সিলেট ১৫ই অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৩০শে আশ্বিন, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ৮:১৬ পূর্বাহ্ণ, আগস্ট ২০, ২০২১
ঢাকা, ২০ আগস্ট ২০২১ : আজ শুক্রবার ১০ মহররম শোহাদায়ে কারবালা (অা:) ‘পবিত্র আশুরা’ দিবস।
কারবালার শোকাবহ ঘটনাবহুল এ দিনটি মুসলমানদের কাছে ধর্মীয়ভাবে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। ত্যাগ ও শোকের প্রতীকের পাশাপাশি বিশেষ পবিত্র দিবস হিসেবে দিনটি পালন করা হয় মুসলিম বিশ্বে। বাংলাদেশেও যথাযোগ্য মর্যাদায় ও সংক্ষিপ্ত কর্মসূচিতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে অাহলে বায়েতের সম্মানে ও ভালোবাসায় পবিত্র আশুরা পালিত হবে।
হিজরি ৬১ সনের ১০ মহররম এই দিনে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (দ.) এর দৌহিত্র হযরত ইমাম হোসেইন (অা.) এবং তাঁর পরিবার ও অনুসারীরা সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে অসম যুদ্ধে ফোরাত নদীর তীরে কারবালা প্রান্তরে ইয়াজিদ বাহিনীর হাতে শহীদ হন। এ ঘটনা স্মরণ করে বিশ্ব মুসলিম যথাযোগ্য মর্যাদায় দিনটি পালন করে থাকে। শান্তি ও সম্প্রীতির ধর্ম ইসলামের মহান আদর্শকে সমুন্নত রাখতে তাদের এই আত্মত্যাগ মানবতার ইতিহাসে সমুজ্জ্বল হয়ে রয়েছে।
কারবালার এই শোকাবহ ঘটনা ও পবিত্র আশুরার শাশ্বত বাণী সকলকে অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে এবং সত্য ও সুন্দরের পথে চলতে প্রেরণা যোগায়।
বিদ্যমান করোনা পরিস্থিতিতে এ উপলক্ষে রাজধানী ঢাকাসহ দেশব্যাপী সংক্ষিপ্ত কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এ উপলক্ষে রাজধানীতে বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে পুলিশ বিভাগ।
করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতির কারণে এবার পবিত্র মহররম উপলক্ষে সব ধরনের তাজিয়া মিছিল, শোভাযাত্রা, মিছিল বন্ধ থাকবে।
আজ ধর্ম মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ নির্দেশনা দেয়া হয়।
ধর্ম মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ৬ আগস্ট ধর্ম মন্ত্রণালয়ের জারি করা বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে সব ধর্মের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে এর আগে আরোপিত বিধিনিষেধ বহাল থাকবে।
একই সাথে পবিত্র মহররম উপলক্ষে সকল প্রকার তাজিয়া মিছিল, শোভাযাত্রা, মিছিল ইত্যাদি বন্ধ থাকবে। তবে যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব অনুসরণপূর্বক আবশ্যক সকল ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান প্রতিপালিত হবে।
দিবসটি উপলক্ষে আজ শুক্রবার সরকারি ছুটি। এ উপলক্ষে জাতীয় দৈনিক পত্রিকাগুলো আজ বিশেষ প্রবন্ধ, নিবন্ধ প্রকাশ করবে। এ ছাড়া বাংলাদেশ বেতার ও বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ বিভিন্ন বেসরকারি রেডিও-টিভি চ্যানেলও এই দিনের তাৎপর্য নিয়ে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা সম্প্রচার করবে।
