মেয়ের বাবাদের লজ্জা থাকতে নেই

প্রকাশিত: ১২:৫৯ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ১২, ২০২৪

মেয়ের বাবাদের লজ্জা থাকতে নেই

Manual7 Ad Code

সংগ্রাহক |

দরজা খুলে নিজের জন্মদাতা পিতাকে হাসি মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মন খারাপ হয়ে গেলো! মলিন মুখে বললাম,
– বাবা, ভিতরে আসো!
বাবা ভিতরে এসে একটা বক্স বাড়িয়ে দিয়ে বললো
– “এই নে, তোর পছন্দের গুড়ের পায়েস এনেছি!”
কিছুটা অবাক হয়ে বললাম
– তুমি এই সামান্য পায়েস দেওয়ার জন্য ৬০ কিলোমিটার পথ জার্নি করে এসেছো?
বাবা হেসে বললো,
– “তোর মা রান্না করেছে। তোকে না দিয়ে কিভাবে খাই মা? তাই নিয়ে চলে আসলাম!”

রুমের ভেতর থেকে ড্রয়িংরুমের দিকে আসতে আসতে আমার শ্বাশুড়ি বললো,
– “বউ মা, কে এসেছে?”
বাবা আমার শ্বাশুড়িকে দেখে বললো
– “কেমন আছেন বেয়ান সাব?”

শ্বাশুড়ি বাবার কথার কোন উত্তর না দিয়ে আবার রুমের ভেতর চলে গেলো! বাবা আসলে আমার শ্বশুরবাড়ির লোকজন খুশি হওয়ার চেয়ে বিরক্তই হয় বেশি!
হুটহাট করে যদি মেয়ের বাড়ি চলে আসে তাহলে শ্বশুড়বাড়ির লোকজন বিরক্ত হবে এটাই স্বাভাবিক! অথচ আমার অবুঝ বাবা সেটা বুঝে না। কয়েকদিন যেতে না যেতেই কিছু না কিছু একটা নিয়ে বাসায় হাজির হবেই!
বাবাকে বললাম,
– যাও বাবা, ভেতরের রুমে আপাতত বিশ্রাম নাও, তারপর দুপুরে খাওয়া-দাওয়া করে চলে যেও।
বাবা কিছুটা অবাক হয়ে বললো
– “মা, আজকেই কি চলে যেতে হবে? তোদের বাসায় একটা দিন থাকি?”
কোনরকম কান্না চেপে রেখে চোখ-মুখ শক্ত করে বললাম,
– না বাবা, তোমার থাকতে হবে না! দুপুরের খাওয়ার পরই চলে যাবে!

কথাটা বলে আমি রান্নাঘরে এসে কাঁদতে লাগলাম। কতোটা অসহায় হলে একটা মেয়ে তার বাবাকে বাসায় একটা দিন রাখতে চায় না, সেটা কেউ বুঝবে না!
শ্বাশুড়ির রুমে এসে মাথা নিচু করে বললাম
– মা, ফ্রীজ থেকে খাসির মাংসটা বের করে রান্না করি? বাবা দুপুরে খেয়েই চলে যাবে।
শ্বাশুড়ি রাগী চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললো
– “এতো মেহমানদারি করতে হবে না! তোমার বাপ তো প্রতি কয়েকদিন পর পরেই আসে! তার জন্য খাসির মাংস রান্না করতে হবে নাকি? যা আছে তা দিয়েই খাইয়ে বিদায় করো! লোকটার লাজ লজ্জা বলতে কিছুই নেই। কয়েকদিন যেতে না যেতেই মেয়ের বাড়ি এসে পড়ে ভালো-মন্দ খাওয়ার জন্য!”
শ্বাশুড়ির কাছে হাত জোর করে মিনতি করে বললাম,
– মা, আল্লাহর দোহাই লাগে, এভাবে বলবেন না! পাশের রুমে আমার বাবা আছে, শুনলে কষ্ট পাবে। কথাটা বলে আমি চলে আসলাম…

শুধু যে আমার শ্বাশুড়ি বাবাকে অপমান করে তা না। আমার স্বামীও করে। একবার আমার স্বামী বাবাকে বাজারের ব্যাগ দিয়ে বলেছিল,
– “বাসায় তো বসেই আছেন। যান বাজারটা করে নিয়ে আসুন!”
মেয়ের জামাই শ্বশুরকে বলেছে বাজার করে নিয়ে আসুন! এটা যে কতোটা অপমানজনক আমার বাবা সেটা বুঝতে পারেনি! উনি ব্যাগ নিয়ে হাসিমুখে বাজার করতে চলে গিয়েছিল!

Manual2 Ad Code

রুমে এসে দেখি বাবা খবরের কাগজ পড়ছে। আমাকে দেখে হাসিমুখে বললো,
– “দেখলি সাকিব আবার সেঞ্চুরি করেছে। ছেলেটার ভেতর দম আছে! দেখিস সামনে আরো ভালো কিছু করবে।”
আমি বাবার দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলাম, আমার বাবা তো এমন ছিল না। নিজের বিন্দু পরিমাণ অপমান সহ্য করতো না। সেই বাবা আমাকে বিয়ে দেওয়ার পর এমন হয়ে গেলো কেন!

