প্রথিতযশা কবি ও নারীবাদী লেখিকা কামিনী রায়: বাংলাসাহিত্যে যার অবস্থান কিংবদন্তিতুল্য

প্রকাশিত: ২:৪০ পূর্বাহ্ণ, অক্টোবর ১২, ২০২৪

প্রথিতযশা কবি ও নারীবাদী লেখিকা কামিনী রায়: বাংলাসাহিত্যে যার অবস্থান কিংবদন্তিতুল্য

Manual7 Ad Code

সৈয়দ আমিরুজ্জামান |

“আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে
আসে নাই কেহ অবনী পরে
সকলের তরে সকলে আমরা
প্রত্যেকে আমরা পরের তরে।”
– কামিনী রায়

ব্রিটিশ ভারতের প্রথম মহিলা স্নাতক ডিগ্রিধারী, সমাজকর্মী, নারীবাদী লেখিকা ও বাংলাসাহিত্যের প্রথিতযশা কবি কামিনী রায়ের ১৬০তম জন্মবার্ষিকী আজ। তাঁর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা ও অভিবাদন!

তাঁর লেখা আরো একটি জনপ্রিয় বিখ্যাত ছড়া কবিতা ‘পাছে লোকে কিছু বলে’

করিতে পারি না কাজ
সদা ভয় সদা লাজ
সংশয়ে সংকল্প সদা টলে,-
পাছে লোকে কিছু বলে।
আড়ালে আড়ালে থাকি
নীরবে আপনা ঢাকি,
সম্মুখে চরণ নাহি চলে
পাছে লোকে কিছু বলে।
হৃদয়ে বুদবুদ মত
উঠে চিন্তা শুভ্র কত,
মিশে যায় হৃদয়ের তলে,
পাছে লোকে কিছু বলে।
কাঁদে প্রাণ যবে আঁখি
সযতনে শুকায়ে রাখি;-
নিরমল নয়নের জলে,
পাছে লোকে কিছু বলে।
একটি স্নেহের কথা
প্রশমিতে পারে ব্যথা,-
চলে যাই উপেক্ষার ছলে,
পাছে লোকে কিছু বলে।
মহৎ উদ্দেশ্য যবে,
এক সাথে মিলে সবে,
পারি না মিলিতে সেই দলে,
পাছে লোকে কিছু বলে।
বিধাতা দেছেন প্রাণ
থাকি সদা ম্রিয়মাণ;
শক্তি মরে ভীতির কবলে,
পাছে লোকে কিছু বলে।

কামিনী রায় ১৮৬৪ সালের ১২ অক্টোবর ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির বরিশাল জেলার বাকেরগঞ্জের (বর্তমানে বরিশাল বিভাগের ঝালকাঠি জেলা) বাসন্ডা গ্রামে কামিনী রায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা চন্ডীচরণ সেন ছিলেন একজন ঐতিহাসিক উপন্যাস লেখক ও পেশায় বিচারক। কামিনী রায় ছোটবেলা থেকেই ছিলেন মেধাবী, ভাবুক ও কল্পনাপ্রবণ।

কামিনী রায় কলকাতার বেথুন ফিমেল স্কুল থেকে ১৮৮০ সালে এন্ট্রান্স (প্রবেশিকা) এবং বেথুন কলেজ থেকে ১৮৮৩ সালে ফার্স্ট আর্টস (এফএ) এবং ১৮৮৬ সালে সংস্কৃতে অনার্সসহ ব্যাচেলর অব আর্টস (বিএ) পাস করেন।

Manual7 Ad Code

কামিনী রায় বিএ সম্পন্ন করে ১৮৮৬ সালে বেথুন কলেজে শিক্ষকতার মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন এবং পরে অধ্যাপক হন।

১৮৯৪ সালে স্ট্যাটিউটরি সিভিলিয়ান কেদারনাথ রায়ের সঙ্গে কামিনী রায়ের বিয়ে হয়। মূলত: কেদারনাথ কামিনীর কবিতা পড়ে মুগ্ধ হয়ে তাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন।

কামিনী রায়ের সাহিত্যচর্চা

Manual2 Ad Code

কামিনী রায় মাত্র আট বছর বয়স থেকে কবিতা লেখা শুরু করেন। সাহিত্যচর্চার পাশাপশি কামিনী রায় সাংস্কৃতিক ও জনহিতকর, বিশেষত নারীকল্যাণমূলক কাজেও আত্মনিয়োগ করেন।

কামিনী রায় একসময় ‘জনৈক বঙ্গমহিলা’ ছদ্মনামে লিখতেন।

Manual5 Ad Code

কামিনী রায় নারীশ্রমিক তদন্ত কমিশনের অন্যতম সদস্য (১৯২২-২৩), বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনে সাহিত্য শাখার সভানেত্রী (১৯৩০) এবং বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সহসভাপতি (১৯৩২-৩৩) ছিলেন।

কামিনী রায়ের পনেরো বছর বয়সে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘আলো ও ছায়া’ প্রকাশিত হয় ১৮৮৯ সালে। তাঁর ‘আলো ও ছায়া’ কাব্যগ্রন্থের ভূমিকা লেখেন হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। এই গ্রন্থে প্রথম দিকে কবির নাম প্রকাশিত হয়নি।

