কর্নেল তাহের নন, পরাজিত হয়েছিল জাসদ

প্রকাশিত: ৩:৫৬ পূর্বাহ্ণ, জুলাই ২৩, ২০২০

কর্নেল তাহের নন, পরাজিত হয়েছিল জাসদ

Manual6 Ad Code

|| সালেক খোকন || ২৩ জুলাই ২০২০ : “ভাই হলেও শাখাওয়াত হোসেন বাহারই ছিল আমার কাছের বন্ধু। আমরা পিঠাপিঠি। কোন সমস্যার কথা সবার প্রথম আমি বাহারকেই বলতাম। বড় বোন সালেহা। তাকেই আমরা বুবু বলি। ময়মনসিংহের মুমিনুন্নেসা কলেজে পড়তেন। ইপসু (পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন) করতেন। ওই কলেজের ভিপিও হন। বুবু ছিলেন দারুণ প্রগতিশীল। রাজনৈতিক চিন্তা চেতনা বুবুর মাধ্যমেই আমরা পেয়েছি।”

“আব্বা ছিলেন স্টেশন মাস্টার। আমাকে নিয়ে সকালে স্টেশনে যেতেন। তিনি কাজ করতেন, পাশে বসে আমি পড়তাম। লেখাপড়ায় ফাউন্ডেশনটা আব্বার কাছেই গড়া। প্রতিকূলতা ফেইস করার শিক্ষাটা আমরা পেয়েছি পরিবার থেকেই। আব্বা বেশ নিভৃতচারি কিন্তু আম্মা ছিলেন দারুণ তেজোদীপ্ত। তার আদরের প্রকাশটা সেরকম ছিল না। তবুও আমাদের ভেতর আম্মার প্রভাবটাই সবচেয়ে বেশি।”

শৈশবের নানা ঘটনার কথা এভাবেই তুলে ধরেন মুক্তিযোদ্ধা ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল (বীরপ্রতীক)। এক বিকেলে তার বাড়িতে বসেই আলাপ হয় ইতিহাসের নানা ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে।

বেলালের পিতা মহিউদ্দিন আহমেদ আর মাতার নাম আশরাফুন্নেসা। আট ভাই ও তিন বোনের সংসারে তিনি সপ্তম। এগার নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার কর্নেল আবু তাহের তার বড় ভাই। তিনি ছাড়াও ৫ ভাই ও এক বোন সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। তাদের বাড়ি নেত্রকোণার পূর্বধলা উপজেলার কাজলা গ্রামে।

Manual4 Ad Code

তার লেখাপড়ায় হাতেখড়ি ময়মনসিংহের খাগড়হর স্কুলে। এরপর ভর্তি হন সিটি স্কুলে। অষ্টম শ্রেণির পর তিনি চলে যান ঢাকায়, শেরেবাংলা নগরে বড় ভাই আরিফুর রহমানের বাসায়। বেলাল ম্যাট্রিক পাশ করেন ১৯৬৯ সালে, মোহাম্মদপুর গভর্নমেন্ট স্কুল থেকে। এরপর ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হন নারায়ণগঞ্জ তোলারাম কলেজে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন ওখানকার ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্র।

শেখ কামালের হাত ধরেই বেলাল ছাত্রলীগের রাজনীতিতে যুক্ত হন। ছাত্রাবস্থাতে গ্রেপ্তারও হয়েছিলেন।

কীভাবে? সে ইতিহাস শুনি তার জবানিতে-

“ছাত্র আন্দোলন তখন তুঙ্গে। স্কুলগুলোতে ঘুরে ঘুরে ছাত্রলীগের কমিটি করছেন শেখ কামাল। তার হাত ধরেই ছাত্রলীগের সঙ্গে যুক্ত হই। তখন ক্লাস টেনে উঠেছি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একবার ধর্মঘট হয়। কয়েকজনসহ খুব সকালে এসেই স্কুল গেইটে দাঁড়াই। ছাত্রদের বুঝিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছি। ঠিক সে সময়ই পুলিশ এসে হাজির। পালিয়ে যাওয়ার রীতি তখন ছাত্রনেতাদের ছিল না। পুলিশ তুলে নিল আমায়। পরদিন নেওয়া হয় কোর্টে। সেখানে শত শত ছাত্ররা মিছিল করছে। আমার নাম ধরেও স্লোগান দিচ্ছে তারা। শুনেই বুকটা ভরে যায়। কামাল ভাই (শেখ কামাল) এসে বললেন- ‘চিন্তা করিস না। কিচ্ছু হবে না। আমি ব্যবস্থা নিতেছি।’

