সবাই কী তারে পায়!

প্রকাশিত: ৪:০১ অপরাহ্ণ, জুন ২৭, ২০২৪

সবাই কী তারে পায়!

সংগৃহীত |

‘অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী’ বইটি পড়ে কন্যা শামারোখের প্রেমে পরেনি এমন পুরুষ হয়তো পাওয়া যাবেনা। কন্যা শামারোখ, যিনি ভাসায় যিনি ডুবায়। যিনি হেঁটে যায় রাস্তার সমস্ত চোখ তার দিকে নিয়ে। কতো পুরুষ তার প্রেমে হাবুডুবু খায়। সবাই তারে পাইতে চায়। সবাই কী তারে পায়।

তারে পেয়েছিলো আমাদের বাংলার জন কিটস, আমাদের তীব্র প্রেমের কবি আবুল হাসান।
আহমদ ছফার ‘অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী’ বইটি পড়েই প্রথম কন্যা শামারোখের সাথে পরিচয়, তারপর তার প্রেমে পরলাম। কল্পনায় উনাকে দেখতেছি নিজস্ব অবয়বে সাজিয়ে। ঘোর লেগে আছে চোখে।চোখের ভেতর উজ্জ্বল কন্যা শামারোখ। সংকল্প ছিলো যদি উনি বাংলাদেশে থাকে তবে যেভাবেই হোক একবার উনার সাথে দেখা করবো। তারপর খোঁজ নেবার পরে জানলাম উনি থাকতেন ইউরোপে। এখন উনি জীবিত নেই।

শামারোখও মরতে পারে! বিশ্বাস করতে তীব্র কষ্ট হলো।

শামারোখের আসল নাম সুরাইয়া খানম। জন্মেছিলেন যশোহরে, ১৩ই মে ১৯৪৪ সালে।

আমাদের সুরাইয়া খানম ছিলেন অসম্ভব সুন্দরী। মেধা, সৌন্দর্য, প্রতিভা, খ্যাতি অখ্যাতি এইসব মিলিয়ে তিনি ছিলেন পারফেক্ট ডেফিনিশন অব ব্রেইন উইথ বিউটি। তিনি ছিলেন প্রাণোচ্ছল, ব্যক্তিস্বাধীনতায় বিশ্বাসী এক নারী। সময়ের তুলনায় তিনি ছিলেন অগ্রবর্তী।
ম্যাট্রিকের পরে করাচী চলে যান পড়াশোনার জন্য। সর্বকনিষ্ঠ অধ্যাপিকা হিসেবে করাচী বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছুকাল দায়িত্ত্ব পালন করেন। এরপর কমনওয়েলথ স্কলারশিপ নিয়ে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করেন। তিনি ছিলেন কেমব্রিজের ট্রিপল অনার্স এবং কেমব্রিজে উপমহাদেশের প্রথম একজন কমনওয়েলথ স্কলার। বিবিসিতে কিছুদিন কাজ করেছেন। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে একজন নিবেদিত কর্মী। ১৬ই ডিসেম্বরে বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক অভ্যুদয়ের পর লন্ডনের ট্রাগালফার স্কয়ারে বাংলাদেশের বিজয় উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে তিনি প্রথম বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। এই উপলক্ষে পতাকা শিরোনামে একটা কবিতাও আছে উনার।
১৯৭৪ এ দেশে ফিরে ১৯৭৬ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্য বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন। শামছুন্নাহার হলে হাউস টিউটর হিসেবেও দায়িত্ত্ব পালন করেন। এতসব কিছুর পেছনে আমাদের আহমদ ছফারও অনেক অবদান। অনেকসময় ছফা অনেক ঝুঁকিও নিয়েছেন সুরাইয়া খানমের জন্যে। থাক সেসব কথা।

