ক্র্যাচের কর্নেলের বিয়ে

প্রকাশিত: ২:৩৩ পূর্বাহ্ণ, জুলাই ২৪, ২০২০

ক্র্যাচের কর্নেলের বিয়ে

Manual2 Ad Code

|| ফজলুল বারী || সিডনি (অস্ট্রেলিয়া), ২৪ জুলাই ২০২০ : পর্যটক জীবনেই আমি ঢাকায় প্রথম কর্নেল তাহেরের বাসায় যাই। শ্যামগঞ্জ-কাজলা ঘুরে মানুষের কাছে তাহেরকে যতোটা জেনেছি-শুনেছি তাঁর সংসারটা দেখার খুব সাধ নয়। মোহাম্মদপুরের খুব সাধারন একটি প্রায় পরিত্যক্ত বাড়িতে তখন সেই সংসার।

Manual1 Ad Code

সাম্প্রতিক সময়ের একজন আলোচিত-বিতর্কিত লেখক মহিউদ্দিন আহমদ লিখেছেন লুৎফা তাহেরকে নাকি চাকরি দিয়েছেন তাঁর স্বামীর হন্তারক জিয়া! একজনের স্বামীকে খুন করে চাকরি-অনুদান দেবার মুখস্ত কালচার বাংলাদেশে আছে।
এরশাদ যেটা খালেদা জিয়াকে অনুদান-বাড়ির আকারে দিয়েছিলেন। খালেদা জিয়ার চাকরি করার মতো পড়াশুনাও ছিলোনা। কিন্তু লুৎফা তাহেরের সংগ্রাম জানার চেষ্টা করলে মহিউদ্দিন সাহেব এভাবে কটাক্ষপূর্ন লেখাটি লিখতেননা।
ছাব্বিশ বছর বয়সেই বিধবা হন লুৎফা তাহের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগ থেকে তিনি মাস্টার্স করেন। তাঁর বাবা একজন সরকারি চিকিৎসক ছিলেন। মাত্র সাত বছরের বৈবাহিক জীবনে তিনি তিন সন্তানের মা হন।
বারডেমের ডাঃ মোহাম্মদ ইব্রাহিমের বন্ধু ছিলেন লুৎফা তাহেরের বাবা। ওই বয়সে বৈধব্য জোটার পর লুৎফা যখন ঢাকায় আসেন তখন পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের দ্বিতীয় গ্রেডের ওই চাকরির সন্ধান দেন এই ডাঃ ইব্রাহিম।
মোহাম্মদপুরের সেই বাসায় প্রথম যাবার মজার একটা অভিজ্ঞতাও ছিল। আমি তখন দিনে গড়ে ১৮-২০ কিঃমিঃ হেঁটে বেড়াই। চেহারার বিধবস্ত অবস্থা। পিঠে একটা ব্যাগের কারনে রাস্তায় অনেক মানুষ আমাকে ফেরিওয়ালা মনে করেও ডাকতেন।
তাহেরের তিন ছেলেমেয়ে নীতু, যীশু, মিশু তিনটাই তখন ছোট। আমাকে দেখে তারা প্রথম সাহায্যপ্রার্থী মনে করেছিল। এসব মনে করে তারা এখনও হাসাহাসি করে। এখনও মজা করে বলে আপনার চেহারা তখন সাহায্যপ্রার্থীর মতোই লাগতো।
অতঃপর আমার পর্যটনের খাতা দেখে পড়ে, ছবির এলবামগুলো দেখে তাদের ভুল ভাঙ্গে। কারন সেটিতে তাদের দাদুমনির লেখাও ছিল। কাজলায় আমি তাহেরের মা আশরাফুন্নেসার আরেকটি ছেলে হয়েছি। যিনি এদের দাদুমনি।
এরপর থেকে তাহের আর পরিবারটিকে জানতে জানতে পরিবারটির একরকম সদস্য একজন হয়ে যাই। এখানে আগে লুৎফা ভাবীর বিয়ের গল্পটা করি। লুৎফা ভাবীর বাবা তখন ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ হাসপাতালের সরকারি ডাক্তার।
ঈশ্বরগঞ্জ রেল স্টেশনের কাছেই তাদের বাসা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলে থাকতেন লুৎফা। মতিয়া চৌধুরীর সঙ্গে সংগঠন করায় তখনই তাঁকে ভালো চিনতেন জানতেন মতিয়া। কর্নেল তাহেরের চাচা ছিলেন ঈশ্বরগঞ্জের স্টেশন মাস্টার।