“দেখা করতে আসে নানাজন। একজন বলে- ‘রিমান্ডে নিলেই পুলিশ র‌্যাকটামে আইস দিয়ে টর্চার করবে।’ নজরুল ভাই, ঢাকা কলেজে পড়তেন। উনি এসে গম্ভীর মুখে বললেন- ‘শুনছি আইস টাইস দিবে। তোরা তো ছোট। আইস না দিয়া ক্রিমটা দিলে ভাল হতো।’ শুনেই ঘামতে থাকি। ওইকথা মনে হলে এখনও হাসি পায়।”

রিমান্ডে নিয়েছিল?

“না। ভাগ্যটা ভাল। জামিন হয়ে যায় আমাদের। কামাল ভাই তখন একটা গাড়িতে করে নিয়ে আসেন ইকবাল হলে। নজরুল ভাই, বাদল ভাই, বরকত ভাই এরা ছিলেন। ছোট বলে একজন আমাকে তার কাঁধে তুলে নেয়। এরপরই পুরো ইকবাল হলে আমাদের নিয়ে মিছিল হয়েছিল। ওইদিন সন্ধ্যাতে কামাল ভাই আমাকে নিয়ে যান তার বাড়িতে, বত্রিশ নম্বরে। ঢুকতেই দেখি বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেঁসে বললেন- ‘এই ছোট্ট ছেলেটাকেও রাজনীতিতে নিয়া আসছোস।’ তার ওই কণ্ঠটা এখনও কানে বাজে।”

Manual4 Ad Code

ম্যাট্রিক পাশের পর বেলাল চলে যান নারায়ণগঞ্জের দেওভোগে, ভাই আবু সাঈদ আহমেদের শ্বশুর বাড়িতে। সেখানে ভর্তি হন তোলারাম কলেজে।

২৫ মার্চ ১৯৭১। ঢাকায় পাকিস্তানি সেনারা শুরু করে গণহত্যা। নারায়গঞ্জে আপনারা তখন কী করলেন?

“আগেই খবর ছড়িয়ে যায় কিছু একটা ঘটবে। নারায়ণগঞ্জ রাইফেলস ক্লাবের রাইফেলগুলো নিয়ে আসা হয় সিরাজ ভাইয়ের নেতৃত্বে। ইপিআররা রাইফেল চালানোটা মোটামুটি শিখিয়ে দেন আমাদের। এরপরই জায়গায় জায়গায় ব্যারিকেড দেওয়া হয়। আর্মিরা যেন মুভ করতে না পারে সেকারণে স্টেশন থেকে ওয়াগন এনে ঢাকা থেকে আসার রাস্তার লাইনে রেখে দেওয়া হয়। আমরা অবস্থান নিই তোলারাম কলেজের ছাদে। নারায়ণগঞ্জ প্রতিরোধের নেতৃত্বে ছিলেন চুনকা ভাইসহ অনেকেই। গোলাগুলির শব্দে আর্মিরা নারায়ণগঞ্জে না ঢুকে পঞ্চবটি নামক জায়গায় অবস্থান নেয়। কিন্তু একদিন পরেই ওরা ট্যাংকের মেইন গান দিয়ে ফায়ার করতে করতে নারায়ণগঞ্জ শহর দখলে করে। এর পর দেওভোগসহ বিভিন্ন এলাকার বাড়িগুলো পুড়িয়ে দিতে থাকে। তখন ডোবার পানিতে লুকিয়ে জীবন বাঁচাই আমরা। কয়েকদিন পর পরিবহন চালু হলে চলে যাই গ্রামে, কাজলায়।”

এরপরই কি ট্রেনিংয়ে চলে যান?

