ভারত উপমহাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের শতবর্ষ

প্রকাশিত: ৫:৩৭ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ১৭, ২০২০

ভারত উপমহাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের শতবর্ষ

Manual4 Ad Code

|| আবদুল্লাহ ক্বাফী রতন || ঢাকা, ১৭ অক্টোবর ২০২০ : এ বছর ২০১৯ সালের ৬ মার্চ বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির ৭১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালিত হয়েছে। কিন্তু আমরা যে কমিউনিস্ট উত্তরাধিকার বহন করি তা এ বছর ১০০ বছরে পদার্পন করেছে। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাকাল নিয়ে ভারতের প্রধান দুটি কমিউনিস্ট পার্টি সিপিআই ও সিপিআই(এম) এর মধ্যে মতভিন্নতা রয়েছে। সিপিআই(এম) ১৯২০ সালের ১৭ অক্টোবর ও সিপিআই ১৯২৫ সালের ২৬ ডিসেম্বরকে প্রতিষ্ঠা দিবস হিসেবে পালন করে। ১৯৫৯ সালের ১৯ আগস্ট অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদকমণ্ডলী ১৯২৫ সালের ২৬ ডিসেম্বরকে সর্বসম্মতভাবে পার্টির প্রতিষ্ঠা দিবস হিসেবে গ্রহণ করেছিল। সে বিতর্কে অংশ না নিয়েই বলা যায় গত শতাব্দীর বিশের দশকের শুরুতেই ভারত উপমহাদেশ তথা বর্তমান ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কমিউনিস্ট আন্দোলন অঙ্কুরিত হয়েছিল। সেই বিবেচনায় ভারত উপমহাদেশে কমিউনিস্ট আন্দোলন তার শতবর্ষে পা রেখেছে। এ নিবন্ধে ভারত উপমহাদেশে কমিউনিস্ট আন্দোলনের উন্মেষকাল নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

মার্কসবাদের সাথে ভারত উপমহাদেশবাসীর পরিচয়

১৮৭১ সালের ১৫ আগস্ট প্রথম আন্তর্জাতিকের সভার কার্যবিবরণী থেকে জানা যায় কলকাতা থেকে জনৈক ব্যক্তি প্রথম আন্তর্জাতিকের সম্পাদকের কাছে এক পত্রে ভারতবর্ষে আন্তর্জাতিকের শাখা প্রতিষ্ঠার ক্ষমতা চেয়েছেন। এ সভায় স্বয়ং কার্ল মার্কস ও ফ্রেডারিখ এঙ্গেলস উপস্থিত ছিলেন। ১৯০০ সালে ডন পত্রিকায় ফ্রেডারিখ এঙ্গেলসের একটি বই নিয়ে গুরুত্বের সাথে আলোচনা করা হয়। ১৯০৪ সালে আমস্টার্ডমে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকে যোগ দেন দাদাভাই নৌরজী। ১৯০৭ সালে স্টুটগার্টে আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন ভিকাজী রুস্তম কামা, সর্দ্দার সিং রাওজী রাণা ও বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়। ১৯১০ সালে মডার্ন রিভিউ পত্রিকায় একটি প্রবন্ধে ‘কমিউনিস্ট ইশতেহার’ থেকে উদ্ধৃতি দেয়া হয়। ১৯১২ সালে লালা হরদয়াল একই পত্রিকায় Karl Marx-A Morden Rishi নামে প্রবন্ধ লিখেন। ১৯১২ সালেই কে. রামকৃষ্ণ পিল্লাই কার্ল মার্কসের জীবনী গ্রন্থ রচনা করেন। মূলতঃ ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লব এবং ১৯১৮-২২ সালের ভারতের শ্রমিকশ্রেণির সংগ্রাম ভারতে মার্কসবাদের উদ্বোধন ঘটায়।

রুশ বিপ্লবের প্রভাব

ভারতীয় জাতীয় বিপ্লবীদের একটি অংশ যারা নানা কারণে দেশের বাইরে অবস্থান করছিলেন এবং দেশের স্বাধীনতার জন্য কাজ করছিলেন ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লব তাদের অনেকের ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। জার্মানিতে যারা অবস্থান করছিলেন তারা স্বদেশমুক্তির জন্য বার্লিন কমিটি’ গঠন করেছিলেন। ১৯২১ সালে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের আমন্ত্রণে ইউরোপ থেকে বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, গোলাম আম্বিয়া খান লোহানীসহ মোট নয় জন যোগ দেন। এদের মধ্যে স্বামী বিবেকানন্দের ছোট ভাই ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত ১৯২৫ সালে দেশে ফিরে এসে মার্কসবাদ প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।

