সিলেট ২রা জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ১৮ই পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ৩:৩৩ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ২৯, ২০২৪
মো. আফজল হোসেইন, বিশেষ প্রতিনিধি | শ্রীমঙ্গল (মৌলভীবাজার), ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪ : নিত্যপণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতি জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। চাল, তেল, খামারের মুরগী, সবজিসহ প্রয়োজনীয় সব কিছুর দাম আকাশচুম্বী হওয়ায় সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে।
শ্রীমঙ্গল উপজেলার বাজারে প্রতিদিনই নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে। চাল, ডাল, তেলের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ মানুষের কেনাকাটা ক্ষমতা কমে গেছে। পরিবার পরিচালনা করা তাদের জন্য দিন দিন কঠিন হয়ে পড়ছে। নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবার এই পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি ভুগছে।
রবিবার (২৯ ডিসেম্বর ২০২৪) শ্রীমঙ্গলের খুচরা বাজারে সরেজমিনে দেখা যায়, সবজির দাম কিছুটা স্বাভাবিক হলেও পোলট্রি মুরগির দাম প্রতি কেজি ২০ থেকে ৩০ টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে। এদিকে, খুচরা বাজারে মাঝারি চালের দাম প্রতি কেজি ৬৫ থেকে ৭০ টাকা,মশুর ডাল মোটা প্রতি কেজি ১১৫ থেকে ১৪০ টাকা, পাম অয়েল প্রতি লিটার ১৫৫ টাকা, বোতলবদ্ধ সয়াবিন তেল প্রতি লিটার ১৭৫ থেকে ১৮০ টাকা, পিয়াজ প্রতি কেজি ৫০ থেকে ৬০ টাকা, রসুন প্রতি কেজি ২২০ থেকে ২৬০ টাকা, খোলা আটা প্রতি কেজি ৪০ থেকে ৪৫ টাকা এবং চিনি প্রতি কেজি ১২৫ থেকে ১৩৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এছাড়াও, ভাল মানের গরুর গোস্ত প্রতি কেজি ৮৫০ থেকে ১০৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
এছাড়াও কৃষি বিপণন এর প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে যে, গত এক বছরে চারটি খাদ্যপণ্যের দাম ১০ থেকে ২০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।এর মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন জাতের চাল,সয়াবিন তেল,খামারের মুরগী, ডিম ফার্ম -লাল।ফলে জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে তাদের আয় বাড়ছে না।
স্বানীয় ব্যবসায়ীরা দাম বাড়ার কারণ হিসেবে বৈশ্বিক বাজারে দাম বাড়া ও পরিবহন খরচ বৃদ্ধি উল্লেখ করছে। তবে সাধারণ মানুষ এই যুক্তি মানতে নারাজ।
রিকশাচালক মো. হাসান মিয়া জানান, তিনি তার স্ত্রী এবং তিন সন্তান মিলে পাঁচজনের একটি পরিবার। তিনি বলেন, “চাল, ডাল, তেল, সবজি সবকিছুর দাম আকাশচুম্বী। রিকশা চালিয়ে দিনে সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা আয় করতে পারি। এ দিয়ে পরিবার চালানো কঠিন।তিনি আরও জানান, মাসে গড়ে ১২ থেকে ১৩ হাজার টাকা আয় করলেও তা দিয়ে পরিবারের খরচ চালানো কষ্টকর।টিসিবি ও ওএমএসের চালের সরবরাহ নিয়মিতভাবে অপ্রতুল থাকায় পরিবারের জন্য এটি যথেষ্ট নয়।
শ্রীমঙ্গল শহরের শ্যামলী আবাসিক এলাকার বাসিন্দা মো. জহিরুল ইসলাম পেশায় একজন কাঠমিস্ত্রী। তিনি পরিবারসহ একটি ভাড়া বাড়িতে থাকেন। তার স্ত্রী ও পাঁচ মেয়েকে নিয়ে সংসার চালান। দৈনিক কাজের ভিত্তিতে তিনি কাঠমিস্ত্রির কাজ করেন এবং দৈনিক ৭০০ টাকা আয় করেন। কিন্তু কাজের সুযোগ সবসময় না থাকায় অতিরিক্ত আয়ের জন্য অটোরিকশা চালান। চলতি বছরে খাদ্যপণ্যের দাম ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, যার ফলে তার সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে। চালের দাম প্রতি কেজি ৬-৭ টাকা, সয়াবিন তেলের দাম প্রতি লিটার ১২ টাকা এবং খোলা আটার দাম প্রতি কেজি ৫ টাকা বেড়েছে। ফলে সীমিত আয়ে বড় পরিবারের খরচ চালানো, বাচ্চাদের পড়াশোনা, বাড়ি ভাড়া এবং মায়ের চিকিৎসার খরচ বহন করা তার জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে।