“সময়টা এপ্রিলের মাঝামাঝি হবে। সাঈদ ও আনোয়ার ভাই তখন চলে আসছেন। বাড়িতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র শুনে উদ্দীপ্ত হতাম। একদিন বাহারই বলে- ‘যুদ্ধ তো শুরু হইছে। চল আমরা চলে যাই।’

“রাজি হয়ে গেলাম। অনেকগুলো পকেটওয়ালা জ্যাকেট ছিল আমার। ওটা পড়ে নিই। সঙ্গে ওয়াটার পিউরিফাইং ট্যাবলেট ও একটা চাকু। মধ্যরাতে বাড়ি ছাড়ার আগে একটা চিঠি লিখে রেখে যাই- ‘আম্মা, যুদ্ধ করার জন্য আমরা চলে যাচ্ছি।”

কর্নেল আবু তাহের (বীরউত্তম), এগারো নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার।
“তাহের ভাই (কর্নেল তাহের) ছুটিতে বাড়ি আসলে প্যারাপিটি, আর্ম অ্যান্ড কমব্যাট প্র্যাকটিস করাতেন। উনি বলতেন, ‘দূরে একটা পাহাড় দেখা যাচ্ছে। তুমি সাত দিনের রেশন নিয়ে পাহাড়টাকে টার্গেট করে হাঁটতে থাকো। দেখবে ঠিকই পৌঁছে যাবে।’ এগুলো আমাদের ইনফ্লুয়েন্স করে। বাড়ি থেকেই তুরা পাহাড় দেখা যায়। তাই ওটা টার্গেট করেই হেঁটে রওনা হই।”

“দুর্গাপুর হয়ে আমরা ভারতের মেঘালয়ের শিববাড়ি গিয়ে উঠি। রিক্রুটিং ক্যাম্পে নাম লেখানোর পর ট্রেনিংয়ের জন্য পাঠানো হয় তুরাতে। প্রথম ব্যাচ ছিল আমাদের। দুই মাস ট্রেনিং শেষে আমি এক্সপ্লোসিভে আর বাহার জুনিয়ার লিডার শিপের বিশেষ ট্রেনিং নিই। এরপরই একটা গ্রুপে বাহারকে কমান্ডে আর আমাকে টোয়াইসির দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হয় শিববাড়িতে। সেখান থেকেই অপারেশন করি হালুয়াঘাটের ঘোষগাঁওয়ে, পাকিস্তানি সেনাদের বিওপিতে। ওটাই ছিল প্রথম অপারেশন। কিন্তু ওই অপারেশনটায় আমরা রিট্রিট করি। আঠারো জন সহযোদ্ধাও শহীদ হয়েছিল ওইদিন। এরপর সেক্টর গঠন হলে চলে যান এগার নম্বর সেক্টর হেড কোয়ার্টার মহেন্দ্রগঞ্জে। সেখানেই তাদের সঙ্গে দেখা হয় ভাই কর্নেল তাহেরের।”

“ভাই হিসেবে এনট্রেন্স ওখানে তাদের ছিল না। কর্নেল তাহের বলতেন- ‘নো মোর ভাই বিজনেস।’ বেলালরাও তাকে স্যার অ্যাডড্রেস করতেন। উনি তাদের নিয়ে একটি সেকশন তৈরি করে দেন। যার কমান্ড করতেন বাহার। কর্নেল তাহেরের সঙ্গে থাকাই ছিল তাদের কাজ।”

“এক অপারেশনে কর্নেল তাহের রক্তাক্ত হন। দেশের জন্য একটি পা-ও হারান তিনি। ওইদিন তার সঙ্গে ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা বেলালও।”

কীভাবে রক্তাক্ত হন কর্নেল তাহের?