পবিত্র আশুরা উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন। রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ তাঁর বাণীতে সাম্য, ন্যায়ভিত্তিক ও শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি মুসলিম উম্মাহর ঐক্য, সংহতি ও অব্যাহত অগ্রগতি কামনা করেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, জাতীয় জীবনে সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে পবিত্র আশুরা থেকে শিক্ষা নিতে হবে।
অাহলে বায়েতের সম্মানে ও ভালোবাসায় পবিত্র আশুরা উপলক্ষে রহমানপুর দরবার শরীফ ও মুফতিয়ে অাজম সাইয়্যেদুনা অাবুতাহের রহমানপুরী (রহঃ)-এর মাজার শরীফে অলোচনা সভা, জিকির অাজকার, মোরাকাবা মোশাহেদা, মিলাদ কেয়াম (দঃ) সহ সমগ্র জাহানের সাম্য, ন্যায়ভিত্তিক ও শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি অাহলে বায়েতপন্থী মুসলিম উম্মাহর ঐক্য, সংহতি ও অব্যাহত অগ্রগতির জন্য দোয়া করা হবে।
ইসলামিক পঞ্জিকা অনুযায়ী মুহররম এর দশম দিনকে আশুরা বলা হয়। এটি ইসলাম ধর্ম অনুসারীদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন।
ইহুদীরা মুসার বিজয়ের স্মরণে আশুরার সাওম বা রোজা পালন করত। তবে মুসলমানরা আশুরার পূর্ব ইতিহাসকে প্রত্যাখ্যান করে এবং তারা আশুরাকে কারবালার বিষাদময় ঘটনার স্মরণে পালন করে।
এই দিনটি অাহলে বায়েতপন্থী মুসলমানদের দ্বারা বেশ আনুষ্ঠানিকভাবে পালন করা হয়ে থাকে। এ উপলক্ষে তারা বিভিন্ন ধরনের মিছিল, মাতম ও শোকানুষ্ঠান আয়োজন করে। তবে একটি ক্ষুদ্র অংশ ততবীর পালন করে থাকে। তবে শিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলগুলোতে এসব অনুষ্ঠান চোখে পড়ার মত। যেমন- পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইরান, ইরাক, লেবানন ও বাহরাইন।
আশুরার ঐতিহাসিক গুরুত্ব
জনপ্রিয় ধারণায়, আশুরা মূলত একটি শোকাবহ দিন কেননা এদিন সাইয়্যেদুল মোরসালিন হজরত মুহাম্মদ (দঃ)-এর দৌহিত্র ইমাম হুসাইন (অাঃ) নির্মমভাবে শহীদ হয়েছিলেন। কিন্তু ইসলামের ইতিহাসে এই দিনটি বিভিন্ন কারণে গুরুত্বপূর্ণ। বলা হয়, এই দিনে আসমান ও যমিন সৃষ্টি করা হয়েছিল। এই দিনে পৃথিবীর প্রথম মানুষ আদম-কে সৃষ্টি করা হয়েছিল। এই দিনে আল্লাহ নবীদেরকে স্ব স্ব শত্রুর হাত থেকে আশ্রয় প্রদান করেছেন। এই দিন নবী মুসা-এর শত্রু ফেরাউনকে নীল নদে ডুবিয়ে দেয়া হয়। নূহ (অাঃ)-এর কিস্তি ঝড়ের কবল হতে রক্ষা পেয়েছিলো এবং তিনি জুডি পর্বতশৃংগে নোঙ্গর ফেলেছিলেন। এই দিনে দাউদ (অাঃ)-এর তাওবা কবুল হয়েছিলো, নমরূদের অগ্নিকুণ্ড থেকে ইব্রাহীম (অাঃ) উদ্ধার পেয়েছিলেন; আইয়ুব (অাঃ) দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে মুক্ত ও সুস্থতা লাভ করেছিলেন; এদিনে আল্লাহ তা’আলা ঈসা (অাঃ)-কে ঊর্ধ্বাকাশে উঠিয়ে নিয়েছেন।