বেসরকারি এনজিও সংস্থার কর্মরত এক চাকরিজীবী জানান, দীর্ঘদিনের সঞ্চয় এবং ব্যাংক অ্যাকাউন্টের টাকা বর্তমানে খরচ করতে হচ্ছে তাদের বেঁচে থাকার জন্য। তিনি বলছেন, একসময় যেসব খরচের জন্য সঞ্চয় করতেন, এখন সেই সঞ্চয় একে একে শেষ হয়ে যাচ্ছে। অতিরিক্ত মূল্যবৃদ্ধির কারণে মাস শেষে পরিবারের ব্যয়ভার চালানো অসম্ভব হয়ে পড়েছে। একদিকে চাল, ডাল, তেল, সবজির দাম বৃদ্ধি, অন্যদিকে বাসা ভাড়া, বিদ্যুৎ বিল, সন্তানের স্কুল ফি বৃদ্ধি, এবং চিকিৎসা খরচ—সবই তাদের কাছে এক বিশাল চাপ হয়ে উঠেছে।
বাজার সিন্ডিকেট, খাদ্য সহ নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের পরিস্থিতি নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সংগঠক, সাপ্তাহিক নতুন কথা’র বিশেষ প্রতিনিধি, আরপি নিউজের সম্পাদক ও বিশিষ্ট কলামিস্ট কমরেড সৈয়দ আমিরুজ্জামান বলেন, “বেশ কয়েক বছর ধরেই খাদ্যসহ নিত্যপণ্যের দাম লাগামছাড়া। গত চার বছরে পেঁয়াজ, সয়াবিন তেল, চাল, ডাল, রসুন, আলু, ব্রয়লার মুরগি ও ডিম—এই আট পণ্যের দাম সর্বোচ্চ ১৫৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। সে তুলনায় সাধারণ মানুষের আয় বাড়েনি। খাদ্য মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে অন্তর্বর্তী সরকার এর মধ্যে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। বিভিন্ন পণ্যের দাম বেঁধে দিয়ে, আমদানি শুল্ক কমিয়ে বাজারদর নিয়ন্ত্রণে সরকার চেষ্টা চালিয়েছে, কিন্তু পণ্যের উচ্চমূল্য অনমনীয়, কিছুতেই নামছে না। ভোক্তারা অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে বাজারে দ্রুত স্বস্তি ফেরানোর আহবান জানিয়ে আসছে বারবার। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, গত নভেম্বরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল প্রায় ১৪ শতাংশ। বর্তমানে প্রকৃত মূল্যস্ফীতি সরকারি পরিসংখ্যানের চেয়ে বেশি। খাদ্যে মূল্যস্ফীতি বাড়লে সবচেয়ে বেশি কষ্টে থাকে নিম্ন বা স্বল্প আয়ের মানুষ। এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় ২৯ শতাংশ মানুষ কম খাদ্য গ্রহণ করে এবং এর চেয়ে বেশি মানুষ খাদ্য কেনার পরিমাণ কমিয়ে ব্যয় সাশ্রয় করছে। স্বল্প আয়ের মানুষের কষ্ট দেখা যায় না। কিন্তু তারা এখন খুব কষ্টে দিন পার করছে। মানুষের কষ্টের সীমা ছাড়িয়ে গেছে। খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমাতে আমাদের খাদ্যের উৎপাদন বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে কৃষকদের সহায়তায় খাদ্য উৎপাদনে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। কৃষিতে ভর্তুকি বাড়াতে হবে। যেসব খাদ্যের সংকট আছে, সেগুলো অতি গুরুত্ব দিয়ে আমদানি করে বাজারে সরবরাহ বাড়াতে হবে। খাদ্যে উচ্চমূল্যস্ফীতির জন্য বাজারের ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট চক্রও দায়ী। ব্যবসায়ী যে সিন্ডিকেট চক্র রয়েছে, সেটা দূর করতে হবে। পূর্ণ রেশনিং ব্যাবস্থা চালু করা সহ টিসিবি সেল কার্যক্রম আরো বাড়ানো উচিত।”
টিসিবি আঞ্চলিক কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. সোহেল রানা জানিয়েছেন, নিম্ন আয়ের মানুষের কষ্ট লাঘব করতে “আমরা নিয়মিতভাবে ডিলারদের মাধ্যমে টিসিবির পণ্য সরবরাহ করছি। তবে সয়াবিন তেলের সংকটের কারণে পণ্যটি সরবরাহ করতে পারছি না। গত দুই মাস ধরে কার্ডধারী পরিবারকে ৫ কেজি চাল ও ২ কেজি ডাল মাত্র ২৭০ টাকা দামে সরবরাহ করা হচ্ছে। প্রত্যেক মাসেই উপকারভোগীদের মাঝে পণ্যগুলো সরবরাহ করার কাজ অব্যাহত রয়েছে।”
নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার বিষয়ে জানতে চাইলে শ্রীমঙ্গলের উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. ইসলাম উদ্দিন জানিয়েছেন যে, তারা বাজার নিয়ন্ত্রণে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি সাধারণ জনগণকে অনুরোধ করেছেন যাতে কোনো ব্যবসায়ী যদি অতিরিক্ত পণ্য মজুদ করে রাখে, সে বিষয়ে তাদের অবহিত করেন। এছাড়াও, উপজেলায় টিসিবি ফ্যামিলি কার্ডধারীর সঠিক সংখ্যা সম্পর্কে তিনি জানিয়েছেন যে, তাদের কাছে এখনই সঠিক তথ্য নেই। তবে, তিনি শীঘ্রই এই তথ্য জানাতে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
সম্পাদক : সৈয়দ আমিরুজ্জামান
ইমেইল : rpnewsbd@gmail.com
মোবাইল +8801716599589
৩১/এফ, তোপখানা রোড, ঢাকা-১০০০।
© RP News 24.com 2013-2020
Design and developed by M-W-D