“কামালপুর ছিল পাকিস্তানিদের শক্তিশালী বিওপি। আগেও ওখানে বেশ কয়েকটা অপারেশন হয়। সবগুলো ছিল আনসাকসেসফুল। কিন্তু এবারের অপারেশনটা ভিন্নরকমের। আমাদের সঙ্গে এসে যুক্ত হয় ভারতের মারাঠা রেজিমেন্ট, গুরখা রেজিমেন্ট আর গার্ড রেজিমেন্ট। সবগুলোর কমান্ডে ছিলেন বিগ্রেডিয়ার ক্লেয়ার। সিদ্ধান্ত হয় অপারেশনটির নেতৃত্ব দিবেন সেক্টর কমান্ডার কর্নেল আবু তাহের।

১৩ নভেম্বর, ১৯৭১। দুপুরে কর্নেল তাহের কমান্ডারদের নিয়ে বসলেন। আমরাও থাকার সুযোগ পাই। বলা হলো ওইদিন রাত ১২টার পরেই অথার্ৎ ১৪ নভেম্বর কামালপুর অ্যাটাক করা হবে। দিনটি ছিল কর্নেল তাহেরের জন্মদিন।”

“বলা হলো, কর্নেল তাহেরের কোড হবে ‘কর্তা’। যে কেউ যোগাযোগ করবে ‘কর্তা’ বলে। রাত ১১টায় রওনা হলাম। কামালপুরের আগেই বানরোড। তারও পেছনে কর্নেল তাহেরের কমান্ড পোস্ট। আমরা ওখানেই পজিশন নিই। পাশেই বিগ্রেডিয়ার ক্লেয়ার, গুরখা রেজিমেন্টে কর্নেল বারাখ, মারাঠা রেজিমেন্টের কর্নেল বুলবুল, গার্টস রেজিমেন্টের বারাট।”

“আর্টিলারি ফায়ারের পর শুরু হবে অপারেশন। রাত তখন ১২টা। মুহুর্মূহু শেল ড্রপিং হচ্ছে কামালপুর বিওপির ওপর। প্রায় সাড়ে তিন হাজার আর্টিলারি থ্রো করা হয়েছিল। উপরে আলোর ঝলকানি। পাকিস্তানি সেনারাও ফায়ার করছে। ট্রেসার ফায়ারও যাচ্ছে। চরম এক উত্তেজনা। কিন্তু করো মনে কোনও ভয় নাই।

নির্দেশ ছিল মুক্তিযোদ্ধারা চার্জ করবে ‘জয় বাংলা’ বলে। কিছুক্ষণ পর চারপাশ থেকে ‘জয় বাংলা’র চিৎকার। কর্নেল তাহেরের কাছে একটা ওয়াকিটকি। সেখানে ল্যাফটেনেন্ট মিজান জানালো- ‘কর্তা আমরা পাকিস্তানিদের প্রথম লাইনের বান্কার দখল করে নিয়েছি।’ তখন আনন্দে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান তুলি।”

“রাত তখন তিনটার মতো মিজানের সঙ্গে যোগাযোগ হচ্ছে না। ওয়াকিটকিতে কর্নেল তাহের বার বার বলছিলেন- ‘মিজান, তুমি কোথায়? ওপাশে কোনো সাড়া নেই। তিনি চিন্তিত হয়ে গেলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য তার ফিলিংসটা সবসময়ই ছিল অন্যরকম। ভোর হয়ে আসছে। হঠাৎ উনি কমান্ড পোস্ট থেকে উঠে গেলেন। বিগ্রেডিয়ার ক্লিয়ারকে বললেন- ‘আমি ফ্রন্টে যাব।’ উনি অবাক হয়ে বলেন, ‘হোয়াট!’ তাহের বলেন, ‘আই হ্যাভ টু সি মাই বয়।’ উনি সামনে রওনা হন। সঙ্গে আমরাও।”

“বানরোডের কাছে গিয়ে বর্ডার ক্রস করি। এরপরই একটা আমবাগান। শেলের আঘাতে পাকিস্তানিদের বান্কারগুলো ভেঙে গেছে। ওরা বেরিয়ে আখক্ষেতে লুকাচ্ছে। দূর থেকে তা দেখছি আমরা।

তাহের ভাই পজিশন নিয়ে নিয়ে এগোয়। বানরোডের ঢালে এসে বসলেন দুই পা ভাজ করে। এক পাশে আমি, আরেক পাশে বাহার, পেছনে তিন-চারজন পজিশনে। কর্নেল তাহের কলফ স্টিক দিয়ে পাকিস্তানিদের দেখালেই, ওদিকে ফায়ার দিচ্ছি। এরমধ্যেই হঠাৎ একটা আওয়াজ হলো। খেয়াল করলাম কর্নেল তাহের আমার ওপর পড়ে যাচ্ছেন। দেখলাম তার বাঁ পা-টা প্রায় বিচ্ছিন্ন, দুইতিনটা ভেইনের সঙ্গে ঝুলে আছে কোনোরকমে।”

পাকিস্তানিদের শেলের আঘাতে?