ট্রেন থেকে নেমে লুৎফা মাঝে মাঝে সেই স্টেশন মাস্টার মুনসেফ উদ্দিনের বাসায়ও যেতেন। কারন স্টেশন মাস্টারের মেয়েরা তাকে খুব পছন্দ করতো। তাহেরের জন্যে কনে দেখা সেভাবেই শুরু। কনের নাম লুৎফা। পড়েন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
কনে দেখতে আসেন তাহেরের ভাই আবু ইউসুফ এবং তাঁর স্ত্রী। সঙ্গিনীটা যে ভদ্রলোকের স্ত্রী এটি লুৎফা প্রথমে জানতেননা। আবু ইউসুফের প্রশ্ন করার ধরন দেখে মনে করেছিলেন পাত্রটা বুঝি ইনিই। তখন বিয়ের পাত্রীকে নানান প্রশ্ন করা হতো।
এ বিয়ের বিষয়টা অবশ্য এক রকম চাপা পড়েও গিয়েছিল! কারন পাত্র সেনাবাহিনীতে চাকরি করেন। সেনাবাহিনীর লোক কখন না আবার মরেটরে যায় এই চিন্তায় পিছিয়ে যায় লুৎফার পরিবার। তাহের তখন সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন।
তাঁর পোস্টিং ছিল চট্টগ্রামে। লুৎফাকে তাহের পরিবারের এতোটাই পছন্দ হয়েছিল যে তারা পিছু ছাড়েনি। অতঃপর লুৎফা একদিন জানতে পারেন তাঁর বিয়ে ঠিক হয়েছে। পাত্র সেনাবাহিনীর সেই ক্যাপ্টেন। ১৯৬৯ সালের ৭ আগষ্ট বিয়ে হয়।
বিয়ের বরযাত্রী হিসাবে তাহেরের বন্ধু সেনাবাহিনীর সদস্য যারা আসেন তারা সামরিক কায়দায় ফাঁকা গুলি করতে করতে ঢোকেন বিয়ের অনুষ্ঠানে। বিয়ের পর দিন তাহের ট্রেনে লুৎফাকে নিয়ে ঢাকা রওয়ানা হন।
তাহেরের ভাই আবু ইউসুফ ও পরিবারের সদস্যরাও সঙ্গে ছিলেন। ট্রেন ময়মনসিংহ স্টেশনে পৌঁছলে তারা দেখেন অনেক ভিড় স্টেশনে। অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ, মতিয়া চৌধুরী প্রমুখ ময়মনসিংহে জনসভা শেষ করে ফিরছিলেন ঢাকায়।
আবু ইউসুফকে তখনই ভালো চিনতেন মতিয়া চৌধুরী। তাঁর অনুরোধে তারা সেই কামরায় ওঠেন। তখনই মতিয়ার সঙ্গে গল্প জমে যায় তাহেরের। একজন সেনা অফিসার দেশের রাজনীতির এত খুঁটিনাটি খোঁজ রাখেন!
মতিয়া যেন তা দেখেশুনে চমৎকৃত হন। লুৎফাও সেই প্রথম দেখেন তাঁর সেনা অফিসার স্বামীটি মূলত একজন রাজনীতিক পোকা! এরপর থেকে দেখতে থাকেন তাঁর শশুরবাড়ির লোকজন, প্রতিটি সদস্য সারাক্ষন রাজনীতিরই আলাপ করেন।
এটিই এদের ধ্যান-জ্ঞান-বিনোদন সবকিছু। বিয়ের পরেই তাহের বদলি হন পশ্চিম পাকিস্তানে। একই সঙ্গে মেজর হিসাবে প্রমোশন পান। হল ছেড়ে লুৎফা তখন ভাসুর আবু ইউসুফের বাসায় থাকতেন।
মাস চারেক পর পাকিস্তান থেকে হঠাৎ একদিন ফিরে আসেন তাহের। তাঁকে কমান্ডো ট্রেনিং’এ ৬ মাসের জন্যে পাঠানো হচ্ছে আমেরিকায়। একমাত্র বাঙালি অফিসার হিসাবে তিনি এই সুযোগ পেয়েছেন। সুযোগটা পেয়ে তাহেরও বেশ খুশি।
ঠিক হয় আমেরিকায় ট্রেনিং শেষে তাহের লন্ডনে আসবেন। ট্রেনিং শেষে তাঁর দুই মাসের ছুটি। ওই সময় লুৎফা যাবেন লন্ডনে। সেখানেই হবে তাদের হ্যানিমুন। লন্ডনে হ্যানিমুন শেষে স্বামীর সঙ্গে লুৎফা পাকিস্তানে যান।
একাত্তরের ফেব্রুয়ারিতে দেশে ফিরে আসেন। তিনি তখন সন্তান সম্ভবা। দেশে তখন বিশেষ এক পরিস্থিতি। বাবার বাড়ি-শশুরবাড়ি যেখানে যান দেখেন শুধু প্রতিরোধ প্রস্তুতি। লুৎফার ভাইরা ঈশ্বরগঞ্জে, তাহেরের ভাইরা কাজলায় ব্যস্ত প্রতিরোধে।