কামিনী রায়ের লেখা কাব্যগ্রন্থ

আলো ও ছায়া (১৮৮৯), নির্মাল্য (১৮৯১), পৌরাণিকী (১৮৯৭), গুঞ্জন (শিশুকাব্য, ১৯০৫), ধর্ম্মপুত্র (অনুবাদ, ১৯০৭), মাল্য ও নির্মাল্য (১৯১৩), অশোকসঙ্গীত (সনেট, ১৯১৪), অম্বা (নাটক, ১৯১৫), বালিকা শিক্ষার আদর্শ (১৯১৮), ঠাকুরমার চিঠি (১৯২৪), দীপ ও ধূপ (১৯২৯), জীবনপথে (সনেট, ১৯৩০), একলব্য, দ্রোণ-ধৃষ্টদ্যুম্ন, শ্রাদ্ধিকী।

কামিনী রায়ের সাহিত্যজীবনে প্রভাব

১৯০৯ সালে কামিনী রায়ের স্বামিবিয়োগ ঘটে। স্বামীর এ অকাল মৃত্যু তাঁর ব্যক্তিজীবনের মতো সাহিত্যিক জীবনকেও গভীরভাবে প্রভাবিত করে। তবে তাঁর কবিতায় রবীন্দ্রনাথের প্রভাব সর্বাধিক। তিনি যেহেতু সংস্কৃতে পন্ডিত ছিলেন, সেহেতু সংস্কৃত সাহিত্যের বিষয় অবলম্বনে রচিত তাঁর কবিতাগুলি অপেক্ষাকৃত উৎকৃষ্ট মানের।

কামিনী রায়ের কবিতায় বহুল ব্যবহূত কিছু শব্দ যেমন- আশা-নিরাশা, হর্ষ-বিষাদ, অবসাদ, আর্তনাদ, সুখ-দুঃখ, স্বর্গ-মর্ত, ভয়, আলো-আঁধার, অশ্রু, জীবন-মরণ, মলিন, শোক, বেদনা, লাভ-ক্ষতি ইত্যাদির দিকে তাকালেই বোঝা যায় তিনি জীবনের ইতি ও নেতি দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। তাঁর কবিতার বিষয়বস্তুর দিকে নজর দিলে দেখা যাবে যে তিনি জীবনের ব্যর্থতা, হতাশা, দুঃখ, বিষাদকেই প্রধান বিষয় করে তুলেছেন।

কামিনী রায়ের কবিতায় জীবনের সাধারণ ঘটনাবলি হৃদয়ের সুকুমার অনুভূতির মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে।

পদক ও সম্মাননা

১৯২৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক কামিনী রায়কে ‘জগত্তারিণী স্বর্ণপদক’ প্রদান করে সম্মানিত করে।
১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গীয় লিটারারি কনফারেন্সের সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হন।
১৯৩২-৩৩ খ্রীস্টাব্দে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদেরও সহ-সভাপতি ছিলেন কামিনী রায়।

শেষ জীবন
শেষ জীবনে কবি কামিনী রায় ঢাকার হাজারীবাগে বাস করতেন। ১৯৩৩ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর কামিনী রায় মৃত্যুবরণ করেন

Manual5 Ad Code

সুপ্রিয় পাঠক ,কবিপ্রথিতযশা কবি কামিনী রায়ের জন্মবার্ষিকীকে উপলক্ষ করে এই লেখাটি নয়। মহান, কৃতিমান মানুষদের নিয়ে সব সময়ই লেখা যায় আমরা এটা বিশ্বাস করি। পরিশেষে, সমাজতন্ত্র অভিমুখী অসাম্প্রদায়িক জনগণতান্ত্রিক ও বৈষম্যহীন ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রত্যয়ে সমতা-ন্যায্যতার প্রশ্নে বাংলাদেশকে এগিয়ে নেওয়ার প্রয়োজনেই বিশ্বজনীন মহান এই গুণীর সাহিত্য, জীবন সংগ্রাম, কীর্তি সম্পর্কে পাঠ প্রাসঙ্গিক ও জরুরী। কিংবদন্তী কবি কামিনী রায়ের প্রতি আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা ও অভিবাদন!

#
সৈয়দ আমিরুজ্জামান
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট;
বিশেষ প্রতিনিধি, সাপ্তাহিক নতুনকথা;
সম্পাদক, আরপি নিউজ;
কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, জাতীয় কৃষক সমিতি;
সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, মৌলভীবাজার জেলা;
‘৯০-এর মহান গণঅভ্যুত্থানের সংগঠক ও সাবেক কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, বাংলাদেশ ছাত্রমৈত্রী।
সাবেক কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, বাংলাদেশ খেতমজুর ইউনিয়ন।
সাধারণ সম্পাদক, মাগুরছড়ার গ্যাস সম্পদ ও পরিবেশ ধ্বংসের ক্ষতিপূরণ আদায় জাতীয় কমিটি।
প্রাক্তন সভাপতি, বাংলাদেশ আইন ছাত্র ফেডারেশন।
E-mail : syedzaman.62@gmail.com
WhatsApp : 01716599589
মুঠোফোন: ০১৭১৬৫৯৯৫৮৯
Bikash number : +8801716599589 (personal)

 

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

 


Follow for More!

Manual1 Ad Code
Manual2 Ad Code