“ওই সময় মনে হয়েছে শেলের আঘাত। কিন্তু পরে অনেক হিসেবে করে দেখলাম শেল ড্রপিং হলে উনি বেঁচে থাকতেন না। উনার শরীরের অন্যান্য জায়গাও ইনজুরড হতো। ওটা আসলে অ্যান্টিপারসনাল মাইন ছিল। যা তার পায়ের চাপে বিস্ফোরিত হয়।”

“উনাকে ধরতে গেলে উনি বলেন, ‘আমার কিছু হয়নি। তোমরা যুদ্ধটা চালিয়ে যাও।’ এদিকে দূর থেকে পাকিস্তানিরা চিৎকার করছে। ওরা বুঝে গিয়েছিল কমান্ডার গোছের কাউকে তারা হিট করেছে। রক্ত গিয়ে কর্নেল তাহের নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছেন। আমি তখন ভুল করে ওয়াকিটকিতে বলে ফেললাম, ‘কর্তা’ ইজ ডেড।”

“পাকিস্তানি সেনারা এগিয়ে আসার চেষ্টা করে। মুক্তিযোদ্ধারা একটা কুঁড়েঘরের দরজা ভেঙে নিয়ে আসেন। ওটায় শুইয়ে টেনে নেওয়া হয় কর্নেল তাহেরকে। কিন্তু এভাবে তো বেশি দূরে নেওয়া যাবে না। একটা আরআর গান আনা হয়েছিল জিপে করে। বেশ দূরে দৌড়ে গিয়ে আমি ওই জিপটা এনে তাকে তুলে নিই। মনোবল তখনও তার ভাঙ্গেনি। এরমধ্যেই আনোয়ার ভাই চলে আসেন। তাকে দেখেই বললেন, ‘দেখো আমার মাথায় ওরা হিট করতে পারে নাই। তোমরা কামালপুর মুক্ত করবে। আমি ফিরে এসে যেন দেখি কামালপুর মুক্ত হয়েছে।’ চিকিৎসার জন্য হেলিকপ্টারে কর্নেল তাহেরকে প্রথমে তুরা এবং পরে নিয়ে যাওয়া হয় গৌহাটিতে।”

স্বাধীনতা লাভের পর দেশ গড়ার কাজে মুক্তিযোদ্ধাদেরও নিয়োজিত করা প্রয়োজন ছিল বলে মনে করেন এই যোদ্ধা। বাকশাল গঠন প্রসঙ্গে তিনি অকপটে তুলে ধরেন নিজের মতটি- “

ইন ওয়ান সেন্স, ফরমেশন অব বাকশাল ওয়াজ টু লেট। ইন এনাদার সেন্স ইট ওয়াজ টু আরলি। বাকশালটা গঠন করা উচিত ছিল দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই। তখন মুক্তিযোদ্ধারা এক জোট ছিল। ফলে বঙ্গবন্ধুর স্ট্রেন্থও থাকতো অন্যরকম। বাকশালের থিমটা ঠিক ছিল। কিন্তু যখন বাকশাল গঠন করা হলো তখন মুক্তিযোদ্ধারা ছিল বিভক্ত। আর সরকারের ভেতর আগাছাও ঢুকে গিয়েছিল অনেক।”

জাসদ ও গণবাহিনী গঠন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “দেখুন, আমি ও বাহার জাসদে যুক্ত ছিলাম না। কিন্তু কর্নেল তাহের, আনোয়ার ভাই, সাঈদ ভাইদের মতো মুক্তিযোদ্ধারা কেন জাসদ করলো সেটাও চিন্তায় আনা দরকার। বঙ্গবন্ধু উদ্যোগ নিলে হয়তো জাসদ হতো না। তখন উনাকেও ঘিরে ছিল মোশতাক চক্র। আবার সেই সময় জাসদ যে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের কথা বলতো সেটা অনেকের কাছেই পরিষ্কার ছিল না। বিভিন্ন লিফলেট আসতো বাসায়। সেখানে লেখা ছিল এমন- ‘যে আন্দোলনটা চলছে সেটার একটা ছেদ ঘটাতে হবে। কী ছেদ? আন্দোলনটাকে অন্য ফরমে নিয়ে যেতে হবে। যার অর্থ অস্ত্র সম্পৃক্ত আন্দোলন। মানে গণবাহিনী তৈরি করা। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি এটা ছিল জাসদের সবচেয়ে ভুল সিদ্ধান্ত।”

