল ইসলাম, মিজানুর রহমান ওরফে ছোট মিজান, রায়হানুল কবির বিভিন্ন সময়ে পুলিশ-র‌্যাবের অভিযানে নিহত হন।

২০১৮ সালের ২৬ নভেম্বর এই মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরু করে আদালত। পরের বছর নভেম্বরের মধ্যে সাক্ষ্যগ্রহণ ও যুক্তিতর্ক শেষ হয়।

২০১৯ সালের ২৭ নভেম্বর ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. মজিবুর রহমান বিশ্বজুডে আলোচিত এই মামলার রায়ে আট আসামির মধ্যে সাতজনের ফাঁসির আদেশ দেন। মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজানকে খালাস দেন। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানাও করা হয়।

তবে আদালতের রায় এখনও কার্যকর হয়নি। করোনাভাইরাস মহামারীতে আটকে গেছে ডেথ রেফারেন্সের পেপারবুক।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