প্রচলিত আছে যে এই তারিখেই কেয়ামত সংঘটিত হবে; যদিও এই বিষয়ে মতভিন্নতা রয়েছে।
ইমাম হুসাইন (অাঃ)-এর শাহাদাৎ
হিজরী ৬০ সনে এজিদ বিন মুয়াবিয়া, পিতার মৃত্যুর পর নিজেকে মুসলিম বিশ্বের খলিফা হিসাবে ঘোষণা করে। তার সম্পর্কে বলা হয় যে সে মদ্যপানকে বৈধ ঘোষণা করেছিল। অধিকন্তু সে একই সঙ্গে দুই সহোদরাকে বিয়ে করাকেও বৈধ ঘোষণা করেছিল। শাসক হিসাবে সে ছিল স্বৈরাচারী ও অত্যাচারী। ইমাম হুসাইন (অাঃ) এজিদের আনুগত্য করতে অস্বীকৃত হন এবং ইসলামের সংস্কারের লক্ষ্যে মদীনা ছেড়ে মক্কা চলে আসেন। মক্কা থেকে তিনি কুফার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। শেষ পর্যন্ত তিনি কারবালার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। এ সময় উমর ইবনে সাদ আবি ওক্কাসের নেতৃত্বে চার হাজার সৈন্য কারবালায় প্রবেশ করে। কয়েক ঘণ্টা পর শিমার ইবনে জিলজুশান মুরাদির নেতৃত্বে আরো বহু নতুন সৈন্য এসে তার সাথে যোগ দেয়৷ কারবালায় দুই পক্ষ মুখোমুখি অবস্থান নেয় এবং যুদ্ধ শুরু হয়। এই অসম যুদ্ধে ইমাম হুসাইন (অাঃ) এবং তার ৭২ জন সঙ্গী শাহাদৎ বরণ করেন। শিমার ইবনে জিলজুশান মুরাদি নিজে কণ্ঠদেশে ছুরি চালিয়ে ইমাম হুসাইন (অাঃ)-কে শহীদ করে। সেদিন ছিল হিজরী ৬১ সনের ১০ মুহররম।
ঐতিহাসিক পটভূমি
এপ্রিল ৬৮০ খ্রিষ্টাব্দ, মুয়াবিয়া কর্তৃক ইয়াজিদকে খলিফা ঘোষণা করা হয়। ইয়াজিদ মদিনার গর্ভনরকে তাৎক্ষণিকভাবে ইমাম হুসাইন (অাঃ) ও অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তিদের আনুগত্য (বায়াত) আদয়ের জন্য নিদের্শ দেয়। কিন্তু ইমাম হুসাইন (অাঃ) তা প্রত্যাখ্যান করেন। কারণ, তিনি মনে করতেন যে, ইয়াজিদ ইসলামের মূল শিক্ষা থেকে দূরে সরে গেছে এবং হজরত মুহাম্মদ (দঃ)- অাহলে বায়েতের সুন্নাহকে পরিবর্তন করছে। অতঃপর হজরত ইমাম হুসাইন (অাঃ) ও তাঁর পরিবারের সদস্য, সন্তান, ভাই এবং হাসানের পুত্রদের নিয়ে মদিনা থেকে মক্কায় চলে যান।
অপরদিকে কুফাবাসী যারা মুয়াবিয়ার মৃত্যু সম্পর্কে অবগত ছিল তারা চিঠির মাধ্যমে তাদের সাথে যোগ দেওয়ার জন্য ইমাম হুসাইন (অাঃ)-কে অনুরোধ করেন এবং উমাইয়াদের বিপক্ষে তাকে সমর্থন প্রদান করে। প্রত্যুত্তরে ইমাম হুসাইন (অাঃ) চিঠির মাধ্যমে জানান যে অবস্থা পর্যবেক্ষনের জন্য তিনি মুসলিম ইবনে আকীলকে পাঠাবেন। যদি তিনি তাদের ঐক্যবদ্ধ দেখতে পান যেভাবে চিঠিতে বর্ণিত হয়েছে সেরূপতবে খুবই দ্রুতই যোগ দিবেন, কারণ একজন ইমামের দায়িত্ব হচ্ছে কুরআন বর্ণিত অনুসারে কাজের আঞ্জাম দেওয়া, ন্যায়বিচার সমুন্নত করা, সত্য প্রতিষ্ঠিত করা এবং নিজেকে স্রষ্টার নিকট সঁপে দেওয়া। মুসলিম ইবনে আকীলের প্রাথমিক মিশন খুবই সফল ছিল এবং ১৮০০ এর অধিক ব্যক্তি শপথ প্রদান করেছিল। কিন্তু অবস্থা ইতিমধ্যে পরিবর্তন হয়ে যায়। উবাইদুল্লাহ ইবনে জিয়াদ কুফার নতুন গভর্নর হিসেবে যোগ দেন এবং মুসলিম ইবনে আকীলকে হত্যার নির্দেশ জারি করেন। আকীলের শাহাদতবরণের খবর পৌঁছার আগেই ইমাম হুসাইন (অাঃ) কুফার উদ্দেশ্যে যাত্রা আরম্ভ করে দেন।