জাসদ করতেন না, কিন্তু কর্নেল তাহেরকে মুক্ত করার অংশ হিসেবে ইন্ডিয়ান অ্যাম্বাসেডরকে জিম্মি করার অপারেশনে যুক্ত হয়েছিলেন কেন?

বীরপ্রতীক বেলালের অকপট উত্তর, “মুক্তিযোদ্ধা ছিলাম। অপারেশন পরিকল্পনা, এক্সপ্লোসিভ ও অস্ত্র চালানোর ট্রেনিং ছিল। শুধুমাত্র ভাই কর্নেল তাহেরকে সেইভ করতেই আমি আর বাহার যুক্ত হয়েছিলাম। বড় ভাইকে মুক্ত করতে জীবন দেওয়ারও শপথ নিয়েছিলাম।”

সেদিনের আদ্যপান্ত শুনি এই বীরের জবানিতে। তার ভাষায়, “একজন অ্যাম্বাসেডরকে জিম্মি করার মাধ্যমে কর্নেল তাহেরসহ জাসদ নেতাদের মুক্ত করতে জিয়া সরকারকে বাধ্য করানোর পরিকল্পনা আগেই ছিল। মূল টার্গেট ছিল বোস্টার, তৎকালীন আমেরিকান অ্যাম্বাসেডর। তাকে জিম্মি করতে রেকিও সম্পন্ন করা হয়। কর্নেল তাহের সবসময় বলতেন- কোন কারণে ভারতীয় অ্যাম্বাসি অ্যাটাক করবা না। কারণ ওরা প্রতিবেশি দেশ। এতে ইন্টারভেনশন হয়ে যেতে পারে। ওই অজুহাতে ওরা ভেতরে ঢুকে পড়তে পারে।”

“আমাদের ডেকে বলা হলো তোমরা প্রিপারেশন নাও। ইন্ডিয়ান অ্যাম্বাসেডরের কথা শুনে আমি আর বাহার প্রথম ‘না’ করলাম। প্রয়োজনীয় রেকিও করা ছিল না তখন। কিন্তু আনোয়ার ভাই তার সিদ্ধান্তে অটল। আগেই ব্যাপকভাবে ছড়ানো হয়েছিল জাসদ ও কর্নেল তাহের ভারতের দালালি করছে। মানুষ তা বিশ্বাসও করতো। আনোয়ার ভাই বোঝালেন, ইন্ডিয়ান অ্যাম্বাসেডরকেই যদি জিম্মি করা হয় তাহলে কেউ ধারণাও করতে পারবে না যে এটা জাসদের কাজ।”

“২৬ নভেম্বর, ১৯৭৫। সকালের দিকে অ্যাকশনে গেলাম। শাখাওয়াত হোসেন বাহারের ছদ্ম নাম ছিল আসাদ। ছিল বাচ্চু (নজরুল ইসলাম), মাসুদ (মাসুদ উদ্দিন), হারুনও (হারুনুর রশিদ)। তখন স্লোগান দেওয়া হতো- ‘আসাদ বাচ্চু মাসুদ হারুন, দিকে দিকে জ্বালো আগুন।’ ওইদিন এরা চারজনই মারা যায়। আমার ছদ্ম নাম ফিরোজ আর মিনুর নাম ছিল সবুজ। আমরা দুজনই শুধু বেঁচে যাই।”