Manual2 Ad Code

নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য যিনি এম এন রায় নামে পরিচিত। তিনি ‘অনুশীলন সমিতি’র সদস্য ছিলেন। ১৯১৫ সালে দলের জন্য অস্ত্র সংগ্রহ করতে বিদেশ পাড়ি দেন। জাপান, চীন হয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যান। সেখানে মার্কসবাদী সাহিত্যের সাথে পরিচিত হন। আমেরিকান এভেলিনা ট্রেন্টকে বিয়ে করেন। মার্কিন পুলিশের নাজেহালের ভয়ে ১৯১৭ সালের গ্রীষ্মে মেক্সিকো চলে যান। সেখানে তিনি সমাজবাদী চিন্তায় আকৃষ্ট হন এবং সেখানকার সমাজবাদী দল ‘সোশ্যালিস্ট ওয়ার্কার্স পার্টি’তে যোগ দিয়ে তার সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯১৯ সালে রুশ কমিউনিস্ট নেতা মাইকেল বরোদিনের সাথে এম এন রায়ের পরিচয় হয়। কমরেড বরোদিনের কাছে রায় মার্কসবাদের শিক্ষা লাভ করেন। তিনি সোশ্যালিস্ট ওয়ার্কার্স পার্টিকেই মার্কসবাদী দলে রুপান্তরিত করেন এবং মেক্সিকোর কমিউনিস্ট পার্টি গঠনের মধ্য দিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের বাইরে পৃথিবীর প্রথম কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯২০ সালের ১৯ জুলাই-৭ আগস্ট পর্যন্ত অনুষ্ঠিত কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের দ্বিতীয় কংগ্রেসে যোগ দেন।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে ভারতের পাঞ্জাব ও হরিয়ানা থেকে প্রচুর শিখধর্মাবলম্বী পাঞ্জাবী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পানামায় গিয়েছিলেন। সেখানে তারা স্বাধীনতার লক্ষ্যে গদর পার্টি সংগঠিত করেন। রুশ বিপ্লবের প্রভাবে তারা মার্কসবাদ-লেনিনবাদে আকৃষ্ট হন। অনেকেই দেশে ফিরে এসে কমিউনিস্ট আন্দোলন সংগঠিত করেন।

প্যান ইসলামিক খেলাফত আন্দোলনে অংশ নেয়া মুসলিম জাতীয়তাবাদী বিপ্লবীরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর হিজরত আন্দোলনে যোগ দিয়ে দেশত্যাগ করে সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্য এশিয়ার প্রদেশসমূহে অবস্থান গ্রহণ করেন। রুশ বিপ্লবের প্রভাবে তাদের অধিকাংশই মার্কসবাদ-লেনিনবাদকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেন।

১৯২২ সালে চৌরিচৌরায় পুলিশ হত্যার ঘটনায় গান্ধী কর্তৃক একতরফাভাবে অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেয়ায় স্বাধীনতাকামী জাতীয়তাবাদী সশস্ত্র বিপ্লবীদের একাংশ কংগ্রেস রাজনীতির প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেন এবং রুশ বিপ্লবের প্রভাবে মার্কসবাদ-লেনিনবাদকে মতাদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেন। বাংলায় ধরণী গোস্বামীর নেতৃত্বে তাঁরা ইয়ং কমরেডস লীগের মাধ্যমে নিজেদের সংগঠিত করেন। এ গ্রুপে মণি সিংহ, গোপাল বসাক, গোপেন চক্রবর্তীসহ অনেকে ছিলেন। এছাড়া গণনায়ক পার্টি, সাম্যরাজ পার্টি, কারখানা গ্রুপ, লাল নিশান গ্রুপ ইত্যাদি মাধ্যমে সংগঠিত জাতীয় বিপ্লবীরা কমিউনিস্ট পার্টিতে শামিল হন।

