একনেকের সভায় লাঠিটিলায় সাফারি পার্ক প্রকল্প অনুমোদনে বিশিষ্টজনদের প্রতিবাদ

প্রকাশিত: ৬:৫০ অপরাহ্ণ, নভেম্বর ১০, ২০২৩

একনেকের সভায় লাঠিটিলায় সাফারি পার্ক প্রকল্প অনুমোদনে বিশিষ্টজনদের প্রতিবাদ

নিজস্ব প্রতিবেদক | ঢাকা, ১০ নভেম্বর ২০২৩ : পাথারিয়া হিল রিজার্ভের জুরি ফরেস্ট রেঞ্জের অধীনে লাঠিটিলা বিটের ৫ হাজার ৬৩১ একর ভূমিতে সাফারি পার্কটি স্থাপনের পরিকল্পনা করেছে বন অধিদপ্তর।

গতকাল বৃহস্পতিবার (৯ নভেম্বর ২০২৩) জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) ৩৬৪ কোটি ১১ লাখ টাকার ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক, মৌলভীবাজার প্রকল্পের (প্রথম পর্যায়) অনুমোদন দিয়েছে।

মৌলভীবাজারের জুড়ি উপজেলার লাঠিটিলা সংরক্ষিত বনাঞ্চলে সাফারি পার্ক নির্মাণে একনেকের সভায় অনুমোদনের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন দেশের বিশিষ্টজনরা। একইসাথে এই প্রকল্প থেকে সরে আসতে সরকারকে আহ্বান জানান ১৯ জন অধিকারকর্মী ও পরিবেশ সংগঠক।

এর আগে দেশের পরিবেশ ও মানবাধিকার কর্মীরা এই বন সংরক্ষণে সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তর, বিভাগ ও মন্ত্রণালয়কে বারবার অবহিত করলেও সেসব উদ্বেগে কর্ণপাত না করায় একটি সংরক্ষিত বনাঞ্চলে সাফারি পার্ক নির্মাণের উদ্যোগে দেশের পরিবেশ ও বাস্ততন্ত্র রক্ষায় সরকারের উদাসীনতা প্রকাশ পেয়েছে।

উল্লেখ্য, ১৯২০ সালে তৎকালীন সরকার এ বনের ৫৬৩১ একর এলাকাকে সংরক্ষিত বনাঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করে। লাঠিটিলা বনে উল্লুক, মায়া হরিণ, বুনো শুকর, ক্ষুদ্র লেজযুক্ত উদবিড়াল, উল্টো লেজি বানর সহ বিপন্নপ্রায় ও বিরল ২০৯ প্রজাতির বন্য প্রাণী এবং ৬০৩ প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে। লাঠিটিলা বন দেশের ছয়টি আন্ত:সীমান্ত সংরক্ষিত বনাঞ্চলের মধ্যে অন্যতম।

জনসংখ্যা আধিক্যের কারণে দেশে ভূমি সংকটের ফলে চাহিদার তুলনায় বনভূমির পরিমাণ যথেষ্ট কম। এই অবস্থায় প্রাকৃতিক বনকে সুরক্ষা দেয়া ও দখল হয়ে যাওয়া বনভূমি উদ্ধার যেখানে অগ্রাধিকার পাওয়ার কথা, সেখানে লাঠিটিলায় দেশের ৩য় সাফারি পার্ক নির্মান প্রাকৃতিক বন রক্ষায় সরকারের চরম অবহেলার বহিঃপ্রকাশ। ইতোপূর্বে কক্সবাজারের চকরিয়ায় বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক ১ এবং গাজীপুরে বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক ২ নির্মাণ করা হয়েছে। ওই দুটি সাফারি পার্ক পরিচালনা নিয়ে বন বিভাগের বিরুদ্ধে একাধিকবার অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। দায়িত্ব অবহেলা ও চরম স্বেচ্ছাচারিতায় একের পর এক বন্যপ্রাণী মৃত্যুতে নাগরিকেরা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যাক্ত করলেও তা আমলে নেয়া হয়নি। দুইটি সাফারি পার্ক পরিচালনায় ব্যার্থতা ও পরিবেশের উপর চরম নেতিবাচক প্রভাব থাকা সত্বেও লাঠিটিলায় আরেকটি সাফারি পার্ক নির্মাণের চেষ্টা অনভিপ্রেত।

বিভিন্ন কারণে লাঠিটিলা সাফারি পার্ক নির্মাণে সরকারের সিদ্ধান্তে দেশের নাগরিকগণ উদ্বেগ জানিয়েছেন। সংরক্ষিত বনাঞ্চল হওয়া সত্বেও লাঠিটিলা এতোদিন বিভিন্নভাবে মানুষের বসতি গড়ে উঠেছে। বনে বসবাসকারীদের জন্য নানা ধরণের অবকাঠামো গড়ে উঠেছে যা বনের স্বাভাবিক পরিবেশ নষ্ট করছে। এমতাবস্থায় বনবিভাগ থেকে এসকল মানব বসতি উচ্ছেদ করে বনের স্বাভাবিক পরিবেশ বজায় রাখার কথা থাকলেও তা না করে গ্রাম বহাল রেখেই সাফারি পার্ক নির্মাণ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। যা মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়।

