ধীরে ধীরে বেড়ে উঠছে যত ধরনের অসমতা বা বৈষম্য

প্রকাশিত: ২:৪৬ পূর্বাহ্ণ, জুলাই ৫, ২০২৩

ধীরে ধীরে বেড়ে উঠছে যত ধরনের অসমতা বা বৈষম্য

মীরা মেহেরুন |

হাজার হাজার লক্ষ বছর ধরে সমাজে বিদ্যমান যে সমস্যা তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুতর সমস্যা হলো জাতি, ধর্ম, বর্ণ ভিত্তিক বিদ্বেষ আর এই বিদ্বেষকে ঘিরে ধীরে ধীরে বেড়ে উঠেছে যত ধরনের অসমতা বা বৈষম্য। এই জাতিভেদ প্রথা নামক পিতৃতন্ত্রের বিষবৃক্ষের শিকড় একটু একটু করে প্রোথিত হয়েছে সমাজ কাঠামোতে। যার ফলাফল আর হলাহলে আক্রান্ত বিশ্বব্যাপী মানব সভ্যতা। নারী পুরুষে বৈষম্যের মূলে কাজ করেছে এই বিদ্বেষপূর্ণ কুচক্রী আর পিতৃতন্ত্রের অপকৌশল।
নারীবাদ তত্ত্বের মূল বক্তব্য হলো, যে যে অধিকার পুরুষ ঘরে বাইরে ভোগ করে সেই সেই অধিকারের নিশ্চয়তা নারীর থাকতে হবে। বিবাহিত জীবনে সমানাধিকার, সম্পত্তিতে সমানাধিকার, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক, ভোটাধিকার, অর্থনৈতিকক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণের নিশ্চয়তা বিধান। নারীর নিজের শরীরের ওপর নিজের অধিকারের নিশ্চয়তা ।
নারীবাদের আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হলো সমাজে বিদ্যমান লৈঙ্গিক বৈষম্যের অবসান। লৈঙ্গিক বৈষম্য বলতে কেবলমাত্র নারীর অধিকার নয় সুবিধাবঞ্চিত পুরুষের অধিকারের নিশ্চয়তার কথাও বলা হয়েছে।
হ্যাঁ, এবার মূল কথায় আসা যাক।
নারীর সন্তান ধারণের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় পুরুষের একটি বিশেষ ভূমিকা থাকে, নারীরা পুরুষ ছাড়াও সন্তান ধারণ করতে পারে টেষ্ট টিউব বেবি বা যে কোনো প্রক্রিয়ায়ই হোক নারী শরীরই সেখানে মুখ্য।
অথচ এই নারী যখন মসজিদের পাশ দিয়ে হেঁটে যায় তখন মসজিদের পবিত্রতা ক্ষুন্ন হয় এবং তা রক্ষার জন্য নারীর যাতায়াত নিষিদ্ধ করে সাইনবোর্ড টানানো হয়।
অথবা স্বয়ং মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রনালয় থেকে এমন সুপারিশ করা হয় যে, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মৃত্যুর পর গার্ড অফ অনার দেওয়ার ক্ষেত্রে উপজেলা নির্বাহী নারী কর্মকর্তার বিকল্প চেয়ে বিল উত্থাপন করা হয়।
প্রশ্ন থেকে যায়, যে বীর মুক্তিযোদ্ধারা মাতৃজঠরে ১০ মাস অবস্থান করেছিলেন এবং মাতৃদুগ্ধ পান করে বয়োজ্যেষ্ঠ হয়ে উঠেছেন এবং স্বাধীনতার সূর্যকে ছিনিয়ে এনেছিলেন নারীকে বিযুক্ত রাখা কি তাঁদেরই দাবি?? অথচ মুক্তিযুদ্ধের একটি অন্যতম দাবী ও প্রত্যাশা ছিলো নারী পুরুষ নির্বিশেষে একটি সমতাভিত্তিক সামাজিক অবকাঠামো। সেই প্রত্যাশা ও স্বপ্নকে লালন করে নারীবান্ধব বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী উপজেলা নির্বাহী অফিসার হিসেবে অধিকাংশ পদে নারীকে অধিষ্ঠিত করেছেন।
নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি এমন সুপারিশ উত্থাপনের বিরুদ্ধে।
সমাজের সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ থেকে নারীকে বিযুক্ত রেখে কোন্ আদর্শ সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে চায় এই পুরুষতন্ত্র??? শিশু হিসেবে জন্মের পর থেকে কন্যা হিসেবে চিহ্নিত করতে করতে, কোনঠাসা করতে করতে, বিযুক্ত করতে করতে, ক্ষেত্র চিহ্নিত করতে করতে নারীকে এতটাই অপদার্থ আর অপ্রয়োজনীয় করে তোলা হয় যে নারী জীবনের প্রতি তার আত্ম- ধিক্কার জন্মায়।
সম্পূর্ণ মাতৃত্ব বিষয়টি, মানবজাতি ও সভ্যতার বিকাশ যেহেতু নারী শরীর ভিত্তিক এই সত্যটিকে পুরুষতন্ত্র আজ অবধি স্বাভাবিকভাবে গ্ৰহণ করতে পারেনি। তাই বারবার নারী শরীর কেন্দ্রিক নানান বিষয়ক ব্যাখ্য- অপব্যাখ্যা করে নারী শরীরকে অশ্লীল চিহ্নিত করেছে আর দিনের আলোয় নারীকে পর্দার আড়ালে ঢেকে রেখে রাতের আঁধারে ঝাঁপিয়ে পড়েছে ধর্ষকরূপে।
নারী কখনো পুরুষকে শরীর মনে করেনি, কিছুই মনে করেনি। যদি তাই মনে করতো তবে দলে দলে সমাজে নারীরা ধর্ষকরূপে অফিসে, বাসে, আড়ালে আবডালে মেতে উঠতো উন্মত্ততায়। নারী পুরুষের সম্পর্ককে নারী কেবল স্বাভাবিক পারস্পরিক বলে মনে করেছে। যার মাধ্যমে বিকশিত হতে পারে একটি উন্নত মানব সভ্যতা।
নারীবাদ চেয়েছে তার নিজের শরীরের ওপর নিজস্ব অধিকার। আতঙ্কিত পুরুষতন্ত্র তাই বারবার ছলে বলে কৌশলে নারীর শরীরকে কখনো প্রয়োজনীয়, কখনো অপ্রয়োজনীয়, কখনো পবিত্র, কখনো অপবিত্র বলে ফতোয়া জারি করে তাদেরকে পুরুষতন্ত্রের সুবিধা মতো ব্যবহার করেছে, ছুড়ে ফেলেছে, ক্ষেত্র নির্ধারণ করে গুরুত্বহীন করে তুলেছে।
গোটা বিশ্বের নারীবাদ যদি কখনো এমন ঘোষণা করে যে, মানব সভ্যতা বিকাশে তারা কোনো ভূমিকা পালন করতে চায় না, তারা চির বন্ধ্যা থাকতে চায়। পুরুষতন্ত্র কার শরীরে মানবসভ্যতার গোড়াপত্তন ঘটাবে আর কার শরীরে শত গজ কাপড় চাপিয়ে পোশাককে ধর্ষণের কারণ চিহ্নিত করবে???
নারী পুরুষের মধ্যে বায়োলোজিক্যাল পার্থক্যকে মেনে নিয়ে বিজ্ঞানকে স্বীকার করতে হবে। বিজ্ঞানকে অস্বীকার করে, প্রকৃতির নিয়মকে অস্বীকার করে স্বজাতিকে পিছনে-অন্ধকারে-কারাগারে দাসত্বের শিকলবন্দী করে রাখার কৈফিয়ত এক সময় না একসময় দিতে হবে। কারণ প্রকৃতি সবসময় ভারসাম্য পছন্দ করে। সময়ের প্রতিশোধ অপ্রতিরোধ্য।
👍👍👍👍👍👍👍

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