এর পাশাপাশি এ সময়কালে শ্রমিকদের শক্তিশালী লড়াই কমিউনিস্ট আন্দোলনের ভিত্তি গড়তে সহযোগিতা করে। ১৯২০ সালের অক্টোবর মাসে মুম্বাইয়ে অল ইন্ডিয়া ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হয়। পুরো ত্রিশের দশক ভারতের শ্রমিকশ্রেণি বড় বড় সংগ্রাম গড়ে তুলে। শুধু মাত্র বাংলার বিভিন্ন শিল্পাঞ্চল, আসামের চা বাগান ও বিহারের খনি এলাকায় অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক উভয়বিধ কারণে ১৯২০ সালে ১৩৭ টি, ১৯২১ সালে ১৫০টি ও ১৯২২ সালে ৯১টি ধর্মঘট সংগঠিত হয়েছিল।

Manual2 Ad Code

বিভিন্ন স্থানে কমিউনিস্ট চক্র বা গোষ্ঠীর উদ্ভব

কমিনটার্নের দ্বিতীয় কংগ্রেসের পরই এম এন রায় ১৯২০ সালের ১৭ অক্টোবর তাসখন্দে প্রবাসী ভারতীয় ও দুজন বিদেশিনীকে নিয়ে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গঠন করেন। এরা হলেন ১) মানবেন্দ্র নাথ রায় (এম এন রায়), ২) এভেলিনা ট্রেন্ট রায় (এম এন রায়ের মার্কিন স্ত্রী), ৩) অবনী মুখার্জী, ৪) রোজা ফিটিংগোফ মুখার্জী (অবনী মুখার্জীর রুশ স্ত্রী), ৫) মুহম্মদ আলী (আহমেদ হাসান), ৬) এম প্রতিবাদী বায়াঙ্কার আচার্য (মান্ডায়াম পার্থ সারথি তিরুমারাই আচার্য), ৭) মুহম্মদ শফিক সিদ্দিকী। এই কমিটির সম্পাদক নির্বাচিত হন মুহম্মদ শফিক সিদ্দিকী। ১৯২০ সালের ১৫ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত কমিটির সভায় রায়, শফিক ও আচার্য এই তিন জনকে নিয়ে পার্টির ‘কার্যকরী কমিটি’ গঠিত হয়। ১৯২১ সালে এই কমিটি কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি লাভ করে। ১৯২২ সালের এপ্রিলে এম এন রায়ের বার্লিন গমনের সাথে সাথে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির হেড কোয়ার্টার বার্লিনে স্থানান্তরিত হয়। এম এন রায়ের সম্পাদনায় ১৯২২ সালের ১৫ মে ইংরেজি ভাষায় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম মুখপত্র পাক্ষিক ‘দি ভ্যানগার্ড অব দি ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেনডেন্স’ প্রকাশিত হয়। মাঝখানে পুলিশের নজরে এড়াতে ‘দি এডভান্স গার্ড’ নামে কয়েক সংখ্যা বের হলেও ১৯২৩ সালের ১৫ মে দ্বিতীয় বর্ষ প্রথম সংখ্যা ‘দি ভ্যানগার্ড’ নামে প্রকাশিত হয়। মাস্টার হেডের নীচে প্রথম বারের মত লেখা হলো ‘ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র’ তার নীচে লেখা থাকতো ‘কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের অঙ্গীভূত’। এ সকল পত্রিকার মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষে অনেক ব্যক্তি কমিউনিস্ট পার্টি ও মার্কসবাদের প্রতি আকৃষ্ট হন।