হুডখোলা রিক্সা, খোলাচুলের সুরাইয়া খানমকে নিয়ে চলতে থাকে। গোধূলি বাতাসে সুরাইয়া খানমের এলোকেশ উড়ে। সেইসাথে উড়তে থাকে তারদিকে দৃষ্টিরত সমস্ত যুবকের বাসনা। তাকে দেখতে দলবেঁধে অন্য ডিপার্টমেন্টের ছাত্ররাও ভীড় জমায় ইংরেজি ডিপার্টমেন্টের সামনে। মাঝেমাঝে তিনি ইন্টারন্যাশনাল হলে আসেন আহমেদ ছফার সাথে দ্যাখা করতে। রুমে বসেন চা পান করেন। অনেকেই ঈর্ষা পোষন করেন মনে মনে।

মাঝেমাঝে আবুল হাসানকে নিয়ে চলে যান লং ড্রাইভে। এটা দেখে হয়তো অনেকেই আফছোস করেন, ইস আমি যদি আবুল হাসান হতাম। আবুল হাসান একবার অসুস্থ হয়ে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় চলে গেলেন জার্মানিতে চিকিৎসার জন্য। ফিরেও আসলেন। এসে সুরাইয়া খানমকে লিখলেন-
‘তুমি আমার কাছে নতজানু হও,
তুমি ছাড়া আমি আর কোনো ভূগোল জানিনা।
আর কোনো ইতিহাস কোথাও পড়িনি।
আমার একা থাকার পাশে তোমার একাকার হাহাকার নিয়ে দাঁড়াও।
হে মেয়ে, ম্লান মেয়ে তুমি তোমার হাহাকার নিয়ে দাঁড়াও।’
আবুল হাসান ‘পৃথক পালঙ্ক’ নামে একটা কবিতার বই সুরাইয়া খানমকে উৎসর্গ করেন।

সুরাইয়া খানমের অসম্ভব রুপের সাথে ছিলেন বহুমুখী গুণ। ছোট বেলা থেকেই লিখতেন কবিতা। প্রথম কবিতা প্রকাশ পায় সমকাল পত্রিকায়। ১৯৭৬ এ ‘নাচের শব্দ’ নামে কবিতার বই প্রকাশ পায় চারুলিপি প্রকাশন থেকে। থিয়েটারের প্রতিও ছিলো প্রচণ্ড আগ্রহ। সেসময় বাংলাদেশ টেলিভিশনের আতিকুল ইসলাম চৌধুরীর প্রযোজনায় রবী ঠাকুরের ‘শেষের কবিতা’ অবলম্বনে তৈরি নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র লাবণ্য’র ভুমিকায় অভিনয় করে দেশব্যাপী আলোড়ন তুলেছিলেন।

২৬ই নভেম্বর ১৯৭৫ এ প্রেমিক আবুল হাসানের মৃত্যু। এই মৃত্যু হয়তো তাকে তীব্র একা করে দিয়েছিলো কিংবা না। কিন্তু এর কিছুদিন পরেই তিনি বিয়ে করে ফেলেন।
আহমদ ছফা তার বইয়ে লিখেছিলেন আবুল হাসানের মৃত্যুর ১৫ দিনের মাথাতেই তিনি বিয়ে করে ফেলেছিলেন।

আশির দশকের শুরুতে তিনি উচ্চশিক্ষার জন্য ইউনিভার্সিটি অব এরিজোনায় চলে যায় স্বামী সহ। সেখান থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ তারপর পিএইচডি কমপ্লিট করেন এবং যোগ দেন এরিজোনার এক ইউনিভার্সিটিতে ইংরেজি সাহিত্যে অধ্যাপিকা হিসেবে।

তারপর দিন বয়ে যেতে থাকে। দিন বয়ে যায়, সুখে দুখে, পাওয়া না পাওয়ায়। অনেক কিছু কাছে আসে। তারচেয়ে বেশীকিছু দূরে যায়। এরিজোনার টুসান শহর থেকে ২০০৬ এর মে মাসে আমাদের থেকে আজন্মের দুরত্ত্বে চলে যান আমাদের সুরাইয়া খানম, আমাদের শামারোখ ।

*কাঁচা হাতের লেখার ভুল ত্রুটি মার্জনীয়। বিভিন্ন বই পড়ে যা জেনেছি সেসবের সংমিশ্রণেই নিজের মত করে লিখেছি।💝🌸

 

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