সুফিবাদ ও তাসাওউফ

প্রকাশিত: ৬:২০ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ৭, ২০২২

সুফিবাদ ও তাসাওউফ

Manual2 Ad Code

মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান |

সুফিবাদ একটি ইসলামি আধ্যাত্মিক দর্শন। আত্মা সম্পর্কিত আলোচনা এর মুখ্য বিষয়। আত্মার পরিশুদ্ধির মাধ্যমে আল্লাহর সঙ্গে এর সম্পর্ক স্থাপনই হলো এই দর্শনের মর্মকথা। ‘সুফ’ অর্থ পশম আর তাসাউফ অর্থ পশমি বস্ত্রে পরিধানের অভ্যাস (লাবসুস–সুফ)। মরমিতত্ত্বের সাধনায় কারও জীবনকে নিয়োজিত করার কাজকে বলা হয় তাসাওউফ। যিনি নিজেকে এরূপ সাধনায় সমর্পিত করেন, তাঁকে সুফি বলে।

তাসাওউফ বা সুফিবাদ বলতে অবিনশ্বর আত্মার পরিশুদ্ধির সাধনাকে বোঝায়। আত্মার পবিত্রতার মাধ্যমে ফানাফিল্লাহর (আল্লাহর সঙ্গে অবস্থান করা) মাধ্যমে বাকাবিল্লাহ (আল্লাহর সঙ্গে স্থায়ীভাবে বিলীন হয়ে যাওয়া) লাভ করা যায়। যেহেতু আল্লাহ নিরাকার, তাই তাঁর মধ্যে ফানা হওয়ার জন্য নিরাকার শক্তির প্রতি প্রেমই একমাত্র মাধ্যম। তাসাউফ দর্শন অনুযায়ী এই সাধনাকে ‘তরিকত’ বা আল্লাহ–প্রাপ্তির পথ বলা হয়। তরিকত সাধনায় মুর্শিদের প্রয়োজন হয়। সেই পথ হলো ফানা ফিশশাইখ, ফানা ফিররাসুল ও ফানাফিল্লাহ। ফানাফিল্লাহ হওয়ার পর বাকাবিল্লাহ লাভ হয়।

বাকাবিল্লাহ অর্জিত হলে সুফি আল্লাহপ্রদত্ত বিশেষ শক্তিতে শক্তিমান হন। তখন সুফির অন্তরে সার্বক্ষণিক শান্তি ও আনন্দ বিরাজ করে।

হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেন, ‘মানবদেহে একটি বিশেষ অঙ্গ আছে, যা সুস্থ থাকলে সমগ্র দেহ পরিশুদ্ধ থাকে, আর অসুস্থ থাকলে সমগ্র দেহ অপরিশুদ্ধ হয়ে যায়। জেনে রাখো, এটি হলো কলব বা হৃদয়। আল্লাহর জিকির বা স্মরণে কলব কলুষমুক্ত হয়।’ সার্বক্ষণিক আল্লাহর স্মরণের মাধ্যমে কলবকে কলুষমুক্ত করে আল্লাহর প্রেমার্জন সুফিবাদের উদ্দেশ্য।

সুফিবাদ উৎকর্ষ লাভ করে পারস্যে। সেখানকার প্রখ্যাত সুফি–দরবেশ, কবি–সাহিত্যিক এবং দার্শনিকেরা নানা শাস্ত্র, কাব্য ও ব্যাখ্যা–পুস্তক রচনা করে এই দর্শনকে সাধারণের থেকে জনপ্রিয় করে তোলেন। কালক্রমে বিখ্যাত অলিদের কেন্দ্র করে নানা তরিকা গড়ে ওঠে। চারটি প্রধান তরিকা সর্বাধিক প্রসিদ্ধি লাভ করে: ১. বড় পীর হজরত আবদুল কাদির জিলানি (র.) প্রতিষ্ঠিত কাদেরিয়া তরিকা, ২. সুলতানুল হিন্দ হজরত খাজা মু’ঈনুদ্দীন চিশতি (র.) প্রতিষ্ঠিত চিশতিয়া তরিকা, ৩. হজরত খাজা বাহাউদ্দিন নকশবন্দি (র.) প্রতিষ্ঠিত নকশবন্দিয়া তরিকা এবং ৪. হজরত শেখ আহমদ মুজাদ্দিদ–ই–আলফে ছানি সারহিন্দি (র.) প্রতিষ্ঠিত মুজাদ্দিদিয়া তরিকা। এ ছাড়া সুহরাওয়ার্দি, মাদারিয়া, আহমদিয়া ও কলন্দরিয়া নামে আরও কয়েকটি তরিকার উদ্ভব ঘটে।