কলকাতা, বোম্বে (বর্তমানে মুম্বাই), লাহোর, মাদ্রাজ (বর্তমানে চেন্নাই) এ চারটি শহরে প্রথম পার্টি গড়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। পৃথক চারটি শহরে প্রায় একসাথে পার্টি গড়ার কাজের সূত্রপাত হয়েছিল যার মধ্যবিন্দু ছিলেন কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক কর্তৃক দায়িত্বপ্রাপ্ত এম এন রায়। এ চারটি জায়গায় কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের সাথে স্বাধীনভাবে সংযোগ সৃষ্টি হয়েছিল এবং কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকই কোনো কোনো ক্ষেত্রে উদ্যোক্তাদের মধ্যে সংযোগ ঘটিয়ে দিয়েছিল। যেমন কোলকাতার মুজাফ্ফর আহমদের সাথে মুম্বাইয়ের শ্রীপাদ অমৃত ডাঙ্গের সংযোগ ঘটিয়ে দিয়েছিল। ১৯২১ সালে ডিসেম্বরের মধ্যেই ভারতবর্ষের অভ্যন্তরীস্থ নবদীক্ষিত কমিউনিস্টদের সাথে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল। মুম্বাইয়ে এস এ ডাঙ্গে প্রথম মার্কসবাদে দীক্ষিত হন। ১৯২১ সালে তিনি। ‘গান্ধী বনাম লেনিন’ নামে পুস্তক লিখেন। ১৯২২ সালে। ‘সোশালিস্ট’ নামে পত্রিকা বের করেন এবং তাকে কেন্দ্র করে একদল তরুণ মাকর্সবাদী সাহিত্য পাঠ শুরু করেন। এদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন সচ্চিদানন্দ বিষ্ণু ঘাটে। চেন্নাই (মাদ্রাজ) এ কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি আকৃষ্ট প্রথম ব্যক্তি হচ্ছেন শ্রমিক নেতা মায়লাপুরম সিঙ্গারাভেলু চেট্টিয়ার। লাহোর (পাঞ্জাব) এ তাসখন্দে গঠিত পার্টির সদস্য মুহম্মদ আলীর প্রভাবে তাঁর বন্ধু পেশোয়ারের এডওয়ার্ডস্ চার্চ মিশন কলেজের অর্থনীতির শিক্ষক গুলাম হুসায়ন চাকুরি ছেড়ে লাহোরে এসে পার্টি গড়ার জন্য রেলওয়ে ওয়ার্কার্স ইউনিয়নে যোগ দিয়েছিলেন। তিনি ‘ইনকিলাব’ নামে একটি উর্দু পত্রিকা প্রকাশ করেন।

১৯২১ সালের নভেম্বর মাসে মার্কসবাদী সাহিত্য ক্রয়ের মাধ্যমে কমিউনিজমের সাথে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ঘটে কলকাতায় বসবাসরত সন্দ্বীপের মুজাফ্ফর আহমদের। তাঁর ক্রয়কৃত বইগুলোর মধ্যে ছিল ‘বামপন্থি কমিউনিজমের শিশুসুলভ বিশৃঙ্খলা’ ও ‘পিপলস্ মার্কস’ (ক্যাপিটেলের সংক্ষিপ্তসার)। ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসে তাঁর পরিচয় ঘটে এম এন রায়ের প্রেরিত নলীনি গুপ্তের সাথে। যিনি রায়ের নির্দেশে ভারতে এসেছিলেন জাতীয় বিপ্লবীদের সাথে যোগাযোগ করে তাঁদেরকে কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি আকৃষ্ট করতে। নলিনী গুপ্তই হচ্ছেন এম এন রায় ও কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের সাথে মুজাফ্ফর আহমদের যোগসূত্র। কমিউনিস্ট আন্দোলনে নেমে মুজাফ্ফর আহমদের সাথে প্রথম সংযোগ হয় জাতীয় বিপ্লবী ভূপেন্দ্রকুমার দত্তের সাথে। দ্বিতীয় আবদুর রাজ্জাক খান এবং তৃতীয় আবদুল হালিম। রাজ্জাক এবং হালিম কমিউনিস্ট পার্টি গড়ায় মুজাফ্ফর আহমদের সহযোগী হলেও ভূপেন্দ্রকুমার দত্ত ফিরে গিয়েছিলেন তাঁর পুরোনো সশস্ত্র রাজনীতিতে। এদের সাথে যুক্ত হন শামসুল হুদা। এরাই বাংলার আদি কমিউনিস্ট।

কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র মামলা

উন্মেষকালেই ভারতবর্ষের কমিউনিস্ট আন্দোলনকে ধ্বংস করার জন্য ১৯২১ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর হতে ১৯২৭ সাল পর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে ফিরে আসা কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে পাঁচটি। ‘পেশোয়ার ষড়যন্ত্র মামলা’ দায়ের করা হয়।

১৯২৩ সালের মে মাস থেকে সারাদেশে কমিউনিস্টদের গ্রেপ্তার শুরু করা হয়। ১৩ জনের তালিকা তৈরি করা হয়। ১৯২৪ সালের ১৭ মার্চ থেকে মুজাফ্ফর আহ্মদ, সওকত উসমানী, এস এ ডাঙ্গে ও নলিনী গুপ্ত এ চারজনের বিরুদ্ধে। ‘কানপুর কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র মামলা’ চালু করা হয়। মুজাফ্ফর আহ্মদ ও ডাঙ্গের চার বছর কারাদ- হয়। যক্ষা রোগে আক্রান্ত হওয়ায় মুজাফ্ফর আহমদ ১৯২৫ সালের ১২ সেপ্টেম্বর মুক্তি লাভ করেন।

ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির কানপুর সম্মেলন

কানপুর কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র মামলার প্রাথমিক অভিযুক্ত ১৩ জনের একজন উত্তরপ্রদেশের সত্যভক্ত ১৯২৫ সালের ২৫-২৮ কানপুরে কমিউনিস্ট সম্মেলন আহ্বান করেন। মাওলানা হসরৎ মোহানী ছিলেন অভ্যর্থনা কমিটির চেয়ারম্যান। ২৫ ডিসেম্বর ছিল উদ্বোধনী পর্ব। ২৬ ডিসেম্বর কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠার বিষয় আলোচনা হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠতায় সিদ্ধান্ত হয় পার্টির নাম হবে ‘ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি’। অন্য সিদ্ধান্তে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের সাথে সম্পর্ক দৃঢ় করার সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়। সম্মেলনে ৩০ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠিত হয়। ১৬ জন সম্মেলনে নির্বাচিত হন। সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন এস ভি ঘাটে ও জে পি বাগেরহাট্টা।

ওয়ার্কার্স এন্ড পেজান্টস্ পার্টি

কমিউনিস্টরা ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির কার্যক্রমের পাশাপশি সারাদেশে ওয়ার্কার্স এন্ড পেজান্টস্ পার্টি সংগঠিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করে। সেইমতে বাংলায় ১৯২৬ সালের ৬ ও ৭ ফেব্রুয়ারি কৃষ্ণনগরে অনুষ্ঠিত প্রথম সম্মেলনে ‘দি লেবর স্বরাজ পার্টি অফ দি ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস’র নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় পেজান্টস্ এন্ড ওয়ার্কার্স পার্টি অফ বেঙ্গল (বঙ্গীয় কৃষক ও শ্রমিক দল)। ১৯২৭ সালের ১৯ ও ২০ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় সম্মেলন অতুলচন্দ্র গুপ্ত সভাপতি ও সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯২৮ সালের ৩১ মার্চ-১ এপ্রিল চব্বিশপরগনা জেলার ভাটপাড়াতে অনুষ্ঠিত তৃতীয় সম্মেলনে সংগঠনের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ওয়ার্কার্স এন্ড পেজান্টস্ পার্টি অফ বেঙ্গল (বঙ্গীয় শ্রমিক ও কৃষক দল)। সম্মেলনে অতুলচন্দ্র গুপ্ত সভাপতি ও মুজাফ্ফর আহ্মদ সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এ সম্মেলনে ‘কল টু অ্যাকশন’ নামে কর্মসূচি গৃহিত হয়। দলের মুখপত্র হিসেবে প্রথমে ‘লাঙ্গল’ পরে ‘গণবাণী’ প্রকাশিত হয়।

১৯২৮ সালের ২১-২৩ ডিসেম্বর কলকাতার আলবার্ট হলে ওয়ার্কার্স এন্ড পেজান্টস্ পাটির সর্বভারতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। পৃথকভাবে গড়ে ওঠা বাংলা, বোম্বে, পাঞ্জাব, যুক্তপ্রদেশের ওয়ার্কার্স এন্ড পেজান্টস্ পার্টির নেতৃবৃন্দ ঐক্যবদ্ধভাবে অল ইন্ডিয়া ওয়ার্কার্স এন্ড পেজান্টস্ পাটি গঠন করেন। পাঞ্জাবের মোহন সিং জোশ ও মুম্বাইয়ের আর. এস. নিম্বকরকে সাধারণ সম্পাদক করে সর্বভারতীয় কমিটি নির্বাচিত করা হয়।

মীরাট ষড়যন্ত্র মামলা

সারা ভারতজুড়ে শ্রমিক আন্দোলনের প্রেক্ষিতে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিকে ধ্বংস করার চক্রান্ত অংশ হিসেবে ভারতের গভর্নর জেনারেলের নির্দেশে ১৯২৯ সালের ২০ মার্চ সারা ভারতে ৩২ জন বিশিষ্ট কমিউনিস্ট, শ্রমিক-কৃষক পার্টির নেতা, ট্রেড ইউনিয়ন ও কৃষকনেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। যাদের মধ্যে তিনজন ছিলেন ব্রিটিশ নাগরিক। ১৯২৯ সালের ১২ জুন মীরাট ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ‘মীরাট ষড়যন্ত্র মামলা’ শুরু হয়। ১৯৩৩ সালের ১৬ জানুয়ারি রায় হয়। মামলার রায়ে কমিউনিস্ট নেতাদের যাবজ্জীবন থেকে নানা মেয়াদের কারাদণ্ড দেয়া হয়।