পথিমধ্যে ইমাম হুসাইন (অাঃ) খবর পান যে আকীলকে কুফায় হত্যা করা হয়েছে। তিনি খবরটি তার সমর্থকদের জানালেন এবং তাদের বললেন যে জনগণ তার সাথে প্রতারণা করেছে। তিনি কোন সংশয় ছাড়াই তার সাথীদের তাকে ছেড়ে চলে যেতে বললেন। অধিকাংশ সঙ্গী তাকে ছেড়ে চলে যায় নিকটাত্মীয়রা ছাড়া। যাই হোক কুফার যাত্রাপথে উবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদের সাথে তাঁকে (ইমাম হুসাইন) মোকাবেলা করতে হয়। কুফাবাসীগণ ইমামবিহীন থাকার কারণে তাঁকে (ইমাম হুসাইন) আমন্ত্রণ করেছিল সে প্রতিশ্রুতির কথা কুফার সেনাবাহিনীকে স্মরণ করতে বললেন। তিনি বললেন যে, কুফাবাসী সমর্থন করেছিলো বলেই তিনি যাত্রা করেছেন। কিন্তু তারা যদি তাঁর (ইমাম হুসাইন) আগমনকে অপছন্দ করে তবে তিনি (ইমাম হুসাইন) যেখান থেকে এসেছেন সেখানে চলে যাবেন। তবে সেনাবাহিনী তাঁকে ( ইমাম হুসাইন) অন্যপথ অবলম্বন করতে বললেন। এতে করে, তিনি (ইমাম হুসাইন) বামদিকে যাত্রা করলেন এবং কারবালায় পৌঁছে গেলেন। সেনাবাহিনী তাঁকে (ইমাম হুসাইন) এমন এক জায়গায় অবস্থান নিতে বাধ্য করল যে জায়গাটি ছিল পানিশূন্য।
সেনাপ্রধান উমার ইবনে সাদ ইমাম হুসাইনের আগমনের উদ্দেশ্য বুঝার জন্য দূত প্রেরণ করলেন। হজরত ইমাম হুসাইন জানালেন যে তিনি কুফাবাসীর আমন্ত্রণে এসেছেন কিন্তু তারা যদি অপছন্দ করে তবে তিনি ফিরে যেতে প্রস্তুত রয়েছেন। যখন এই প্রতিবেদন ইবনে জিয়াদের কাছে পৌছল তখন তিনি সাদকে ইমাম হুসাইন ও তাঁর সমর্থকদের ইয়াজিদের প্রতি আনুগত্য আদায়ের নির্দেশ দিলেন। তিনি এও নির্দেশ দিলেন যে, ইমাম হুসাইন ও তাঁর সঙ্গীরা যাতে কোন পানি না পায়। পরের দিন সকালে উমার বিন সাদ তার সেনাবাহিনীকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে বললেন। আল হুর ইবনে ইয়াজিদ আল তামিম সাদের দল ত্যাগ করে হুসাইনের সাথে যোগ দিলেন। তিনি কুফাবাসীদের বুঝাতে ব্যর্থ হয়ে নবীর নাতীর সাথে বিশ্বাসঘাতকতার জন্য ভৎসর্ণা করলেন। অতঃপর যুদ্ধে তিনি শহীদ হন।
কারবালার যুদ্ধ সকাল থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। দিনটি ছিল ১০ ই অক্টোবর ৬৮০ খ্রিষ্টাব্দ (মুহাররম ১০, ৬১ হিজরি) এই যুদ্ধে প্রায় ৭২ জন শহীদ হন যাদের সকলেই পানি বঞ্চনার শিকার হন। অর্থাৎ সকল পুরুষ সদস্যই শহীদ হন কেবলমাত্র রোগা ও দুর্বল জয়নুল আবেদিন ছাড়া।
এটি এক অসম যুদ্ধ ছিল। যেখানে ইমাম হুসাইন ও তাঁর পরিবার বিশাল এক বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। বিখ্যাত ইতিহাসবিদ আবু রায়হান আল বিন্নী এর মতে, “তাবুগুলোতে আঙুন ধরিয়ে দেওয়া হয় এবং মৃতদেহগুলোকে ঘোড়ার খুড় দ্বারা ক্ষতবিক্ষত ও পদদলিত করা হয়; মানব ইতিহাসে কেউ এমন নৃশংসতা দেখেনি। হত্যার আগমুহূর্তে হজরত ইমাম হুসাইন (অাঃ) বলেন, “ আমার শাহাদতবরণের মধ্য দিয়ে যদি হজরত মুহাম্মদ (দঃ)-এর দ্বীন জীবন্ত হয়, তবে আমাকে তরবারি দ্বারা টুকরো টুকরো করে ফেল।”