ওই অবস্থায় এপ্রিলের ৬ তারিখে বাবার বাড়িতে তার প্রথম সন্তান জয়া’র জন্ম হয়। এই মেয়েটির আরেক নাম নিতু। কিন্তু দেশের ওই অবস্থায় ঈশ্বরগঞ্জ থাকাটা লুৎফার কাছে নিরাপদ মনে হয়না।
সাত দিনের ছোট বাচ্চাকে নিয়ে লুৎফা চলে গেলেন কাজলার শশুরবাড়িতে। ওখানেও তখন বিশেষ পরিস্থিতি। শুধু পরিবারের সদস্য না, ঢাকা থেকেও বিপুল সংখ্যক মানুষ পালিয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছেন সেই বাড়িতে। বাড়িজুড়ে ঠাঁই নেই ঠাঁই নেই অবস্থা!
লুৎফার দুশ্চিন্তা তখন তিনি তাহেরের কোন খবর পাচ্ছিলেননা। তাদের একটি সন্তানের জন্ম হয়েছে। বাবা তাঁর রাজকন্যা দেখলোনা। খবরও পৌঁছানো গেলোনা। ওই সময়েই কাজলার বাড়িতে একটি ইঙ্গিতপূর্ণ চিঠি আসে!
মায়ের কাছে লেখা চিঠিতে তাহের জানান, ‘যখনই সম্ভব হবে, সময়মতো পৌঁছাবো’। কাজলার বাড়িতে তখন সবাই ভিড় করে রেডিও শোনেন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, আকাশবানী কলকাতা, বিবিসির বাংলা অনুষ্ঠান তখন ভীষন জনপ্রিয়।
জুলাই মাসে আকাশবানী রেডিওর একটি খবরে তারা চমকে ওঠেন। আকাশবানীর খবরে বলা হয়, পাকিস্তান থেকে পালিয়ে দিল্লী এসে পৌঁছেছেন চার গুরুত্বপূর্ন সেনা অফিসার। তারা মুক্তিবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওসমানীর সঙ্গে দেখা করেছেন।
নিরাপত্তার স্বার্থে তাদের তখন নাম প্রকাশ করা হয়নি। কিন্তু লুৎফা এবং তাহের পরিবারের সদস্যরা ধারনা করতে পারেন এই চারজনের একজনই তাহের। জুলাইর শেষের দিকে ছদ্মবেশে বাড়িতে আসেন দুই আগন্তুক।
এদের একজন তাহেরের ভাই আবু সাঈদ এবং অপরজন লুৎফার ভাই সাব্বির। তাহের লুৎফাকে নিয়ে যেতে তাদেরকে পাঠিয়েছেন। তাহেরের দুই বোন ডালিয়া-জুলিয়াকে নিয়ে লুৎফা রওয়ানা হন। বোরকা পরে নেন লুৎফা।
শিশু মেয়ে জয়াকে লুকান বোরকায়। তারা প্রথমে ট্রেনে করে নেত্রকোনার টাকরাকোনা পর্যন্ত যান। এরপর সীমান্ত পর্যন্ত যেতে নৌকা নেন। কিন্তু দূর্গম সেই যাত্রা। পথ বন্ধুর। সতর্কতা হিসাবে বারবার পথ-রুট পাল্টাতে হচ্ছিল।
তাহেরের পলায়নের খবর ক্ষিপ্ত পাকিস্তানিরা তার বাবার বাড়ি-শশুরবাড়িতে অভিযান চালিয়ে নানাজনকে ধরে নিয়ে গেছে। তারা হন্যে হয়ে খুঁজছে লুৎফা তাহেরকে। নানান সংগ্রামে ভারতে পৌঁছতে পারেন লুৎফা। জয়ার বয়স তখন তিনমাস।
পথের নানান অনিয়মে তার ডায়রিয়া দেখা দেয়। মেঘালয়ের তুরায় পৌঁছবার পর মুক্তিযোদ্ধারা তাদেরকে একটি বাড়িতে তোলা হয়। সেখানে পৌঁছে প্রথম সন্তানের মুখ দেখেন তাহের। তাঁর সঙ্গে তখন বিএসএফ’এর কয়েক কর্মকর্তা।
মেয়ে দেখে খুশি খুশি চেহারায় তাঁর একটিই বক্তব্য, বলেছিলামনা। চলে আসবো। চলে এসেছি। মেয়ে দেখা শেষে আবার তাহের ফিরে গেলেন যুদ্ধে। এটিই মুক্তিযুদ্ধ। এমন এক যুদ্ধক্ষেত্রের নেতা ছিলেন জনতার তাহের।

Manual6 Ad Code

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

 


Follow for More!

Manual1 Ad Code
Manual5 Ad Code