প্রায় সাড়ে চার কোটি টাকা ব্যয়ে তৈরি ২৪৬ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনটিতে বনটিকে একেবারে আমূলে বদলে দেওয়ার পরিকল্পনার কথা বলা আছে। পুরো পরিকল্পনা এবং এর নেতিবাচক প্রভাবের কথা চিন্তা করে স্বাভাবিকভাবেই শুধু সিলেট অঞ্চলে নয় সারা বাংলাদেশে পরিবেশ সচেতন মানুষের মধ্যে উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে।

বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্তবর্তী লাঠিটিলায় এখনো হাতির বিচরণস্থল হিসাবে পাথারিয়া হিল রিজার্ভ ফরেস্ট (পিএইচআরএফ) পরিচিত। প্রশাসনিকভাবে পিএইচআরএফ দেশের জুড়ি ও বড়লেখা এই দুটি উপজেলার মধ্যে অবস্থিত। ২০১৫ সালের সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী, বর্তমানে সংরক্ষিত বনটির আয়তন ৮০ বর্গ কি.মি.; এরমধ্যে লাঠিটিলার আয়তনই ২০ বর্গ কিলোমিটার। এমতাবস্থায় এই বনাঞ্চলে এমন সাফারি পার্ক নামে বন ধ্বংসের আয়োজনের মুষ্ঠিমেয় কিছু লোকের আর্থিক লাভ ছাড়া তা দেশের জন্য কোনভাবেই মঙ্গলজনক হবে না। এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে দেশের প্রচলিত আইন লঙ্ঘণ করে স্থানীয় জনগোষ্ঠী, বাস্তুতন্ত্র ও জীববৈচিত্রের উপর চরম নেতিবাচক প্রভাব পরবে। তাই, দেশের অন্যান্য নাগরিকদের উদ্বেগের সাথেসাথে আমরাও লাঠিটিলা সাফারিপার্ক প্রকল্পের বিরুদ্ধে আমাদের সুস্পষ্ট অবস্থান ব্যক্ত করছি। সংশ্লিষ্ট মানুষের মতামত উপেক্ষা করে লাঠিটিলা ধ্বংশের এই প্রকল্প এগিয়ে নিলে তা বৃহত্তর সামাজিক আন্দোলনে রূপ নিবে বলে আমরা মনে করছি।

আমরা, অবিলম্ব্যে সরকারকে এই প্রকল্প বাতিলের জন যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের দাবী জানাচ্ছি।

বিবৃতিতে স্বাক্ষরকারীগণ হলেন,
সুলতানা কামাল, সভাপতি, মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন;
রাশেদা কে চৌধুরী, প্রধান নির্বাহী, গণস্বাক্ষরতা অভিযান;
ড. মুজিবুর রহমান হাওলাদার, সাবেক চেয়ারম্যান, জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন;
অধ্যাপক আনু মুহাম্মাদ, সাবেক অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়;
সৈয়দ আমিরুজ্জামান, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট;
কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, জাতীয় কৃষক সমিতি;
সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, মৌলভীবাজার জেলা;
সাধারণ সম্পাদক, মাগুরছড়ার গ্যাস সম্পদ ও পরিবেশ ধ্বংসের ক্ষতিপূরণ আদায় জাতীয় কমিটি;
শারমিন মুরশিদ, প্রধান নির্বাহী, ব্রতী;
সঞ্জিব দ্রং, সাধারন সম্পাদক, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম;
শরীফ জামিল, সমন্বয়ক, ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশ;
ড. মেজবাহ কামাল, অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়;
ড. মোহাম্মদ জহিরুল হক, উপাচার্য, মেট্রপলিটন বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট;
এম এস সিদ্দিকী, বেসরকারি উপদেষ্টা, বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন;
রুবায়েত ফেরদৌস, অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়;
ড. আদিল মোহাম্মদ খান, নির্বাহী পরিচালক; ইনস্টিটিউট আব প্ল্যানিং ্অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি);
ফাদার জোসেফ গোমেজ, সমন্বয়ক, আদিবাসী পরিবেশ রক্ষা আন্দোলন, সিলেট;
মীর মোহাম্মদ আলী, সহকারী অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়;
মোকারম হোসেন, সাধারণ সম্পাদক, তরুপল্লব;
নিখিল চন্দ্র ভদ্র, সমন্বয়ক, সুন্দরবন ও উপকুল সুরক্ষা আন্দোলন;
আব্দুল করিম কিম, সুরমা রিভার ওয়াটারকিপার, সিলেট;

ফ্লোরা বাবলি তালাং, সাধারণ সম্পাদক, কুবরাজ আন্তোপুঞ্জি উন্নয়ন সংগঠন।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