“ইন্ডিয়ান অ্যাম্বাসি তখন ধানমণ্ডি দুই নম্বরে। তিনজন দাঁড়ালো অপজিটে, জার্মান কালচারাল সেন্টারের কাছে। আমি, বাহার ও সবুজ গেইটের সামনে। অস্ত্র ছিল পিস্তল ও রিভলবার। একটা মার্সিটিজ গাড়িতে করে ইন্ডিয়ান অ্যাম্বোসেডর শমর সেন গেইটের ভেতরে ঢুকে। কাজের অজুহাতে আমরাও ভেতরে যাই। সমর সেন গাড়ি থেকে নামেন। সেখানে থাকে চারজন সিকিউরিটি। সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠবেন তিনি। ওইসময়ই তাকে আমরা গান পয়েন্টে নিব। এমনটাই ছিল পরিকল্পনা।”

“কিন্তু চারজন সিকিউরিটি ছাড়াও সেখানে যে উনিশ জন ‘ব্ল্যাকক্যাট’ সৈন্য ছিল- এটা আমাদের জানা ছিল না। মূলত বঙ্গবন্ধু হত্যার পরই অ্যাম্বাসিতে এই ‘ব্লাকক্যাট’ দেয় ইন্ডিয়ান গভর্মেন্ট। তারা লুকিয়ে থাকতো ভেতরে।”

Manual8 Ad Code

“সমর সেন বেশ লম্বা। দোতলায় উঠতে উনি সিঁড়িতে পা রাখলেন। তখনই আমি এক পাশে রিভেলবার ঠেকালাম। অন্যপাশে সবুজ ও পেছনে বাহারও রিভলবার ঠেকায়। আমি বললাম- ‘মিস্টার সেন টেল ইওর ম্যান নট টু ফায়ার। আদারওয়াইজ, আই শ্যাল কিল ইউ।’ উনি এদিক ওদিকে তাকিয়ে কাঁপছেন। লম্বা হওয়াতে তাকে আমরা ফিজিক্যালি গ্রিপে পাচ্ছিলাম না। ফলে এক সময় সে পড়ে যায়।”

মুক্তিযোদ্ধা শাখাওয়াত হোসেন বাহার, বীরপ্রতীক
“ঠিক তখনই একটা সিঙ্গেল সট ফায়ার হয়। তাকিয়ে দেখি চারপাশে ব্লাকক্যাটে ভরা। ভেতরের রুম থেকে সব চলে আসছে। পেছন থেকে ওরা প্রথম ফায়ার করে বাহারকে। সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। আমার মনে হলো কেউ আমাকে জোরে ধাক্কা দিয়েছে। একটা গুলি এসে লাগে ডান কোমরে। সবুজের শরীরের নানা জায়গায়ও লাগে ৬-৭টা বুলেট। প্রচণ্ড ব্লিডিং হচ্ছিল ওর। ওই সময় সমর সেনেরও গুলি লাগে। নিচে পড়ে থাকে আমাদের বাকী চারজনের ডেড বডি।”

“সবুজকে নিয়ে আমি দোতলায় একটা রুমে আশ্রয় নিই। চিন্তা তখন একটাই- ‘বাঁচতে হবে।’ রিভলবারটা কার্পেটের নিচে ফেলে দিই। ২৫-৩০ মিনিট পর গুলি থামতেই সারেন্ডার করি। প্রথমে স্বীকার করিনি। বাইরে যেতেই দেখি আর্মি চলে আসছে। ওরা আমাদের তুলে নেয় সিএমএইচে। সেখানেই অপারেশন করে কোমর থেকে গুলি বের করে আনা হয়। ওই মামলায় পাঁচ বছরের সাজা হয়েছিল।”

Manual3 Ad Code

কর্নেল তাহেরের সঙ্গে শেষ দেখা হয় কারাগারে, তার ফাঁসির আগের দিন। অ্যাম্বাসি অ্যাটাকের বিষয়টিতে উনি বেশ বিরক্ত হয়েছিলেন। এক কথায় বললেন- ‘ইউ হ্যাভ ডান এ গ্রেট ব্লান্ডার।’ জেল খেটেছি কোনো আফসোস নেই। কিন্তু তাহের ভাইকে তো মুক্ত করতে পারলাম না। বরং বাহারের মতো বন্ধু ও ভাইকে হারিয়েছি ওইদিন। যার স্মৃতিগুলো এখনও আমাকে কাঁদায়।”

বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা গঠন কি তখন সেনাবাহিনীর ভেতর চেইন অব কমান্ড ভাঙ্গতে প্রভাবিত করেছিল? আপনার কী মত?