Manual8 Ad Code

দুপুরে বাবাকে খাওয়ানোর সময় মাছের মাথাটা যখন বাবার প্লেটের দিকে বাড়িয়ে দিবো, তখন শ্বাশুড়ি এসে বললো
– “তুমি জানো না, মাছের মাথা ছাড়া আমার ছেলে খেতে পারে না। কোন হিসাবে নিজের বাবাকে মাছের মাথা দিচ্ছো?”
বাবা তখন শুধু তারকারীর ঝোল মেখে খেতে খেতে বললো
– “তুই এতো ভালো রান্না করিস কিভাবে? বাড়ি গেলে তোর মাকে একদিন শেখাবি। ২৫ বছর ধরে সংসার করছে, অথচ রান্নাটা ভালো করে শিখতে পারেনি!”
আমি তখন কাঁদতে কাঁদতে বাবাকে বললাম
– আল্লাহ কি তোমাকে একটু লাজ লজ্জা দেয়নি। এতো অপমানের পরেও কয়দিন পর পর মেয়ের শ্বশুড়বাড়ি এসে হাজির হও। তুমি যদি আমার ভালো চাও, তাহলে এই বাড়িতে আর এসো না!

বাবা সেদিন আমাকে আর কিছুই বলেনি। শুধু যাবার সময় আমার মাথায় হাত বুলিয়ে হাসিমুখে চলে গিয়েছিল…

সেদিনের পর বাবা আর কখনো আমার শ্বশুরবাড়ি আসেনি। মাঝখানে আমার শ্বাশুড়ি অসুস্থ হলো, স্বামীর ব্যবসার অবস্থা খারাপ হলো, বাবাই সব টাকা দিয়েছে কিন্তু বাসায় আসেনি!
একদিন শ্বাশুড়ি আমাকে বললো,
– “বেয়ান মশাই তো আর আসে না!”
আমি হেসে বললাম
– “মেয়ের বাসায় এসে কি করবে? মেয়ে তো তাকে একবেলা মাছের মাথা দিয়ে খাওয়াতে পারতো না। তরকারির ঝোল দিয়েই ভাত খেতে হতো। তাই হয়তো আর আসে না!”
স্বামী একবার বললো,
– “বাবাকে বলো একবার বাসায় আসতে!”
একথা শুনে স্বামীর চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম,
– “কেন! বাজার করার লোক আছে তো! শুধু শুধু আরেকজন লোক বাসায় আনার দরকার কি? শ্বাশুড়ি কিংবা স্বামী সেদিন কিছু বলতে পারেনি। শুধু মাথা নিচু করে ছিল…

২ বছর পর…
আমি মেয়ের মা হয়েছি। কিন্তু মেয়ের প্রতি আমার চেয়ে আমার স্বামীর দরদ বেশি! মেয়ে রাতে যতোক্ষণ সজাগ থাকে, ততোক্ষণ মেয়েকে কোলে নিয়ে হাঁটে!।মেয়ে ঘুমালে মেয়ের মুখের কাছে মুখ নিয়ে নিঃশ্বাসের শব্দ শুনে! মেয়ে যেদিন আধো আধো গলায় বাবা বলে ডেকেছিল, সেদিন আমার স্বামী খুশিতে বাচ্চাদের মতো কান্না করে দিয়েছিল!

একদিন মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে আমাকে আমার স্বামী বললো,
– “আমার মেয়েকে আমি বিয়ে দিবো না! সারাজীবন আমার কাছে রাখবো। মেয়েকে ছাড়া আমি থাকতেই পারবো না”!

Manual7 Ad Code

আমি তখন স্বামীর চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম
– “আমার বাবাও হয়তো ঠিক এভাবে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল আমাকে বিয়ে দিবে না। আমাকে ছাড়া থাকতে পারবে না। কিন্তু মেয়ে মানুষ বলে কথা। বিয়ে তো দিতেই হবে। মেয়েকে বিয়ে দিলো। মেয়ের বাসায় এসে প্রতিবার অপমানিত হয়ে যেতো, তবুও আবার আসতো!”

কথাগুলো শুনে আমার স্বামী যখন নিরব হয়ে রইলো তাখন আমি চোখের জল ফেলতে ফেলতে বললাম,
– তোমারা আমার বাবাকে যতোটা বেশরম ভেবেছিলে, বিশ্বাস করো আমার বাবা এমন বেশরম না! উনি সবই বুঝতো, তবুও না বুঝার অভিনয় করতো। একমাত্র মেয়ে ছিলাম তো, তাই মেয়েকে দেখার জন্য বাবার হৃদয়টা কাঁদতো। তাই কয়েকদিন পর পর এসে পড়তো।

রাতে কান্নাকাটি করে কখন ঘুমিয়েছি জানি না। পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি আমার স্বামী ল্যাগেজ গুছিয়ে তৈরি হয়ে বসে আছে!
অবাক হয়ে বললাম,
– কোথাও যাবে নাকি?
স্বামী মেয়ের দিকে তাকিয়ে কান্না ভেজা চোখেও মুখে হাসি নিয়ে বললো,
– “মেয়ের বাবা যেহেতু হয়েছি, সেহেতু শ্বুশুরের কাছে গিয়ে নির্লজ্জ হবার ট্রেনিং নিতে হবে! কারণ একদিন আমাকেও হয়তো অনেক অপমান সহ্য করতে হবে, যেমনটা আমি আমার শ্বশুরকে করেছি। মেয়ের বাবাদের তো আবার লজ্জা থাকতে নেই!”

আমি আমার স্বামীকে কিছু বলতে পারছিলাম না। শুধু দেখছিলাম আর ভাবছিলাম, মেয়ের বাবা হবার পর নিজের করা ভুলের জন্য কতোটা অনুতপ্ত হলে একটা ত্রিশোর্ধ মানুষ বাচ্চার মতো কান্নাকাটি করে!
আজকের পর থেকে স্বামীর প্রতি আমার কোন অভিযোগ নেই…
#
সংগৃহীত

Manual1 Ad Code

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

 


Follow for More!

Manual1 Ad Code
Manual7 Ad Code