উমাইয়া সৈন্যরা হজরত ইমাম হুসাইন (অাঃ) ও তাঁর পুরুষ সঙ্গীদের হত্যা করার পর সম্পদ লুট করে, মহিলাদের গয়না কেড়ে নেয়। শিমার জয়নাল আবেদীনকে হত্যা করতে চাইলে জয়নাব বিনতে আলী এর প্রচেষ্টায় কমান্ডার উমার ইবনে সাদ তাকে জীবিত রাখেন। তাকেও (জয়নাল আবেদীন) বন্দী নারীদের সাথে দামেস্কে ইয়াজিদের দরবারে নিয়ে যাওয়া হয়।
আশুরা উদযাপনের রীতি
ইহুদিরা আশুরা উপলক্ষে মুহররম মাসের ১০ তারিখে রোজা রাখে।
অাহলে বায়েতপন্থী সুন্নী ও শিয়া সম্প্রদায় মর্সিয়া ও মাতমের মাধ্যমে এই দিনটি উদযাপন করে।
আশুরা উপলক্ষে ৯ এবং ১০ মুহররম তারিখে অথবা ১০ এবং ১১ রোজা মুহররম তারিখে রাখা মুলমানদের জন্য সুন্নত।
প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রতি ভালোবাসা ও আনুগত্যই ইমান। আল্লাহ তাআলা কোরআন কারিমে বলেন, ‘(হে নবী সা.) আপনি বলুন, “তোমরা যদি আল্লাহর ভালোবাসা পেতে চাও, তবে আমাকে অনুসরণ করো, তাহলে আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন, তোমাদের গুনাহ মাফ করে দেবেন”’ (সুরা-৩ আল ইমরান, আয়াত: ৩১)। হজরত আনাস (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমাদের কেউ মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না আমি তার কাছে তার পিতা, তার সন্তান ও সব মানুষের চেয়ে বেশি প্রিয় না হব’ (বুখারি শরিফ, প্রথম খণ্ড, পরিচ্ছেদ: ৮, হাদিস: ১৩-১৪, পৃষ্ঠা: ১৯, ই. ফা.)। নবীজি (সা.)-এর ভালোবাসার পূর্ণতা হলো আহলে বাইতের ভালোবাসায়। আল্লাহ তাআলা কোরআন কারিমে উল্লেখ করেছেন, ‘ (হে নবী সা.) আপনি বলুন, “আমি তোমাদের কাছে কোনো বিনিময় চাই না, চাই শুধু আমার স্বজনদের (আহলে বাইতদের) প্রতি ভালোবাসা”’ (সুরা-৪২ শুরা, আয়াত: ২৩)।
আহলে বাইত হলো নবী হজরত মুহাম্মদ (দঃ), হজরত ফাতিমা (অা.), হজরত আলী (অা.), হজরত হাসান (অা.) ও হজরত হুসাইন (অা.) এই পরিবারের সদস্য। এঁদের মাধ্যমেই সংরক্ষিত হয়েছে নবীবংশ। নবীবংশেরই ৭০ জন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য শাহাদত বরণ করেছেন আশুরার দিনে, ইরাকের কুফা নগরীর কারবালার প্রান্তরে ফোরাত নদীর তীরে।
রাসুলে করিম (দ.) বলেন, ‘আমি জ্ঞানের নগর, আলী তার সদর দরজা’ (তিরমিজি)। ‘আমি যার বন্ধু আলীও তার বন্ধু’ (তিরমিজি: ৩৭১৩, ইবনে মাজাহ: ১২১)। ‘হজরত ফাতিমাতুজ জোহরা (রা.) হলেন জান্নাতি রমণীদের প্রধান’ (মুস্তাদরাকে হাকেম,৩: ১৮৫, সিলসিলাতুস সহিহা লিল আলবানি,৩: ৪১১)। ‘হজরত হাসান (রা.) ও হজরত হুসাইন (রা.) হলেন বেহেশতি যুবকদের সরদার’ (মুসনাদে আহমাদ, ১৭: ৩৭)। ‘কারবালা’ ফোরাত নদীর তীরে অবস্থিত একটি প্রান্তর, যেখানে ৬২ হিজরির মহররম মাসের ১০ তারিখ শুক্রবারে নবীদৌহিত্র হজরত হুসাইন (রা.) অত্যন্ত করুণভাবে শাহাদত বরণ করেছিলেন। মানবতার ইতিহাসে এটি অত্যন্ত বিয়োগান্ত ঘটনা। কারবালা যেন আরবি ‘কারব’ ও ‘বালা’–এর সরল রূপ। ‘কারব’ মানে সংকট, ‘বালা’ মানে মুসিবত। তাই কারবালা সংকট ও মুসিবতের প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