তিনি বলেন, “তাহের ভাইয়ের মুখে যতটুকু শুনেছি তাতে মনে হয়েছে উনি প্রাতিষ্ঠানিক সেনাবাহিনী বিলিভ করতেন না। উনি বলতেন- ‘ইটস আ পিপল’স আর্মি। আর্মি হবে পিপল অরিয়েন্টেড প্রডাকটিভ আর্মি। এটা ছিল তার চিন্তা। সে দৃষ্টিকোণ থেকে ঠিকই ছিল বিপ্লবী শ্রমিক সংস্থা গঠন। কারণ সংস্থার প্রতিটি টায়ারেই তো কমান্ড ছিল।”

কর্নেল তাহেরকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

“মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল তাহের- শতভাগ সফল। জাসদে তার যেটুকু দায়িত্ব ছিল, তার যে অ্যাসাইনমেন্ট ছিল, তিনি তা শতভাগ পালন করেছিলেন। কিন্তু জাসদের বাকী নেতৃবৃন্দ তা করেনি। পোস্তাগলা, টঙ্গি আমাদের শ্রমিক বেল্ট। শ্রমিকরা ওখান থেকে এসে ঢাকায় ফ্লাডেড হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। অথচ কেউ বিন্দুমাত্র মুভ করে নাই। ফলে আমরা আমাদের ভাইকে হারিয়েছি। আমার মনে হয়, কর্নেল তাহের মৃত্যুটাকে আলিঙ্গন করেছেন। হয়তো তিনি ভেবেছেন তার মৃত্যুর মধ্য দিয়েই উনি যে স্বপ্নটা দেখেছেন সেটা প্রজন্মের কাছে বেঁচে থাকবে।”

কর্নেল তাহের কি পরাজিত?

মুক্তিযোদ্ধা বেলালের অকপট উত্তর, “নাহ, তাহের ভাই পরাজিত নন। পরাজিত জাসদের ওইসব নেতারা যারা তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্বটা পালন করেননি। মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, কর্নেল তাহের নন পরাজিত হয়েছিল জাসদ।”

“প্রজন্মের হাত ধরেই দেশ এগিয়ে যাবে। তবে তাদের গাইডলাইনটাও তৈরি করে দিতে হবে সঠিক নেতৃত্বের মাধ্যমে।”- এমনটাই মনে করেন মুক্তিযোদ্ধা ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল (বীরপ্রতীক)।

পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে বীরপ্রতীক ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল।

চোখেমুখে আলো ছড়িয়ে প্রজন্মের উদ্দেশে তিনি বললেন শেষ কথাগুলো- “মুক্তিযুদ্ধটা হয়েছিল একটি অসাম্প্রদায়িক চিন্তা থেকে। সে চিন্তাটি তোমরা বাঁচিয়ে রেখো। দেশটাকে ভালবেসো। মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বের ইতিহাসকে অন্তরে ধারণ করো। অন্যায়কে প্রশ্রয় দিও না। মানুষের বিপদে পাশে দাঁড়িও। মনে রেখো, এটাই বাঙালির সবচেয়ে বড় শক্তি।”

সংক্ষিপ্ত তথ্য

নাম : মুক্তিযোদ্ধা ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল (বীরপ্রতীক)।

ট্রেনিং: ভারতের তুরা থেকে দুই মাসের ট্রেনিং শেষে এক্সপ্লোসিভের ওপর বিশেষ ট্রেনিংও সমাপ্ত করেন।

মুক্তিযুদ্ধ করেছেন: এগারো নম্বর সেক্টরে হালুয়াঘাটের ঘোষগাঁও বিওপি এলাকায়। এছাড়া কামালপুর অপারেশনে কর্নেল তাহের আহত হওয়ার দিন তিনি তার সঙ্গে ছিলেন।
#
ছবি ও ভিডিও : সালেক খোকন

#
সালেক খোকন

লেখক, গবেষক।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

 


Follow for More!

Manual1 Ad Code
Manual4 Ad Code