বাংলায় পার্টির বিস্তার

১৯৩৪ সালের মধ্যে ছয়টি জেলা- কলকাতা, হাওড়া, হুগলী, বর্ধমান, যশোর, মেদিনীপুর পার্টির সাংগঠনিক কমিটি গঠিত হয়। ১৯৩০ সালে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখল এবং ১৯৩২ সালে কংগ্রেসের অসহযোগ আন্দোলনের ফলে অসংখ্য জাতীয় বিপ্লবী এবং কংগ্রেস কর্মী কারারুদ্ধ হন। এদের অনেকেই কারাগারে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ মতাদর্শ চর্চা করেন এবং নিজেদের কমিউনিস্ট পার্টির কর্মী হিসেবে পরিচয় দেন। ১৯৩৭-৩৮ সালে তাঁরা মুক্ত হয়ে পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন এবং বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে পড়েন। ফলে ১৯৩৯ সালের মধ্যে দার্জিলিং ও কোচবিহার জেলা ছাড়া প্রতিটি জেলায় পার্টির সাংগঠনিক কমিটি গঠিত হয়।

Manual4 Ad Code

চক্র বা গোষ্ঠী স্তর থেকে পার্টি স্তরে উত্তরণ

Manual3 Ad Code

১৯৩৩ সালের ডিসেম্বর মাসে কলকাতায় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সর্বভারতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনে বাংলার প্রতিনিধিত্ব করেন আব্দুল হালিম, রণেন সেন, সোমনাথ লাহিড়ী। মুম্বাই থেকে উপস্থিত ছিলেন ড. গঙ্গাধর অধিকারী, এস জি পাটকর, নাগপুর থেকে এম এল জয়মন্ত, পাঞ্জাব থেকে গুরুদিৎ সিং, উত্তর প্রদেশ থেকে পি সি যোশী। সম্মেলনে ড. গঙ্গাধর অধিকারী সর্বসম্মতিক্রমে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। সম্মেলনে উপস্থিত সকলকে নিয়ে কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত হয়। বড়লাটের নির্দেশে ১৯৩৪ সালের ২৮ জুলাই কমিউনিস্ট পার্টিসহ সারাদেশে অসংখ্য বামপন্থি সংগঠন বেআইনি ঘোষণা করা হয়। মুম্বাইয়ে সুতাকল শ্রমিকদের ধর্মঘট সংঘটিত করায় ১৯৩৪ সালে ডা. অধিকারীকে গ্রেপ্তার করে বিজাপুরে অন্তরীণ রাখা হয়। অধিকারীর পরে এস ভি ঘাটে সাধারণ সম্পাদক হন। একই বছর ঘাটে কারান্তরীণ হলে এস এস মিরাজকর সাধারণ সম্পাদক হন। এস ভি ঘাটে, এস এস মিরাজকর, সোমনাথ লাহিড়ী এই তিনজনকে নিয়ে পলিটব্যুরো গঠিত হয়। ১৯৩৫ সালে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের সপ্তম কংগ্রেসে যোগদানের জন্য মস্কো যাওয়ার পথে সিঙ্গাপুরে গ্রেপ্তার হন মিরাজকর। তখন সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেয়া হয় সোমনাথ লাহিড়ীকে। ১৯৩৬ সালের শুরুতে লাহিড়ী মুম্বাইয়ে গ্রেপ্তার হয়ে যান। এসময় দুই বছর জেল খেটে বের হয়ে এসে পার্টির সদর দপ্তরের দায়িত্ব গ্রহণ করেন পি সি যোশী। ১৯৩৬ সালে লক্ষেèৗয় কেন্দ্রীয় কমিটির সভায় অজয় ঘোষ, ভরদ্বাজ, ড. অধিকারী ও পি সি যোশীকে নিয়ে পলিটব্যুরো গঠিত হয় এবং পি সি যোশী সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। পার্টির গোপন সদর দপ্তর কলকাতায় স্থানান্তরিত হয়।

লেখক : সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, সিপিবি

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