কারবালার এই হৃদয়বিদারক ঘটনা মহিমাময় মহররম মাসের ঐতিহাসিক মহান আশুরার দিনে সংঘটিত হওয়ায় এতে ভিন্নমাত্রা যোগ হয়েছে। এতে এই শাহাদতের মাহাত্ম্য যেমন বহু গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে, তেমনি আশুরা ইতিহাসে নতুন পরিচিতি পেয়েছে। আজ আশুরা ও কারবালা বা কারবালা ও আশুরা সমার্থক; একে অন্যের পরিপূরক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
‘ফোরাত’ কুফার একটি সুপ্রাচীন নদী, এই নদীর কূলে অবস্থিত কারবালার প্রান্তর। হুসাইনি কাফেলা যখন কারবালায় অবস্থান করছে, তখন তাদের পানির একমাত্র উৎস এই ফোরাত নদী কুফার শাসক উবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদের বাহিনী ঘিরে রাখে, অবরুদ্ধ করে রাখে নিরস্ত্র অসহায় আহলে বাইতের সদস্যদের। এই নদী থেকে পানি সংগ্রহ করতে গেলে ফুলের মতো নিষ্পাপ দুগ্ধপোষ্য শিশু আলী আসগর সিমারের বাহিনীর তিরের আঘাতে শহীদ হয়।
এজিদের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর জন্য কুফাবাসী হজরত হুসাইনকে (রা.) পত্রের মাধ্যমে আমন্ত্রণ জানায়। তাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে তিনি সেখানে গেলে তারা তাঁকে একাকী বিপদের মুখে ফেলে রেখে নিজেরা নীরব ও নিষ্ক্রিয় থাকে। কারবালা আজও ঘটে চলেছে দেশে দেশে। দুনিয়ার প্রতিটি নদী আজ ফোরাতের কান্না করছে। কুফা যেন সিন্দাবাদের ভূত হয়ে মানবতার ঘাড়ে চেপে বসেছে। দামেস্ক, তুরস্ক ও মিসরের সে খলনায়কদের প্রেতাত্মারা এখনো আমাদের অজ্ঞানতার তমসায় আচ্ছন্ন করে রেখেছে।
সত্য ও ন্যায়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত কারবালার প্রান্তরে নির্মম নির্যাতন ও নিপীড়নে পরাজিত প্রতারিত হুসাইনি কাফেলা চিরস্মরণীয় ও বরণীয়। প্রতিটি আশুরা ও শোহাদায়ে কারবালা দিবস আমাদের নতুন পথ ও নতুন জীবনের প্রতি অনুপ্রেরণা জোগায়। জীবনের ব্রত, ত্যাগের শিক্ষা, আত্মমর্যাদাবোধ জাগ্রত করে; ভয়কে জয় করে, নিজের জীবন উৎসর্গ করে, রক্তলাল মুক্তির পথ তৈরি করে, পরবর্তী প্রজন্মের জন্য সহজ পথ ও সুন্দর সমাজ বিনির্মাণ করাই শোহাদায়ে কারবালার মহতী শিক্ষা।
শোহাদায়ে কারবালা দিবস মুসলিম বিশ্বের আন্তর্জাতিক শোক দিবস। কারবালার শিক্ষা হলো সর্বজনীন মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করা। এ জন্য প্রয়োজন নবীপ্রেম, আহলে বাইতের প্রতি ভালোবাসা, ধর্মনিষ্ঠা, আত্মত্যাগ, দায়িত্ববোধ ও কর্তব্য পালন, মানুষের কল্যাণে জীবন উৎসর্গ করা। ভোগ নয়, ত্যাগেই সুখের সন্ধান করা। যেদিন সমগ্র পৃথিবীতে পরিপূর্ণরূপে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে, সত্য ও সুন্দরের জয় হবে, সেদিনই কারবালার প্রায়শ্চিত্ত হবে। সার্থক হবে আহলে বাইতের আত্মদান।
সম্পাদক : সৈয়দ আমিরুজ্জামান
ইমেইল : rpnewsbd@gmail.com
মোবাইল +8801716599589
৩১/এফ, তোপখানা রোড, ঢাকা-১০০০।
© RP News 24.com 2013-2020
Design and developed by ওয়েব নেষ্ট বিডি