Manual3 Ad Code

আরব, ইয়েমেন, ইরাক, ইরান, খোরাসান, মধ্য এশিয়া ও উত্তর ভারত থেকে সুফিরা বাংলাদেশে সুফিবাদ প্রচার করেন। খ্রিষ্টীয় একাদশ–দ্বাদশ শতাব্দীতে যেসব সুফি–সাধক এ দেশে ইসলাম প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন শাহ সুলতান রুমি (র.), বাবা আদম শহিদ (র.), শাহ সুলতান বলখি (র.), শাহ নিয়ামাতুল্লাহ বুতশেকন (র.), শাহ মখদুম রুপোশ (র.), শেখ ফরিদউদ্দিন শক্করগঞ্জ (র.), মখদুম শাহ দৌলা শহিদ (র.) প্রমুখ। এঁরা গভীর পাণ্ডিত্য ও বিভিন্ন অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন বলেও কথিত আছে। কয়েকজন সুফি–দরবেশ ইসলাম ও সুফিবাদ প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাঁদের মধ্যে শেখ জালালুদ্দিন তাব্রিজি (র.), শাহ জালাল (র.), শেখ আলাউল হক (র.), খান জাহান আলী (র.), শরফুদ্দিন আবু তাওয়ামা (র.), শাহ ফরিদউদ্দিন (র.) প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।

হিন্দু ও বৌদ্ধধর্মের গুরুসাধকেরা আধ্যাত্মিকতার মাধ্যমে যেভাবে দীক্ষা দান করতেন, সেভাবে মানবপ্রেম তথা সৃষ্টির প্রতি প্রেমের স্রষ্টার প্রেমার্জন সুফিবাদের মূল আদর্শ।

Manual2 Ad Code

সুফিরা নিজেদের আদর্শ জীবন এবং সুফিবাদের প্রেম–ভ্রাতৃত্ব ও সাম্যের মধুর বাণী প্রচার করে জাতি–ধর্মনির্বিশেষে এ দেশের সাধারণ মানুষের মন জয় করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক জীবনেও সুফিদের প্রভাব লক্ষ করা যায়।

Manual7 Ad Code

যেমন নদী ও সমুদ্রপথে যাতায়াতের সময় মাঝিরা ‘বদর পীরের’ নাম স্মরণ করেন। শুধু তা–ই নয়, নিরাপদ গন্তব্যে পৌঁছানোর উদ্দেশ্যে শহরের যানবাহনে পর্যন্ত বিভিন্ন পীর–আউলিয়ার নাম লেখা থাকে। লৌকিক ধারার মুর্শিদি–মারফতি গান, গাজির গান, গাজিকালু–চম্পাবতী কাব্য ও অন্যান্য মরমি সাহিত্য, মাদার পীর ও সোনা পীরের মাগনের গান ইত্যাদি বিভিন্ন পীর–দরবেশকে কেন্দ্র করে রচিত।

Manual3 Ad Code

সূত্র: মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, ‘যার যা ধর্ম’, পৃষ্ঠা ৩৩৬–৩৩৭, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা।

* মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান: প্রয়াত সাবেক প্রধান বিচারপতি, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

 


Follow for More!

Manual1 Ad Code
Manual5 Ad Code